“শপথ” (পর্ব-৬)

0
1896

“শপথ” (পর্ব-৬)

স্যামস্ এর জীবনটা উলট পালট হয়ে গেছে। যে ভয়ে সে এতদিন আতঙ্কিত ছিল সেই ভয়টাই সত্যি হলো। কি করে সে অবন্তিকার সামনে দাঁড়াবে? নিজের মনটাকেই যেখানে সান্ত্বনা দিতে পারছে না সেখানে অবন্তিকাকে কি বলে সান্ত্বনা দেবে? নিজেকে আর সে সামলাতে পারলো না। নিজের রুমে এসে সে অব্ অব্ বলে চিৎকার করতে শুরু করলো। “এই একটা জীবনে তোমাকে ছাড়া বাঁচবো কি করে অব্? আমার বাকী জীবনটা কাটবে কি করে? তুমি বলে দাও আমায়!”

সেদিন রাতে অবন্তিকা বারান্দায় বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে জেনেও সে বারান্দায় গেল না। অনেক রাত পর্যন্ত অবন্তিকা স্যামস্ এর জন্য অপেক্ষা করলো। অবন্তিকা তাকে ফোন করলো, সে ফোন রিসিভ না করে ফোনটাকে হাতে নিয়ে ফ্লোরে বসে রইল। আর মনে মনে বললো, “অব্ আমি ঠিক নেই, আমি আর কোনো দিন ঠিক থাকবো কি না জানি না। আমার জীবনটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। জানি সেই জীবনে এক মুঠো রং ছড়িয়ে দিতে তুমি আর আসবে না। তোমার মরণ বার্তা হাতে নিয়ে কি করে তোমার সামনে দাঁড়াবো অব্? আমি যে খুব বেশি সহসী নই। রুমে চলে যাও অব্, আমার জন্য আজকে অন্তত অপেক্ষা করো না!”

অবন্তিকার ফোন কল বন্ধ হয়ে গেল। সে আরো কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থেকে রুমে চলে গেল। রাত প্রায় শেষ প্রহরে এসে ঠেকেছে। অবন্তিকার মনে হাজার রকমের প্রশ্ন উঁকি দিয়ে চলেছে। কেন আজ স্যামস্ ফোন রিসিভ করলো না? কেন সে বারান্দায় এলো না? নাকি সে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে? এই সব ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে গেল কিন্তু স্যামস্ এর চোখে ঘুম নেই। অবন্তিকা রুমে চলে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর স্যামস্ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। অবন্তিকার বন্ধ দরজার দিকে ভেজা চোখে চেয়ে রইল সে। আজ নিজেকে পৃথিবীর সেরা অসহায় মনে হচ্ছে তার। সব কিছু আজ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করতে ইচ্ছে করছে।

অবন্তিকার রিপোর্ট দেখার পর থেকে তার বাবা মা তার আড়ালে গুমরে গুমরে কাঁদে। অবন্তিকা তার এই ব্রেইন ক্যান্সার সম্পর্কে কিচ্ছু জানে না। তাকে বুঝতে দেয়া হয়নি যে, এত বড় একটা অসুখ সে বয়ে বেড়াচ্ছে। সে প্রতিদিন রাতে বারান্দায় বসে স্যামস্ এর জন্য অপেক্ষা করে। স্যামস্ সুক্ষ্ম অভিনেতার মত অবন্তিকার সামনে দাঁড়ায়। শুকনো ম্লান হাসির আড়ালে যে দগ্ধে যাওয়া একটা বিরাট ক্ষত লুকিয়ে রেখেছে সে তা অবন্তিকাকে টের পেতে দেয় না।
–“এই ডাকাত ডাক্তার দিনরাত এত কিসের ভাবনায় পড়ে থাকেন?”

অবন্তিকার কথাতে নিশ্চুপ থাকে স্যামস্। সে মনে মনে বলে, ‘মন পড়তে পারা মেয়েটা কি জানে যে আমি কি ভাবনায় মেতে থাকি?’
স্যামস্ এর জবাব না পেয়ে অধৈর্য হয়ে অবন্তিকা বললো-
–“আমার সামনে দাঁড়িয়েও কি আপনার ভাবনাতে ঢুব দিতে হবে সাহেব?”
–“তা নয় অব্”
–“তাহলে কি?”
আজকাল অবন্তিকাকে তার টুনি মনের কথা জিজ্ঞেস করতেও স্যামস্ ভয় পায়। না জানি সে সব বলে ফেলে।
–“তোমার শরীর কেমন এখন?”
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


স্যামস্ এর শুকনো ম্লান হাসির আড়ালে রাখা ক্ষতটা পরিষ্কার ভাবে দেখতে পায় অবন্তিকা। মানুষটা যে তার অসুস্থতা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারে সে। তাই সুস্থ থাকার নাটকটা তাকে করতেই হয়।
–“ঠিক আছে শরীর। আমি ভীষণ ভালো আছি।”
–“ভেরী গুড।”
অবন্তিকা যে তার সামনে সুস্থ থাকার নাটক করে সেটা বুঝতে পারে স্যামস্। বুঝেও লাভ নেই, কি বলবে সে? দু’টো মানুষ একে অপরের আড়ালে পুড়ছে। দু’জনার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে একে অপরকে খুশি করার। অথচ দু’জনের টুনা টুনি মন সব কিছুই ফাঁস করে দিচ্ছে। এ কেমন ভালোবাসা?

একটা করে দিন যাচ্ছে আর অবন্তিকাও একটু একটু করে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। স্যামস্ এর বিবর্ণ পৃথিবীর পাশে ছোট্ট একটা ঝাঁপসা পৃথিবী অবন্তিকার। প্রচন্ড মাথাব্যাথায় সে বেহুশ হয়ে যায়। ইদানিং তার দিনগুলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে থেকেই কাটে। আগের অবন্তিকা আর নেই, সে এখন সবকিছু মনে রাখতে পারে না। সবাইকে ঠিকমত চিনতেও পারে না। ভুলে গেছে সে তার ডাকাত ডাক্তারকে। স্যামস্ যখন তার সামনে দাঁড়ায় তখন সে তার দিকে নিশ্চুপ চেয়ে থাকে। এই দৃশ্য স্যামস্’কে ভেঙে চুরমার করে দেয়। সে অবন্তিকার সামনে দাঁড়ানোর সাহস পায় না।
লাস্ট চান্স হিসেবে অপারেশন করতে হবে। অপারেশন করলেও বাঁচার চান্স খুব কম তবুও অবন্তিকার বাবা মা একটা লাস্ট চান্স নিতে চায়। স্যামস্ এর মন সায় দেয় না কিন্তু অবন্তিকার বাবা মায়ের সিদ্ধান্তের উপরে কথা বলার অধিকার তার নেই।

অবন্তিকার জীবন প্রদীপ নিভে গেল। অপারেশন সাক্সেসফুল হলো না। অপারেশন থিয়েটারেই অবন্তিকা মারা গেল। স্যামস্ এর জীবনের সব রঙ মুছে দিয়ে অবন্তিকা না ফেরার দেশে চলে গেল। অবন্তিকার মা পাগলের মতো প্রলাপ বকছেন। তার বাবাকে ডাক্তার ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে রেখেছেন। উনি মেয়ের ছবি বুকে নিয়ে ঘুমোচ্ছেন। স্যামস্ এর মা দু’টো শোক বহন করছেন। এক অবন্তিকার মৃত্যু, দুই তার ছেলেকে সামলাতে পারছেন না।
আর স্যামস্! আজ তার পৃথিবীটা ঘনিয়ে আঁধার নেমেছে। আজ তার জীবন সূর্য চিরদিনের জন্য ডুবে গেছে। আজ অবন্তিকা লাশ হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে অবন্তিকা, যে ঘুম স্যামস্ এর শত আর্তনাদেও ভাঙবে না। স্যামস্ নির্বাক হয়ে অবন্তিকার লাশের পাশে বসে অপলক তার দিকে চেয়ে আছে।
সাদা কাপড়ে অবন্তিকার সারা শরীর ঢাকা। শুধু মুখটুকু সে বের করে রেখেছে। এখানেই পৃথিবীর সব ভাষা ইতি টেনেছে। ছেলে এমন মূর্তির মতো বসে আছে, এই দৃশ্য দেখে স্যামস্ এর মা ছেলেকে শান্তনা দেবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। কান্না ছাড়া উনার গলা দিয়ে আর কোনো স্বর বের হচ্ছে না।

অবন্তিকার লাশ নিয়ে তার বাবা মা দেশের বাড়িতে চলে গেলেন। সাথে স্যামস্ও গেল। সেদিন বাড়ি ফিরে এসে স্যামস্ তার ব্যালকোণ বারান্দার দরজা আর জানালা বন্ধ করে দিলো। মাঝখানে তিনটা বছর কেটে গেছে সে কোনো কারণেও বারান্দার দরজা খোলেনি। আজ এত বছর পর অবনির মাঝে অবন্তিকার ছবি খুঁজে পেয়ে সে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। স্যামস্ এর মন চিৎকার করে বলছে, “অবন্তিকা সামনে এসো, আজ আমি তোমাকে দেখতে চাই!”

অবনি তার বারান্দার দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। বিপরীত বারান্দায় সে স্যামস্’কে দেখতে পেয়ে হতবাক হলো। সে আজকেই প্রথম এখানে তাকে দেখছে। অবনিকে দেখে স্যামস্ চমকে উঠল। ভেতরের মনের চিৎকার কি তাহলে অবনি শুনতে পেয়েছে? তাহলে কি তারও টুনি মন আছে? কিন্তু স্যামস্ তো অবনিকে দেখতে চায়নি, সে চেয়েছে অবন্তিকাকে। তাহলে অবন্তিকার চিঠির ঐ লাইনটা কি সত্যি হতে চলেছে? “মনের ডাক্তার আমি আবার আসবো তোমার জীবনে, অন্য কারো মাঝে তুমি আমার জলছবি দেখতে পাবে। শপথ করো তাকে ফিরিয়ে দেবে না।”
সৌজন্যতার খাতিরে অবনি বললো-
–“কেমন আছেন?”
অবনির কথাতে চেতনায় ফিরলো স্যামস্।
–“জ্বী ভালো”
–“এখানে কি কিছু খুঁজছেন?”
–“হ্যাঁ। ”
–“কি খুঁজছেন?”
–“স্মৃতি।”
–“এই বারান্দায় বুঝি অনেক স্মৃতি আছে?”
–“শত শত স্মৃতি এখানে লেপ্টে আছে।”
–“ওহ”
স্যামস্ উৎসুক হয়ে বললো,
–“আচ্ছা আপনার বাবা মা আত্মীয় স্বজন নেই?”
–“আছে তো।”
–“তারা কোথায়?”
–“অন্য শহরে।”
–“আচ্ছা আপনি অবন্তিকা নামের কাউকে চেনেন?”
–“কেন বলুন তো?”
–“এমনি। চেনেন কি না বলুন।”
–“না তো।”
–“অবন্তিকার চেহারার সাথে আপনার চেহারার বেশ মিল আছে। বিশেষ করে চোখ আর নাক।”
–“অবন্তিকা কে?”
থমকে যায় স্যামস্। ঘোরের মধ্যে একটা অচেনা মেয়েকে সব কিছু বলতে চলেছিল সে। মনে মনে সে বললো, “অবন্তিকা হলো আমার ভেতরের সত্ত্বা। আমার অস্তিত্ব জুড়ে থাকা মানুষ। আমার জীবনের আরেকটা নাম অবন্তিকা।”
কিন্তু মুখে সেটা বলতে পারলো না সে। নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো-
–“আমার পরিচিত।”

অবনি দাঁড়িয়েই রইল স্যামস্ রুমে চলে এলো। রাত পোহালেই অবন্তিকার মৃত্যু বার্ষিকী। সে ড্রয়ার থেকে অবন্তিকার একটা ছবি বের করলো। এলোমেলো চুলগুলো কপালে পড়ে আছে, ঠোঁটে নির্মল মিষ্টি হাসি, চোখ দুটো দুষ্টুমিতে মাখামাখি হয়ে আছে। এই ছবিটা দেখে কত শতবার যে, সে তার প্রেমে পড়েছে তার হিসেব নেই। ছবিটা দেখতে দেখতে স্যামস্ এর চোখ ঝাঁপসা হয়ে গেল। এই পৃথিবীটা এমন কেন? বাস্তবতাই বা এত নিষ্ঠুর কেন? কতটা নির্মম ভাবে বাস্তবতা কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে ছিনিয়ে নেয়! এমন একটা বিয়োগ ব্যাথা বইতে যে পাজর ভেঙে যায়, যা সবাই উপলব্ধি করতে পারে না। যার হারিয়েছে সেই শুধু বুঝবে যে, হারানোর যাতনা কাকে বলে। ঝাঁপসা চোখ আর কান্নায় ভাঙা ভাঙা স্বর নিয়েই স্যামস্ অবন্তিকার ছবির সাথে কথা বলতে শুরু করলো।

–“অব্ যোজন যোজন দূরে থেকেও তোমার মনের ডাক্তারকে নিয়ে তোমার টেনশন শেষ হয় না জানি। আমি বেশ আছি। রোজ মাইলের পর মাইল তোমাকে ভাবি। তোমার স্মৃতিগুলো বৃত্তের মত আমাকে ঘিরে রেখেছে। ঐ বৃত্তের ভেতরে আমি বিন্দু হয়ে আমারণ রয়ে যাব। এত বড় জীবনে যে কটা দিন তোমাকে কাছে থেকে ভালোবাসতে পেরেছি সে কটা দিন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছি এবং আমরণ দেখবো। তোমার অবিরাম কথা বলা, তোমার মুগ্ধ করা হাসি, তোমার দুষ্টুমিতে ভরা চোখ, আমার প্রতি তোমার সীমাহীন অভিযোগ, নদীর ধারে বসে বৃষ্টিতে নদীর ভিজে যাওয়া দেখা, মাঝরাতে আমার দরজাতে ঢিল ছুড়ে আমাকে বারান্দাতে নিয়ে যাওয়া, এই সব স্মৃতিগুলো মনে রাখতে রাখতেই আমার সব আয়ু শেষ হয়ে যাবে। হয়ত নতুন কোনো কষ্ট অনুভব করার সুযোগ পাবো না কখনও। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন ভালোবাসার এই দিনগুলোর শ্রেষ্ঠ্যত্ব ঘোষণা করবো আমি। বেঁচে থাকার জন্য যদি আরো কয়েকটা জীবন পাই তবে শুধু তোমাকেই ভালোবাসবো। তোমাকে ভালোবেসে একবার শুধু নয়, যদি শত কোটি জনম থাকে তবে হাসি মুখে শত কোটিবার আমি মরে যেতে চাইবো। এ জীবনে তোমাকে পাওয়া হয়নি, পরের জীবনেও আমি শুধু তোমাকেই চাই অব্। প্লিজ তুমি ‘না’ বলো না।”

বিঃদ্রঃ গল্পের কাহিনী এবং চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে গল্প কখনোই মিলবে না। জীবন কখনও গল্পের মতো সাজানো গোছানো হয় না। গল্পটা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য লেখা হয়েছে তাই বিতর্কিত মন্তব্য প্রত্যাশিত নয়।

(পরের পর্ব আসছে…..)
Written by- Sazia Afrin Sapna

পর্ব-৫
https://m.facebook.com/groups/884724498624937?view=permalink&id=930499564047430

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে