রঙ তুলির প্রেয়সী
২.
‘বলছিলাম যে, তিথি তো চলে এসেছে আজ।’ জাওয়াদের প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বললেন মুনতাহা।
‘তিথি কে?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় জাওয়াদ।
‘ওমা! এরই মধ্যে ভুলে গেলি? বলেছিলাম না তোকে? সুমেলির মেয়ে। ও মারা যাওয়ার আগে আমাকে চিঠি লিখে গিয়েছিলো। তিথিতো দু’বছর আগে আরেকবার এসেছিলো তখন তুই ছিলিনা। আদিয়ার বয়সেরই। ভারি মিষ্টি…’
‘আচ্ছা। বুঝেছি।’ বলে খাবারে মন দিলো জাওয়াদ।
‘আজ দেরি করলি যে?’
‘দরকার ছিলো আজ অফিসে। বাবার সাথে স্কাইপে একটা মিটিং ছিলো।’
‘ও আচ্ছা।’ বলে উশখুশ করতে লাগলেন মুনতাহা। বিষয়টা নজরে এলো জাওয়াদের। সে বললো, ‘কিছু বলবে মা?’
‘হ-হ্যাঁ…’
‘কী?’ কপাল কুঁচকে তাকালো জাওয়াদ।
‘তিথিকে তোর পাশের ঘরটায় থাকতে দিয়েছি…’ নিচের দিকে তাকিয়ে বললেন মুনতাহা। একমুহূর্তের জন্য জাওয়াদের হাত থেমে গেল। সে চোখ তুলে তাকালো। মুনতাহা আবার বললেন, ‘তো-তোর জিনিসগুলো আমি তোর আলমারিতে…’
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
‘ঐ আলমারির ভেতর যা যা ছিলো সব বের করেছিলে?’ জাওয়াদের শীতল কণ্ঠ।
‘হ্যাঁ তা করেছি…’
‘কাজটা করার আগে আমাকে অন্তত বলা উচিত ছিলো।’ কথাটা বলে উঠে দাঁড়ায় জাওয়াদ। তারপর হাত ধুয়ে চলে যায় সেখান থেকে। নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ সেদিকে মুনতাহা। তারপর হাঁক ছাড়লেন, ‘এই টুনি… এগুলো গুছিয়ে রাখ তো। আর ঢেকে রাখিস ভালো করে।’
________________________________________________
আদিয়ার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিলেন মুনতাহা। পাশেই উনার ঘাড়ে মাথা রেখে দুনিয়ার তাবত গল্প করেই যাচ্ছে তিথি। আদিয়ার মাথায় তেল দেয়া শেষ করে তিথিকে বললেন মুনতাহা, ‘উঠ তো, উঠে এখানে এসে বোস। তেল দিয়ে দেই। মাথা ঠাণ্ডা হবে, ঘুম ভালো হবে।’
‘যা বলেছো। একটা লম্বা ঘুম দরকার আছে আজ।’ বলতে বলতে ফ্লোরে বসে পড়লো তিথি। মুনতাহা তেল দিতে লাগলেন ওর মাথায়। এমন সময় টুনি এসে ঢুকে ঘরে।
‘খালাম্মা, বড় ভাইজানের কালা কফিডা এখন বানামু?’
‘কালা কফি?’ কপাল কুঁচকে আদিয়ার দিকে তাকায় তিথি। আদিয়া ফিক করে হাসে। টুনি বলে, ‘আরে আফা ঐযে কালা রঙের কফি আছেনা? আরে দুধ ছাড়া বানায় যেটা। ঐটা।’
‘ওহ ইউ মিন ব্ল্যাক কফি?’
‘হ হ বেলেক কফি। আপনেরে দিমু? বড় ভাইজান তো চিনি ছাড়া খায়। আপনেরে চিনি দিয়া দিমু?’
‘হাও সুইট! বাই দ্য ওয়ে আমি বেলেক কফি খাইনা।’ বলে খিলখিল করে হাসে তিথি। মুনতাহাও হাসেন। আদিয়া টুনির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুই যা, আমি দিয়ে আসছি।’
‘আইচ্ছা।’ বলে বেরিয়ে গেল টুনি।
তেল দেয়া শেষ করে তিথির চুল শক্ত করে বেণি করে দিলেন মুনতাহা। তারপর বললেন, ‘যা এবার রুমে গিয়ে ঘুমা।’
________________________________________________
তন্নতন্ন করে আলমারির ভেতর খুঁজতে লাগলো জাওয়াদ। নাহ, নেই, কোথাও নেই। ‘কোথায় গেল? কোথায় গেল?’ বিড়বিড় করতে করতে আরেক দফা উল্টাপাল্টা করে ফেললো আলমারির ভেতর। দু’হাতে চুল টেনে ধরে ধুপ করে বসে পড়লো সে বিছানার ওপর। ওটা কি রয়ে গেল ওঘরে? আগপিছ চিন্তা না করে হনহন করে হেটে বেরিয়ে গেল নিজের রুম থেকে জাওয়াদ।
গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে লাগেজের কাপড়গুলো ভাঁজ করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখছিলো তিথি। দরজাটা খোলাই রেখেছিলো, ঘুমানোর আগে বন্ধ করবে বলে। হাতের কাপড়টা আলমারিতে তুলে রাখার জন্য পেছন ঘুরতেই আঁতকে ওঠে তিথি। পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নিলো সে। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার। আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে মাত্র তার ভাঁজ করে রাখা কাপড়গুলো ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলছে। দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ধমকে উঠে বললো তিথি, ‘আরে কে আপনি? এসব কী? এভাবে ফেলছেন কেন আমার কাপড়? আরে এ.. আরে এস.. এই! কী হচ্ছে এসব?’
পাত্তাই দিচ্ছেনা জাওয়াদ। পাগলের মতো কিছু একটা খুঁজে যাচ্ছে সে। খুঁজতে গিয়ে পুরো আলমারি এলোমেলো করে দিচ্ছে। তিথি আবার বললো, ‘বিগত এক ঘণ্টা ধরে আমি এই কাপড়গুলো ভাঁজ করছি। এভাবে ছানাছানি করছেন কেন? পরে আবার কে এসব ভাঁজ করবে? আপনি?’
জাওয়াদের যেন কানেই যাচ্ছেনা কোনো কথা। সে এমন ভাব করছে যেন এই ঘরে তার নিজের ছাড়া আর কারো অস্তিত্বই নেই। পাগলের মতো এই ড্রয়ারে খুঁজছে তো আবার ঐ কাপড় ফেলছে। তিথির রাগ এবার তুঙ্গে। সে চেচিয়ে উঠলো, ‘কারো ঘরে আসার আগে নক করে আসতে হয়। এটা কেমন অভদ্রতা? আপনার সাহস তো কম না দেখছি! আর এভাবে… মামণি…’
‘ডোন্ট শাউট ড্যাম ইট!’ বলেই একটা শাড়ি পেছনের দিকে ছুঁড়ে ফেলে জাওয়াদ। সেটা গিয়ে পড়লো তিথির মুখের ওপর। শাড়িটি হাতে নিয়ে আর্তনাদ করে বললো তিথি, ‘পাঁচ মিনিট সময় নিয়ে এই শাড়িটি ভাঁজ করেছি। এখন আবার কে করবে!’
‘উফ!’ বলে ফ্লোরে একটা লাথি দিলো জাওয়াদ। তারপর আবার আলমারির ভেতর হাতড়াতে লাগলো। হঠাৎ তার হাত থেমে গেল। ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। তার কাঙ্ক্ষিত জিনিসগুলো দেখতে পেলো সে। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো জাওয়াদ। জিনিসগুলো হাতে নিয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেল সে রুম থেকে। একবার পেছন ফিরে তাকিয়েও দেখলোনা। হতভম্ব তিথি হা হয়ে তাকিয়ে থাকলো জাওয়াদের গমনপথে। কেউ একজন এসে এভাবে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিলো, তারপর আবার এমন ড্যাম কেয়ার ভাব দেখিয়ে চলেও গেল। ব্যাপারটা হজম হলোনা তার। নিজে নিজেই বললো, ‘এ কে রে! কত বড় খবিশ ছেলে!’ খানিকক্ষণ ফোঁস ফোঁস করলো তিথি। তারপর আবার বললো, ‘একবার স্যরিও বললোনা। এভাবে সবকিছু… দাঁড়া ব্যাটা!’ তারপর ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড়গুলোর ওপর একবার চোখ বুলালো তিথি। ‘মামণি…’ বলে চেচাতে চেচাতে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
__________________________________________________
আদিয়া কফি নিয়ে এসে দেখলো জাওয়াদ রুমে নেই। সে কফির কাপটা টেবিলের ওপর রেখে পেছন ঘুরলো বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। তখনই বারান্দা থেকে জাওয়াদের গলা কানে এলো, ‘কে?’
‘আমি, বড় ভাইয়া। তোমার কফি এনেছি।’ বলে বারান্দায় যেতে নিলেই দেখলো জাওয়াদ চলে এসেছে ভেতরে। আদিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘কী খবর তোর পড়ালেখার? কেমন আগালি?’
‘ভালোই। তোমার কফিটা।’ বলে টেবিল থেকে কফির কাপটা নিয়ে জাওয়াদের হাতে তুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো আদিয়া। বিছানায় বসে জাওয়াদ আনমনে চুমুক দিচ্ছিলো কফিতে। আদিয়া রুমের এদিক ওদিক চোখ বুলাচ্ছিলো। হঠাৎ দেয়ালে টানানো ছবি দুটোয় চোখ আঁটকে গেল। চাপা দির্ঘশ্বাস ফেললো আদিয়া। সময় কত নিষ্ঠুর! কী নিষ্ঠুরভাবে বদলে দিলো সবকিছু! কফি শেষ করে আদিয়ার দিকে কাপটা বাড়িয়ে দিলো জাওয়াদ। আদিয়ার সেদিকে খেয়াল নেই। সে তাকিয়ে আছে ছবি দুটোর দিকে। আদিয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে জাওয়াদও তাকালো ওদিকে। তারপর আবার আদিয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ দিয়ে শিস দিলো। নড়েচড়ে দাঁড়ালো আদিয়া। জাওয়াদ জিজ্ঞেস করলো, ‘কী এতো চিন্তা করিস?’
‘ন-না ম-মানে, ভাবছিলাম… ভাবছিলাম এটা খাও কীভাবে!’ কাপটা হাতে নিতে নিতে আমতাআমতা করে বললো আদিয়া।
‘কোনটা?’ হেসে বললো জাওয়াদ।
‘এইযে এটা। চিনি ছাড়া, একদম তেতো!’ মুখ বিকৃত করে বললো আদিয়া।
‘খেয়ে দেখ একদিন। তুইও পারবি।’ বলে হাসলো জাওয়াদ।
‘আল্লাহ মাফ করুন। ছয় মাসের জন্য আমার জিহবা খাবারের মজা ভুলে যাবে। এতো তেতো বাবারে বাবা! অ্যাট লিস্ট চিনি দিয়ে তো খাওয়া যায়!’ বলতে বলতে বেরিয়ে গেলো আদিয়া। হাসতে লাগলো জাওয়াদ। তারপর পেছন ঘুরে তাকালো দেয়ালে টানানো ছবিগুলোর দিকে। হেটে ওগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর একটা ছবির ওপর পরম আদরে হাত বুলিয়ে হেসে হেসে বলতে লাগলো, ‘দেখলি? এমন কফি খাওয়ানো শিখিয়ে গেলি যে লোকে আমাকে কথা শোনাচ্ছে। ভালো কিছু শেখাতে পারলিনা?’
হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকলো জাওয়াদ ছবিগুলোর সামনে। ইশ, বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথাটা আবার হচ্ছে। চট করে ঘুরে দাঁড়ায় সে। তারপর টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে চলে যায় বারান্দায়। কষ্টগুলোকে ধোঁয়ায় রূপ দিতে!
________________________
চলবে….
@ফারজানা আহমেদ