#লাজুকপাতা
#পর্ব-২০
বাচ্চাগুলোর পরীক্ষা শেষ, নতুন বছর শুরু হতে চলল। মা ফোন করে বাড়ি যেতে বলছেন বারবার। শীত মানে পলাশবাড়ীতে হৈচৈ আনন্দ। পিঠে বানানোর প্রতিযোগিতা লেগে যায়। এদিকে পরী আপাও আমাকে লোভ দেখায়। জরী তুই গেলে আমিও যাব। আমি নাবিদ কে বলতে সাহস পাই না। টানা উনত্রিশ টা দিন আমাকে ছেড়ে দূরে থেকে বেচারা এমনিতেই কেমন পাগল পাগল হয়ে গেছে। ফেরার পর বারবার বলল,
“আমি যদি জানতাম এত্তগুলা দিন থাকতে হবে, তাইলে তোমাকে বগলদাবা করে নিয়ে যাইতাম। ”
আমি মৃদু হাসি। নাবিদ আমার হাসি দেখে বলে,
“তুমি আমাকে ছাড়া ভালোই ছিলে না? আপার ওখানে ঘুরে আসছ! রাত জেগে সিনেমা দেখছ তাই না! ”
আমি কিছু বলি না। আমার অনুভূতি, ভাবনা কিছুই নাবিদ কে জানাই না। জানাতে ইচ্ছে করে না। আমি জানি ও অনেক কিছু বোঝে। তবুও ক্ষেপানোর জন্য এসব বলে।
নাবিদ আমাকে সহজেই পারমিশন দেয়। তবে শর্ত দেয়, পাঁচ দিনের বেশী একদিনও নয়। আজ, কাল, পরশু এসব ধানাইপানাই যেন না হয়। তবে এবার আম্মাও অসন্তুষ্ট হয়। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে খালার সঙ্গে বলে,
“আমাগো সময় শাশুড়ীর অসুখ দেখে একলা ফালাইয়া বাপের বাড়ি যাবার কথা জীবনেও ভাবি নাই৷ আর এখনকার বউরা…. অবশ্য বউদের কী দোষ! আমার পেটের পোলাই তো আমারে শত্রু ভাবে। এমন ভাব করে যেন আমি শত্রু। ”
আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। তিনি জানেন যে আমি কোনো জবাব দেব না। তাই টাপুর টুপুর কে নিয়ে ঝামেলা করার চেষ্টা করলো। বলল,
“এই শীতে তুমি যাও, আমার নাতনিদের নিও না। বন জঙ্গলে আমার নাতনিদের আমি পাঠাব না। ”
আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম। বললাম,
“আমাদের বাড়ি বন জঙ্গলে? আপনি না গিয়েই কিভাবে জানলেন?”
আম্মাও বিদ্রুপ করে বললেন, যারা গেছে তারাও তো কেউ বলল না তোমরা রাজপ্রাসাদে থাকো।
আমি হেসে বললাম,
“আচ্ছা মা টাপুর টুপুর আপনার কাছেই থাকুক। ওরা তো আর নিজের মেয়ে না যে জোর দেখাব। আমি বরং শান্তিতেই বেরিয়ে আসি। ”
পরী আপাদের সঙ্গে ট্রেনে যাবার ব্যবস্থা করা হয়। আপা আমার জন্য ঢাকায় আসেন। তাকে ছাড়তে দুলাভাইও আসেন। শীতের রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে স্টেশনে পৌছাই নাবিদ কে নিয়ে। ও আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, কী কী করা যাবেনা। আমি হু হা তে জবাব দেই। নাবিদ ট্রেনে উঠিয়ে দেয়ার সময় রাজ্যের খাবার দিয়ে দেয়। ট্রেন ছেড়ে দেয়, আমি নাবিদ কে জানালা দিয়ে বিদায় জানাই। এক মিশ্র অনুভূতি, একদিকে আনন্দ অন্যদিকে ছেড়ে যাবার কষ্ট।
শীতের রাত, ট্রেন জার্নি, বাড়ি যাবার আনন্দ সবমিলিয়ে দারুণ এক অনুভূতি।
***
বাড়িতে ক’টা দিন আনন্দেই কাটে। নিরু আপা আসে। ফুপুরাও আসেন তাদের ছেলে মেয়ে নিয়ে। পাশের বাড়িতে ঢেকিতে চাল কোটা হয় পিঠের জন্য। ভাপা, পুলি, চিতই বানানোর ধুম লেগে যায়। শীতের রাতে বাড়ির সবাই মিলে দেশী হাসের সঙ্গে চিতই পিঠা নিয়ে পিকনিকের আয়োজন করে, উঠোন ভর্তি বাচ্চাদের ছুটে বেড়ানো দেখে আমার টাপুর টুপুর এর জন্য মন খারাপ হয়। মেয়ে দুটো থাকলে একটু আনন্দ করতে পারতো।
নিরু আপার সঙ্গে এবারের গল্পগুলো অন্যরকম। আপা এবারে আন্তরিকতা একটু কম দেখায়। বরং আমার কষ্টের গল্প শুনে বেশী খুশি হয়। আমাকে জিজ্ঞেস করে,
“তোর শাশুড়ী নাকি অনেক জালায়?”
“কে বলল আপা? তেমন কিছু না তো।”
“আরে এসব জিনিস তুই চাপায়ে রাখবি কেমনে? ছোট চাচি আর আব্বা গেল না কয়মাস আগে? তোর গা থিকা নাকি গয়না খুলে নিছে তোর শাশুড়ী। ”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এখানকার এই এক সমস্যা, ঘটনা ঘটে এক লোকে বানায় আরেক। আমি হেসে বলি,
“না খুলে নেয় নাই। আমি এমনিই দিয়া দিছি। ”
নিরু আপার মুখটা অন্যরকম লাগে। খুশি চেপে রাখলে মানুষের মুখ যেমন লাগে তেমন। আপা আমাকে বলে,
“তার মানে তোর সংসারও আমাগো মতনই! পুরোপুরি শান্তি নাই?”
আমি পরী আপার সতর্কতার মানে বুঝতে পারি। কিছু সময় মন খারাপ থাকে তারপর আবার ঠিক হয়ে যায়। এইসব কথাবার্তার পর নিরু আপার সঙ্গে আর গল্প জমে না।
বাড়িতে সপ্তাহ খানেক কাটিয়ে ঢাকায় আপার সঙ্গেই ফিরি। আম্মা আমার সঙ্গে প্রথমে অতো বেশী কথা না বললেও আমার ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র দেখে তার মেজাজ ভালো হয়ে যায়। এদিকে টাপুর টুপুর আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ওদের সঙ্গে ভাব জমাতে অবশ্য বেশী সময় লাগে না।
দুদিন যেতে না যেতেই আম্মা মুক্তার গল্প বলেন। জুয়েল ভাই লোকটা নাকি বিরাট শয়তান। মুক্তাকে দিয়ে ঘরের কাজকর্ম করায়। আমি একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করব যে এতে শয়তানির কী আছে আম্মা! ঘরের কাজ তো কম বেশী সবাই কেই করতে হয়। কিন্তু ঘটনা অন্যকিছু। জুয়েল ভাইয়ের জন্য রাতে উঠেও মুক্তাকে রাঁধতে হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে রুটি বানাতে হয়। সেই রুটি গোল হয় না কেন এই নিয়ে আরেক কাহিনী।
জুয়েল ভাই আমাকে ফোন করে তার বউয়ের কাহিনী বলে। বলে,
“চিন্তা করবেন না ভাবী, দুইমাসে এমন ট্রেনিং দেব যে একদম সিধা হয়ে যাবে। ঘরে বসে শুধু খাইতো আর ঘুমাইতো না!”
একদিন সকালে দেখি আম্মার ভীষণ মন খারাপ। শুনলাম মুক্তাকে নাকি জুয়েল ভাই পিঠে ধড়াম ধড়াম কয়েকটা কিল দিয়েছে। বেচারি বলেছিল সকালে রান্না করতে পারবে না, ঘুমাবে। এই ঘটনা আবার জুয়েল ভাই নিজেই ফোন করে জানিয়েছে। সেই সঙ্গে আম্মাকে এও বলেছে,
“ওর টোট্যালি আপনার বাসায় যাওয়া বন্ধ। আপনে তুলুতুলু করেন দেখে এই অবস্থা! নবাবজাদী দশ টা পর্যন্ত ঘুমায়। নামাজ কালামের খবর নাই। ”
আম্মার মুখের দিকে তাকানো যায় না। জামিল ভাই অবশ্য এই ঘটনায় খুশি। সে বলে, জামাই একখান হইছে মাশাল্লাহ। একদিন বাজার কইরা ভালো, মন্দ খাওয়ান দরকার।
জানুয়ারীর শেষে বাড়িতে নতুন বিপদ এলো। বিপদ বলব, নাকি আপদ বলব বুঝে উঠতে পারি না। জামিল ভাই বিয়ে করে আনলেন। আগে পিছে কাউকে কিছু জানালেন না, সরাসরি বিয়ে করে আনলেন। ভৈরবে গিয়েছিল কাজের জন্য। সেখানে দিন পাঁচেক ছিলো। ফেরার সময় বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে। বিয়ে হয়ে যাবার পর নাবিদ কে ফোন করে জানালো।
সংসারে শান্তি যেটুকু বা ছিলো সেটুকুও শেষ হতে চলল।
চলবে…