লাল নীল ঝাড়বাতি পর্ব-০৮

0
730

#লাল_নীল_ঝাড়বাতি(পর্ব:৮)
#নাফিসা_আনজুম
,,

আজকে ওনার জীবনের বিশেষ একটা দিন। এই দিনে পৃথিবীতে আসছে উনি। বিয়ের আগে যতোটা অপরিচিত ছিলো মানুষটা বিয়ের পর তার থেকে বেশি চিনেছি ওনাকে। স্বামি স্ত্রীর বন্ধনটা পবিত্র। স্বামির যখন ইচ্ছা স্ত্রীর কাছে আসতে পারে, সেখানে এই মানুষটা আমাকে অনেকটা সময় দিয়েছে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। আমি তাকে আর দূরে রাখতে চাই না। আমারো যে বড্ড ভালোবাসতে ইচ্ছা করে ওনাকে। যখন তখন জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে। ওনার কপালে চুমু দিতে ইচ্ছা করে। ওনার কাধে মাথা রেখে জোৎস্না দেখতে ইচ্ছা করে।
তাই আজ ওনার জন্মদিনটা একটু অন্য ভাবে সেলিব্রেট করবো।

নিচতলার ড্রয়িংরুমটা সাজিয়ে নিলাম। অবশ্য আমার সাথে ফাহিম ভাইয়া আর আপুও ছিলো। শাশুড়িমা মাঝে মধ্যে একবার বলে যে বাড়ির বউদের একটু শান্তশিষ্ট মানায় তবে আমাকে সরাসরি কিছু বলে না তাই ওনার ওসব কথা আমি গায়ে মাখি না। আমার মতে বাড়ির বউদের ওতো চুপচাপ মানায় না, নয়তো সবাই অহংকারী ভাবতে পারে। বাড়ির বউরা একটু চঞ্চল হবে, বাড়ির কাজ করবে, সবার সাথে মিলেমিশে চলবে সেটাই ভালো।

বাড়ি সাজানো হয়ে গেলে ওনার পছন্দ মতো সব রান্না করলাম। ওনার বাড়ি ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলাম।
সন্ধ্যা সাতটার সময় ফোন করে বললো গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে ফিরতে দেরী হবে।
আজকে তারাতাড়ি আসতে বলেছি আর আজকেই গাড়িটা খারাপ হতে হলো। কি আর করার অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। সময় যেনো কাটতেই চায় না। বেশ কিছুক্ষণ পর উনি এলেন। বাবা মা, ফাহিম ভাইয়া রজনী আপু সবাই রেডি, আমি গিয়ে দড়জা খুলে দিলাম।

কি ব্যাপার ঝুমুর বাড়ি অন্ধকার কেনো,,

আমি কোনো কথা বললাম না, ওনার হাত ধরে আরেকটু সামনে গেলাম। যেতেই এক এক করে পুরো বাড়িতে লাইট জ্বলে উঠলো ওনার আর আমার মাথায় ফুলের পাপড়ি পরতে লাগলো, সবাই
একসাথে বলে উঠল,,
হ্যাপি বার্থডে আয়ান চৌধুরী।

উনি পুরো শক্ড। আগেও ওনার জন্মদিন পালন করা হয়েছে তবে সে সময় অনেক আত্নিয় স্বজন ছিলো গান বাজনা ছিলো । তারপর থেকে কিছু বছর উনি জন্মদিন পালন করেন নি। ওনার এতো আত্নিয় স্বজন গান বাজনা হৈ হুল্লোড় পছন্দ না। তাই আমি সবটা শুনে কোনো আত্নীয়কে বলি নি। শুধু আমাদের পরিবারকে নিয়েই ওনার জন্মদিন পালন করতে চাইছি।

উনি সবাইকে সাথে নিয়ে কেকটা কাটলেন। আমি ওনার জন্য একটা পাঞ্জাবি এনে রাখছিলাম যেহেতু আমার পড়নে শাড়ি। হাত ভর্তি চুড়ি, কানের দুল গলায় ওনার দেয়া বাসর রাতের নেকলেস সব পরেছি। উনি নিচের ওয়াশ রুম থেকেই ফ্রেশ হয়ে আসলেন। তারপর সবার সাথে বসে খাওয়া দাওয়া করলেন।
একটু পর উনি ওপরে যেতে ধরলেই আমি ওনার পথ আটকে ধরলাম কারন এখন ওনাকে কিছুতেই রুমে যেতে দেওয়া যাবে না। নয়তো আমাকে নির্লজ্জের খাতায় নাম লেখাতে কেউ দ্বীধাবোধ করবে না।

এই এই শুনুন না, মাথা নিচু করে বললাম।

উনি আমার ঘারে হাত রেখে বললো, বলো না

একটু,,

একটু কি,,

একটু ছাদে যাবেন।

উনি হেসে বললো এটা বলতে এতো কিছু,, আচ্ছা বলো তো বিয়ের পর থেকে আমি তোমাকে কখনো ধমক দিছি

আমি মাথা নাড়লাম, অর্থাৎ না

তাহলে আমাকে দেখে ভয় পাও কেনো হুমম

না মানে, আপনি অফিস থেকে আসলেন,সবাইকে সময় দিলেন বিশ্রাম না নিয়ে এখন আমার সাথে ছাদে যাবেন তাই ভাবলাম,,

স্বামিরা বউকে সময় দিতে কিপটামি করে না, আমি তো একদমি না। সবার মাঝে তো আর বউকে সময় দেয়া যায় না তাই বউকে দেওয়ার জন্য সময় আলাদা ভাবেই রাখতে হয়।

কথা বলতে বলতে ছাদে আসলাম। ছাদের মাঝখানে আগে থেকেই ছোট্ট একটা টেবিলে ছোট্ট একটা কেক রাখা ছিলো। পাশে একগুচ্ছ গোলাপ আর কয়েকটা মোমবাতি আর একটা ছুড়ি। আমি টেবিলের সামনে গিয়ে ওনাকে বললাম, এখন আমি যা যা করবো,আপনি বাঁধা দিবেন না। আমি জানি উনি আমাকে বাঁধা দেবে না তবুও বলে রাখলাম।
আমি একে একে সবগুলো মোমবাতি জ্বালিয়ে নিলাম। মূহুর্তের মধ্যে ছাদের মাঝখানটা আলোয় আলোকিতো হয়ে গেলো। চারিদিকে অন্ধকার আর মাঝখানে আলো, আলোর মাঝখানে লাভের ছোট্ট একটা চকলেট কেক। ওর মাঝখানে লেখা আই লাভ ইউ A। এটা আমি নিজে হাতে লিখেছি‌। আয়ান বানানটা পুরোটাই হয় নি, কেকটা ছোট, তাই শুধু এ টাই লিখতে হয়েছে।

উনি দুই হাত ভাঁজ করে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওনার এই চাহনি আমার চেনা,আগেও দেখেছি ওনার এই চাহনি, এই চাহনিতে আছে আমাকে কাছে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, আমাকে পা*গল করে দেওয়ার জন্য এই তাকানো টাই যথেষ্ট, এতো দিন নিজেকে সামলে রাখলেও আজকে আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না, উনি এতো গভীর ভাবে কেনো তাকিয়েছে, তবে কি উনি বুঝে গেছে আমি কি চাই।
ছেলেমানুষের ভালোবাসা খুব ভয়ঙ্কর যদি সেটা হয় এক নারীতে। এক নারীতে আসক্ত পুরুষ ভীষণ শক্ত ভাবে ভালোবাসে। তাকে পাওয়ার জন্য পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করতে পারে। সে নিজে যতোই কঠিন মানুষ হোক না কেনো, ভালোবাসার মানুষটার কাছে সে বরাবরি মাথা নিচু করে থাকে। আমি এই মানুষটাকে সবসময় গম্ভীর আর একরোখা মানুষ ভাবতাম অথচ মানুষ টা আমার সাথে একটাবার গলা উঁচু করে বা আমি কষ্ট পাবো এমন কথা বলে নি। আমি আগে ভাবতাম আমাকে সহ্য করার মতো,বোঝার মতো আমার মতোই একজন মানুষ লাগবে, কিন্তু আমি ভুল ভাবতাম আমার মতো হলে হয়তো তাকেই আমার সহ্য করা লাগতো নয়তো আমাদের ঝামেলা হতো‌। এই মানুষটার আমাকে বোঝার মতো ক্ষমতা আছে। আমি রেগে গেলে উনি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নয়তো কথা ঘুরিয়ে নেয়। তবুও কখনো আমার বিপরীতে কিছু বলে না। তাকে কি ভালো না বেসে থাকা যায়। আমি আরো আগেই বলতাম ভালোবাসার কথাটা কিন্তু যখন শুনলাম কিছুদিন পর ওনার জন্মদিন তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম এই দিনটার জন্য।

উনি এখনো এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমি আস্তে আস্তে ওনার কাছে গিয়ে ওনার হাতে ছুড়িটা তুলে দিলাম। উনি এখনো কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটু হাসলাম। কারন আমি জানি উনি কেনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি টেবিলের উপর থেকে ফুলগুলো নিয়ে ওনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম,, লজ্জার মাথা খেয়ে ওনার চোখে চোখ রেখে বললাম,,

আমি আপনাকে ভালোবাসি আয়ান। ভীষণ ভালোবাসি। আমি আপনার সাথে আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাটাতে চাই। আপনার সুখের সাথি আর দুঃখের ভাগীদার হতে চাই‌। আপনি কি আমাকে ভালোবাসবেন। তারপর দুজনে চুপচাপ,,

কি আজব উনি তো এখনো কোনো কথা বলছে না, তবে কি উনি এসবে খুশি নন। নাকি বোবায় ধরলো‌। আরে ভাই কথা বলেন, আমার হাঁটু লেগে গেছে। এসব আমি মনে মনে ভাবলাম। তারপর একটু জোরেই বললাম,, আমি আমার সন্তানদের নিয়ে একটা ফুটবল টিম বানাতে চাইইই। আপনি কি সাহায্য করবেন।

এবার উনি হো হো করে হেসে উঠলো। যাক বাবা অবশেষে মুখে বুলি ফুটলো।

উনি আমার হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে আমাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বললো,, আমি তো তোমাকে ভালোবাসি ঝুমুর। এতো দিন তো শুধু তোমার বলার অপেক্ষায় ছিলাম।

উঁহু,,আমার আরো ভালোবাসা চাই

উনি আরো জোরে চেপে ধরে বললেন,সব ভালোবাসাই তোমার। তুমি আদাই করে নিলে আমি দিতে বাধ্য।

তারপর কেক টা কেটে প্রথমে আমার মুখে তুলে দিলেন। বাকীটা নিজে খেলেন। উনি আমাকে কোলে নিয়ে রুমের দিকে যেতে লাগলেন। রুমের দিকে যতো এগোচ্ছি ততো আমার হার্টবিট বাড়তেছে।

উনি রুমের সামনে এসে আরেকবার আমার মুখের দিকে তাকালেন, আমি ভয় আর লজ্জায় ওনার বুকে মুখ লুকালাম। উনি আমাকে কোলে নিয়েই ভেতরে ঢুকলেন। লাইট জ্বালানোর সাথে আমি ওনাকে চেপে ধরলাম। মনে হচ্ছে উনি হাঁসতেছে।

মিসেস আয়ান চৌধুরী কি নিজের বাসরঘর নিয়ে সাজিয়েছে,,

ওনার এই কথাটা শুনে লজ্জায় আমার বলতে ইচ্ছা করতেছে, আল্লাহ একটা মই দাও আমি উপরে উঠে যাই।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে