লাভ ম্যারেজ  পর্বঃ ০১

0
2811

লাভ ম্যারেজ  পর্বঃ ০১
– আবির খান

মাঃ নে বাবা একটু পানি খা। গলাটা ভিজা। আর কতো কষ্ট করবি!!!

নিরবঃ দেও মা। আর কষ্ট কিসের।

নিরব মায়ের হাত থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে খেলো। কারণ নিরব এখন অনেক ক্লান্ত। মাত্র বাসা বদল করে পুরান ঢাকায় একটা দোতলা বাসায় এসে উঠেছে। দুইটা রুম, একটা কিচেন আর একটা টয়লেট।

নিরবরা আগে যে বাসায় ছিলো, সেখানের বাড়িওয়ালা হঠাৎই ৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। নিরবের একার পক্ষে এতো টাকা বাসা ভাড়া দেওয়া সম্ভব না। তাই নিরব বাড়িওয়ালাকে বলেছিলো,

নিরবঃ চাচা, আমারতো টিউশন পড়িয়ে যা আসে তার অর্ধেকই আপনাকে দিয়ে দেই। এই তিনটা হাজার টাকা এখন না বাড়ালে হয়না?? চাচা আমিতো এখন এতো বেশি ভাড়া দিতে পারবো না। একটু সাহায্য করেন। অনুনয়ের স্বরে।

বাড়িওয়ালাঃ ভাড়া না দিতে পারলে চলে যাও। ভাড়া যখন বাড়িয়েছি তখন সবার মতো দিতে পারলে দিবা, না দিতে পারলে চলে যাবা।

নিরবঃ চাচা, ভালো বলেছেন। তাহলে আমরা চলেই যাচ্ছি সামনের মাসে।

বাড়িওয়ালাঃ ঠিক আছে যাও। আর শুনো এই মাসের ভাড়াটা দিয়া যাইও। আবার ভাড়া না দিয়া ভাইগো না। তোমাদেরতো বিশ্বাস নাই।

নিরবঃ হায়রে চাচা, এতোদিন ছিলাম একদিনও দেরি হয়েছে আপনাকে ভাড়া দিতে?? আর আপনি বলছেন ভাড়া না দিয়ে চলে যাবো!!!

বাড়িওয়ালাঃ হইছে হইছে। ভাড়া দিয়া চলে যাইও।

এরপর নিরব অনেক বাসা খুঁজে শেষমেশ ৫০০০ টাকায় পুরান ঢাকার এই দোতলায় বাসাটা পায়। নিরব আর নিরবের মা এতেই অনেক খুশি।

নিরব যে বাসাটা নিয়েছে সেটা দোতলা বাসা। তিনতলায় ছাদ। আর নিচতালা সম্পূর্ণ বাড়িওয়ালার। বিশাল বড় বাসা। তবে দোতলার একপাশ শুধু নিরবকে ভাড়া দিয়েছে আর অন্য পাশ এখনো তালাবদ্ধ মানে ভাড়া হয়নি।

নিরব, বাবা হারা ছেলে। শুধু মা আছে। আর কোনো ভাই বোন নেই। নিরবের বাবা ওদের ছেড়ে চলে যায় আজ থেকে ৩ বছর আগে। সেদিন নিরব প্রথম ভারসিটিতে গিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে বাসায় এসে শুনে বাবা আর বেঁচে নেই। সেদিন কিন্তু নিরবের অনেক কান্না করার কথা ছিলো, কিন্তু নিরব এক ফোঁটাও কান্না করেনি। নিরবের মা নিরবকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করেছে। তাও নিরব কাঁদেনি। কেন জানেন?? কারণ সেদিন নিরব কাঁদলে তার মা অনেক ভেঙে পরতো। তাই মায়ের কথা ভেবে নিরব সেদিন মায়ের সামনে কাঁদেনি। কিন্তু যখন বাবাকে কবর দিয়ে এসে সবার আঁড়াল হয়ে নিজেকে একদম একা করে ফেলে তখন নিরব অনেক কেঁদেছিলো। সেই কান্না এতোটা বেদনাদায়ক ছিলো যে, যে কাউকে কাঁদতে বাধ্য করতো। নিরব মায়ের কথা ভেবে নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নেয়। ডিপ্রেশনে অনেক বার পরতে নিলেও মায়ের মলিন মুখটা নিরবের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাই নিজেকে শক্ত করে নেমে পরে এক জীবন যুদ্ধে। আর আজও লড়ে যাচ্ছে।

নিরব এখন ৩য় বর্ষের ছাত্র। ৫ টা টিউশনি করায়। সব মিলিয়ে ১৫০০০ টাকা পায়। তা থেকে ৬০০০ টাকা ভাড়াতে চলে যাবে। গ্যাস বিল আর কারেন্ট বিল সহ। বাকি ৯০০০ হাজার টাকা দিয়ে মায়ের ঔষধে যায় ৩০০০ টাকা। পুরো মাসে বাজারে যায় ৩০০০ টাকা। হাতে থাকে আর ৩০০০ টাকা। তা দিয়ে কোনোভাবে নিরব পড়া লেখা করে।

কোনো টিউশনি পড়তে পারে না নিরব। ভাগ্য ভালো নিরব ভালো ছাত্র হওয়ায় ওকে ভারসিটিতে টাকা দিতে হয়না। স্যাররা ওকে ফুল ফ্রী করে দিয়েছে ওর ভালো রেজাল্টের জন্য। নিরব টিউশনি না পড়লেও ওর এক কাছের বন্ধু মানে বেস্ট ফ্রেন্ড ওকে অনেক সাহায্য করে পড়ালেখায়। যেমন স্যারদের নোটস, লেকচার সিট আরো অনেকভাবে সাহায্য করে। নিরবের ইচ্ছা ও বিসিএস পরীক্ষা দিবে। ওর বিশ্বাস ও অবশ্যই পাশ করবে। তাহলে ওর সব দুঃখ আর কষ্ট দূর হয়ে যাবে। মাকে আর কষ্ট করে একটা দুইটা শাড়ি প্রতিদিন পরতে হবে না। নিরব আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে তার লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য। কিন্তু নিরব এখন সম্পূর্ণ নতুন এক এলাকায়। চারদিকে সব নতুন লোকজন। নিরব যেসব জায়গায় পড়াতো তা সব পুরনো বাসার ওখানে।

এখন নিরব অনেক চিন্তায় পরেছে যে কিভাবে এতো দূরে গিয়ে ছাত্রদের পড়াবে। প্রতিদিন তাকে রিকশায় যেতে হবে। আসতে যেতে মোট খরচ ১০০ টাকা। মানে মাসে ৩০০০ টাকা শুধু গাড়ি ভাড়াই। তাই নিরবকে এখানে কাউকে পড়াতে হবে। তাহলে মাস শেষে ওর হাতে কিছু টাকা থাকবে। নিরব বসে বসে এসব ভাবছে। আর জানালা দিয়ে আসা বাতাস খাচ্ছে।

নিরব দেখতে একদম সাধারণ। তার চেহারায় আছে একটা শান্ত শান্ত ভাব। মুখটা ফরসা আর চোখগুলো অনেক সুন্দর। চুল গুলো একটু বড়। উল্টিয়ে আঁচড়ানো। দেহ লম্বা ফিটফাট। নিরব একদম সাধারণ হলেও তার মধ্যে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। তা হলো, তার দিকে তাকালেই যে কেউ তার মায়ায় পরে যায়। একটা ভালো লাগা কাজ করে। ভারসিটি লাইফে বহু মেয়ের প্রেমের প্রস্তাব পেলেও একটাতেও সাড়া দেয়নি নিরব। আসলে কাউকে মন থেকে ভালোই লাগেনি ওর।

এখন,

মাঃ নিরব বাবা, যা গোসলটা করে আয়। ঘেমে তো তোর অবস্থা খারাপ।

নিরবঃ যাচ্ছি। আচ্ছা মা, তোমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো এখানে?? ক্লান্তমাখা মুখ নিয়ে।

মাঃ ধুর বোকা কি কষ্ট হবে!! এত্তো সুন্দর একটা বাসায় আবার কিসের কষ্ট। চারদিকটা খুব খোলামেলা। আমার অনেক ভালোলাগছে। খুশি মনে।

নিরবঃ মা দোয়া কইরো যেন তোমাকে ওই উঁচু বিল্ডিং এ নিয়ে যেতে পারি। যেখানে কোনো কষ্ট নাই। শুধু আরাম আর আরাম।

মাঃ বাবা তুই এসব কি বলছিস?? তুইতো ভুল শিক্ষা গ্রহণ করছিসরে।

নিরবঃ মানে?? অবাক হয়ে।

মাঃ আমার কথাটা গুরুত্ব সহকারে শুন।

নিরবঃ আচ্ছা মা বলো।

মাঃ শোন, জীবনে কোনো দিন ধনী কিংবা অন্যের চেয়ে বড় হতে চাবি না। যদি চাস, তাহলে তুই নিজের সব হারাবি। ভালো কাজ করবি আর অনেক বেশি পরিশ্রম করবি। দেখবি সফলতা নিজেই তোর কাছে দৌড়ে চলে আসবে। শুধু সাফল্যের পিছনে যারা দৌড়ায় তারা কখনো সাফল্য পায়না। কিন্তু যারা শুধু সাফল্য অর্জনের জন্য না বরং নিজেকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অনেক বেশি পরিশ্রম করে তারাই জীবনে সফল হয়। বুঝলি এবার??

নিরবঃ মা সত্যিই তুমি ধন্য। আজ থেকে বড় হওয়ার জন্য না মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য পরিশ্রম করবো।

মাঃ হুম সবসময় এটা মাথায় রাখবি। আর শোন, জীবন হলো এক যুদ্ধক্ষেত্র। যেখানে হার জিত উভয়ই আছে। অনেক কষ্ট, বেদনা জীবনে আসবে তাই বলে হার মানবিনা। লড়াই করবি দেখবি জয় তোরই হবে। আর দুঃখ কষ্টতো জীবনের একটা অংশ। আজ যদি দুঃখ না পাস তাহলে যে পরে সুখটা পাবি তার মূল্যটা কিভাবে বুঝবি??

নিরবঃ সত্যিই মা তুমি ঠিক বলেছো। আমাদের যা আছে তাতেই আমরা সুখী। মা, তুমি সবসময় এভাবে আমার জন্য দোয়া করবে, যেন তোমার কথা মতো চলতে পারি।

মাঃ ইনশাআল্লাহ বাবা। তুই পারবিই। যা এখন গোসলটা করে আয়।

নিরবঃ মা বাসায়তো সাবান নাই। আমি একটা সাবান নিয়া আসি??

মাঃ আচ্ছা যা।

নিরব সিড়ি দিয়ে নিচে নামছে। হঠাৎই একজন নিরবের মায়ের মতো বয়ষ্ক মহিলা নিরবের পথ আটকায়।

আন্টিঃ খাড়াও বাবা, তুমি কি আমগো নতুন ভাড়াটিয়া নাকি??

নিরবঃ জ্বি আন্টি।

আন্টিঃ তা কুতায় যাইতাছো?

নিরবঃ আন্টি একটু বাজারে যাচ্ছিলাম।

আন্টিঃ আচ্ছা আচ্ছা যাও। তোমার মায় বাছায় আছে না??

নিরবঃ জ্বি আন্টি আছে।

আন্টিঃ আইচ্ছা পরে কথা কমুনে। যাও।

বলেই আন্টি চলে গেলো। নিরবও গেট থেকে বের হয়ে দোকানের দিকে যাচ্ছে আর হাসছে। ঢাকায়া ভাষাটা ওকে বেশ মজা দিচ্ছে। বাসাকে বলে বাছা। হা হা। নিরব হাসতে হাসতে একটা দোকানে গেলো।

নিরবঃ চাচা একটা সাবান দেনতো।

দোকানদারঃ কি বাবা এলাকায় কি নতুন নাকি??

নিরবঃ জ্বি চাচা।

দোকানদারঃ ভালা। তা কুন বাড়িতে উঠলা??

নিরবঃ এইতো চাচা ০৭ নং বাড়িটায়।

দোকানদারঃ খাইচেরে কি কইলা। হেইতো বহুত ডেঞ্জারাস। বাবা ছাবধানে থাইকো।

নিরবঃ কই চাচা আমিতো দেখলাম বাড়িওয়ালা অনেক ভালো।

দোকানদারঃ হুম ভালোর ভালো আবার খারাপের বহুত খারাপ আছে। ঠিক মতো থাইকো। এই নেও তোমার সাবান।

নিরবঃ চাচা কতো??

দোকানদারঃ আরে কি কও টেকা লাগবো না। তুমি আমগো এলাকায় নতুন আইছো এডা তোমারে ফ্রী দিলাম। হুনো বাবা, আমগো ঢাকায়াগো দিল বহুত বড় আছে, কোনো ছমছ্যা হইলে জানইও।

নিরবঃ আচ্ছা চাচা। কিঞ্চিৎ হাসি দিয়ে।

নিরব সাবান নিয়ে চলে আসলো। আসার সময়ও মুখে হাসির রেখা ছিলো। আসলেই ঢাকায়া মানুষগুলো অনেক ভালো আর বড় মনের মানুষ হয়। এসব ভাবতে ভাবতে নিরব বাসায় চলে যায়।

দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিরব একটা ঘুম দেয়। বিকেল ৪.২৬ মিনিটে নিরবের ঘুমটা ভেঙে যায়। নিরব উঠে দেখে মা এখনো ঘুমাচ্ছে। তাই ও মুখটা ধুয়ে দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে ছাদে চলে যায়। ছাদটা কেমন তা দেখার জন্যই মেইনলি ছাদে যাওয়া। নিরব আস্তে আস্তে ছাদে উঠলো।

ছাদটা অনেক বড় আর সুন্দর। ছাদের একপাশে বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ। আর তার ঠিক সামনেই একটা দোলনা। নিরব আস্তে আস্তে হেঁটে দোলনাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। খুব সুন্দর দোলনাটা। বসার লোভ সামলাতে না পেরে নিরব তাতে বসেই পরলো। দক্ষিণ দিকে দোলনাটার মুখ হওয়ায় বেশ ভালোই বাতাস এসে লাগছে নিরবের গায়ে আর সাথে ফুলের মন মুগ্ধকর সুবাস। নিরবের এখন কবি হতে ইচ্ছা করছে। যেইনা একটা কবিতা বলতে নিবে ওমনি পিছন থেকে হঠাৎ একটা মেয়ের কড়া কণ্ঠ ভেসে আসলো।

– এই কে রে?? এত্তো বড় ছাহছ আমার দোলনায় বহছ। এই দেহিতো কেঠা??

নিরব তাড়াতাড়ি উঠতে নিলেই….

চলবে…?

কোনো ভুল হলে জানাবেন।

সবার বেশি বেশি সাড়া চাই। আর মন্তব্য করে জানাবেন কেমন লেগেছে। ?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে