#লাজুকপাতা
#পর্ব-২৩
টুম্পা ভাবী যাবার আগে টাপুর টুপুর কে নিয়ে বাবা দেখা করতে যান। জামিল ভাইয়ের রাগারাগি, হুমকি কোনো কিছুই বাবা কর্নপাত করেন না। তিনি নাতনিদের নিয়ে চলে যান। আম্মা নিজের চোখ কে যেন বিশ্বাস করতে পারেন না। যে মানুষ টা সারাজীবন তার হ্যাঁ তে হ্যাঁ, না তে না বলেছে সে আজ কথা শুনলো না।
জামিল ভাই রেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন দুদিন পর। ফেরার পর বাবার সঙ্গে তেমন কথাও বলেন না।
মুক্তার জীবন টা অনেক সহজ হলো এবার। দুই মাসের প্রেগন্যান্ট শুনে জুয়েল ভাই পারলে এলাকাশুদ্ধ সবাই কে মিষ্টি খাওয়াতেন। আমাকে বলল,
“ভাবী দোয়া করবেন। ছেলে হোক, মেয়ে হোক একটা সুস্থ সুন্দর বাচ্চা হোক। আমি দুইটা গরু জবাই করে খাওয়াব। ”
জুয়েল ভাইয়ের উচ্ছ্বাসে আম্মা ভীষণ খুশি। কিন্তু মুক্তার শাশুড়ীর কাছে আদিখ্যেতা লাগছে। আর জুয়েল ভাইকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত সে মুক্তাকে কিল, ঘুষি দিয়েছে।
আম্মা মুক্তাকে বাড়িতে আনলেন। ও বাড়িতে আদর যত্ন হবে না ঠিকঠাক। প্রথম বাচ্চা হবার সময় মেয়েদের নাকি আদর, যত্ন লাগে ভালোমতো।
মুক্তা বাড়িতে আসার পর লিপি ভাবীর কাজ আরও বেড়ে গেল। সে আনন্দেই কাজগুলো করছে। কাজ করতে তার কোনো ক্লান্তি নেই।
মুক্তা আবার সেই আগের মতো। স্বামীর অনেক টাকা, শ্বশুর বাড়িতে অনেক কিছু আছে সেই গল্প। ইচ্ছেমতো টাকা পয়সা খরচ করে এটা সেটা কিনে। একদিন আম্মাকে ডিনার সেট কিনে দিলো। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, টাকা থাকলেই হয় না শুধু। খরচ করতেও জানতে হয়।
আমার আর চুপ থাকতে ইচ্ছে করে না। আমি হেসে বলি, যারা রোজগার করে না তারাই এই কথা বলতে পারে। রোজগারি মানুষজনের মুখ থেকে এমন কথা বেরোয় না।
মুক্তার জবাবও বেশ কঠিন। বলে,
“সবার রোজগার লাগে না। স্বামী হাতখোলা হলে রোজগার লাগে না। ”
আমার যেন কী হয়। সবসময় চুপ থাকতে পারলেও এবার আর পারি না। ক্ষেপে গিয়ে বলি,
“মুক্তা, দশ মাস পর তোমার অবস্থা যে আবার আগের মতো হবে না। তার কী কোনো ঠিক আছে। দিনের শুরু যে ঘুষি দিয়ে হবে না তার গ্যারান্টি কী! অবশ্য টাকা হাতে পেলে এটা তোমাদের জন্য কিছুই না। ”
মুক্তা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে। আর কারোর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষা আমি করি না। দরজা আটকে দেই। নিজের উপর রাগ হয়। এই বাড়িতে আসার পর মুক্তার সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক হয়েছিল। কি সুন্দর গল্প হতো মাঝেমধ্যে! আর এখন!
এই নিয়ে আম্মা নাবিদের কাছে অনেক নালিশ করে। বাইরে পড়তে গিয়ে আমার খুব অহংকার হয়েছে। ছেলেমেয়ে পড়িয়ে কটা টাকা হাতে আসার পর কাউকে মানুষ বলে মনে করি না। নাবিদ আমাকে ঠান্ডা গলায় বলল,
“মুক্তা যতদিন আছে তুমি আর ওর সঙ্গে কথা বোলো না। আমি জানি ও এখন বেয়াদব হইছে। তুমি চুপচাপ থেকো।”
এই ঘটনার পর আমি নীরব হয়ে যাই। অন্যরাও আমার সঙ্গে কথা বলার সময় সতর্ক হয়।
***
বর্ষাকালের এক দিনের ঘটনা। নাবিদ ওর কিছু জরুরী কাগজপত্র খুঁজে পাচ্ছিলো না। নিজে খুঁজছিলো, সঙ্গে আমাকেও বলছিল খুঁজে দিতে।
আলমারি, বইপত্র সব জায়গায় খোঁজা হচ্ছিলো। হঠাৎ একটা বইয়ের ভাজে একটা খাম পেলাম। পুরোনো খাম। খামে আমার ছবি। ছবিটা দেখে আমি থমকে গেলাম। নাবিদ তখনও নিজের জিনিসপত্র খুঁজতে ব্যস্ত। আমি ছবিটা হাতে নিয়ে ওর সামনে গেলাম। ও খানিকটা অপ্রস্তুত হলো। একটু হাসার চেষ্টা করলো। অপরাধী দের অপরাধ ধরা পড়লে মুখের অভিব্যক্তি যেমন হয় তেমন হলো। বলল,
“এটা কোথায় পেলে? ”
আমিও পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তুমি এটা কোথায় পেলে? ”
নাবিদ জবাব দিতে একটুও সময় নেয় না। বলে,
“তোমাদের বাড়ি থেকে দিয়েছিল বোধহয়। হ্যাঁ, মামাই দিয়েছিল তো। নাহলে তোমার আগের ছবি আমি কোথায় পাব। ”
আমি নাবিদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাবিদও কিছু সময় আমাকে দেখলো, তারপর চোখ নামিয়ে নিলো।
আমি অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। উত্তর জানতেও ইচ্ছে করে না। সবকিছু কেমন ফাঁকা লাগে। ভোতা অনুভূতির সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়।
আমি চুপচাপ থাকি, নাবিদও কেমন চুপচাপ হয়ে যায়। দুই, এক কথার পিঠে আমার তরফ থেকে যখন স্বতঃস্ফূর্ততা পায় না তখন ই চুপচাপ হয়ে যায়।
পরের দিন টা শুরু হয় অন্যান্য দিনের মতোই। নাবিদ সবকিছু হাতের কাছে পেয়েও যখন আমাকে ডাকে তখন আমার নির্লিপ্ততা বোধহয় ওর চোখে পড়ে। খেতে বসে ঠিকঠাক গলা দিয়ে খাবার নামে না। লিপি ভাবী আমাকে বলে,
“ভাইয়ের কি হইছে জরী। একটা রুটিও আজ ঠিকঠাক শেষ করতে পারলো না?”
আমি জবাব দেই না৷ পরের বেলা আমাকে আবার প্রশ্ন করে,
“তোমার কি হইছে জরী। ”
এবারও আমি চুপচাপ থাকি৷ আমার আসলে কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না।
নাবিদ রোজকার মতো আমাকে যাবার সময় বলে,
“আমি গেলাম জরী। ”
আমি অন্যান্য দিনের মতো আচ্ছা বলার পরিবর্তে বলি,
“আমি বাড়ি যাব। ট্রেনের টিকিট নিজেই করে নিতে পারব। এবার কটা দিন বেশী করে থেকে আসি। লিপি ভাবী তো আছেই। কারোর কোনো সমস্যা হবে না।”
নাবিদ বোধহয় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বোধহয় বললাম এই কারণে, আমি তো ওর দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো বলেছিলাম।
***
আমি যেদিন পলাশবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম সেদিন সকাল থেকে বৃষ্টি। আমাকে যেতে দেখে জামিল ভাই বললেন,
“বাড়িতে এমন কী আর্জেন্ট জরী! এমন বৃষ্টিতে কেউ যায়! বাদ দাও, কাল যাবে। আমি স্টেশনে পৌছে দেব। ”
নাবিদও সেখানে থাকে। কোনো কথা বলে না। বাবা, লিপি ভাবী, সবার বারন স্বত্তেও আমি আসি। বারবার বারন করার পরও নাবিদ আমাকে এগিয়ে দিতে আসে।
সিএনজি তে ওঠার পর আমার খেয়াল রাখে। প্লাস্টিকের কাগজ টা এগিয়ে দেয় যেন না ভিজে যায়। ট্রেনে একগাদা খাবার কিনে দেয়। অনেক প্রশ্ন করেও আমার থেকে হু, হা জবাব ছাড়া আর কিছু পায় না।
ট্রেন ছাড়ার আগে শুধু একবার বলে,
“ফোন টা ধইরো জরী। ”
আমি তখনও অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। ট্রেন ছেড়ে দেবার পর একাই কিছুক্ষন কাঁদি। আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমি ভান জানিনা। নাটক করতে পারি না। চুপচাপ থাকা আর ভান করার মধ্যে অনেক তফাত।
আমার হাতে সেই ছবিটা। যেটা নাবিদের বইয়ের ভাজে পেয়েছিলাম। পেছনে লেখা লাজুকপাতা।
এই ছবির গল্প আমি জানি। নাবিদ জানেনা। এই ছবিটা তুলেছিল একজন লুকিয়ে। আমার মামার মেয়ের বিয়ের সময় তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। গায়ে পড়ে সে আলাপ করতে এলেও আমি ভয়ে সরে এসেছিলাম।
তারপর মাস দুয়েক পর একদিন আমার নামে চিঠি আসে। পোস্ট অফিস থেকে বাবাকে চিঠিটা দেয়া হয়। বাবা সেই চিঠি পেয়ে অবাক হয়। তার মেয়েকে কে চিঠি পাঠালো! তাও আবার অন্য শহর থেকে।
বাবা সেই চিঠি মাকে কিংবা আমাকে না দেখিয়ে পরী আপাকে দেখায়। পরী আপা বলে তার এক পরিচিত আমার নামে চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠি তার৷ বাবা সরলমনে মেনে নেয়।
পরী আপা আমাকে নিয়েই চিঠি খোলে। চিঠির সঙ্গে কয়েকটা আমার ছবি। সেই সঙ্গে লেখা,
“তুমি নাম না বললেও আমি কিন্তু নাম জেনে নিয়েছি। তবে সেই নামে তোমায় মানায় না। আমি তোমার নাম দিলাম লাজুকপাতা। ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরোতে আমার বছর দুয়েক লাগবে। আমাদের নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে। ”
এই চিঠি, ছবি পরী আপা ছিড়ে ফেলে বলল, এসব মাথায় নিস না তো। কোথাকার কোন আলতু ফালতু ছেলে।
তবুও কেন জানি লাজুকপাতা নাম টা আমি মাথা থেকে বের করতে পারলাম না।
চলবে…