যোজন – বিয়োজন পর্ব: ০৩
লেখা: মিশু মনি
.
স্বর্ণের চেহারায় এক ধরণের মায়া আছে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই আর দৃষ্টি সরাতে ইচ্ছে করেনা।মন চায় তাকিয়েই থাকি!
স্বর্ণের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ও বলল,ম্যাডাম কি ঘুমাবেন না?
– হুম ঘুমাবো।
– আচ্ছা,এক বিছানায় ঘুমাতে আপত্তি আছে? নাকি আলাদা শোবো?
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।এ কেমন প্রশ্ন! হয়ত আমি তারচেয়ে বয়সে বড়।কিন্তু তাই বলে আলাদা ঘুমাতে হবে কেন? সদ্য বিবাহিত দম্পতি রা কি কখনো আলাদা ঘুমায়?
– কি ভাবছেন মহারানী?
– তোমার ইচ্ছা।
– আমার যা ইচ্ছা তাই হবে?
– হ্যা হবে।
স্বর্ণ কি যেন ভাবলো।তারপর শয়তানি মার্কা হাসি দিয়ে বলল,তুমি না আমার স্ত্রী।
আমি হেসে বল্লাম- হুম স্ত্রী।
– তোমার প্রতি না আমার অনেক অধিকার আছে?
বলেই এগিয়ে আসলো। আমি কখনো ই লাজুক ছিলাম না।কিন্তু আজ কেন যেন খুব লজ্জা লজ্জা লাগে।মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললাম,হুম আছে।
– আমার ইচ্ছা তুমি পূরণ করবা না?
বলেই আরো এগিয়ে আসলো।
আমি লজ্জায় নীল হয়ে বললাম,হুম।
– তাহলে একটা ইচ্ছে পূরণ করো না..
– কি?
আমি উৎসুক চোখে তাকালাম। স্বর্ণ খুব মিষ্টি গলায় আদুরে স্বভাবে বলল,আমার না এখন ইচ্ছে করছে…
– কি ইচ্ছে করছে?
– ইচ্ছে করছে তোমার হাতে…
– আমার হাতে? কি?
– ইচ্ছে করছে তোমার হাতের একটা ডিম ভাজি খাই।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।ডিম ভাজি! এত্ত রোমান্টিক ভাবে কাছে এসে,মিষ্টি গলায়,আদুরে স্বভাবে কেউ ডিম ভাজি খাওয়ার কথা বলে! কোথায় আমি ভাবলাম একটু ইয়ে টিয়ে হবে… তা নয়,এ দেখি একটা বান্দরের হাড্ডি! দুষ্টু ছেলে কাহাকা!
.
স্বর্ণ এগিয়ে এসে বলল,ও মহারানী..
– হ্যা..
– যাও না,একটা ডিম ভেজে দাও না..
– এখন?
– হু… দেখি কেমন স্বামী সেবা করতে পারো। যাও না ম্যাডাম মিশু বুড়ি।
– বুড়ি! আমি বুড়ি?
– আরে বাবা রাগছো কেন? বুড়ি টা হচ্ছে আদরের ডাক।আসলে আরেকটা নামের সাথে মিল খুঁজে পাচ্ছি তো।তাই বললাম।
– কিসের নাম?
– মাদাম মেরি কুরি, আর ম্যাডাম মিশু বুড়ি… মিল আছে না?
আমি উৎসুক চোখে চেয়ে আছি স্বর্ণের দিকে।ছেলেটা কখন কি বলে আমি কিছুই বুঝতে পারিনা!
স্বর্ণ বলল,দিবেনা?
– কি দিবো?
– ডিম ভেজে? যাও একটা ডিম ভেজে আনো।নাকি আমি বয়সে ছোট বলে স্বামী হিসেবে মানবে না?
– কি যে বলো! বলেছি না বয়স কোনো ব্যাপার নয়।এখন আমরা স্বামী স্ত্রী এটাই আসল সত্য।
– ওহ,তারমানে আমাকে স্বামী বলে মানবে? আমার কথামত চলবে?
– হ্যা,
– আমার সেবা করবে?
– হ্যা,
– বাহ! বাহ! যাও আগে একটা ডিম ভেজে দেখাও দেখি।
.
আমি মুখ কাচুমাচু করলেও কিছু বললাম না।প্রায় দেড় বছর যাবত আমি নিজে রান্না করে খাইনা।আজ বাসর রাতে আমাকে রান্না ঘরে ঢুকতে হবে! হায় ভগবান! পিচ্চিরা যে আসলেই যন্ত্রণার হয়,এবার বুঝলাম।
.
আমি রান্নাঘরে এসে ডিম ভাজতে লেগে পড়লাম। স্বর্ণ ও পিছুপিছু এসে আমার ডিম ভাজা পরিদর্শন করছে।
বলল,মহারানীর মুখ গোমড়া কেন? হাসি মুখে ডিম ভাজো,নয়ত আমি ডিম ভাজি খাবো না।
হায় কপাল! এখন নাকি হাসিমুখে ডিম ভাজতে হবে!
মুখটা হাসি হাসি করে কড়াইয়ে তেল ঢাললাম।
স্বর্ণ বলল,ডিমে লবণ কম দিও।
আমিও ওর কথামত ডিম ভাজতে লাগলাম। স্বর্ণ বলল,একি! তুমি শুধু কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে আছো কেন?
– তাহলে আর কিসের দিকে তাকাবো?
– আমার দিকে।একবার আমার দিকে তাকাবা,আরেকবার ফ্রাইপ্যানের দিকে তাকাবা।
– কিহ! তোমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ডিম ভাজতে হবে?
– হ্যা হবে।
– পারবো না।
– বুঝেছি। তারমানে তুমি আমাকে স্বামী হিসেবে মানবে না।আমার দূর্ভাগ্য,আজ বয়সে ছোট বলে স্ত্রী আমাকে মানেনা!
আমি তো একদম থ! এ কেমন কথা! আমি না মানলে আবার ডিম ভাজতে আসি?
– সে তো সবাই ভাজবে।সব স্ত্রী কেই বললে ডিম ভাজবে।কিন্তু স্বামীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কয়জন ডিম ভাজে শুনি? আমার দিকে তাকিয়ে থাকো নয়ত ভাব্বো,আমাকে মেনে নিচ্ছো না।
– হায় ভগবান! এ কেমন ছেলে!
.
বাধ্য হয়েই একবার স্বর্ণের দিকে তাকাচ্ছি তো আরেকবার ডিম ভাজার দিকে।হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না!
.
স্বর্ণ পুরো রান্না ঘর ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। আমার ডিম ভাজা হয়ে গেছে।তখন ই স্বর্ণ ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে এনে আমার সামনে রেখে বলল,মহারানী। ফিশ ফ্রাই খাবো।
– কিহ! এখন আবার ফিশ ফ্রাই! অসম্ভব!!
স্বর্ণ মুখ কালো করে বলল,তারমানে ফিশ ফ্রাই করবা না? হায় কপাল আমার! আজ বয়সে মাত্র মাত্র মাত্র ৮ বছরের বড় বলে বউ আমার কথা শুনেনা! আমাকে স্বামী হিসেবে মানেনা! আমি বাচতে চাইনা,এ জীবন রেখে কি হবে আমার!
– ন্যাকা! ন্যাকামো রাখো। ডিম ভাজি খেয়ে চুপচাপ ঘুমো গিয়ে।
– বুঝেছি। তুমি আমাকে বিয়ের রাতেই মানছো না,আর বাকি জীবন টা তো পড়েই আছে! আমি অভাগা,বউ আমাকে স্বামী হিসেবে মানেনা!
আমি হতভম্ব! এই ছেলে তো আচ্ছা বিচ্ছু একটা! ১ ঘন্টা আগেও বোঝা যায়নি এই ছেলে এতটা বিচ্ছু!
সে যাই হোক,আমি এবার ফিশ ফ্রাই করতে লেগে গেলাম।এমনি তেই শীতকাল, তারউপর ফ্রিজে রাখা মাছ বরফে জমে হিম হয়ে আছে।এই মাছ দিয়ে কিভাবে কি হবে,ভাবতে পাচ্ছি না।বিচ্ছু ছেলেটা যেভাবে জ্বালাতন শুরু করলো, না জানি কপালে আরো কি আছে! হাসিও পাচ্ছে,রাগ ও হচ্ছে।
.
স্বর্ণ খুব মজা করে ডিম ভাজি খাচ্ছে।আহা! যেন জীবনে কখনো ডিম ভাজি খায়নি!
স্বর্ণ বলল,কি ভাবছো মহারানী?
– কিছুনা।
– আমি জানি তুমি কি ভাবছ।
– কি?
– ভাবছ,ছেলেটা বাপের জনমে ডিম ভাজি খায়নি।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।হাসতে হাসতে বললাম,হুম সেটাই ভাবছি।কিভাবে বুঝলে?
– তুমি তো আমার বউ।চোখ দেখলেই বুঝতে পারি কি ভাবছো।
– বাহ! ভালো তোহ!
– আজ্ঞে মহারানী। আমার ফিশ ফ্রাই কতদূর?
– এখনো ঢাকায় জ্যামে আটকে আছে।
স্বর্ণ হো হো করে হেসে উঠল। এমন ভাবে হাসছে যেন জীবনে এমন মজার কথা শুনেনি!
হাসতে হাসতে সম্ভবত ডিম ভাজি গলায় আটকে গেছে।কাশতে শুরু করলো।
আমি ছুটে গিয়ে জল এনে দিলাম।স্বর্ণ জল খেয়ে ইয়া বড় ঢেকুর তুলে বলল,এই না হলে আমার বউ! তাহলে বর হিসেবে মানছো তো?
– এ কেমন কথা সুপ?
– কি সুঁ?
– সুপ,স্বর্ণ থেকে সুপ।
– আহ! দারুণ দারুণ! তাহলে তুমি মিশু থেকে মি.. ওকে মি দেখো তো মাছ কতদূর?
.
আমি এসে মাছ ভাজার কাজ শুরু করে দিলাম।ছেলেটা ভীষণ জ্বালাচ্ছে।আমার বিরক্ত হওয়ার কথা।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়,আমার বিরক্ত লাগছে না।বরং ভালো লাগছে।
.
স্বর্ণ তার প্রেমের গল্প শুনাতে লাগলো। আমি গল্প শুনতে শুনতে মাছ ভেজে ফেললাম।তারপর স্বর্ণকে খাইয়ে দিতে হলো।খাইয়ে না দিলে বলছিল,আমাকে বর হিসেবে মানছো না? বাধ্য হয়েই খাওয়ালাম। বিচ্ছু একটা!
.
রাক্ষস ছেলে একাই খাচ্ছে।আমাকে একবার খেতেও বলছে না! এ কেমন!
স্বর্ণ বলল,এভাবে তাকিয়ো না।আমার পেট খারাপ করবে তো।
– মানে!
– মানে আমার পাতলা পায়খানা হবে।
– ছিঃ, কি যে বলো!
– হুম মি,এখন তুমি খাও এইগুলা।
বলেই আমাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। আমার হয়েছে যত জ্বালা!
.
রুমে আসতেই স্বর্ণ বলল,মহারানী আমি কি তোমাকে আন্টি ডাকতে পারি?
– হায় ভগবান। কেন এ কথা?
– তুমি যদি তাড়াতাড়ি বিয়া করতা,এতদিনে আমার মত একটা জোয়ান ছেলে থাকতো তোমার।
– ছি স্বর্ণ।এসব কি বাজে কথা! আমি কিন্তু এবার রেগে যাচ্ছি।
– ওরে বাবাহ! আমার বুড়িটা রেগে যাচ্ছে! আচ্ছা সরি।আসো এদিকে।
– না…
– আরে বুড়ি কথা শোনো।
আমি আরো গাল ফুলিয়ে ফেললাম।স্বর্ণ শব্দ করে হেসে আমাকে কাছে টেনে নিলো!
চলবে