শত্রু শত্রু খেলা পর্ব-০৭

0
669

#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৭
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

দরজায় ক্রমাগত করাঘাত হচ্ছে কিন্তু দরজা খোলার মতই কেউই আসলো না। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকালো সৌরভ। ঝুমুর দরজায় খিল দিয়ে বসে আছে দেখে কিছু অশ্রাব্য গা*লি ছুড়লো ঝুমুরের নামে। দীর্ঘ সময় পেরুলেও ঝুমুর দরজা না খোলায় সে চলে আসার জন্য উদ্ধত হলে আচমকাই খট করে দরজা খোলার শব্দ হলো। সৌরব বিস্মিত হলো ঝুলিকে দেখে।

হতবিহ্বল হয়ে দশ বছরের ঝুলি তাকিয়ে আছে সৌরভের দিকে। চোখ কচলাতে কচলাতে বললো এতবার দরজা ধাক্কাচ্ছিলে কেনো?

সৌরভের গম্ভীরস্বর কিন্তু মুখের আদল পরিবর্তন করে বললো তোমার আম্মু কোথায়?

ঝুলি কিছুক্ষণ চুপ করে কিছু ভাবলো। তারপর নিরস গলায় বললো আম্মু তো বাসায় নেই। কোথায় গেছে আমি জানি না। আম্মু আপনাকে চলে যেতে বলেছে সৌরভ ভাইয়া। আপনি বাসায় চলে যান।

সৌরভ এতক্ষণ মাথায় করে যে রাগের ফোয়ারা নিয়ে এসেছিলে তা ঝুলির কথা শুনে গলে গেছে। কিন্তু মুখে তার পূর্বের ন্যায় গাম্ভীর্যের ভাব রেখে রুষ্ট কন্ঠে বললো সামনে থেকে সরো আমি ভিতরে যাবো।

ঝুমুর রুমের এককোণে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল। কিন্তু বিধিবাম তার নির্বোধ অকালকুষ্মাণ্ড মেয়েটা সৌরভকে আটকাতে পারেনি। তার মুখে নিষ্করুণ রুক্ষ হাসি। চোখের চাউনিতে তার বড্ড হতাশার ছাপ।

সৌরভ কোনো ভণিতা ছাড়াই জিজ্ঞেস করলো। আপনি কি বলেছেন আমার মা’কে?

ঝুমুর ইতিউতি করছিলো। শিকারী জালে আটকে পড়া ইদুরের মত ছটপট করছিলো। শুকনো ঢোক গিলল সে। আমতা আমতা করে বললো আমি ছাদে কাপড় আনতে গেছিলাম। দেখি তোমরা দু’জন একে অপরকে জড়িয়ে মুখে মুখে কিছু করছিলে।

সৌরভ লাল রক্তিম চোখে তাকালো ঝুমুরের দিকে। বজ্রকন্ঠে বলল আপনি নিজে দেখছেন আমাদের এসব করতে।

না দেখলেও বুঝতে পারছিলাম। আমার দূর থেকে তাই মনে হচ্ছিলো।

তারপর ঝুমুর কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইলের গ্যালারি থেকে একটা ছবি বের করে সৌরভকে দেখালো। সৌরভের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো ছবি দেখে। এই ছবিতে কোন এঙ্গেলে মনে হচ্ছে ওরা আজে-বা*জে কিছু করছে। সে প্রিয়ার হাত দুটোকে উল্টো করে পিঠের দিকে ধরে আছে। আর তারা দুজন দুজনের দিকে র*ক্তচক্ষু নিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তবে যারা নির্বোধ তাদের কাছে অন্য কিছু মনে হতে পারে। সৌরভ ছবি ডিলেট দিয়ে দিলো। ঝুমুরকে কিছু কড়া কথা বললো।

এরপর এমন কিছু করবেন তো আপনার অস্তিত্ব মাটির উপরে নয় নিচে থাকবে। সো বি কেয়ারফুল চাচী!

কথাগুলো বলে সৌরভ গট গট করে বেরিয়ে পড়লো ঝুমুরের বাসা থেকে।

ঝুমুর তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। তার জান তো আজ বেরিয়েই যেতো। কি বাঁচাটাই না বাঁচলো সে!

____________

কাকডাকা ভোরে প্রিয়ার ঘুম ভাঙলো কিঞ্চিৎ দূরে থাকা চড়ুই পাখির কিচিরমিচিরে। তার বারান্দার ভেন্টিলেটরের ফোকরে এক চড়ুই দম্পত্তির বসবাস। এরাই রাত-দুপুর তার আশে পাশে ঘুরে বেড়ায় আর কিচিরমিচির করে। প্রিয়ার বেশ ভালো লাগে এদেরকে। তাই চুপটি করে এগুলোর কাজ দেখে।

আনোয়ার এসে প্রিয়ার কান্ড দেখে আনমনে হেসে উঠলেন। মেয়েটা চোখের পলকে বড়ো হয়ে গেলো। দু’দিন আগেও বায়না করতো তার সাথে খেলার জন্য। আজ কত বড়ো হয়ে গেছে। একটা কথা ভেবেই চোখের কোণে জল জমলো। মেয়েরা বুঝি খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাই পরের ঘরে যাওয়ার জন্য। তার ঘরের আলো হয়ে অন্য ঘরে গিয়ে আলোকিত করবে।

প্রিয়া চকিতে মুখ ঘুরিয়ে তাকাতে আনোয়ারকে দেখে আৎকে উঠলো।

আব্বু তুমি কখন এলে।

আনোয়ার মেকি হাসলেন। মেয়েটা বড়ো হলেও এখনো কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগে। এই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে কিভাবে থাকবে সে। পুরো ঘর তো শূন্য হয়ে যাবে। আনোয়ার মেয়েকে কাছে ডেকে শিয়রে বসতে বললেন। প্রিয়া কোনো দ্বিধা ছাড়াই বাবার কাছে গিয়ে বসলো। কৌতুহলী হয়ে বললো বাবা তুমি কিছু বলবে?

আনোয়ার নিশব্দে হাসলো। মেয়েটা না চাইতেও অনেক কিছু বুঝে যায়।

খাবার ঘরে এসে প্রিয়া কিছুটা অবাক হলো। মারিয়ার থমথমে মুখ দেখে সে ভড়কালো। কিন্তু মারিয়া চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। প্রিয়া মাঝে মধ্যে মায়ের হাবভাব বুঝার চেষ্টা করছে। মারিয়া পরোটার প্লেট এগিয়ে দিলেন মেয়েকে। ডাল আর ডিম ভাজি প্রিয়াকে দিয়ে সে চুপচাপ উঠে গেলেন। যাওয়ার আগে একবার মেয়েকে পরখ করলেন। কিছু কথা বলতে গিয়েও তার ঠোঁট কাঁপছে। কিভাবে মেয়েকে জিজ্ঞেস করবেন? মুখে জড়তা রেখে অস্পষ্ট সুরে বললেন,

তোমার সৌরভকে ভালো লাগে?

প্রিয়া মাত্রই পরোটার বড় এক টুকরো মুখে পুরেছিলো। মারিয়ার কথা শুনে সে বড়সড় একটা বিষম খেলো। গলায় যেনো সব আটকে তার নিশ্বাস যায় যায় অবস্থা। মারিয়া পানি দিলেন মেয়েকে।

শান্ত গলায় বললেন খেয়ে নাও আমরা পরে কথা বলবো।

প্রিয়া আকাশ থেকে পড়লো। তার মা কি বলবে এই সার্কাসকে নিয়ে। কিন্তু সে সার্কাসকে পছন্দ করতে যাবে কেনো? তার মা এই কথা কেনো বললো তার বোধগম্য নয়?

_______________

কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্য রিকশার জন্য বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়ানো প্রিয়া। রিকশার হদিস না পেয়ে হতাশ হয়ে বিমূর্তচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। আচমকা তার চোখ পড়লো তার পাশের ব্যক্তিটির উপর। লোকটাকে আজকে অসম্ভব স্নিগ্ধ সুন্দর সুপুরুষ লাগছে তার কাছে।

কুঁচকানো কালো চুলগুলো জেল দিয়ে আবৃত তার। বাইকে বসায় সামনের চুলগুলো মৃদু বাতাসের তালে তালে উড়ে বেড়াচ্ছে। মেরুন রঙের গেঞ্জি পরিহিত শ্যামবর্ণা পুরুষটিকে সৌন্দর্যের দিক থেকে এক আদর্শ সুদর্শন সুপুরুষই বলা যায়।

আড়চোখে একবার সৌরভকে দেখে আবার আগের মত দাঁড়িয়ে আছে সে। ছেলেটা দেখতে মাশাল্লাহ কিন্তু আচরণ একদমই নাউজুবিল্লাহ।

সৌরভ বাইকে বসে প্রিয়াকে দেখে বি*রক্তিতে মুখ কুঁচকালো। এই মেয়েটা যত নষ্টের গোড়া। তার জন্য আজকে তাকে এত অপ*দস্ত হতে হচ্ছে। তার চরিত্র নিয়ে বা*জে কথা বলছে। ঝুমুরের মত ব*দমহিলা তাকে এত বড়ো অপবাদ দিলো। সব দোষ এই মেয়েটার।

সৌরভ ইচ্ছে করেই ভো ভো শব্দে বাইক স্টার্ট দিলো।

পিনপতন নীরবতার মাঝে আকস্মিক বাইকের ভো ভো শব্দদূষণে প্রিয়া যারপরনাই বিস্মিত হলো। নিষ্করুণ দৃষ্টিতে তাকালো সৌরভের দিকে।

সৌরভ তখনও হ্যান্ডেলে হাত রেখে ভো ভো শব্দ বাজিয়ে যাচ্ছে। সেও প্রিয়ার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখে কথা না বললেও তাদের মধ্যে চোখে চোখে স্নায়ুযু*দ্ধ চলছে।

শেষে ত্যাক্ত-বির*ক্ত হয়ে প্রিয়া মুখ খুললো। আপনার কি সমস্যা?

সৌরভ মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। সে চোখ দিয়ে প্রিয়াকে গি*লে খাচ্ছে। উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না তার।

প্রিয়ার মেজাজ চটে গেলো। কপাল কুঁচকে বললো নিজেকে সৌদি প্রিন্স আব্দুল্লাহ ভাবেন। যেখানে সেখানে নিজের আধিপত্য খাটাতে আসেন। জোকার একটা।

সৌরভের উদ্দেশ্য কঠিন দু’বাক্য ছুড়ে সে পায়ের কদম বাড়ায় সামনের দিকে।

সৌরভের মাথার মগজ টগবগ করছে প্রিয়ার কথা শুনে। সেও জোরালো গলায় বললো তা আপনি কি রাণী ভিক্টোরিয়া। সে জন্য মানুষকে মানুষ ভাবেন না।

মানুষ হলেই তো তাকে নিয়ে ভাববো।

তুমি তো নিজেই মানুষ না অন্যকে নিয়ে কি ভাব্বে।

সার্কাস, জোকার এদেরকে আমি মানুষ ভাবি না।

তুমি কি? নিজেই আস্ত একটা বাঁদর। বাঁদরামি ছাড়া আর কিছু জানো। পড়ালেখা তো নাম মাত্র করো। একটা ম্যাথ দিলে সারাদিনেও করে দেখাতে পারো না। কিন্তু বাঁদরামি ঠিকিই পারো।

আপনি কি নিজেকে কখনো আয়নায় দেখছিলেন। চেহারা তো একটা লম্বা শামুকের মত। দেখলেই বমি আসে।

কি বললে? আমাকে দেখলে তোমার বমি আসে। আমি কি আর তোমার মত যার তার গায়ে পড়ে ঝ*গড়া করি? আমার মত ছেলেকে দেখার জন্য মেয়েদের লাইন পড়ে যায়। বুঝলে!

সেটা তো পড়বেই। পাবলিক টয়লেট দেখলেই তো সবাই লাইনে দাঁড়াবেই।

হোয়াট, ননসেন্স!

প্রিয়ার কথা শুনে সৌরভ বাইক দাঁড় করালো। কিন্তু ততক্ষণে প্রিয়া একটা রিকশা পেয়ে উঠে যায়।

সৌরভ চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে। এই মেয়েকে সে ছাড়বে না। আচ্ছা শিক্ষা দিবে।

পাশের বাড়ির বারান্দা থেকে ঝুমুর সবটাই দেখে। রাগে গজগজ করতে থাকে। তার কাছে সাধু সাজে এই সৌরভ। নিজেরা মাখো মাখো প্রেম করলে কিছু হয় না। শুধু আমি বললে দোষ। নেহাৎ সে সৌরভেকে ভয় পায় নয়তো এখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসতো এদের মাখো মাখো প্রেমের কথা।

____________

কলেজের এককোণে বসে আছে প্রিয়া। রাঢ়ী, শ্রাবণ, নীলের সাথে সে কথা বলছে না। এরা সত্যিকার অর্থে তার বন্ধু নয়। বন্ধু হলে তো বাইরের কারো কথা বিশ্বাস করতো না।

রাঢ়ী বেহায়ার মত প্রিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার বাল্যকালের বন্ধু সে। এই বন্ধুর রাগ ভাঙানো জরুরি তার। নীল, শ্রাবণকেও ডাক দিলো।

তিনজনেই প্রিয়ার সম্মুখে বসা। প্রিয়া উঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। কিন্তু তার আগেই রাঢ়ী খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। প্রিয়ার মুখে কঠিন ভাব হলেও মনে মনে খুশি হয়। তবে প্রকাশ করতে সে নারাজ।

নীল কান ধরে বললো বইন এবার চুপ যা না। অনেক তো হয়ছে তোর গন্ডারের মত রাগারাগি। বাপ্রে! ছোটো খাটো এই রকম বিষয় নিয়ে রাগলে হয় না’কি?

প্রিয়া তেতে উঠলো কি কইলি আমি গন্ডারের মত রাগারাগি করি। আমারে তোর কোন অ্যাঙ্গেলে গন্ডারের মত লাগে?

শ্রাবণ প্রিয়াকে শান্ত করালো। বইন বাদ দে না। হেতে ছোট্ট মানুষ কইলাছে আরি। বুঝে নো, মাফ করি দে ছা। আন্ডা কি তোরে কিছু কইছি। বান্দর তো আর গন্ডার অইনা হেতে তো আর হিয়ান জানে না। (ফেণীর আঞ্চলিক ভাষা নিজ দায়িত্বে বুঝে নেন)

প্রিয়ার রাগ এবার সপ্তম আকাশে উঠলো। র*ক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো শ্রাবণের দিকে। বে*য়াদব সর সামনে থেকে। সবগুলাই এক ঘাটের মাঝি।

বাকী তিনজনে হো হো করে হেসে উঠল।

রাঢ়ী শক্ত করে ঝাপটে ধরে আছে প্রিয়াকে। প্রিয়া নিজেই আর না পেরে হেসে দিলো বন্ধুদের কথা শুনে।

________

তপ্ত দুপুরেই হেটে চলেছে সৌরভ। রাতে এক চেনা অচেনা মানবী তাকে কল দিয়ে বলেছে ফেণী রাজাঝির দিঘির পাড়ে আসতে। সে আসতে চাইনি কিন্তু সেই অচেনা মানবী কি বলতে চাই সেটা জানতে হবে তাকে।

এতদিন পর তার কি চাই সেটা জানা জরুরি। মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি তার।

মানুষ ম*রে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায় কারণে অকারণে।

চলবে,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে