#শক্তিময়ী
৩০ তম পর্ব
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
এক বছর কেটে গেছে। জীবনের তাল,লয় একটু হলেও ফেরত এসেছে ফুপুর পরিবারে। আবারও আবদুর রহমান সাহেবের বৃদ্ধাশ্রম, আবারও অদিতির ড্রিম প্রজেক্ট, ফুপুর সেলাই প্রশিক্ষণ। এখনো আমরা পরিবারের সবাই ছয়মাসে একবার অন্ততঃ একসাথে গ্রামের বাড়ি যাই, তিন চারদিন থাকি, কিন্তু সেই ভালো লাগা কাজ করে না। অদিতি এবারে মুখ খুললো,”আব্বু নেই, পরী নেই, নানু নেই। বাকিরা তো আছে। আমরা কেন আনন্দ করবো না? কেন গান গাইবো না?কেন হাসবো না? কেন আগের মতো পিকনিক করবো না? কেন মনটা খারাপ করে চুপচাপ বসে থাকবো? এতে কি আব্বু,পরী,নানু ফেরত আসবেন? এতে কি তাঁদের আত্মা শান্তি পাচ্ছেন? মানুষের মৃত্যু হবে,এটা কি স্বাভাবিক না? তাই বলে আমরা বছরের পর বছর মরার মতো বেঁচে থাকবো? এমন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলার জন্য আল্লাহ আমাদের তৈরি করেছেন? আর মা আমার দেখা অসাধারণ এক ভালো মানুষ, সেই সাথে মোষ্ট কেয়ারিং, ইনডাসট্রিয়াস, হেল্পফুল, ইনটেলিজেন্ট। মায়ের মধ্যে অসাধারণ শক্তি ও দৃঢ়তা ছিলো।কোথায় গেলো সেই শক্তি? আবার আগের মতো হয়ে যাও, মা। তুমি হাসলে সারা বাড়ি হেসে উঠবে। আব্বু ও পরী শান্তি পাবে। প্লিজ এভরিবডি , বি পজিটিভ। পজিটিভ থটস,পজিটিভ অ্যাটিচিউড,পজিটিভ ভাইবস, পজিটিভ অ্যাকটিভিটিস। ”
অদিতির উদ্যোগে কাজ হলো। আমরা তালি দিতে দিতে গান গাইলাম,”আমরা করবো জয় একদিন। ” তিথি ভাবী পরপর পাঁচটা গান গাইলেন। যদিও মাঝেমাঝেই আবেগে,কষ্টে গলা ভেঙে যাচ্ছিলো। অদিতি গাইলো,”আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে।” অদিতির উদ্যোগে সব বাচ্চাকাচ্চা মিলে বাড়ির পেছনের বাগানে কয়েকটা মাটির চুলা বানিয়ে নিজেরাই খিচুড়ি আর ডিম রান্না করলো। সাথে বেগুন ভাজা। দারুণ একটা পিকনিক হলো। বিকাল হওয়ার আগেই আমরা বিশাল দল বের হলাম গ্রাম ঘুরতে। অদিতি সব বাচ্চাদের নিয়ে “বৃক্ষ রোপণ” কর্মসূচী পালন করলো। আমাদের সব ভাই বোনদের পঞ্চান্ন জন বাচ্চা একটা করে গাছ লাগালো মহা উৎসাহে। অদিতি ঘোষণা করলো, এই জায়গার নাম হবে “আনন্দ কানন।” প্রথা মেনে গ্রামবাসীদের ভোজ খাওয়ানো হলো। অদিতির আব্দারে তিথি ভাবী মেয়েকে পিঠে নিয়ে সাঁতার কাটলেন। অনেক আগে এই ভাবেই অদিতিকে সাঁতার কাটা শিখিয়েছিলেন তিথি ভাবী। আমাদের ভাইরা আর ভগ্নিপতিরা মিলে হাডুডুর প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন। ভাইরা এক দল, জামাইরা আরেক দল। এই প্রতিযোগিতায় দারুণ হাসাহাসি হলো। শ্যালক-সম্বন্ধীর হাতে আটকা পড়ে একেক জামাইয়ের অবস্হা দেখে দর্শকরা হেসে খুন। সেই দর্শকদের মধ্যে ফুপা-ফুপুও আছেন। অনেকদিন পরে তাঁদের প্রাণখোলা হাসি দেখে খুব ভালো লাগলো।হাডুডু খেলার এই সুপার আইডিয়াটাও আমাদের অদিতি সোনার। কতোদিন পরে আমাদের এই বিশাল বাড়িটা হেসে উঠলো। আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম।
ঢাকায় ফুপা-ফুপু -তিথি ভাবী ফিরলেন প্রাণশক্তিতে বলীয়ান হয়ে। ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিভিন্ন সেবামূলক কাজকর্মে। আবদুর রহমান সাহেবের বৃদ্ধাশ্রম এখন পাকা দালান। ষোলটা বড়,প্রশস্ত ঘর। সামনে টানা বড় বারান্দা। ফুলের বাগান। ষাটজন বৃদ্ধ -বৃদ্ধা। পুষ্টিকর মানসম্মত উপাদেয় পেটভরা খাবার, ভালো জামাকাপড়, নিজেদের মধ্যে আড্ডা, সুচিকিৎসা। দুইটা টিভি।
অনাথ কিংবা ফেলে দেওয়া শিশুদের নিরাপদ আশ্রয় তৈরি হয়ে গেছে। অদিতি নাম রেখেছে “আনন্দ নিকেতন।” একতলা সুন্দর, ছিমছাম বিল্ডিং। ইলমা,অর্কসহ দশজন শিশু বাস করছে এখানে। এই দশ দেবশিশুকে নিয়ে ভাবী আর ফুপা-ফুপুর উৎসাহ আর ব্যস্ততার সীমা নেই। আপন মায়ের মতো তাদের আগলে রেখেছে আমাদের দুই শক্তিময়ী, তিথি ভাবী আর অদিতি। আমরা শপথ নিয়েছি, কোনো নবজাতককে ডাষ্টবিনে পড়ে থাকতে দিবো না। দেশের কোনো ক্লিনিক বা বাসায় যেন অবৈধ গর্ভপাত না করানো হয়। আইজি সহ বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা আমাদের নিকটাত্মীয়। তাঁদের বারবার এই বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর অনুরোধ করেছি আমরা। যে কোন অবাঞ্ছিত শিশু আনন্দ নিকেতনে পরম আকাঙ্খিত। পাশেই আরেকটি বিল্ডিং তৈরির কাজ প্রায় সম্পূর্ণ। এই ভবনের নামও অদিতির দেওয়া, “পরীর রাজ্য। ” এখানে শুধু মেয়ে শিশুরা থাকবে।
অদিতির স্বপ্ন অনেক বড়। আনন্দ নিকেতন আর পরীর রাজ্যের শিশুরা একদিন মহীরূহ হবে। জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও যেন তারা আপনজনদের অভাব অনুভব না করে। ওরা বড় হবে হাসি আনন্দে, মায়ায় ভালোবাসায়। ওরা পড়ালেখা করবে,কাজকর্ম শিখবে। সুনাগরিক হওয়ার সব গুণ তাদের মধ্যে থাকবে। একদিন আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী হবে,এখানে মিথ্যা কথা কেউ বলবে না,এখানে অসৎ পথে কেউ চলবে না।
এতো শিশুর উপস্হিতিতে, এতো স্বপ্নের ভীড়ে ভাবী,ফুপা,ফুপু সব অবসাদ কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। তিথি ভাবী আর ফুপা-ফুপু ভাবীর আব্বাকেও জোর করে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে এসেছেন,একা বাসায় থাকতে দেন নি।অদিতি নিজ গুণে এখন নানারও নয়নমনি।
ফুপু প্রায় বলেন,”আমরা যখন থাকবো না, তখন তোর কি হবে দিদিভাই? যতো নিকটাত্মীয় থাকুক, একান্ত আপনার জনের দরকার হয় অদিতি। তোর মা হতে ইচ্ছা করে না? কতো প্রস্তাব আসছে এখনো, বিয়েটা কর বোন। শান্তিতে চোখ বুঁজি। ”
“যারা প্রস্তাব দেয় দাদুমনি,তারা আমার আয় উপার্জন দেখে প্রস্তাব দেয়। আমি কারো সম্পর্কে মন্দ কিছু বলতে বা ভাবতে চাই না, তাও বলি, যারা আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে, তারা ভালো মানুষ নয়। আমার জন্ম ইতিহাস জেনে, আমার রক্তিয়দের সম্পর্কে জেনেও ছত্রিশ বছরের এই আমাকে যারা বিয়ে করতে চায়, তাদের উদ্দেশ্য ভালো না। কখনো কেউ যদি সত্যি আমাকে ভালোবেসে হাত বাড়ায়, তাহলে আমি তাকে গ্রহণ করবো।”
“অভি ভালোবেসে হাত বাড়িয়েছিলো।ওকে রিজেক্ট করলি কেন?”
“অভি আমাকে ভালোবাসে নি দাদুমনি। ভালোবাসলে আমার রক্তের সম্পর্কের লোকজনের পরিচয় জেনে সরে দাঁড়াতো না। ছয়মাসের মাথায় এক বিশাল প্রভাবশালী পরিবারের ডানাকাটা পরীকে বিয়ে করে ফেলতো না। ”
ফুপু কথা খুঁজে পান না। অদিতিকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। কিছুদিন পরে আবার বিয়ের কথা তোলেন।
ভাবী বেসরকারি ভাবে শ্রেষ্ঠ সমাজসেবিকার পুরস্কার লাভ করেছেন। কোনো গ্রুপিং,লবিং ছাড়া। আমরা দেবর -ননদরা বেসরকারি নামকরা প্রতিষ্ঠানটিকে ভাবী সম্পর্কে জানিয়েছিলাম। ভাবীকে না জানিয়ে। জানালে তিনি কোনো অবস্থায় রাজি হতেন না। বিয়াল্লিশ বার রক্তদান, তিনটি পতিতাপল্লিতে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করা, বৃদ্ধাশ্রম ও অনাথাশ্রম পরিচালনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা, প্রচুর গাছ লাগানো, লাইব্রেরি স্থাপন ও সবাইকে ভালো বই পড়াতে উদ্বুদ্ধ করা, কমপক্ষে বিশজন মেয়েকে স্বাবলম্বী করার জন্য ভাবী এই পুরস্কার পেলেন।
অদিতি নিজ যোগ্যতায় পেলো সেরা উদ্যোক্তার পুরষ্কার। “পরিবেশ বাঁচাও ” নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকেও সে পুরষ্কার পেলো গাছ লাগানোর জন্য। তার বিপুল কর্মভান্ডার সম্পর্কে তো মানুষ জানেই না। আমরা খুবই প্রচার বিমুখ পরিবার।তারমধ্যে ভাবী আর অদিতি আরেক কাঠি বাড়া।
আমাদের পরিবারের সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে পরোপকারী, সবচেয়ে প্রেরণাদায়িনী এই দুই নারী নিশুতি রাতে নীরবে চোখের পানি ফেলেন। অদিতি বাবার চিঠিগুলোতে হাত বুলায়। চুমু খায়। তিথি ভাবী আনন্দ ভাইয়ের ছবিতে হাত বুলান, মায়ের ছবিতে চুমু খান, পরীর ছবি বুকের মধ্যে জাপটে ধরে রাখেন। মা-মেয়ের চোখের নোনা পানিতে বালিশ ভিজে যায়।
চলবে।