রঙ তুলির প্রেয়সী
৭.
‘উফ, মা। হয়েছে কী বলোতো? সাত-সকালে এতো চিৎকার চেচামেচি কীসের?’ চোখ কচলাতে কচলাতে ডাইনিং টেবিলের সামনে আসতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল আদিয়ার। জাওয়াদের সাথে বসে চা খাচ্ছেন হেলাল আহমেদ। আদিয়াকে দেখেই একগাল হেসে বললেন, ‘আটটা বাজে। এই উঠলি তুই? আয় এদিকে আয়।’ বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন উনি। আদিয়া এখনও হতভম্ব। আস্তে আস্তে হেঁটে গেল সে। হেলাল আহমেদ মেয়েকে নিজের কোলে বসালেন। তারপর বললেন, ‘ব্রাশ করেছিস?’
না সূচক মাথা নাড়লো আদিয়া। জাওয়াদ বললো, ‘কতোদিন বলেছি ঘুম থেকে উঠেই ব্রাশ না করে রুম থেকে বেরোবিনা।’
হেলাল আহমেদ জাওয়াদকে থামিয়ে আদিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। যা ব্রাশ করে আয়। তোর মা আলুর পরটা বানাচ্ছেন। একসাথে খাবো। রিয়াদ উঠেছে?’
আদিয়া আবারও না সূচক মাথা নাড়লো। জাওয়াদ বললো, আমি ডেকে আনছি।’ তারপর চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে গেল। আদিয়া রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো মুনতাহা আলুর পরটা ভাঁজছেন। টুনি পেঁয়াজ কাটছে। সে এগিয়ে গিয়ে মুনতাহার পাশে দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমিতো ভুত দেখার মতো কেঁপে উঠেছিলাম। হঠাৎ করে বাবা এসে গেল যে? কোনো সমস্যা হয়েছে মা?’
‘আরে না। সারপ্রাইজ দিবে নাকি। এভাবে কেউ আসে বল? রান্নাবান্না কিছুর ঠিকঠাক নেই এইযে সকাল সকাল এলো আগে বললে তো কিছু আইটেম রেঁধে রাখতাম।’
‘যাকগে। আমি অনেক মিস করছিলাম বাবাকে। ফ্রেশ হয়ে আসি বাবার হাতে খাবো।’ বলে হাসি দিয়ে চলে গেল আদিয়া। মুনতাহা টুনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে হয়েছে? একটু দেখতো আমার বাথরুমের কল ছাড়া কিনা। ভুলে গেছি।’
‘হইয়া গেছে আর একটু।’ বললো টুনি।
_______________
প্রায় পাঁচ মিনিট থেকে রিয়াদের দরজায় দাঁড়িয়ে ডেকেই যাচ্ছে জাওয়াদ। রিয়াদের কোনো সাড়াশব্দ নেই। রিয়াদ থাকে দোতলার একেবারে শেষ প্রান্তের ঘরটায়। তিথি ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে একটু মাথা নেড়ে চারপাশে দেখছিলো। হঠাৎ খেয়াল করলো ডান’দিকে একেবারে শেষ প্রান্তে একটা ঘরের সামনে কোমরে দু’হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে জাওয়াদ। কৌতূহল নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল তিথি।
‘রিয়াদ ভাইয়ার দরজার সামনে চোরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’
তিথির কথা শুনে চট করে ফিরে তাকালো জাওয়াদ। চোখে মুখে তার চরম বিরক্ত। জাওয়াদ এভাবে হুট করে পেছন ফিরে তাকানোর কারণে তিথি খানিকটা পিছিয়ে গেল। তারপর দু-হাত উপরে তুলে সারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বললো, ‘উউউ! এভাবে তাকাতে হয়না। কুচ কুচ হয়।’
‘হোয়াট!’ চোখ বড় বড় করে বললো জাওয়াদ।
‘কিছুনা। এভাবে তাকালে তো ভয়ে মরা একটা তেলাপোকাও জীবিত হয়ে উড়তে শুরু করবে, আর আমিতো…যাকগে। কী করেন এখানে?’
জাওয়াদ মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বললো, ‘রিডিকিউলাস!’ তারপর আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে দুটো টোকা দিলো রিয়াদের দরজায়। তিথি একটা ভেংচি দিলো। মনেমনে বললো, ‘ভালো করে কথা বল ব্যাটা, আমি তো সুন্দর করেই কথা বলতেছি। এহ! ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি যেন মরেই যাচ্ছি!’ মনের কথা মনেই চেপে রেখে মুখে বললো, ‘বুঝলাম। রিয়াদ ভাইয়াকে ডাকা হচ্ছে। তবে মাথার ধূসর কোষগুলোতে হালকা কমন সেন্স থাকলে আমার মনেহয় ভালো হতো।’
এবার জাওয়াদ ঘুরে আগুন চোখে তাকিয়ে বললো, ‘পটরপটর করতে কেউ বলেছে? আর হোয়াট ডু ইউ মিন বাই কমন সেন্স হে? কী বলতে চাইছো?’
জাওয়াদের দৃষ্টিতে খানিকটা চুপসালো তিথি। তারপর আমতাআমতা করে বললো, ‘ন-না মানে, বলছিলাম যে… এ-একটা কল করলেই তো হয়। এতোক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছেন নিশ্চয়ই পায়ে ব্যাথা করছে? আমি মানবতার খাতিরে বললাম। আচ্ছা আমি যাই হে।’ বলেই আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে চলে গেল তিথি হনহন করে। জাওয়াদ কয়েক মুহূর্ত তাকালো তিথির গমনপথে। তারপর হেসে দিলো হুট করে। তিথির চুপসানো মুখটা মনে করে ভারী মজা পেলো জাওয়াদ। তারপর হাসতে হাসতেই মোবাইল বের করে কল করলো রিয়াদকে।
সিঁড়ির কাছে এসে একবার পেছন ফিরে তাকালো তিথি। দেখলো জাওয়াদ ছাদে যাচ্ছে। তখনই তার মনে পড়লো আসার পর থেকে ছাদে যাওয়া হয়নি। একবার যেতে হবে।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
‘আসসালামুয়ালাইকুম আঙ্কেল।’ হাসি হাসি মুখ করে হেলাল আহমেদের পেছনে এসে দাঁড়ায় তিথি।
‘আরে আরে তিথি মা যে। কতো বড় হয়ে গেছো তুমি! আসো আসো বসো।’ বলে নিজের ডানদিকের চেয়ারটা টেনে দিলেন তিনি। তিথি দেখলো ওপাশের চেয়ারে আদিয়া বসে আছে। আর হেলাল আহমেদ তাকে আলুর পরটা মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। তিথি হেসে এসে বসলো উনার পাশে। মুনতাহা বললেন, ‘তোকে ডাকতে পাঠিয়েছিলাম। মনেহয় বাথরুমে ছিলি, টুনি গিয়ে পায়নি। নে এবার খাবারটা খেয়ে নে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে তোর।’
তিথি হেসে বললো, ‘সে খাবো ক্ষণ। কিন্তু আঙ্কেল আসবেন বললেনা কেন কেউ? আমিও রিসিভ করতে যেতাম।’
মুনতাহা বললেন, ‘জানলে তো বলবো? হুট করে না বলে চলে এলেন।’
‘তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য হয়তো। মিস করছিলে তো খুব, আসার পর থেকে মনমরা দেখেছি। তাইনা আঙ্কেল?’ তিথি হেসে তাকালো হেলাল আহমেদের দিকে। হেলাল আহমেদ হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘এইতো, আমার এখানকার সবাই হচ্ছে বুদ্ধু। আর এই আমার তিথি মা হচ্ছে বুদ্ধিমতী।’
‘আর কূটনী বুড়িও।’ ফোঁড়ন কাটলো আদিয়া।
‘আমি কোনো কূটনামি করিনি।’ ঠোঁট ফুলিয়ে বললো তিথি। হাসলেন হেলাল আহমেদ। মুনতাহা বললেন, ‘হয়েছে এবার খা। আর এই দুধের গ্লাসটা শেষ করবি। আজ কোনো কথা শুনবোনা, পুরোটা খাবি।’
‘মামণি, প্লিজ একটু কমাও।’ কাতর স্বরে বলে তিথি। হেলাল আহমেদ বললেন, ‘এমন করতে হয়না। বড়দের কথা শুনতে হয়।’
তিথি আর কিছু বললোনা। ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে থাকলো দুধের গ্লাসটার দিকে। আচ্ছা, এসব খাওয়াদাওয়া কে বের করলো?
‘তোমার এক ছেলেকে ডাকতে আরেক ছেলে গেল। গিয়ে দুজনেই কোথায় গায়েব হলো? খাবারদাবার তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমার একটু ঘুমোতে হবে। তার আগে রিয়াদের সাথে একটু দেখা করবো।’ আদিয়াকে খাওয়ানো শেষ করে বললেন হেলাল আহমেদ।
‘কিজানি। এদের মতিগতি আমি বুঝিনা। দুটোতে এক হলে খবর থাকেনা। কী করছে কে জানে।’ বললেন মুনতানা। আদিয়া পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো, ‘বড় ভাইয়া তো ছোট ভাইয়াকে ডাকতে গেল। ডাকতে গিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়লো নাকি?’
তিথি এবার চোখ তুলে তাকালো। তার মনে পড়লো সে দেখেছে জাওয়াদকে ছাদে যেতে। সে বললো, ‘উনাকে তো দেখলাম ছাদে যাচ্ছেন।’
‘বড় ভাইয়া?’ জিজ্ঞেস করলো আদিয়া।
‘হুম।’
মুনতাহা আদিয়াকে বললেন, ‘খাওয়া তো শেষ। যা তো দেখ কী করে ওরা। ডেকে নিয়ে আয়।’
‘এক মিনিট আমারও শেষ। আমিও যাবো।’ উঠে দাঁড়িয়ে বললো তিথি।
____________________
জাওয়াদ ছাদে এসে দেখলো রিয়াদ বুকডন দিচ্ছে। হেসে দিলো সে। এ ছেলের কোনোকিছুরই কোনো টাইম টেবিল নেই। রিয়াদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। তারপর বললো, ‘সকাল ন’টায় এক্সারসাইজ? ওয়াও ব্রো! ওয়াও!’
‘তবুও তো তোর মতো বডি বানাতে পারিনা। বেড লাক! আজ কয়টা দিলি?’
‘একটাও না। সময়ই পাইনি। আর তাছাড়া, এক্সারসাইজ করতে হয় ভোরবেলা।’ বলে হাসলো জাওয়াদ।
উঠে বসলো রিয়াদ। তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘সময় পাসনি মানে? ভোরবেলা কী কাজ ছিলো?’
‘বাবাকে রিসিভ করা।’
‘মানে? বুঝলাম না।’
‘মানে বাবা চলে এসেছেন। ডাকছেন তোকে। চল।’
‘কী বলিস! হঠাৎ? কোনো সমস্যা হলো নাকি?’ রিয়াদ খানিক চিন্তিত হয়ে বললো।’
‘সারপ্রাইজ, মায়ের জন্য।’ বলে হাসলো জাওয়াদ। হাসলো রিয়াদও। হেসে বললো, ‘স্টিল হি ইজ সো রোম্যান্টিক।’
‘হুম। চল এবার।’
‘দাঁড়া। বুকডন হয়ে যাক একবার? আজতো দিলিনা।’
জাওয়াদ চোখ ছোট করে ভাবার মতো করে বললো, ‘উম, নট অ্যা বেড আইডিয়া। দিয়েই যাই চল।’ বলেই টি-শার্ট এক টানে খুলে ফেললো জাওয়াদ। রিয়াদ ভ্রু উঁচিয়ে বললো, ‘ওয়াও ম্যান! দিনদিন তো হট হচ্ছিস। আমি ভাবছি আমার বিয়েতে সবাই আমাকে না তোকে দেখবে।’
হাসলো জাওয়াদ। দুজনেই ছাদে উপুড় হয়ে বুকডন দিতে লাগলো।
আদিয়া আর তিথি ততক্ষণে এসে ছাদের দরজায় দাঁড়িয়েছে। আদিয়া এগিয়ে গিয়েই বলতে লাগলো, ‘বাহ বাহ, বাবা ওদিকে অপেক্ষা করে আর এদিকে উনারা বডি বানাচ্ছেন। বাবা বসে আছেন তো।’
থামলো জাওয়াদ। উঠে দাঁড়ালো। রিয়াদ ছাদেই শুয়ে টি-শার্ট পরে নিলো। জাওয়াদ হেসে বললো, ‘এজন্যেই আমার সাথে দিতে মানা করি। আমি দিলাম এইটুক সময়ে ষোল। আর তুই সাত।’ বলে পাশে রাখা ছোট পানির বোতল থেকে পানি খেয়ে নিজের খালি গায়েও পানি ঢাললো সে বোতল থেকে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছে তিথি জাওয়াদের দিকে। জাওয়াদের বুকের পশমগুলো লেপ্টে আছে বুকের ওপর। বিন্দু বিন্দু জল বেয়ে পড়ছে বুক, পেট বেয়ে। কপালে, নাকে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শরীরে প্রতিটি ভাঁজ… না না, এবস, নিশ্বাসের সাথে ওঠানামা করছে। হাসছে জাওয়াদ, সেই হাসিটা দেখতে কেমন যেন অদ্ভুত ভালো লাগছে তিথির। তিথির কেমন মাথা ঘুরছে, পা টলছে। ঘেমে যাচ্ছে তিথি। ঢোঁক গিললো সে। আবার তাকালো। বিড়বিড় করে বললো, ‘এমন লাগছে কেন? কেন দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে বারবার?’ তিথি আরো একবার তাকালো। নাহ, মাথাটা ভনভন করছে ওর। তাড়াতাড়ি করে নেমে গেল সে। এখানে থাকলে নিশ্চিত অজ্ঞান হবে।
__________________
তিথি বসে আছে নিজের রুমের বারান্দায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে। পেছনে আদিয়া এসে দাঁড়িয়েছে সেটা খেয়ালই করেনি সে। ঘোর কাটে আদিয়ার ডাকে। আদিয়া বলে, ‘কীরে? ওভাবে না বলে চলে এলি যে। বললি ছাদে ঘুরবি।’
তিথি কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। খানিক দোনামোনা করে হেসে বললো, ‘বাথরুম পেয়েছিলো। এখন ছাদে বসে তো করতে পারবোনা…’
হো হো করে হাসলো আদিয়া। তিথি একটা নিশ্বাস নিলো। আদিয়া বললো, ‘তুই ঠিক আছিস? কেমন লাগছে।’
‘না, মানে মাথাটা একটু ধরেছে।’
‘রেস্ট নে। একটু শুয়ে পড়। পরে আবার ছাদে যাবো।’
‘আচ্ছা।’
হেসে বেরিয়ে গেল আদিয়া। তিথি দরজা লাগিয়ে আলমারি থেকে জাওয়াদের ডায়েরিটা বের করলো। তারপর বিছানায় এসে বসলো ওটা নিয়ে। কেমন যেন বুক কাঁপছে তিথির। সাহস হচ্ছেনা খুলে দেখার। আচ্ছা, ডায়েরিটা কী রেখে দিয়ে আসবে? এভাবে পড়া ঠিক হবে? পরক্ষণেই আবার নিজেকে শুধালো। এনেছে যখন পড়েই নিক। তিথি গভীর চোখে তাকালো ডায়েরিটার দিকে। খুব একটা বড় না ডায়েরিটা। পাতলা। বেশিক্ষণ লাগবেনা শেষ করতে। তিথি একটা ঢোঁক গিললো। আস্তে আস্তে ডায়েরির প্রথম পাতা উল্টালো। সাথেসাথে দেখতে পেলো একটা ছবি লাগিয়ে রাখা। দুজন মানুষ একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসছে। দুটো মানুষের চেহারাই তার পরিচিত। কৌতূহল নিয়ে আরেক পাতা উল্টায় তিথি। দেখতে পেলো লেখা আছে অনেক কিছু। পড়তে শুরু করলো তিথি…….
_________
চলবে……..
@ফারজানা আহমেদ
সবাইকে ঈদ মোবারক ?