শক্তিময়ী পর্ব-২২+২৩

0
1766

#শক্তিময়ী
পর্ব ২২
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

ফুপুর মুখে গাঢ় অন্ধকার। তিনি তাঁর প্রিয়, প্রগতিশীল বান্ধবী লুবনার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। অনেক গল্পগাছার পরে তিনি আবিদ আর অদিতির প্রসঙ্গে কথা তোলেন। চরম সত্যকে গোপন করতে হয় না। তিনি বন্ধুকে অদিতির জন্মবৃত্তান্ত বলেছেন। তার আগে অদিতি সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো গল্প করেছেন। অদিতির ইতিহাস জানতে পেরে লুবনা আন্টি এতো রেগে গিয়েছেন যে ফুপুকে একগাদা কথা শুনিয়েছেন। ফুপুর কি কমন সেন্স নষ্ট হয়ে গেছে? এক অবৈধ বাচ্চা, তাও আবার অশিক্ষিত, নিম্নবিত্ত ও ঠগবাজ পরিবারের, কি করে কোন বিচার বুদ্ধিতে তার সাথে আদিবের বিয়ে দেওয়ার কথা ফুপু ভাবলেন? ফুপুও এক পর্যায়ে বন্ধুকে বলেছেন,” তা অবৈধ বাচ্চা বড়লোক,উচ্চশিক্ষিত,সম্ভ্রান্ত পরিবারের হলে তখন তাও একটু ভেবে দেখতে, তাই না?তুমি এক কথায় না করে দিতে পারতে। এতো রেগে যাওয়ার কি হলো? আর অদিতি আমার নাতনি,আমার। আমার বাপের বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ি সম্পর্কে, আমার ও আমার হাসব্যান্ডের সম্পর্কে সবকিছুই তো জানো তুমি। আমাদের পরিবারের শ্রেষ্ঠ সন্তান হলো অদিতি। তোমার নাতি সম্পর্কে আমি মন্তব্য করবো না, তবে তুমি আমার নাতনির আত্মীয় হওয়ার যোগ্য নও। ”

তিথি ভাবী বললেন,”এমন করে বলতে গেলেন কেন মা? উনার আর দোষ কি? সবাই এই ভাবেই বলবে।”

“তাহলে তিথি,কাউকে কোনো কিছু বলারই দরকার নেই। অদিতি আমাদের, এটা কি সত্যি কথা না? তাহলে অকারণে আমরা এতো হিস্ট্রি ঘাঁটাঘাঁটি কেন করবো? ওরা কে? ওরা তো অদিতির কেউ না। অদিতি তাদের চিনে না,ওরাও অদিতিকে চেনে না। তাহলে কেন আমরা অদিতির বিয়ের সম্বন্ধ করতে যেয়ে ওদের কথা টেনে আনবো?”

“তা হয় না মা। এগুলো গোপন করা ঠিক না। আর এগুলো জানাজানি হয়ে যায়। অনেকেই কথা লাগিয়ে দেয়। দুঃখের কথা,এর মধ্যে আমার নিজের বাপ-মা-ভাই -বোনও আছেন। এতো চিন্তা করবেন না।অদিতির বিয়ে না হলে না হবে। কিছু জিনিস আল্লাহর উপরে ছেড়ে দিতে হয়।”

” কি দুর্ভাগ্য ! আমার আনিলা এতো কোয়ালিফাইড, সে কিনা পড়ে পড়ে শ্বশুর বাড়ির মার খেতো। পরে আর বিয়েই করলো না। আর আমার অদিতি, এতো ভালো,লক্ষী,গুণী, তার বিয়ের কি হবে তার কোনো ঠিক নেই।”

“মা, আপনি এতো আধুনিক মানসিকতার, আপনি এসব নিয়ে এতো ভেঙে পড়ছেন কেন?আনিলা তার মেয়েকে নিয়ে ভালো আছে।অদিতিও ভালো থাকবে।”

আনিলা আপার এক্স হাসব্যান্ডের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে কয়েকদিন আগে। অদ্ভুত বিষয়, এই খবর পেয়ে আনিলা আপা ভিডিও কল করে প্রচুর কান্নাকাটি করেছেন। মানুষের মন বোঝা বড় দায়।

আপার সাবেক শাশুড়ি প্যারালাইজড , একেবারে শয্যাশায়ী। এক মেয়ে তাঁর সাথে মুক্তি পেয়েছে। বাকি দুজনে বদ্ধ কুঠুরিতে। তিনজনের স্বামীই তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে বহু আগেই, ছেলেমেয়েগুলো যত্নের অভাবে, মায়ের অপকর্মের জন্য হতাশায় উচ্ছন্নে গেছে। খুবই এলোমেলো অবস্থা পুরো পরিবারের। আনিলা আপার স্বামীর লাশ নিতে কেউ আসে নি। শেষে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম লাশ দাফনের ব্যবস্থা করেছে। লোকটার প্যারালাইজড মা ইশারায় ইঙ্গিতে , অবোধ্য শব্দ করে বারবার বুঝাতে চেয়েছেন ডেডবডি নিয়ে এসে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হোক, কেউ পাত্তা দেয় নি।

তিথি ভাবী গিয়েছিলেন ঐ বাসায়। শয্যাশায়ী অসহায় বৃদ্ধা ও তাঁর মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন,”আমাকে চিনতে পারছেন? আমি আনিলার ভাবী।আনিলাকে মনে আছে নিশ্চয়ই? এখন আপনারা আমাকে বলেন তো,এতো অন্যায় করে কি লাভ হলো আপনাদের? কি ভাবতেন, অন্যায় অত্যাচার করেই যাবেন, বিলাসী জীবনে আরাম আয়েশ করতেই থাকবেন, অনন্ত কাল এই ভাবেই চলতে থাকবে? কখনো অন্যায় ধরা পড়বে না, কখনো আপনাদের আয়েশি জীবনে বিঘ্ন ঘটবে না,কখনো জরা,বার্ধক্য, মৃত্যু আসবে না,তাই না? আপনি আপনার ছেলের ফাঁসির জন্য দায়ী, আপনি আপনার মেয়েদের ও নাতি নাতনিদের জীবন নিজ হাতে ধ্বংস করেছেন। আপনার মতো মা যেন পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি না থাকে।”

আনিলা আপা অনেক বড় চাকরি করেন। প্রচুর বেতন পান। এমিলি ভারি লক্ষী একটা মেয়ে। মা-মেয়ে দু’জনই দু’জনকে চোখে হারায়। আনিলা আপা ফুপা-ফুপিকে বলে দিয়েছেন তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে আর ফিরবেন না, মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসবেন, তাঁর প্রাপ্য সব সম্পত্তি যেন অদিতি,সমুদ্র আর পরীকে সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। এটা শুনে সমুদ্র -পরী দু’জনেই জানিয়েছে, ঐ সম্পত্তির কিছু তাদের লাগবে না, সবটুকু অদিতিকে দিয়ে দেওয়া হোক।

এসব কথা সব মুখে মুখেই হয়েছে, কিন্তু ভাবীর আম্মা হাড়ে হাড়ে চটেছেন। বাড়তি উদারতার জন্য সমুদ্র -পরীকে ফোন করে বকা ঝকাও করেছেন। তিথি ভাবীকে বলেছেন,” তোমার ভাগ তোমার নামে দিবো না।সমুদ্র আর পরীর নামে লিখে দিবো। নইলে ওদের কপালে কিছু জুটবে না,সবকিছু একজনের গর্ভেই যাবে।”

” আমাকে কোনো ভাগ দেওয়া লাগবে না,আম্মু।”

“বললামই তো, তোমাকে দিচ্ছি না।অনেক কষ্টে গড়া সম্পত্তি। সেটা নিয়ে নয় ছয় করার বিলাসিতা আমাদের সাজায় না। তোমার অংশ তোমার নামে নয়, সমুদ্র -পরীর নামে লিখে দিবো।”

“ওরা দেশে আসবে না আম্মু। তুমি বরং ওদের ভাগ কোনো জনকল্যাণ সংস্থায় দান করে দাও।”

“আমি তোমার মতো দয়াবতী নই,তিথি। আমি সমুদ্র -পরীকেই দিবো। তোমার নামে লিখলে তুমি সবটাই তোমার দত্তক মেয়েকে দিয়ে দিবে।সেটা আমি হতে দিবো না।”

আমি বুঝি না, খালাম্মার সবকিছুই ভালো, কিন্তু অদিতির প্রতি তাঁর এতো প্রবল ঘৃণা কেন? এতো বছর পরেও? যেখানে তাঁর মেয়ের আদরের ধনকে একে একে ফুপা-ফুপু, আনন্দ ভাইয়া, সমুদ্র , পরী সবাই মেনে নিয়েছে এবং বর্তমানে সবাই অদিতিকে চোখে হারায়, অদিতিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, সেখানে খালাম্মার মধ্যে এতো তিক্ততা কেন অদিতির ব্যাপারে? মেয়েটির বোন ম্যারো তো তিনি সানন্দেই গ্রহণ করেছেন।

অদিতির এমবিএ খুবই সফল ভাবে শেষ হলো। তার বেকারির ব্যবসা রীতিমতো দৌড়াচ্ছে। ফুপা বললেন,এতো বড় বাড়ি, নিচের তলার দুইটা ঘর নিয়ে নিজেই দোকান দাও না দিদি ভাই। ” সবারই তেমন ইচ্ছা। ওই দুইটা রুম এমনি এমনি পড়ে আছে। এদের একটার দরজা দিয়ে বাড়ির সামনের লনে নামা যায়। অদিতিও খুশি মনে মেনে নিলো।

যাত্রা শুরু করলো “Tithi’s food shop.” ভাবী চোখ ভরা খুশি ও পানি দুটো নিয়েই নামকরণের ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানালেন, অদিতি শুনলো না।

বিক্রি, হিসাব রাখা, আরও টুকটাক কাজের জন্য গ্রাম থেকে আমাদের এক দূর সম্পর্কের , নিম্নবিত্ত, ডিভোর্সী বোনকে নিয়ে আসা হলো। বাবার বাড়িতে সে বেশ কষ্ট ও অপমানের মধ্যে বাস করছিলো। নাম শম্পা। এখানে এসে সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। ফুপা-ফুপু -আনন্দ ভাই-তিথি ভাবী,মাজেদা বু’র স্নেহ,আদর আর দোকানের ছোট্ট মালকিন অদ্বিতীয়ার ভালোবাসা ভরা ব্যবহার, ভালো খাওয়া দাওয়া, ভালো পোশাক, ভালো বেতন, সর্বোপরি কথাবার্তা -আচার আচরণে সবার বুঝিয়ে দেওয়া যে শম্পা বাড়িরই একজন, বাইরের কেউ নয়, এই বোধ শম্পাকে অশেষ শান্তি দিলো,তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান জন্ম নিলো। এভাবে ফুপা-ফুপু,আনন্দ ভাইয়া-তিথি ভাবী ও অদিতির বিচক্ষণতায়, বুদ্ধিমত্তায় ও মনের সৌন্দর্যে কতো অসহায় মানুষ যে উপকৃত হয়েছিলো,স্বাবলম্বী ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়েছিলো, এখনও হচ্ছে, তার সংখ্যা আমার জানা নেই।

“Tithi’s food shop” দুর্বার গতিতে চলতে থাকলো। নানা স্বাদের নানা ডিজাইনের কেক,পেস্ট্রি, স্যান্ডউইচ, রোল,বিস্কিট বিক্রি হতে লাগলো দেদারসে। কয়েকমাসের মধ্যে খাবারগুলোর চাহিদা অনেক বেড়ে গেলো।অদিতি ফ্রাইড রাইস আর চিকেন ফ্রাইয়ের ব্যবস্থাও করলো।অদ্বিতীয়ার ব্যবসা বাড়তে লাগলো।

এতো সাফল্যের পরও ফুপা-ফুপু, আনন্দ ভাইয়া-তিথি ভাবী দুশ্চিন্তা করেন অদিতির বিয়ে নিয়ে। বয়স তো বসে নেই। মেয়েকে সারাজীবন মাথায় তুলে রাখতে তাঁদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা নেই। তবু! মেয়ে সুখে সংসার করছে দেখলেও শান্তি। কিন্তু অদিতির উপযুক্ত ছেলে কোথায় পাবেন? গাড়ি-বাড়ি-নগদ টাকা দিয়ে অনেকে জামাই কিনে, কিন্তু সে কথা আমরা চিন্তাও করতে পারি না।

ফুপু একদিন বললেন,” সমুদ্রকে বরং জিজ্ঞেস করি ওর চেনাজানা ভালো ছেলে আছে কিনা, বাংলাদেশের হোক আর অন্য দেশের হোক। অদিতির উপযুক্ত ছেলে পেলে দরকার হয় বাইরে সম্বন্ধ করি। ওরা এইসব পাস্ট হিস্ট্রি নিয়ে মাথা ঘামায় না। অদিতি ওখানে আরও পড়াশুনা করবে, ঘর সংসার করবে।আমাদের খুব কষ্ট হবে ওকে ছাড়া থাকতে, কিন্তু নিজেদের স্বার্থের জন্য তো ওকে আটকে রাখতে পারি না। ও সুখে থাকুক,শান্তিতে থাকুক। ”

“বিয়ে করলেই কি সুখে থাকা যায় মা?আনিলার বিয়ে কতো সাধ করে দিয়েছিলেন, তাও বাবার বন্ধুর ভাইয়ের ছেলে, কি হলো?এতো দুশ্চিন্তা করবেন না অদিতির বিয়ে নিয়ে। আল্লাহ যা চাইবেন,তাই হবে।”

দুইটা ঘটনা একই সাথে ঘটলো। এক বিকেলে লম্বা,ছিপছিপে, চশমা পরা, দারুণ হ্যান্ডসাম এক ছেলে এলো ফুপুর বাড়িতে। নাম অভি। অদিতির তিন বছর সিনিয়র। একই ভার্সিটির। অন্য বিভাগ। বর্তমানে নর্থ সাউথের লেকচারার।পাশ করার পরপরই উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু অদিতিকে রাজি না করানো পর্যন্ত সে কোথাও যেতে পারছে না। অদিতির সব কথা সে জানে। নিষ্ঠার সাথে পিছনে লেগে থাকায় অদিতি তাকে জন্মকাহিনী জানিয়ে দিয়েছে। তাতে অভির কিছু যায় আসে না।প্রথম থেকেই অদিতিকে তার ভীষণ পছন্দ। অদিতির ব্যক্তিত্ব, মিষ্টি কথা,কথা বলার স্টাইল, অদিতির গান, অদিতির স্বনির্ভর হওয়ার জন্য প্রবল ইচ্ছা, চেষ্টা, পরিশ্রম, অদিতির পরোপকার, অদিতির হাসি, অদিতির চেহারা সবই
অভির ভীষণ, ভীষণ পছন্দ। অভির জগৎ অদিতিময়। বাসা থেকে বিয়ে ও উচ্চ শিক্ষা দুটোর জন্য ই প্রবল ভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। অদিতির কথা বাবা-মা-ভাই -বোনদের অনেক আগেই খুলে বলেছে অভি।প্রথম দিকে বাবা-মা ভীষণ নারাজ ছিলেন, এখন তাঁদের পূর্ণ সম্মতি আছে। অভির বাবা-মা ভার্সিটির অনুষ্ঠানে অদিতির গান শুনেছেন, ভার্সিটিতে খোঁজ খবর নিতে যেয়ে অদিতির অঢেল প্রশংসা শুনেছেন প্রত্যেকের কাছে, অভির মা এখানে এসে কেক ও কিছু স্ন্যাকস কেনার ছলে অদিতির সাথে কথাবার্তা বলেছেন, এ বাড়ির সব সদস্যদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছেন, তাঁরা ইমপ্রেসড।

দ্বিতীয় ঘটনা হলো, গৃহ সহকারী ডলি তিথির কানে কানে বললো,এক মহিলা তিথি ম্যাডামের খোঁজ করছে, বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ান ভাই ভিতরে খবর পাঠিয়েছেন।

তিথি ভাবী গেলেন। গেটের সামনে মহিলাটা দাঁড়িয়ে আছে। চঞ্চল চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তিথি ভাবীর হাত-পা বরফ হয়ে গেলো। অদ্বিতীয়ার গর্ভধারিণীকে চিনতে তাঁর সময় লাগে নি।

“তুমি?”

” ছ্লামালাইকুম। কেমন আছেন?”

“ভালো। ভিতরে ঢুকো। হ্যাঁ, এখানে দাঁড়াও। কেন এসেছো?”

“মাইয়াডারে দেখতে পরান পুড়ে ম্যাডাম। ওরে দেখতে আইছি। ”

” জেলে যেতে চাও? না চাইলে এখনই বিদায় হও।”

“মাইয়াডারে একবার দ্যাখতে দিবেন না?এইডা কি কন? নয় মাস প্যাডে রাখলাম, সেই নাড়ি ছেঁড়া ধনরে দেখবার দিবেন না, কেমন মাইয়া লোক আপনি?”

মহিলার লোভ ও চালাকিতে চকচক করা মুখে থুথু ফেলার ইচ্ছা সংবরণ করে ভাবী মিসড কল দিয়ে আনন্দ ভাইয়াকে ডাকলেন।

“কি ব্যাপার? এই মহিলা এখানে? কে তোমাকে এখানকার ঠিকানা দিয়েছে?”

“কিলিনিক থেকে পাইছি। আমার মাইয়াডারে দেখবার আইছি।”

“তোমার কোনো মেয়ে এখানে থাকে না। বের হও।”

” আপনেরা অ্যাতো চামার ক্যা রে? আমার মাইয়ারে না দেইখখা আমি এইহান থন যামু না। ”

আনন্দ ভাইয়া চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,”এক্ষুনি যদি বের না হও এখান থেকে, তোমাকে জ্যান্ত কবর দিবো।”

“অতো সহজ না। আমার বাপ,মা, স্বামী সবাই দাঁড়াইয়া রইছে রাস্তায়। আমার মাইয়ারে দ্যাখতে দেন। নাকি ওরে বিদেশে বিক্রি করে দিছেন আপনারা?”

তিথি ভাবী গায়ের জোরে এক চড় মারলেন মহিলাকে। আনন্দ ভাইয়াকে বললেন,”পুলিশে ফোন করো এক্ষুনি। সবকটা শয়তানকে ধরে নিয়ে যাক। এগুলো মানুষ না। পিশাচ। আসছে টাকাপয়সার জন্য। কত বড় সাহস! আমাদের ব্ল্যাকমেইল করার জন্য ঢাকায় এসেছে। কি ব্ল্যাকমেইল করবে তুমি?আমার মেয়ে সব কথাই জানে। রিয়াজ, দেখোতো,রাস্তায় এই মহিলার বাপ-মা আর স্বামী দাঁড়িয়ে আছে। ওদেরকে ভেতরে নিয়ে আসো। ”

মহিলা মোবাইলে চাপ দিতে যাচ্ছিলো, ভাবী খপ করে তার হাত ধরে ফেললেন।

“চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। তারপর তোমার চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে জেলে ঢুকে পচে মরো। মারের চোটে পুলিশ তোমাদের পেট থেকে সব কথা বের করে নিবে।”

চলবে।

#শক্তিময়ী
পর্ব ২৩
বড় গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

“অদিতি, তোকে জন্ম দিয়েছিলেন যিনি, তাঁকে দেখবি?দেখতে ইচ্ছা করে? তাঁরা কি করেন,কোথায় থাকেন, জানতে ইচ্ছা করে?”

“হঠাৎ এ কথা কেন, মা? কি হয়েছে? এমন প্রশ্ন তো আগে করো নি। উত্তর যদি জানতেই চাও,তাহলে বলি, তুমি আমার মা। তুমি আমার সব।দাদা-দাদুমনি-ভাইয়া-পরী-আব্বু-তুমি, তোমরাই আমার সব। ”

“ধর্, তোর যদি তাঁকে দেখার খুব ভালো সুযোগ থাকে,তাহলে দেখবি? পরে কখনো আফসোস করবি না তো যে আমরা জানতাম,তবু তোকে বললাম না কেন? ”

অদিতি বড় বড় শ্বাস ফেলছে,” কি হয়েছে মা? উনি কোথায়,তুমি জানো?”

“তুই আমার কথার জবাব দে। তোর কি জন্মদাত্রী সম্পর্কে প্রায়ই কৌতূহল হয়? জানতে ইচ্ছা করে তাঁর সম্পর্কে? ”

“না,মানে, আমি ঠিক, আমি জানি না মা। কিন্তু কেন হঠাৎ এই কথা?”

“উনি আমাদের নীচের তলার গেস্টরুমে বসে আছেন।”

অদিতি ভীষণ চমকে উঠলো। তিথি অদিতির হাত ধরে স্বাভাবিক গলায় বললো,”আয়।”

অদিতি দেখলো, গেষ্টরুমে কয়েকটা বাড়তি চেয়ার আনা হয়েছে। আব্বু কঠিন মুখে বসে আছেন একটায়। সঞ্জুচাচা আব্বুর চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে। চোয়াল আর মুখের পেশি শক্ত। দরজার কাছে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছেন মৃদুল চাচা তাঁর ছয় ফিট এক ইঞ্চি লম্বা শরীর নিয়ে।

অদিতি অন্যান্যদের দিকে তাকালো। লম্বা কাঁচা পাকা দাড়ি,পাকা ই বেশি, পানের কষ ঠোঁটের এক কোণে, পরণে ময়লা জোব্বা আর লুঙ্গি, চশমা চোখে এক বৃদ্ধ। মাথায় গোলাপি টুপি। মুখে চরম ধূর্ততার ছাপ। এক বৃদ্ধা, নীল বোরখা পরা, পান চিবাচ্ছেন আর হাত দিয়ে মুখ থেকে বের হয়ে আসা পানের রস মুছছেন, পায়ে স্যান্ডেল, নোংরা বড় বড় নখ হাতে পায়ে। এক না তরুণ, না মধ্যবয়সী লোক, বেশ শক্ত সমর্থ, হাফ হাতা শার্ট, তাতে বড় বড় ফুলের ছাপ, নীল প্যান্ট, চোখে সানগ্লাস, সরু গোঁফ। হলদে দাঁতগুলো বের হয়ে আছে।

এক মহিলা। মোটামুটি সুন্দর বলা যেতো কিন্তু ধূর্ততা ও লোভে ভরা দুটি চোখ মানুষটাকে কুৎসিত করে ফেলেছে। চোখ মনের আয়না। মহিলার চেহারা দেখে অদিতি কথাটার সত্যতা উপলব্ধি করলো এবং বুঝতে পারলো, হায়! এই মহিলার জঠরে সে বড় হয়েছে।

অদিতিকে দেখে মহিলা “ওরে আমার জান রে,ওরে আমার কলিজা ” বলে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলো কিন্তু তিথি ভাবী স্বাভাবিক গলায় দৃঢ় ভাবে বললেন,” শীলা, তোমার চেয়ারে চুপচাপ বসো। অদিতিকে দেখতে চেয়েছো,দেখো। ওর সাথে কোনো কথা থাকলে বলো। তারপরে আমরা উঠবো। অদিতি ও আমাদের বিশ্রাম দরকার। তোমরা রাতের খাবার খেয়েছো তো ঠিকঠাক? ”

” ওরে আমার ময়না পাখি রে, এমন একখান দিন নাই,যেদিন তোর জন্য চোক্ষের পানি ফালাই নাই। কই না কই তোরে খুঁজছি আর আল্লারে ডাকছি,আল্লাহ, আমার মাইয়ারে আমার কোলে ফিরাইয়া দাও। ”

শীলা আবার অদিতির দিকে ছুটে আসছিলো জড়িয়ে ধরার জন্য, অদিতি সরে গেলো। শান্ত গলায় তিথিকে বললো,”মা, আমার কাজ আছে।আমি ভিতরে গেলাম।”

“মা কারে কও আম্মু?আমিই তোমার মা। তোমারে অনেক মিছা কথা বলছে এরা। আজ আমি তোমারে সব সত্য কথা বলবো। একটু বসো,আম্মু।”

কি আশ্চর্য রকমের বদমাশ আর নির্লজ্জ এরা! গুষ্ঠিসহ ধরা পড়ার পরে কতো মাফ চাওয়া, নাকি কান্না কাঁদা। তাদের ভুল হয়ে গেছে, এমন আর কোনোদিন হবে না। শিলা আবেগবশত আজেবাজে কথা বলে ফেলেছে আনন্দ -তিথিকে, আসলে মেয়ের জন্য ইদানিং খুব কষ্ট হয়,মন পোড়ে। একবার চোখের দেখা দেখে চলে যাবে, আর আসবে না। শীলার বাপ-মা কয়দিন বাঁচে না বাঁচে, নাতনিকে দেখলে, তার কাছে মাফ চাইলে শান্তিতে মরতে পারে।

এসব কথায় গলে যাওয়ার মানুষ আনন্দ ভাইয়া -তিথি ভাবী নন। কিন্তু এদের রক্ত অদিতির গায়ে,এটা ভেবে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন নি বা পুলিশ ডাকেন নি। বসতে দিয়েছেন এই ঘরে, সন্ধ্যায় ভালো নাশতা আর রাতে পোলাও কোরমা খাইয়েছেন। সেই সাথে বের করে নিয়েছেন পেটের কথা।

ক্লিনিকেরই এক প্রাক্তন কর্মচারী তাদেরকে অদিতির কথা জানায়। এ বাড়ির ঠিকানাও দেয়। অদিতি বড় ব্যবসা করে, অদিতি এই বিশাল বিত্ত ও
প্রভাবশালী পরিবারের নয়নমনি,এসব তথ্য সেই কর্মচারী ই,যার নাম রাহেলা, শীলাদের জানায়। মেয়ের উপার্জনে মায়ের তো হক আছে, তাছাড়া চরম দূ্র্দিন যাচ্ছে পরিবারের, প্রায়ই না খেয়ে দিন গুজরান করতে হয় তাদের, তাই এখানে আসা।

আনন্দ ভাই বলেছিলেন, ” তুমি তো আমার মেয়েকে মেরেই ফেলতে। আল্লাহর ইচ্ছায় আর আমার স্ত্রীর চেষ্টায় মেয়ে আমার বেঁচে যায়। সেই সময় আমার মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তোমাদের হাত-পা ধরতে হতো, রীতিমতো ব্যাপারটাকে পুঁজি করে জমজমাট ব্যবসা করেছিলে তোমরা, বহু টাকা পয়সা নিয়ে মেয়ের জন্ম দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলে। সেই মেয়েকে কোন লজ্জায় দাবী করো? তার উপার্জনে তোমাদের হক আছে এমন চিন্তা আসে কেমন করে?”

জানা গেলো, এই হলুদ দাঁতের লোকটা অদিতির বাবা নয়। সে শীলার দ্বিতীয় স্বামী। ষোলো-সতেরো বছর বয়সে শীলা তার মায়ের সাথে কাজ করতো গ্রামের ধনবান ব্যাপারি বাড়িতে। ঐ সময়ে পঞ্চাশ বছর বয়সী, চার ছেলেমেয়ের বাপের সাথে শীলার অবৈধ সম্পর্ক হয়। ব্যাপারি শীলাকে বিয়ে করার আশ্বাস দেয়। শীলার মা ব্যাপারটা ঠিকই বুঝতে পারে। তার প্রশ্রয়ে ব্যাপারটা বহুদূর গড়ায়। মেয়ে যদি এতো বিত্তশালী বাড়ির মালকিন হয়,তাহলে কপাল খুলে যাবে একেবারে। শীলা অন্তঃসত্ত্বা হয়। ব্যাপারিকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। শীলা আর তার মায়ের দাপট তখন ক্রমশ বাড়ছিল। এমনকি ব্যাপারি গিন্নি ও ছেলেমেয়েদের উপরেও তারা হালকা পাতলা দাপট দেখানো শুরু করে দিয়েছিলো। ক্রমে পেট স্ফীত হতে থাকে। ঘটনার জানাজানি হয়। ব্যাপারির বড় ছেলে সাতাশ বছর বয়সী জামাল বিশাল এক রাম দা বাপের গলায় ধরে। ছোটোটা বেধড়ক পিটায় শীলা,তার মা,বাপ, ভাইকে। পুরো গ্রামে ছিছিক্কার পড়ে যায়। বড় ছেলের দায়ের সামনে ব্যাপারি সব সম্পত্তি বৌয়ের নামে লিখে দেয়, বৌয়ের পা ধরে মাফ চাইতে বাধ্য হয়। শীলা আর তার মা’কে নাকে খত দিতে হয় ব্যাপারি গিন্নির পায়ের কাছে। ব্যাপারির ভাই আর ছেলেরা শীলাদের খড়ের ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। হুমকি দেয়, এই গ্রামে বা তার আশেপাশে দেখা গেলে শীলাদের পুড়িয়ে মারবে।

প্রথমে শীলারা আশ্রয় নেয় তাদের নানার বাড়ির গ্রামে। সপ্তাহ খানিক যাওয়ার পরে নিজেদের গ্রামের এক লোক এসে জানায়, কে বা কারা ব্যাপারির ধড় থেকে কল্লা আলাদা করে ফেলেছে। সেই অজ্ঞাত আসামীরা শীলা আর তার বাচ্চাকেও খুন করার জন্য খুঁজছে। গ্রামবাসীরাও এমনটা চায় যেন ঘটনাটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। অকারণে দ্বিতীয় বিয়ে করা, পরকীয়ার ঘটনা, অবিবাহিত অবস্থায় গর্ভবতী হওয়ার ঘটনা যেন গ্রামে আর না ঘটে ।

এসব শুনে ভয়ে শীলারা পালিয়ে আসে ঢাকায়। এখন পেটের এই বাচ্চা দিয়ে হবে টা কি? এমন মেয়েকে কেইবা বিয়ে করবে, আর কারা ই বা কোনো কাজ দিবে? ঢাকা শহরে বসে খাওয়াও অসম্ভব ব্যাপার। তাই পেটের শত্রুকে
ক্লিনিকে নিধন করতে আসা। এই ক্লিনিকের সন্ধান দিয়েছে ওখানকারই কর্মচারী রাহেলা আখতার,ঢাকার যে বস্তিতে শীলারা উঠেছিল,সেখানেই মহিলাটা বাস করতো।

অদিতিকে পেটে রাখার জন্য অনেক টাকা পেয়েছিলো শিলা আর তার পরিবার, ওখান থেকে ক্লিনিকের মহিলা মোটা একটা কমিশন আদায় করে নেয়। আর বুদ্ধি দেয়,”বাচ্চা খালাস হলেই পালিয়ে যাস। ওদের নিজেদের ছেলেপুলে আছে,ওরা তোর বাচ্চা কোন সাধে রাখবে? সমাজসেবা করে তো, ভুলিয়ে ভালিয়ে তোদের বাচ্চা নষ্ট করা থেকে আটকেছে, তোদের বাচ্চা এখন তোদের গলাতেই ঝুলিয়ে দেবে। ”

শীলারা পালায় রাহেলা বেগমের গ্রামের বাড়িতে। তিথি ভাবীর দেওয়া টাকা পয়সা দিয়ে ওখানে একটুকরা জমি কেনে,ঘর উঠায়। শিলার ভাই রাহেলার ভাইদের কাজে যোগ দেয়। চোরাচালানী। এই কাজ করে শীলার ভাই জসীম ভালো টাকাপয়সা আয় করে, ইটের বাড়ি বানায়,বেশ গয়নাগাটি দিয়ে এক সুন্দরীকে বিয়ে করে আর বিয়ের সাতদিনের মধ্যে দলের কিছু লোকের হাতে খুন হয়। জসীমের মৃত্যুর পরে বাড়ির সবাই মিলে জসীমের বৌকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, তবে গয়নাগাটি রেখে দেয়। মেয়েটার বাবার দিনে আনি দিনে খাই হাল,তবু জসীমের সাথে মেয়ের বিয়ের সময় কিছু ধানী জমি যৌতুক দিয়েছিলেন, সেটা আর ফেরত পেলেন না। কারণ জসীমের ভাই কাশেম তখন বড় একটা গ্যাঙের সদস্য, মাদক পাচারে তার দারুণ দক্ষতা। ঘরে নদীর স্রোতের মতো টাকা আসতে লাগলো, দোতলা পাকা বাড়ি হলো, বাপকে বড় একটা দোকান করে দিলো, পানির দরে জমি কিনতে লাগলো, বিয়ে করলো, তারপরে এক দিন মোটর সাইকেল বহর নিয়ে নিজেদের গ্রামে যেয়ে ব্যাপারীর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলো। ব্যাপারির দুই ছেলেকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের বাইরে এনে শত শত গ্রামবাসীর সামনে কুপিয়ে মারলো, ভয়ে কেউ টুঁ শব্দটাও করলো না। কেউ গ্রেফতার হলো না,কোনো বিচার আচার হলোনা। ব্যাপারি বাড়ি,তাদের বিঘা বিঘা জমি, পুকুর, স্হাবর-অস্হাবর সব সম্পত্তি এখন কাশেমের দখলে,কাশেমের নামে।

অদিতির থেকে মুক্তি পাওয়ার তিন বছর পরে শীলা বিয়ে করেছিলো পাশের গ্রামের এক জোতদারকে। এই লোকের অবস্থা ছিলো বিরাট। একটা বৌ আর তিনটা মেয়েও ছিলো। ছেলের আশায় জোতদার সুন্দরী তরুণী শীলাকে বিয়ে করলো। সম্পদের আশায় শীলা লোকটাকে বিয়ে করলো। জোতদার তাকে গয়না গড়িয়ে দিলো অনেক, নিজের নামে অনেক জমিও লিখিয়ে নিলো শীলা। তারপরে এক পুত্রকে জন্ম দেওয়ার পাঁচ বছরের মাথায় ছেলেকে রেখে বাপের বাড়ি চলে এলো শীলা। এর তিন বছর পরে জোতদারেরই এক দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই মোস্তাককে শীলা বিয়ে করে। এ ঘরে একটি মেয়ে আছে।

কাশেম এখন বাপ-মা-বোনকে আগের মতো দেখে না। তার প্রাণের আশংকা আছে বিধায় অনেক সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে বৌ বাচ্চা সহ সে শীঘ্রই বিদেশে চলে যাবে। আয়ের একটা উৎস থাকা দরকার। রাহেলার কাছ থেকে তারা অনেক কিছু শুনেছে অদিতির ব্যবসা আর এই বাড়ির জাঁকজমক সম্পর্কে। তাই মেয়েকে দেখতে আসা।

এ সমস্ত কথা ভাবী ওদের পেট টিপে টিপে বের করেছেন। ভাবীর কথার জালে পড়ে শেয়ালের মতো চতুর মানুষগুলোও সব কথা বলে ফেলেছে।

আনন্দ ভাইয়া বলেছিলেন, “এরা সব কটা ভয়ংকর ক্রিমিনাল। এদের পুলিশে দেওয়া দরকার। আর ঐ কাশেমকেও বিদেশে পালানোর আগে ধরিয়ে দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। ”

শীলার বাবা পানের কষ মুছতে মুছতে হাসিমুখে বলেছিল,”বাবাজি, আমরা যে এইসব কথা তোমারে কইছি,তার পরমাণ দিতে পারবা? আমরা কিচ্ছু কই নাই। তুমি এমন মিছা কথাগুলো কই থেকে পাইলা,বাবাজি? আর কাশেম ফেরেশতার মতন মানুষ। তুমি ওর নামে কি কইবা পুলিশরে? ”

সবার গা ঘৃণায় গুলিয়ে উঠছিলো বারবার। অদিতি এতো কুৎসিত, ভয়ংকর পরিবারের মেয়ে? বাপ এক নারীলোভী ব্যাপারি,সেই ঘরে অদিতির দুটো ভাই আর দুটো বোন ছিলো। ভাই দুটো আবার পিতৃহত্যাকারী, সেই ভাই দুটোকে খুন করেছে অদিতির ছোট মামা কাশেম যার হাতে আরও অনেকের রক্ত লেগে আছে। লোভী মায়ের জোতদার স্বামীর ঘরে অদিতির একটা ভাই আছে। মা জাতির কলংক এই মহিলার বর্তমান ঘরে অদিতির একটা বোন আছে। কি চরিত্রহীন, অমানবিক, লোভী, নিষ্ঠুর পরিবারের মেয়ে অদিতি!

এদের সাথে অদিতির দেখা করানোর ঘোর বিরোধী ছিলেন ফুপা-ফুপু, আনন্দ ভাইয়া, সঞ্জু ভাইয়েরা। তিথি ভাবী বললেন,” অদিতির কিছু কিছু লেখা আমি পড়েছি। ওর খুব জানার ইচ্ছে, ও কার পেটে ছিলো, কার ঔরসে ছিলো, কি ঘটনা হয়েছিল আসলে। আমি ওর জানতে চাওয়ার এই ইচ্ছাকে মূল্য দিই। না হলে সারাজীবন এই প্রশ্নটা ওকে তাড়িয়ে বেড়াবে। শান্তিতে থাকতে দিবে না। সুতরাং, দেখা হোক। মেয়ে আমার অনেক বুদ্ধিমতী, সাহসী, বাস্তববাদী, আল্লাহভক্ত। ওকে নিয়ে তোমরা টেনশন কোরো না। আর এই যে তোমরা! তোমাদেরকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারতাম, পুলিশে হ্যান্ড ওভার করতে পারতাম, করিনি।শুধুমাত্র অদিতির সাথে চরম দুর্ভাগ্যক্রমে তোমাদের রক্তের সম্পর্ক আছে বলে। আমার মেয়েকে জাস্ট পাঁচ মিনিটের জন্য দেখবে,ভদ্র ভাবে কথা বলবে,তারপর চলে যাবে।এরপরে যদি অদিতির ত্রি সীমানায় দেখি তোমাদের, তাহলে কিন্তু আমি তোমাদের একজনকেও ছাড়বো না। ”

“আমরা শুধু মাইয়াডারে এক পলক দেখবো ম্যাডাম। আর মাইয়াতো অনেক বড় ব্যবসা করে শুনছি, আপনেরাতো রাজ রাজড়া,মাসে যদি কিছু টাকা পাঠাইতেন_”

“একটা পয়সাও দিবো না। অদিতিও দিবে না। ”

শীলার মা বললো,”এতো বড়লোক হইয়াও আমার নাতিনের পয়সায় আপনাদের লালচ! আমি কিছু বুঝি না নাকি? ওর ব্যবসার টাকা আপনারা যা লইবেন, লন। কিন্তু দু’চারটা পয়সা তো সে মা-নানা-নানীর জন্য খরচ করতে পারে। পারে না? রক্তের সম্পর্কের দাম নাই? ”

তখন সন্জু ভাইয়ের রণমূর্তি দেখে সবাই ঘাবড়ে গিয়েছিল। কথা ছিল, অদিতিকে দেখে তারা চলে যাবে। এখন কথাভঙ্গ করে আবার নাটক শুরু করেছে।

অদিতি চলে যাচ্ছিলো, শীলার মুখে এই কথা শুনে ঘুরে তাকালো, তারপরে শান্ত গলায় বললো,”আমার আব্বু -মা, দাদা-দাদু,চাচু-ফুপিদের নিয়ে একটা বাজে কথা যদি কেউ বলে, আমি তাকে খুন করে ফেলবো। মা,এদের বিদায় দিয়ে দাও, আর কখনো যেন আমার চোখের সামনে না আসে। দেখার ইচ্ছা ছিলো,ইচ্ছা মিটে গেছে। যতোটা খারাপ কল্পনা করতাম, তার চেয়েও অনেক অনেক খারাপ। আমি চোখ দেখে মানুষ চিনতে পারি। আমি ভেতরে গেলাম মা। ”

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে