রঙ তুলির প্রেয়সী ২৪.

0
3311

রঙ তুলির প্রেয়সী
২৪.

সবকিছু শেষ হতে হতে রাত প্রায় আড়াইটা বেজে গেল। অনেকেই আগে আগে জায়গা জুড়ে শুয়ে পড়েছে। সব মেহমানদের জায়গা দিতে গিয়ে শেষে আদিয়া, তিথি, ফাহি তিনজনকেই নুহার সাথে নুহার ঘরে থাকতে হলো। নুহা, আদিয়া ও ফাহি তিনজনেই শুয়ে আছে বিছানায়। বিছানাটা অনেক বড়। পাঁচজন শুতে পারবে অনায়াসে। তিথি দরজার বাইরে পায়চারি করছে শুধু। একদম ইচ্ছে হচ্ছেনা ওর, নুহার ঘরে নুহার সাথে এক বিছানায় ঘুমুতে। তিথি একটা লম্বা শ্বাস নিলো। চারদিকে তাকালো, পুরো বাড়িটাই নিস্তব্ধ হয়ে আছে, ঘুমোচ্ছে সবাই। তিথি জাওয়াদের ঘরের দিকে তাকালো। দরজাটা খোলা। কিন্তু জাওয়াদ রিয়াদসহ তাদের বন্ধুরা সবাই এখনও ছাদে রয়ে গিয়েছে। এরা মনেহয় সারারাত ছাদেই থাকবে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ঘুমোতে যাবে আর তখনই কিছু একটা মাথায় আসলো তিথির। একগাল হাসলো সে। তারপর আস্তে আস্তে চলে গেল জাওয়াদের ঘরে।
__________

ফাহি আর আদিয়া কিছু একটা নিয়ে গল্প করছে আর খিলখিল করে হাসছে। নুহা শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে দেখছে আর নিশপিশ করছে। অনেকক্ষণ থেকে তিথির কোনো খোঁজ নেই। তিথি কোথায় হতে পারে এটা ভাবতেই তার মেজাজ আগুন হয়ে যাচ্ছে। নুহা জোরেসোরে একটা ধমক দিয়ে বললো, ‘এই তোরা ঘুমাস না কেন? এই ফাহি, ঘুমা। নাহলে কালকে পেত্নী লাগবে।’
‘ওহ হ্যাঁ, আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম। এই ভাবি ঘুমাও ঘুমাও।’, বলেই চট করে পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করলো আদিয়া। ফাহি ঠোঁট টিপে হাসলো। আদিয়া তাকে ভাবি ডেকেছে। কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে তার। হৃদয়ে সুখের প্রজাপতিরা উড়ছে প্রাণপণে। শুয়ে আলগোছে চোখ বুজলো সে। কাল থেকে তার নতুন জীবনের শুরু হবে।

নুহা শুয়ে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করলো। নাহ, কিছুতেই ঘুম আসছেনা তার। বুকের ভেতরে একটা অদ্ভুত অশান্তি বিরাজ করছে।
‘তোদের বাসার মেয়েটা এখনো আসেনা কেন?’, দোনা মোনা করে জিজ্ঞেস করেই ফেললো নুহা।
‘এভাবে বলছো কেন? ওর একটা নাম আছে। নাম ধরে বলো।’, বললো ফাহি।
‘এতো সম্মানের কিছু নাই ওরে, বুঝছিস।’, নুহা হাত উঁচিয়ে বললো।
আদিয়া বিরক্তি নিয়ে ‘চ’ কারান্ত একটা শব্দ করলো। তারপর বললো, ‘ছাড়ো তো। যখন আসার আসবে। তুমি ঘুমাও।’
‘যখন আসার আসবে মানে? একটা বাইরের মেয়ে এভাবে বাড়িতে রাত বিরেতে ঘোরাঘুরি করবে?’
‘বাইরের মেয়ে হতে যাবে কেন?’
‘তো ও তোদের কোন সম্পর্কের আত্মীয়, শুনি?’
‘নুহাপু, বেশি বেশি করছো তুমি। তিথি আমাদের আপনজন।’
‘হাহ! মাই ফুট!’, বলে এদিক-ওদিক তাকালো নুহা। আদিয়া আবার কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু ফাহি তাকে চুপ করিয়ে দিলো। তারপর ফাহি আর আদিয়া দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু নুহা ঘুমোতে পারছেনা। সে শান্তি পাচ্ছেনা। আস্তে আস্তে উঠে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
__________

‘রিয়াদ, ঘুমোতে যা। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।’, রিয়াদের পাশে এসে বসে বললো জাওয়াদ। ছাদে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলো ওরা চারজন। নাহিদ এখানে শুয়ে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। আর রাকিব ঘুমে ঢুলছিলো।
‘আজকে আমরা সবাই আমার রুমে ঘুমোবো। এই তো শেষ, আর তো পারবোনা।’, বললো রিয়াদ।
‘আচ্ছা ঠিক আছে। এমনিতেই আর জায়গা নেই। আমার রুমটা সম্ভবত খালি আছে।’
‘থাকুক। তবুও আজ আমার সাথে ঘুমোবি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’, বলে হাসলো জাওয়াদ। তারপর নাহিদ আর রাকিবকে ডেকে তুললো জাওয়াদ। একসাথে সবাই ছাদ থেকে নেমে সোজা রিয়াদের ঘরেই চলে গেল।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

তিথি দাঁড়িয়ে আছে জাওয়াদের ঘরের বারান্দায়। কারো হাঁটার আওয়াজ পাচ্ছে সে। কপাল কুঁচকে গেল। ভালো করেই জানে, এটা জাওয়াদ না। পরমুহূর্তে মনে পড়তেই বাঁকা হাসলো। তখনই পেছনে শুনলো নুহার গলা,
‘তুমি এখানে কী করছো?’
তিথি মুচকি হাসছে। নুহার কথার কোনো উত্তর দিচ্ছেনা। ফিরেও তাকাচ্ছেনা নুহার দিকে। যেন সে নুহার অস্তিত্ব টেরই পায়নি। তিথির এমন দায়সারা ব্যবহার দেখে নুহা ফুঁসতে লাগলো। ক্যাটকেটে গলায় বললো, ‘শুনতে পাচ্ছো না?’
‘কী শুনবো?’, কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো তিথি।
‘কী জিজ্ঞেস করেছি?’
‘ওহ, দাঁড়িয়েছিলাম। প্রকৃতি দেখছি।’
‘এইটা তোমার প্রকৃতি দেখার জায়গা?’, ধমকে উঠলো নুহা।
‘একদম চেচাবেনা, নুহাপু।’, শীতল কণ্ঠে বললো তিথি। আবার বললো, ‘আমি কোথায় কী করবো সেটা দেখার বিষয় অবশ্যই তোমার নয়। অতিথি তুমি। বিয়ে খেতে এসেছো, সেদিকেই মন দাওনা। আমার পেছনে কেন পড়ে আছো?’
নুহা স্তব্ধ হয়ে গেল। গোল চোখ নিয়ে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘আমি কোনো অতিথি না। এটা আমার হবু শ্বশুর বাড়ি। আমার ফিয়ন্সের ঘরে তুমি প্রকৃতি দেখছো?’
‘তোমার ফিয়ন্সে? সেটা কে?’
‘জাওয়াদ।’
‘কোনদিন হলো তোমার ফিয়ন্সে?’, তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো তিথি।
নুহা বাঁকা হাসলো। বললো, ‘আমাদের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। শীঘ্রই বিয়ে করবো আমরা।’
‘কী বলো! প্রতিদিন আমার লিপস্টিক খায়। আমার কোলে মাথা রেখে আকাশ দেখে। প্রতি রাতে আমার শরীরের পশমে পশমে সে সুখ খোঁজে। আর এখন বিয়ে তোমাকে করবে? আমি এটা হতে দেব?’, অবাক হওয়ার ভান করলো তিথি।
নুহার ভাব এখন এমন যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে তার মাথার উপর। কিছু বলতে পারছেনা সে। শুনতেও পারছেনা কিছু। বধির হয়ে গেছে যেন। কোনোমতে বললো, ‘যা তা বলবেনা। একদম বাড়ি থেকে বের করে দেবো।’
তিথি কপাল কুঁচকে বললো, ‘কিন্তু, জাওয়াদ কি আমাকে যেতে দেবে? আমাকে যেতে দিলে প্রতি রাতে কার সাথে…’
‘তিথি!’, চিৎকার করে উঠলো নুহা। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। রাগে যেন সে পৃথিবী অন্ধকার দেখছে। তিথি খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। নুহা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই।
_________

বাড়িতেই ফাহি আর রিয়াদের আকদ হবে। বড়সড় অনুষ্ঠান হবে। জাওয়াদ দের বাড়ি অনেক বড়। ঘণ্টা দুয়েক আগে ফাহিকে নিয়ে সবাই পার্লারে গেছে। আসায় সময় হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু মোটামুটি তৈরি। কাজিও চলে আসবে। চারিদিকে খুশির জোয়ার বইছে। কিন্তু হাহাকার করছে মনিরা বেগমের বুকটা। চাঁনতারা বেগমের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন, তিথিকে জাওয়াদের বউ করা হবে। রিয়াদের বিয়েটা মিটে গেলেই তিথি আর জাওয়াদের বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক করা হবে। মনিরা বেগম ও চান, জাওয়াদ সুখী হোক। কিন্তু নিজের নাড়ী ছেড়া মেয়েটার জন্য বুক পুড়ছে খুব। ভয়ও হচ্ছে। মেয়েটা জেদি। যা চেয়েছে জীবনে সব পেয়েছে। হুট করে এই না পাওয়াটা মেনে নেবে কীভাবে সে। গত রাতে এসেছিলো সে উনাদের ঘরে। এসে অনেক কান্নাকাটি করেছে। বারবার একটা কথাই আওড়াচ্ছিলো সে, ‘আমি জাওয়াদকে ছাড়া বাঁচবো না। আমার জাওয়াদকে চাই!’। অসহায় মা আর বাবা শুধু মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া ছাড়া কিছুই বলতে পারেন নি তখন। নাজিম হোসেন কাজের বাহানা দিয়ে চলে গেছেন তিথির সাথে জাওয়াদের বিয়ের খবরটা শোনার পরে। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মনিরা। একটু আগে দেখে এসেছেন আঞ্জুমান, মেহেরুন, আর মুনতাহা মিলে খুব যত্ন করে সাজাচ্ছিলেন তিথিকে। মাহির শাড়ি পরিয়েছেন। কী স্নিগ্ধ লাগছিলো মেয়েটাকে! একদম মাহির মতো। কান্না পাচ্ছে খুব মনিরা বেগমের। কোনোরকমে তিনি কান্না চেপে রাখলেন।
________

‘ভাইয়া ভাইয়া। তুমি বিয়ে করবা। তোমার বিয়েতে আমি নাচবো ব্রাদার কি দুলহান গানে।’
সবাই বসে ছিলো ড্রয়িংরুমে। পার্লার থেকে এখনও ওরা আসেনি, আসার অপেক্ষা করছে সবাই। হেলাল আহমেদ কাজির সাথে কথা বলছিলেন। জাওয়াদ রিয়াদের সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছিলো। তখনই সাহিল এসে কথাটা বললো। জাওয়াদ হেসে বললো, ‘আচ্ছা নাচবি।’
সাহিল খুশি হয়ে গেল। দৌড়ে চলে গেল সেখান থেকে খেলতে। জাওয়াদ হেসে হেসে সিঁড়ির দিকে তাকাতেই তার চোখ চিলিক দিয়ে উঠলো। তিথি আসছে। ভালোকরে তাকালো জাওয়াদ। তিথি সেই শাড়িটা পরে আছে, যেটা সে মাহিকে উপহার দিয়েছিলো। জাওয়াদের বুক কাঁপতে লাগলো। গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো। আকাশী রঙে তিথিকে মনে হচ্ছে আকাশ থেকে নেমে আসা পরী। ঢোঁক গিললো জাওয়াদ। নিজেকে শান্ত করলো। জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। তিথি এসে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখে চোখ পড়লো দুজনের। জাওয়াদ মুচকি হাসলো। ভাবতে লাগলো, কীভাবে একবার কাছে পাওয়া যায় তিথিকে।

পার্লার থেকে নিয়ে আসা হলো ফাহিকে। সোফায় রিয়াদের পাশে বসানো হলো তাকে। নুহা এসেই জাওয়াদের পাশে দাঁড়ালো। গলা খাঁকারি দিলো জাওয়াদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। কিন্তু আশ্চর্য! জাওয়াদের মন যেন অন্য কোথাও। জাওয়াদের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই তিথিকে দেখতে পেলো নুহা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটা ধাক্কা খেলো সে। তিথি মাহির শাড়ি পরেছে! মাহির! এসবের মানে কী? নুহার বুকটা দুরুদুরু কাঁপতে লাগলো। সে জাওয়াদকে ডাকলো, ‘জাওয়াদ…’
জাওয়াদ একবার নুহার দিকে তাকিয়ে আবার তিথির দিকে তাকিয়ে থাকলো। নুহা আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাকে কেমন লাগছে, জাওয়াদ?’
জাওয়াদ যেন কিছু শুনলো না। সে হেঁটে রিয়াদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলো। নুহার বুক ভেঙে কান্না আসতে চাইলো। কিন্তু না, সে কাঁদবেনা। এতো সহজে সে হার মানবেনা। আস্তে আস্তে হেঁটে তিথির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো নুহা। ঠিক তখন আদিয়াও এসে দাঁড়ালো ওদের পাশে। নুহা বললো, ‘তোকে অনেক মিষ্টি লাগছে, আদিয়া।’
‘থ্যাঙ্কিউ, নুহাপু। তোমাকেও সুন্দর দেখাচ্ছে।’
নুহা হাসলো। বললো, ‘লাগার কথা। আমিতো আর কারো পুরনো কাপড় পরি নি। যা পরেছি সব ব্র‍্যান্ড নিউ।’, কথাটা বলার সময় তিথির দিকে তাকিয়ে ছিলো নুহা। আদিয়া আর তিথি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে যে কথাটা কেন বললো নুহা। তিথি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো, ‘এই আদিয়া, শাড়িটা দেখ। বড় মামানি দিয়েছেন। আমাকে নিজের হাতে বড় মামানি, ছোট মামানি আর মামণি মিলে সাজিয়েছেন। এই শাড়িটি পুরনো হলেও, ভালোবাসা অনেক বেশি আছে এতে।’
‘তোকে পরীর মতো লাগছে।’, বলে হাসলো আদিয়া। তিথিও হাসলো। নুহা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না সেখানে।

ভালোয় ভালোয় মিটে গেল ফাহি আর রিয়াদের বিয়ে। সোফায় একসাথে বসে আছে দুজন। ফাহি জড়সড় হয়ে বসে আছে। রিয়াদ দুষ্টুমি করে কয়েকবার নিজের শরীরের সাথে ফাহির শরীরের ঘষা লাগিয়েছে। একটা সময় ফাহি বলে উঠলো, ‘উফ ভাইয়া, এমন করো না।’
রিয়াদ তব্দা লেগে গেল। ভাইয়া! সে বললো, ‘রাতে বুঝাবো। ভাইয়া নাকি সাইয়া।’
লজ্জায় কুকড়ে গেল ফাহি। হেসে দিলো রিয়াদ। তাদের দুজনের ফটোশুট চলতে লাগলো অবিরাম।
_______

জাওয়াদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে তিথি আর জাওয়াদ। জাওয়াদের বুকে মাথা রেখে শান্তির নিশ্বাস নিচ্ছে তিথি। জাওয়াদ আস্তে করে বললো, ‘শাড়িটা কে দিয়েছে?’
‘বড় মামানি।’
‘সুন্দর লাগছে তোমাকে।’
তিথি কিছু বললোনা। জাওয়াদকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তারপর জাওয়াদের চোখে চোখ রেখে বললো, ‘আমি জীবনে বাবার ভালোবাসা পেয়েছি কিনা জানিনা। মনে নেই। মায়ের ভালোবাসা পেয়েছি তবে মা’কে হারিয়েছি অবেলায়। তারপর এখানে এসে মামণি আর আঙ্কেলের ভালোবাসায় নতুন করে মা আর বাবার ভালোবাসার অনুভূতি পেয়েছি। আর এখন, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা মানুষ। যার সংস্পর্শে জীবন পূর্ণতা পায়। হ্যাঁ, আপনাকে পেয়েছি আমার ভালোবাসার মানুষ হিসেবে। আপনার সংস্পর্শে এসে আমার জীবন, মন, সবকিছু পূর্ণতা পেয়েছে। আমি আপনাকে হারাতে চাইনা। আপনাকে হারালে আমি নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে বসবো।’
জাওয়াদ আজলা ভঙ্গিতে তুলে ধরলো তিথির মুখ। কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো। কিছুক্ষণ কাটলো নীরবে। নীরবতা ভেঙে জাওয়াদ বললো, ‘আমার তৃষ্ণা মেটাবো। কাছে এসো। প্রেমিক হিসেবে শেষ বারের মতো মেটাবো। তারপর মেটাবো স্বামী হয়ে।’
তিথি ইশারাটা বুঝলো। মুচকি হেসে কাছে গেল। তিথিকে নিজের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে জাওয়াদ নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের তৃষ্ণা মেটাতে লাগলো। এই দৃশ্যটা দেখছিলো নুহা। পাশের বারান্দা থেকে। চোখ থেকে তার পানি ঝরছিলো। আর ঠোঁটে ছিলো এক ভয়ঙ্কর হাসি। সেই হাসি নিয়েই সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সবার অগোচরে ছাদে গিয়ে উঠলো। দাঁড়ালো ঠিক জাওয়াদের রুমের ওপরে। তারপর রেলিঙের ওপর উঠে দাঁড়ালো। পাগলের মতো হাসলো, শব্দহীন হাসি। তারপর আবার কান্না করতে লাগলো। কুনকুনে শব্দে কাঁদলো। তারপর আবার হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করলো, ‘কীরে মাহি? নিজে পাসনি বলে আমাকেও পেতে দিবিনা? কী ভেবেছিস? না পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে এখানে পড়ে থাকবো আমি? আসছি তোর কাছে। তোর সাথেই বোঝাপড়া করবো। আমাকে হারানো হ্যাঁ? আমাকে?’
কথাগুলো বলে দম নিলো নুহা। তারপর আবার কাঁদতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘মা, বাবা। কেন জীবনে কোনো চাওয়া অপূর্ণ রাখোনি? কেন ভালো মন্দ যা চেয়েছি দিয়েছো? কেন আমার কথামতো চলেছো? দেখোনা, আর এই না পাওয়ার যন্ত্রণা আমাকে থাকতে দিচ্ছেনা। আমার সহ্য হচ্ছেনা। কীভাবে হবে? না পাওয়ার যন্ত্রণাটা যে কোনোদিন অনুভব করি নি।’
আর তারপর… জগত সংসার ভুলে গিয়ে চোখ বন্ধ করে লাফ দিলো নুহা। লাফ দেয়ার সময়ও তার মনে একটাই কথা চলছিলো। জীবনে যা চেয়েছে পেয়েছে। আর এই জীবনের সবথেকে বড় চাওয়াটা সে পাবেনা। এই না পাওয়া নিয়ে সে দুনিয়াতে থাকতে পারবেনা।

ধুপ করে একটা শব্দ হতেই জাওয়াদ বারান্দায় রেলিঙ গলে নিচে তাকালো। তাকাতেই ‘নুহা’ বলে চিৎকার করে দৌড়ে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। তিথি কাঁপছে। খুব বেশি কাঁপছে, থরথর করে। সে দেখেছে, কেউ একজন লাফ দিয়েছে ছাদ থেকে। নুহা? আস্তে আস্তে রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে। নিচের দিকে তাকাতেই একটা আর্তনাদ করে উঠলো তিথি। সবকিছু অন্ধকার দেখতে লাগলো। গড়গড় করে বমি করে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়লো সে। যখন জ্ঞান আসলো, দেখলো সে জাওয়াদের কোলে। জাওয়াদ তাকে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। পাশেই মুনতাহা বিলাপ করছিলেন, ‘তিথি, মা কিছু হবেনা তোর। কিছু হয়নি। তুই একদম নিজেকে দোষ দিবিনা।’
তিথির কানে কিছু যাচ্ছেনা। কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। সে জাওয়াদের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো হাউমাউ করে। সে দায়ী? নুহার এই অকাল মৃত্যুর জন্য সে দায়ী? নুহা কী তার ওপর রাগ করে এভাবে চলে গেল? কিছু ভাবতে পারছেনা তিথি। কাঁদছে চিৎকার করে।

পাঁচ মাস কেটে গেল। নুহার মৃত্যুর শোক সহ্য করতে না পেরে চাঁনতারা বেগম হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেলেন। নুহার মা বাবা মেয়ের শোক ভুলতে বিদেশে থিতু হলেন। আর তিথি? নিজেকে বারবার নুহার মৃত্যুর জন্য দায়ী ভাবতে ভাবতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলো। তারপর মনিরা বেগম দেশ ছাড়ার আগে একদিন আসলেন তিথির কাছে। তারপর তিথিকে বুকে জড়িয়ে কাঁদলেন অনেকক্ষণ। তিথিও কাঁদলো সবকিছু চুরমার করে। তারপর থেকে বাড়ির সবার যত্নে আর জাওয়াদের ভালোবাসায় আস্তে আস্তে ঠিক হলো তিথি।

আজ জাওয়াদ আর তিথির বিয়েটা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলো। তিথি বাসর ঘরে অপেক্ষা করছে জাওয়াদের জন্য। আর বসে বসে মোবাইলে গেমস খেলছে। সাথে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে ফুল ভলিউমে গান শুনছে। মোবাইলে এতোটাই মগ্ন ছিলো তিথি যে কখন জাওয়াদ এসে পাশে বসেছে সেই খেয়ালে নেই সে। খেয়াল করলো তখন, যখন জাওয়াদ এক টানে মোবাইল থেকে ইয়ারফোনটা খুলে নিলো। তিথি বিরক্তির স্বরে বললো, ‘উফ, গান শুনছিলাম তো।’
‘সালাম করতে হয়।’, গম্ভীর কণ্ঠে বললো জাওয়াস।
‘ওহ আচ্ছা। আসসালামু আলাইকুম, সোয়ামী।’
তিথির বলার ভঙ্গিতে হেসে দিলো জাওয়াদ। হেসে হেসে বললো, ‘এবার?’
তিথি কপাল কুঁচকে তাকালো। বললো, ‘এবার কী?’
‘জানোনা?’
‘উহুম।’
‘কাছে আসো।’
মুচকি হেসে কাছে গেলো তিথি। জীবনের সমস্ত সুখ যেন ঐ রাতটায় এসে তার পায়ে লুটিয়ে পড়লো। প্রতিটা রন্ধ্র সুখের গান গাইছিলো। স্বর্গীয় অনুভূতিরা কড়া নাড়ছিলো হৃদয়ের মণিকোঠা তে। নতুন জীবনের শুরু হলো ভালোবাসার জালে। দুজনে ডুবে থাকলো ভালোবাসায়।
_______

২০ বছর পর……..
জাওয়াদ আর তিথির মেয়ে নাজিফা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেই থাকে। এখন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, ভার্সিটির কেন্টিনে বসে। এমন সময় তার এক রুমমেট এসে বললো, ‘তুই এটা কী করলি? এভাবে নুমাইরার পাজামাতে গিট্টু দিয়ে রাখলি কেন? বেচারি ওয়াশরুমে গিয়ে কেঁদে দিছে। পাজামাতেই কাজ সেরে দিছে।’
‘রুমে যে করেনাই এটাই ভালো। নাহলে আবার আমি কেমনে থাকতাম। যাক, এখন আর আমার সাথে লাগার আগে একশো বার চিন্তা করবে।’
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো নাজিফার কাণ্ডে। নাজিফাও হাসছিলো মিটিমিটি।
________

(সমাপ্ত)
আমার গ্রুপ লিংক- https://www.facebook.com/groups/831432960641690/?ref=share

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে