শক্তিময়ী
বড় গল্প (১ম পর্ব)
নাহিদ ফারজানা সোমা
ফুপুর বাসায় মহা গ্যাঞ্জাম চলছে। ব্যাপারটাতে কেউ রাজি না।শুধু ভাবি ছাড়া।
আনন্দ ভাই অর্থাৎ আমার ফুপাতো ভাই ঘোরতর বিরোধী। তিথি ভাবির কান্নাকাটি, অনুরোধ -উপরোধ কিছুই আনন্দ ভাইয়াকে টলাতে পারছে না।
” আমার এতো শখ নেই যে,হাবিজাবি যা তা এনে ঘর ভরাবো।”
তিথি ভাবির বাবা জামাই এর সুরে সুর মেলালেন,
“একদম আমার মনের কথা, আনন্দ। এসবের ফল কখনোই ভালো হয়না। রক্ত অনেক বড় ফ্যাক্টর।”
“তিথি,পরিস্কার বলে রাখি, তুমি যদি তোমার ইচ্ছায় অনড় থাকো,তাহলে মা, আনন্দ আর তুমি অন্য বাসায় থাকো। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তোমাকে এ কথা বলতে,কিন্তু আমার বাসায় কোনো পাপ আমি বরদাস্ত করবো না।” আমার ফুপা বললেন তাঁর বৌমাকে।
“পাপ কেন বলছেন বাবা?”
“পাপ না? বাপের ঠিক নেই, তাকে পাপ বলে নাতো কি বলে?একটা জারজ বাচ্চা থাকবে আমাদের বাসায়?তোমার একটা ছেলে আছে না?এমনতো না,তুমি নিঃসন্তান। আল্লাহ চাইলে আরও বাচ্চা হবে। এমন উদ্ভট চিন্তা তোমার মাথায় কে ঢুকালো?”
“বাবা, একটা তিন মাসের বাচ্চা যদি ভাল,সুন্দর একটা জীবন পায়,আপনার ভালো লাগবেনা?কেউ যদি ওদের না নেয়,কি হবে ওদের? ”
“এসব ভাবার জন্য সরকার আছে,সমাজ কল্যাণ দপ্তর আছে,এনজিও আছে, তোমার চিন্তা না করলেও চলবে। তাছাড়া কয়টাকে উদ্ধার করবে তুমি? বলো,কয়টাকে?”
“একটাকে অন্তত উদ্ধার করি।”
“তিথি,একদম চুপ। তুমি এই বাচ্চা নিয়ে আর একটা কথাও বলবে না,এটাই শেষ কথা।”
ভাবিটা আমার বরাবরই পাগল। তার বিভিন্ন পাগলামি নিয়ে স্বামী -শ্বশুর -শাশুড়ি সবাই রীতিমতো আহ্লাদিত।ফুপা-ফুপুর মতো ভালো মানুষ কমই আছে।
তিথি ভাবির পাগলামির কিছু উদাহরণ দিই। বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়ি এসে তিনি তরকারি বন্টনের চমৎকার পদ্ধতি চালু করলেন। মাছ -গোশতো-সব্জির হাঁড়ি-কড়াইএর সামনে সারি দিয়ে বাটি থাকে, সমান সাইজের, ঝকঝকে পরিস্কার, গৃহকর্মী কুসুম, মাজেদা বুবু আর ড্রাইভার সাহেবের জন্যও। বাড়ির একেকজনের জন্য একেকটা বাটি। সবার মধ্যে সমান বন্টন। কারোর বেশি, কারোর কম,কারোর গোশতের টুকরো বড়,কারোর ছোট,তা হবে না। নিয়ম করে ভাবি কুসুম আর মাজেদা বুবুকে পড়ান, ড্রাইভার সাহেবের ক্লাস নাইনে পড়া মেয়েটিও ভাবীর কাছে বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়তে আসে সপ্তাহে চারদিন। ভাবির পাল্লায় পড়ে আমরা বাইশজন ভাই-বোন নিয়মিত রক্তদাতা হয়েছি। আমরা সব ভাই বোন এখন ভাবির চ্যালা হয়ে গৃহকর্মীদের পড়াই, ঝুমুর-নূপুর-আরিফতো রীতিমত বস্তিতে যেয়ে পড়ায়। সন্জু তার দলবল নিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে যেয়ে বাচ্চাদের পড়ায়, খাবার কিনে দেয়। লীনা-মৃদু বস্তিতে যেয়ে দেখেশুনে জামাকাপড় বিলায়। আমাদের ডাক্তার বোন লুবনা আপা আর নীতু আপা প্রতি শুক্রবারে বিনা পয়সায় গরীবদের চিকিৎসা করে।
সবই হয়েছে ভাবির কল্যাণে। আগে আমরা এসব নিয়ে চিন্তাও করতাম না।
এখন ভাবির আব্দার, পাশের একটা রহস্যময় ম্যাটারনিটি কাম ক্লিনিক হতে তিনি একটি মেয়ে শিশু দত্তক নিবেন।বাচ্চাটার মা সাত মাসের বাচ্চা নস্ট করতে এসেছিল। কোন ভাবে সে ভাবির পাল্লায় পড়ে। ভাবি অনেক বুঝিয়ে তাকে বাচ্চাটা রাখতে ও জন্ম দিতে বাধ্য করেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে বাচ্চাটার সব দায়-দায়িত্ব তিনি নিজে নিবেন। এজন্য তিনি গরিব মেয়েটিকে আর তার বাপ-মাকে টাকা-পয়সাও দেন যেন তারা একটা দোকান দিতে পারে। এই হলো ইতিহাস।
“প্রথম কথা,জারজ বাচ্চা আমি সংসারে অ্যালাও করবোনা। দ্বিতীয় কথা,কতো আইনি জটিলতা আছে,জানো?তৃতীয়ত,ভবিষ্যতে এই বাস্টার্ডকে তুমি সম্পত্তির ভাগ দিবে? কল্পনার রাজ্যে না থেকে বাস্তবে পা ফেলো।”
“আমি চ্যালেঞ্জ নিতে চাই। অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়ে দিতে চাই। তোমরা যাকে জারজ বলো,আমি তাকে এমন ভাবে গড়ে তুলতে চাই,যেন সে মাথা উঁচু করে দেখিয়ে দিতে পারে, তার একমাত্র পরিচয় মানুষ,
জারজ বলে কোন শব্দ হয়না, সো কল্ড জারজদের আর দশটা বাচ্চার সাথে এতোটুকু পার্থক্য নাই।”
“বড় বড় বুলি কপচিও না। নিজের বাচ্চা পালতে মানুষ হাঁপিয়ে যায়,সেখানে পরের বাচ্চা,তাও আবার বাপের ঠিক নাই। ”
কথা কাটাকাটি হচ্ছে ভাইয়া-ভাবি-ফুপা আর ভাবির আব্বার মধ্যে। আমরা নীরবে ভাবির পক্ষে থাকা কতোগুলো নিরীহ মানুষ।
“তুমি এতো করিৎকর্মা, মেয়েটিকে তার ঐ প্রেমিকের সাথে মিল করিয়ে দিতে পারতে?”
“প্রেমিক কি এমন ধোঁকা দেয়?তার সাথে কোন বুদ্ধিতে
মেয়েটার মিল করাবো?তবে হ্যাঁ, পুলিশের সাহায্য নিতে পারতাম,লোকটাকে জেল খাটাতে পারতাম,বড্ড ভুল হয়ে গেছে। ”
“অনেক নিঃসন্তান দম্পতি আছে,বাচ্চার জন্য মাথা কুটে মরছে, তারা নিক।”
বাচ্চাটা আছে ক্লিনিকটাতে,এক আয়ার তত্বাবধানে, বাচ্চার দেখাশোনার জন্য ম্যানেজার আর আয়াকে টাকা দিতে হচ্ছে। বাচ্চার খাবার,জামাকাপড়, কাঁথা ভাবি সাপ্লাই দিচ্ছে, নিয়ম করে,যত্নের সাথে। ওই অল্পবয়সী মা আর তার বাপ-মা বাচ্চার জন্মের পর পালিয়ে গেছে, মিথ্যা ঠিকানা দিয়ে।
“এ পর্যন্ত ছয়জনের সাথে কথা বলেছি বাচ্চাটাকে নেওয়ার জন্য, তারা ডাক্তারের পর ডাক্তার দেখায়,পীর ফকির ধরে, জানে বাচ্চা হওয়ার আর সম্ভাবনা নেই, তবু বাচ্চা দত্তক নিবে না। অথচ এরা যদি সবাই একটা করে বাচ্চা দত্তক নিতো, কি ভালোই না হতো।” আমাদের অতি প্রিয় আন্টি, মানে তিথি ভাবির মা বললেন।
ভাবি তেজোদৃপ্ত গলায় বললেন,”যাদের সামর্থ্য আছে,তাদের সবার একটা হলেও বাচ্চা দত্তক নেওয়া উচিৎ,নিজ সন্তানের মতো লালন -পালন করা উচিৎ। এটা মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব। ”
“বাহ্,বাহ্, ব্যাভিচার করে সব জারজ পয়দা করবে আর আমরা মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করবো।কি বুদ্ধিমানের কথা। এতে ব্যাভিচার ভাইরাসের মতো করে সমাজে ছড়িয়ে পড়বে।”
“শোন,তিথি, মা আমার, বাচ্চাটাকে আমরাই কোন সেফ হোমে নিয়ে যাই,খরচাপাতি যখন যা লাগে তুমিই দিবে,কিন্তু এ জিনিস বাসায় আনার কথা মনেও এনোনা।”
“না মা, আমি তাকে নিজ সন্তানের মতো মানুষ করতে চাই। আমি পারবো।আমাকে দেখে আর দশটা বাপ-মা পারবে। এই যে আমার ভাই -বোন,দেবর-ননদরা বসে আছে,তারা পারবে।আমি সমাজের পরিবর্তন আনতে চাই।”
“কষে এক থাপ্পড় লাগাবো,বাঁদর মেয়ে।পেটের শত্রু! মনে রাখিস, তুই বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, বেগম রোকেয়া না।”
“সত্যি আমি বেগম রোকেয়া, বিদ্যাসাগর না। উনারা নমস্য। তবে উনারা উনারাই, আর আমি আমিই। ”
বিতর্কের আর শেষ হয়না। ভাবি জিদ করে খাওয়া ছেড়ে দিলেন। তিনদিন অনশনের পরে আবার মিটিং।
ফুপা প্রথম মুখ খুললেন।
“তিথি, আইনের মারপ্যাঁচ জানো?”
“জ্বী বাবা,সবকিছু জেনে নিয়েছি ভালো করে।”
“ভবিষ্যতে তোমার সহায় সম্পত্তি কিভাবে ভাগ করবে?
আমার দাদাভাই এর ভাগ থেকে ঐ বাচ্চাটাকেও দেবে?”
“সম্পদ নিয়ে কিচ্ছু ভাবিনি বাবা। মানুষ আগে।সম্পদ অনেক পরের কথা। আমার দুই বাচ্চাকে আমি খুব যত্ন করে মানুষ করবো। তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দিব। মেয়ে বড় হলে আমি সবকিছু জানাবো,দুই ছেলেমেয়েকেই।”
“এতে সে মেন্টাল ট্রমায় পাগল হয়ে যাবে না?”
“সে ভাবেই তৈরি করবো বাবা, যে কোন পরিস্থিতি ফেস করতে পারার নামই শিক্ষা। আমি সব কিছু সম্ভব করে দেখাবো,বাবা।”
” ওকে আমি, তোমার মা,আনন্দ,তোমার আব্বা-আম্মা কেউ সহ্য করতে পারবো না।তুমি ওর জন্য আমাদের ত্যাগ করতে পারবে?তোমার নিজের সন্তানকে?”
“না বাবা,তা পারবোনা।তখন আমি ওকেই ত্যাগ করবো।কিন্তু প্রচণ্ড কষ্ট আর অপমানবোধ নিয়ে আমার বাকিটা জীবন কাটবে।আমি হয়তো কখনো আর স্বাভাবিক হতে পারবো না। আপনিতো জানেন বাবা, আমি মিছেমিছি কোন কথা বলিনা। আমি শুধু এটা ভেবে অবাক হচ্ছি,একটা তিন মাসের বাচ্চার এতো ওজন যে কেউ তাকে বহন করতে পারছে না?”
“শোন মা,তোমাকে আমি অত্যন্ত স্নেহ করি।তাই এবারে রাজি হলাম। কিন্তু ঐ বাচ্চাকে যদি আমরা কেউ ই আদর-যত্ন না করি,কখনোই না করি,মনে কষ্ট পেওনা কিন্তু। ”
“থ্যাঙ্কিউ বাবা, থ্যাংকস এ লট।”
“আরেকটা কথা, আর কখনো এ ধরণের ভূত মাথায় চাপলে সেটাকে কিন্তু প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। ”
“প্রশ্ন ই ওঠে না বাবা। এমন পরিস্থিতিতে আবার পড়লে ঠিক অন্য একটা ভালো উপায় বের করে নিবো।”
ভাবি লাইন দিয়ে মুরব্বিদের সালাম করতে লাগলেন। আনন্দ ভাইয়াকে হালকা করে জড়িয়ে ধরলেন সবার সামনে।ঐ যে বললাম না,ভাবী কিছুটা পাগল টাইপের।
চলবে