যদি প্রেম দিলে না প্রাণে পর্ব-০৫(শেষ পর্ব)

0
1596

#যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

শেষ পর্ব

🖋️রিয়া সেন দত্ত 🖋️

রবিবারের সকাল, অপর্ণা একটা ঢোলা পায়জামা আর কুর্তা পড়ে বাইরের ঘরে বসে চা খেতে খেতে খবর কাগজে চোখ বোলাচ্ছে | হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠতেই খবর কাগজ থেকে চোখ তুলে নিজের মনেই বললো, “এই সময় আবার কে এলো “| দরজাটা খুলে সামনে তাকাতেই অপর্ণার চোখ কপালে ওঠার জোগাড় | মৈনাক এসেছে |

মৈনাক অপর্ণাকে এভাবে দেখে খানিক ইতস্ততবোধ করে | অপর্ণা ভীষণভাবে অবাক হয়ে ভাবছে কি করবে | বাধ্য হয়ে মৈনাক নিজেই জিজ্ঞেস করে “আসতে পারি?” চোখের সামনে এভাবে মৈনাককে দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়ে অপর্ণা বলে “দিদি জামাইবাবু তো নেই, আপনি?…”, মৈনাক খানিক হাসার চেষ্টা করে বলে সে জানে |

তারপর বাধ্য হয়েই প্রায় নিজে অপর্ণার পাশ দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে চোখের সানগ্লাসটা খুলে পকেটে রাখতে রাখতে চারদিকটা দেখে নেয় | অপর্ণা দরজা বন্ধ করে এসে মৈনাককে বসতে বলে | মৈনাক একটা চেয়ার টেনে বসে | অপর্ণা কি করবে কি বলবে নিজের স্বামীকে ভেবে পায় না | হঠাৎ আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে “চা খাবেন?” মৈনাক অপর্ণার দিকে দৃষ্টিপাত না করেই বলে, “না, আমি এই সময় চা খাই না |” এরপর দুজনেই চুপচাপ | ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভূত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে তখন | সময় যে কিভাবে কাটছে তা নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা সিলিং ফ্যানটাই সাক্ষ্মী |

-বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর অপর্ণা নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করে, “আপনি হঠাৎ এখানে?” অপর্ণার সরাসরি প্রশ্নের জবাব সেই অর্থে কিছু না থাকলেও মৈনাক বললো, “আসলে এই দিকে এসেছিলাম…”, অপর্ণার চোখের দিকে তাকাতেই একটু থেমে বললো ঢোক গিলে , “না মানে কতগুলো কথা জানার ছিল, আপনি না মানে তোমার থেকে, একটু জল খাব |” এবার অপর্ণা উঠে রান্নাঘরে জল আনতে গেলে মৈনাক অপর্ণার যাওয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে | আজ থেকে সাড়ে ৯ বছর আগের মেয়েটা আর আজ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা কি আদৌ এক? আজও সেরকম নিষ্পাপ সরল চাহনি তবে আগের চেয়ে অনেক গভীর | বিয়ের পড়ে একরাতে একবারই মৈনাক দেখেছিলো ওকে |

….জল নিয়ে ফিরে এসে মৈনাককে ডাকলে মৈনাকের সম্বিত ফেরে | চা এর আধখাওয়া কাপ টা হাতে নিয়ে খেতে খেতে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো “বলুন, কি বলবেন?” অপর্ণার শান্ত স্নিগ্ধ চোখদুটো মৈনাক দেখলো | এখনকার মেয়েদের এতো চুল অনেকদিন মৈনাক দেখেনি | তার মায়ের এমন কোমর ছাড়িয়ে চুল ছিল এককালে |

মৈনাকের চুলে একটু পাক ধরেছে অপর্ণা লক্ষ্য করলো | কোর্টে মন দিয়ে দেখার সুযোগ হয় না একে অপরকে, তাই সামনে থেকে দেখার এমন সুযোগ অপর্ণা হাতছাড়া করতে চায় না | অপর্ণা যে মনে মনে মৈনাককেই চায় | চেহারাটা একটু খারাপ হয়ে গেছে দাড়ি -গোঁফ এর জঙ্গল তৈরী হয়েছে মুখে | চোখ থেকে সানগ্লাস টা নামানোর পর অপর্ণা দেখেছে মৈনাকের কোটরগত চোখদুটো | বাইরে থেকে যতই কঠিন হক না কেন ভেতরে ভেতরে চোখ দুটো বড়ো অসহায় |

কিন্তু অপর্ণাও নিজের আত্মভিমান ছাড়তে রাজি নয় | বড়ো অভিমান তার মৈনাকের প্রতি | যদিও অপর্ণা বোঝে এ প্রেম একতরফা, এ অভিমান একতরফা | মৈনাক তার অভিমান কোনোকালেই ভাঙাবে না | বড়ো কষ্ট হয় অপর্ণার | কাছের করে পেতে ইচ্ছে করে নিজের স্বামীকে | কিন্তু মৈনাক যে এ সম্পর্কে দেওয়াল তুলে দিয়েছে যা ভেদ করে যাওয়া অপর্ণার কাছে কঠিন মনে হয় | এতো তিরস্কারের পরেও সে মৈনাককেই ভালোবাসে আর সারাজীবন বাসবেও | একতরফা প্রেম যে বড়ো যন্ত্রণার | দাম্পত্য এই সম্পর্কে একতরফা প্রেম যে কত যন্ত্রণার তা অপর্ণা তিলে তিলে অনুভব করে |

নিজেকে যতদূর সম্ভব সংযত রেখেই অপর্ণা জিজ্ঞেস করে “আপনি নিশ্চয়ই কোনও কারণে আমার কাছে এসেছেন, সেটা কি কেস সংক্রান্ত?” তারপর অপর্ণা থেমে দৃঢ় ভাবে বলে, ” যদি তাই হয় তবে আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে বা আলোচনা করতে চাই না ” অপর্ণার এরকম তির্যক স্পষ্টভাষণের জন্যে মৈনাক খুব একটা প্রস্তুত ছিল না | সে খানিক ভ্রু কুঁচকে ভালো করে অপর্ণাকে একবার দেখে নিয়ে ভনিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো “তীর্থ তোমার কে হয়? বন্ধু? ” খানিক আমতা আমতা করে বললো “নাকি তোমার প্রেমিক বা বলা ভালো তুমি ভালোবাসো তাকে?” এতক্ষন অপর্ণা মন দিয়ে মৈনাকের কথা শুনছিলো, হঠাৎ এমন প্রশ্নে তার অভিমানের আগুনে যেন ঘৃতাহুতি হলো, সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “মানে, কি বলতে চান আপনি?”

মৈনাক থতমত খেয়ে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে বলে “না আসলে, আমি…”, অপর্ণা মৈনাককে থামিয়ে বলে চলে “কোথায় ছিলেন এতগুলো বছরে?আমাকে চিনলেন কবে বুঝলেনই বা কবে স্ত্রী হিসেবে? আর কতটা যন্ত্রণা দিলে আপনি শান্তি পাবেন বলতে পারেন, আপনি সেদিন বিয়ে করতে না চেয়েও বিয়ে করেছিলেন আর আমি কি অপরাধ করেছিলাম? কিসের পরীক্ষা দিচ্ছি আমি?” অপর্ণার রাগে চোখে জল আসে | আবার বলে “একজন স্ত্রী তার স্বামীর থেকে যে সম্মানটুকু চায় আপনি তার সিকিভাগও কখনো দেননি, পরিচয় দিতেই লজ্জা পেয়েছেন, আমাকে আপনি একফোঁটাও চেনেন না কাজেই এমন প্রশ্ন করার স্পর্ধা আপনাকে কে দিয়েছে?” মৈনাক অপর্ণাকে এভাবে রেগে যেতে দেখে খানিক থতমত খায় | অপর্ণার ভেতরে এতো তেজ মৈনাক সেদিনই দেখেছিলো কোর্টে অথচ এতো রাগ যে থাকতে পারে এই মেয়েটার মধ্যে তা মৈনাক বুঝতে পারে নি | অথচ কত স্নিগ্দ্ধ, শান্ত মেয়েটা | চুপচাপ করে থেকে মৈনাক বলে “তোমাকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি জানি, তাই তোমাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছি তুমি কি সত্যিই তীর্থ কে ভালোবাসো, যদি বাসো আমি নির্দ্বিধায় তোমাকে আইনিভাবে মুক্তি দেবো | ”

অপর্ণা শান্ত ভাবে মৈনাকের খুব কাছে এসে চোখে চোখ রেখে বলে “আরেকটা ভাবেও মুক্তি দিতে পারেন, সেদিন হাতটা চেপে ধরেছিলেন আজ গলাটা ধরুন সব জ্বালা আপনারও জুড়োবে হয়তো আমারো, আমার বাবা কোনোদিন আমাকে মেয়ে বলে গ্রহণ করেনি, আপনি স্ত্রী বলে গ্রহণ করেননি | সমাজে আমি কুমারী বিবাহিতা নাকি বিধবা কোনটা আমি বলতে পারেন? সেদিন বাবা বিয়ে দিয়ে দিলো জানতেও পারিনি কার সাথে বিয়ে হচ্ছে আমার, আমি সবার জীবনের বোঝা হয়ে আর বাঁচতে চাই না তবে এটুকু বলতে চাই আর যাই করুন এতো বড়ো কালী মুখে লেপে দেবেন না আমি আপনার স্ত্রী, ভালোবাসার সুযোগ দিলেন কোথায় আপনাকে? এতগুলো বছরে কতবার খোঁজ নিয়েছেন আমার? কেমন আছি জিজ্ঞেস টুকুও করেননি, কি মনে করেন নিজেকে?”

… একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্নের মুখে অপর্ণার চোখে আর চোখ রাখতে পারে না মৈনাক | অপর্ণার চোখদুটো মুছতে বড্ডো ইচ্ছে করলেও ছুঁতে পারে না মৈনাক | তারপর লজ্জায় মাথা নিচু করে বলে “আমি এভাবে বলতে চাইনি, তোমাকে কয়েকটা কথা বলার আছে তীর্থ দোষী নয় আমি জানি | সত্যিটা যাতে সামনে আসে আমি চেষ্টা করব, আর আমি চাই মৃতা রেবা সোরেন ন্যায় পাক, তুমি সাবধানে থেকো অপর্ণা |” এই প্রথম মৈনাকের মুখে নিজের নাম শুনে অপর্ণা অবাক হয়ে একবার তাকায় |

মৈনাক দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো তারপর পেছনে তাকিয়ে অপর্ণাকে বললো “তোমার বাবা মারা গেছেন আমি সব জেনেছিলাম. ওনার থেকে, তুমি যেদিন বসু ভিলায় ফিরতে চাইবে আমি নিজে আসব তোমায় নিতে ” এই বলে মৈনাক দরজা খুলে বেরিয়ে যায় | অপর্ণা তাকিয়ে থাকে ওর চলে যাওয়ার দিকে | বাবার খবর সে দীর্ঘদিন নেয়নি | জানত ও না জানতে চাইতও না | কিন্তু মৃত্যুর খবরটা অপর্ণাকে একটু নাড়া দিলো | বাবা নামটাও মুছে গেলো জীবন থেকে | যদিও অনেক আগেই তা মন থেকে মুছে গেছে |

মৈনাক এর বিচক্ষণ চোখও সেদিন বুঝেছিল অপর্ণা হয়তো তাকে ঘৃণা করে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

মৈনাক ফিরে এসে যাহোক খেয়ে দুপুরে চেম্বারে চোখ বন্ধ করে চেম্বারে নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে | সকালের অপর্ণার ওই মুখখানা বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে | সাথে মল্লিকার সাথে কাটানো মুহূর্ত | সব যেন তোলপাড় হচ্ছে মনের মধ্যে | কোনটা ঠিক কোনটা ভুল কিছু ঠাওর করতে পারছে না সে | বড়ো অধৈর্য হয়ে চোখ খোলে বাড়ির কাজের লোকের ডাকে |

এম এল এ সত্যেন ঘটক এসেছে | মৈনাক ওনাকে বিকেলে আসতে বললেও উনি আগেই এসে গেছেন | মৈনাক ওনাকে দেখে প্রথমে বিরক্ত হলেও সেটা বুঝতে না দিয়ে জিজ্ঞেস করে এতো আগে আসার কারণ
—সত্যেন ঘটক বলে “ওই মেয়েছেলেটা! কি যেন নাম ? হ্যাঁ, অপর্ণা তা দুদিনের মেয়েছেলে কিনা আপনার মতো উকিলকে ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে! এটা কেমন হলো উকিল বাবু?”,
মৈনাক শুরুতেই ধমক দিয়ে বললো “মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ মিস্টার ঘটক, একজন মহিলা সম্পর্কে কি ভাষায় কথা বলছেন? ভদ্র ভাষায় কথা বলুন |”,
—– সত্যেন ঘটক একটু চুপ করে থেকে একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বললো, “সে আপনি যাই বলুন, মিডিয়ার লোকগুলো তো বলছে ওর সঙ্গে নাকি আপনার বিয়ে হয়েছিল! আপনি নাকি মেনে নেননি তাই…”
——মৈনাক কড়াভাবে তাকিয়ে টেবিলে ঝুকে বললো, “দ্যাট ইজ নান অফ ইওর বিজনেস, পয়সা দিচ্ছেন মানে মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি” বলে জোড়ে ধমকের সুরে বলল “গেট লস্ট আপনার কেস আমি লড়বো না, আর দেখি কে আপনার ছেলেকে বাঁচায়, আপনি নেতা আপনার নিজের এলাকায়, আপনার পার্টি অফিসে, এখানে নন মনে রাখবেন এখানে আর পাঁচজন মক্কেল এর মতো আপনিও আমার মক্কেল, কাজেই সেই জায়গাটা বুঝে কথা বলতে আসবেন সত্যেন বাবু, নাহলে এর ফল ভালো হবে না!”
—— মৈনাকের ওরকম ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে সত্যেন ঘটক খানিক ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বললো ” না মানে আমি কিছুই বলছি না ওই কানাঘুষ চলছিল সেটাই বললাম আর কি!”
—— মৈনাক সোজা হয়ে তাকালে সত্যেন ঘটক বলে “না মানে ওই তীর্থ বলে ছেলেটির সাথে ওই মেয়েছেলেটার সাথে ওহ ভুল হয়ে গেছে মহিলার নাকি একটু আবার ইন্টু মিন্টু ছিল একসময় ” বলেই আবার একটা খিকখিক করে ফিচেল হাসি দিয়ে “নাহ , ওখানে তো কেউ জানতো না ও বিবাহিতা, তাই একটু ছেলেটার বাড়িতে ঘুরে বেরিয়েছে, নাহ বন্ধু তো বন্ধুর বাড়ি যেতেই পারে তাই না…. একটু গাঢ় বন্ধুত্ব হলে আবার….”

মৈনাক চেঁচিয়ে বলে “গেট আউট, গেট আউট এই বাড়ির চারপাশে যদি দেখি….” সত্যেন ঘটক মৈনাকর ওরকম ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে ভয় পেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দরজার সামনে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন “তীর্থ ছাড়া পেলে আপনার ও ক্ষতি আমার ও ক্ষতি, ভেবে দেখবেন ব্যাপারটা |” মৈনাক ঘা খাওয়া বাঘের মতো গর্জন করে বললো “গেট আউট!”

বাইরে বেড়িয়ে সত্যেন ঘটক রাগে নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকে “কি করতে যে এই উকিলকে ধরলাম কে জানে আর যদি বা ধরলাম তাও আবার ওই মেয়েছেলেটার বরই হতে হলো, শালা আপদ কপাল! ছেলেটাও তেমনি হয়েছে একটা কাজ বললাম সে আর হয় না ” সত্যেন বাবুকে বিড়বিড় করতে দেখে তার সহকারী বাবলা কানের কাছে বলেন আপনি চিন্তা করবেন না ও মাল সামনের দিন কোর্টে উঠবে না |”

সত্যেন থামিয়ে দিয়ে বললেন, “না রে বাবলা, এ উকিল এর অনেক দূর হাত, ওই মেয়েছেলেকে কিছু করতে গেলে নিজেরাই ফেঁসে যাবো |” তারপর বিড়বিড় করতে করতে একটা সিগেরেট ধরিয়ে টানতে টানতে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

অপর্ণা বেশ কয়েকদিন লক্ষ্য করলো সে কোর্টে বেরোনোর সময় একটা গাড়ি তাকে অনুসরণ করে | ব্যাপারটা বাড়ি ফিরে সুপ্রতীককে সে জানায় | সুপ্রতীকের বুঝতে অসুবিধা হয় না অপর্ণার বিপদ পায়ে পায়ে ঘুরছে | সে দেরি না করে তার মৈনাককে ফোনে সব জানায় |

সেদিন কোর্টে বেরোনোর সময় ট্যাক্সি ধরতে গেলে একটা বড়ো ট্রাক গায়ের পাশ দিয়ে এমন ভাবে বের হয় যে আরেকটু এদিক ওদিক হলেই অপর্ণার দুর্ঘটনা হত | সাথে সাথে অপর্ণা দেখে একজন লোক ওই গাড়িটিকে অনুসরণ করে মোটর বাইকে | কিন্তু কে এই লোকটা? অপর্ণা বুঝে ওঠার আগেই নজরের বাইরে চলে যায় | ধাঁধায় পড়ে যায় অপর্ণা | কে করছে কেনই বা করছে বুঝতে পারে না |

ভরা এজলাসে একপ্রস্থ শুনানি হয়েছে |
জজ সাহেব একটু রিসেসে যাওয়ায় অপর্ণা পাবলিক প্রসিকিউটর এর সাথে কথা বলছে | মৈনাক ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে | সত্যেন ঘটক ও এজলাসে উপস্থিত | তার মতলবটা বুঝতে অপর্ণার অসুবিধা হচ্ছে না | অপর্ণার ওপর যেন রাগ ফেটে পড়ছে |

কোর্টে মৈনাকের সাথে অপর্ণা একেবারেই অপরিচিতের মতো ব্যবহার করে | চোখে চোখ পড়লেও সরিয়ে নেয় | কোনোপ্রকার সৌজন্যমূলক হাসি বা কথা কিছুই বিনিময় করে না মৈনাকের সাথে, মৈনাকের বেশ অদ্ভূত লাগে |

সুপ্রতীক এর তদারকিতে কলকাতা ক্রাইম ব্রাঞ্চের দেবেন্দ্র বর্মন যিনি একসময় সুপ্রতীক এর ভালো বন্ধু ছিলেন তাকে এই কেসে সাহায্য করার জন্যে সুপ্রতীক অনেক করে অনুরোধ করে | দেবেন্দ্র বর্মনের অনেক ওপরতলা পর্যন্ত হাত |তাই কান আর মাথা দুটো টানতেই অসুবিধা হয়নি |

এজলাসে জজ সাহেব এসে পড়ায় মামলার শুনানি আবার শুরু হয় | পক্ষে বিপক্ষে প্রমাণ আদালতে পেশ হয় | ইতিমধ্যে এমন একটি মেডিকেল রিপোর্ট কোর্টের কাছে এসেছে যেখানে বলা হয়েছে তীর্থর ডি এন এ এর সাথে ধর্ষণকারীর ডি এন এ কোনোভাবে মেলেনি | ট্রায়াল কোর্টে উত্তরবঙ্গ পুলিশ কোনও মেডিকেল রিপোর্ট জমা করেনি | এরজন্যে তাদেরকে শো কস করার আবেদন জানিয়েছে অপর্ণা | পূর্ণাঙ্গ তদন্তের ওপর ভিত্তি করে রিপোর্ট তৈরী করা হয়েছে | রিপোর্ট অনুযায়ী রেবার ধর্ষণ একজন নয় বেশ কয়েকজন করেছে | রেবার ভ্যাজাইনাতে যে সেমেন এর নমুনা পাওয়া গেছে তার সাথে তীর্থর সেমেন এর সাথে কোনোপ্রকার মিল নেই কাজেই এই ধর্ষণের সাথে যে তীর্থর জামিন যেন মঞ্জুর করা হয় | অপর্ণা এই আবেদন
জানিয়েছে |

ঘটনার তদন্তের পরে আরো একটা চমক সামনে আসে | এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আছে | মহামান্য আদালত ট্রায়াল কোর্টকে এ বিষয়ে যেন নির্দেশ দেন তাকে যথাপযুক্তভাবে যেন কোর্টে পেশ করা হয় এতে এই কেসের একটা নতুন দিক খুলবে অপর্ণা আর্জি জানায় মহামান্য কোর্টের কাছে |

সবদিক বিচার করে জজসাহেব তীর্থর জামিন মঞ্জুর করেন | সাথে পুলিশকে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দেন | সাথে উত্তরবঙ্গ পুলিশ এর এ ধরণের গাফিলতির জন্যে শো কস এর নোটিশ দেওয়া হবে | তীর্থ এ বিষয়ে কোনোভাবে জড়িত কিনা খতিয়ে দেখারও নির্দেশ দেন সাথে ট্রায়াল কোর্টকে নির্দেশ দেন দীর্ঘ শুনানি পর্বে এই কেসটি যেন আটকে না যায় |

তীর্থর জামিন হতেই তীর্থ ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ জানায় | তারপর অপর্ণার সাথে দেখা করে দুটো হাত ধরে বলে “আমি তোকে কি বলে ধন্যবাদ দেবো জানি না, তোর এই ঋণ শোধ করতে পারবো না হয়তো শুধু বলবো তু্ই সুখী হোস ” তীর্থর চোখে জল দেখে অপর্ণা বলে “তোর গায়ে যে কালি লেগেছে তোকে বেকসুর খালাস প্রমাণ করে তোর গা থেকে সেই কালি তুলে তবে রণে ভঙ্গ দেবো – মাসিমা তো আমার মা এর মতো তারতো তু্ই ছাড়া কেউ নেই রে তাই লড়াইটা লড়তেই হবে, গুই আমার খুব ভালো বন্ধু যে, কয়েক মাস অপেক্ষা কর | ”

মৈনাক দূর থেকে অপর্ণা আর তীর্থকে দেখছিলো | মনের মধ্যে চাপা রাগটা যেন ফুটে উঠলো | তড়িঘড়ি করে নিজের সব জিনিসপত্রগুলো নিয়ে কোর্টের বাইরে এসে ড্রাইভারকে নিজের কোর্ট আর গাউনটা দিয়ে রুক্ষভাবে বললো “গাড়ি বার করো আমি বেরিয়ে যাবো ” মৈনাকের এই চেহারা দেখে ড্রাইভার রামদুলাল আর কিছু বলার সাহস পেলো না | নাহলে তার দাদাবাবু কোনোকালেই এই দুপুরবেলা কোর্ট থেকে বেরিয়ে এভাবে বাড়ি যায় না |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

গত দুদিন ধরে মৈনাকের জ্বর | সেদিন কোর্ট থেকে ফেরার পরেই শরীরটা ঝিমঝিম করছিলো | সেই যে এসে নিজের ঘরে শুয়ে পড়েছিল সন্ধেবেলাতে যখন বাড়ির কাজের লোক ঘরের আলো জ্বালে তখন দেখে মৈনাক কুঁকড়ে শুয়ে আছে সেই দেখে মনপ্রভা দেবীকে খবর দিলে তিনি এসে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দেখেন ছেলের গা পুড়ে যাচ্ছে | জ্বরের ঘোরে ভুল বকছে | দেরি না করে ডাক্তার ডাকেন তিনি |

… একই শহরে অপর্ণা আছে মনপ্রভা জানেন কিন্তু তাকে ডাকার ইচ্ছে একেবারেই মনপ্রভার নেই | কারণ সে কলকাতায় এসে আসার পর একবারের জন্যেও বসু ভিলায় আসেনি | অপর্ণার এতো বড়ো স্পর্ধা দেখে তিনি অবাক হয়েছেন | তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছেন নিজের ছেলের বিরুদ্ধে তাকে কোর্টে লড়তে দেখে | তিনি কল্পনা করতে পারেননি | যাকে গ্রাম থেকে তিনি তুলেছে এনে এতো বড়ো বাড়ির বৌ করেছেন তার কিনা এতো স্পর্ধা!

ডাক্তার এসে ওষুধ দিয়ে গেছে | রিপোর্ট করতে দিয়ে গেছে | মনপ্রভা ইন্দ্রানীকে ফোনে সব জানিয়েছে | ওষুধ পড়লেও খুব দুর্বল | রিপোর্টে টাইফয়েড এসেছে | ইন্দ্রানীর কাছ থেকে খবর পেয়েও অপর্ণা বসু ভিলায় যেতে চায়নি | কিন্তু যখন সুপ্রতীক এর থেকে সে শোনে তার প্রাণ সেদিন মৈনাকের জন্যেই বেঁচেছিলো | কারণ মৈনাককে খবর দেওয়ার পর মৈনাকই পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এর কাছে জানিয়ে একজনকে নজর রাখার জন্যে জানিয়ে ছিল | এটা শোনার পর অপর্ণা বুঝে উঠতে পারছিলো না কি করবে |

দুদিন চরম মানসিক টানাপোড়েন এর পর অপর্ণা এসেছে মৈনাককে দেখতে | কিন্তু মনপ্রভা রাজি নন অপর্ণা তার ছেলের কাছে যাক | বাইরের ঘরে অপর্ণা অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু মনপ্রভা মৈনাকের ঘরে যাওয়ার অনুমতি কিছুতেই দিতে নারাজ | বাধ্য হয়ে অপর্ণা বাইরের ঘরেই সারা রাত থাকে | মৈনাককে না দেখে সে কিছুতেই ফিরে যাবে না |

বাইরের ঘরের সোফায় হেলান দিয়ে অপর্ণা চোখ বুজে আছে রাতে খায়নি কিছুই | কাজের লোকের থেকে মৈনাকের খোঁজ নিয়েছে | মনপ্রভার কানে সবই গেছে | বাধ্য হয়ে সে খানিকক্ষণের জন্যে দেখতে যেতে দেয় | নিজের স্বামীকে একবার দেখার সুযোগ পেয়ে অপর্ণা গিয়ে দেখে একদিন যে ঘরে তার প্রথম রাত একা একা কেটেছিল সেই ঘরে সেই বিছানায় মৈনাক ঘুমোচ্ছে | গায়ে মোটা চাদর | মুখটা এই কদিনেই শুকিয়ে গেছে | বড়ো মায়া হয় অপর্ণার | কাছে বসে মাথায় হাত বোলায় | মৈনাক তখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছে |

সেদিন রাতে প্রচন্ড বৃষ্টিতে সারা কলকাতায় জল জমে গেছে | ওদিকে মৈনাকের জ্বরটা বাড়লে একটানা বসে জলপট্টি দিতে থাকে | বেহুঁশ অবস্থায় মৈনাক শুধুই “মলির “নাম ধরে ডাকতে থাকে বারবার যখন বলে “আমি আসছি মলি ” অপর্ণার বুকটা যেন কেঁপে উঠতে থাকে | সে যে কোনোভাবেই মৈনাককে হারাতে চায় না | ওদিকে মনপ্রভা ঠাকুর ঘরে বসে ছেলের জন্যে কাঁদতে থাকে | ডাক্তার আসতে পারছে না | মাঝরাতে যখন কোনও ভাবেই জ্বর কমছে না উপরন্তু বেড়ে চলেছে তখন বাধ্য হয়ে অপর্ণা মৈনাকের মাথায় জল ঢালতে শুরু করে | এই কান্ড দেখে বাড়ির কাজের লোক মনপ্রভাকে খবর দিলে তিনি এসে অপর্ণাকে তীব্রভাবে ভৎসনা করেন এতো রাতে এভাবে জল ঢালার জন্যে | অপর্ণা কোনও দিকে কান না দিয়ে জল ঢেলে যায় | এরপর আস্তে আস্তে মৈনাকের জ্বরটা নামতে থাকে | ভোরের দিকে ক্লান্ত অপর্ণা দেখে মৈনাকর জ্বরটা আপাতত নেই | সাথে সাথে ডাক্তারকে ফোন করলে তিনি এসে মনপ্রভা দেবীকে বলেন | অপর্ণা মাথায় জল না ঢাললে বিপদ হতে পারত | ওদিকে মৈনাক চোখ খুলে অপর্ণাকে দেখে প্রথমে অবাক হয় | তারপর তার মনে পড়ে সেদিন তীর্থর অপর্ণার হাত ধরার কথাটা সে সাথে সাথে মুখে ঘুরিয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে | ওদিকে মনপ্রভা অপর্ণার প্রতি এরকম ব্যবহার করার জন্যে খুব লজ্জায় পড়ে গিয়ে অপর্ণার কাছে ক্ষমা চাইলে | অপর্ণা বিনীত ভাবে জানায় এটা তার কাজ ছিল |

গত কয়েকদিনের অক্লান্ত সেবা যত্নে মৈনাক সুস্থ হয়ে এসেছে | এই কদিনে বহু রাত জেগেছে অপর্ণা | কিন্তু দুজনের মধ্যে কথা হয়েছে দু -একটা | বলতে চেয়েছে দুজনেই কিন্তু পারেনি | ফিরে যাবার জন্যে মনপ্রভাকে জানালে তিনি কিছুতেই রাজি হন না | এই কদিনে অপর্ণাকে তিনিও একটু একটু করে বুঝেছেন, চিনেছেন | এই মেয়েই পারবে তার ছেলেকে একদম ঠিক করতে | এ বিশ্বাস তার হয়েছে |

ঘুম থেকে উঠে মৈনাক দেখে স্নান সেরে অপর্ণা শাড়ি পড়ে চুল খুলে তার ঘরের আয়নায় সিঁদুর পড়ছে | মৈনাকের ইচ্ছে করে স্ত্রীর কাছে যেতে কিন্তু পারে না | মৈনাকের চা দেওয়ার সময় অপর্ণার হাতটা স্পর্শ করতে মৈনাকের ইচ্ছে করে কিন্তু পারে না | ওদিকে অপর্ণা নিজের ভালোবাসা আর সেবায় মৈনাককে সুস্থ করে এবার ফ্ল্যাটে যাবার জন্যে মৈনাককে জানালে মৈনাক বাধা দিতে চাইলেও পারে না | মাথা নেড়ে শুধু বলে “তোমার যা ইচ্ছে ” | মৈনাকের এমন কথায় অপর্ণার আরো অভিমান হয় | অভিমানে পোড়া চোখ দুখানা মৈনাক কি দেখতে পাচ্ছে না নাকি চাইছে না এটা অপর্ণা বুঝে উঠতে পারে না | মৈনাক এখন পুরোপুরি সুস্থ | তবে দুর্বল |

অপর্ণা তিন দিন হলো ননদের ফ্ল্যাটে ফিরে গেছে | মনটা অবশ্য বসু ভিলাতেই সে রেখে এসেছে এবার | মৈনাক এই বারো দিনে অনেক কিছুই দেখেছে | অপর্ণার মতো ওই টুকু মেয়ের মৈনাক জানে মলি ও কে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল আর অপর্ণা ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে শিখিয়েছে | অতটুকু মেয়ের কাছে মৈনাক বসু পরাস্ত সবদিক দিয়ে | এমনকি ভালোবাসায় ও হারিয়ে দিয়েছে সে | ওর ধৈর্যের কাছে হেরে মস্তা নত হয়ে আসে | লক্ষ্যে স্থির অবিচল একটা মানুষ | মৈনাকের সময় কাটছে না এই তিন দিন অপর্ণাকে বড্ডো দেখতে ইচ্ছে করছে | মৈনাকের মনে হয় কত সুন্দর করে যত্ন নিয়ে সে এই ঘর আর তার ওই স্টাডি রুম পরিষ্কার করে রেখেছে |

মনপ্রভা ছেলেকে সকালে দেখতে এসে বুঝেছেন এবার অপর্ণার আসাটা প্রয়োজন | এতে ওদের দুজনেরই মঙ্গল | ছেলের উদাসীন চোখ তাকে বুঝিয়েছে আর দেরি করা ঠিক না | খানিক দূরত্ব কাছে এনে দেবে বেশি হলেই বিপদ | ছেলের সাথে কথা বলেও তিনি বুঝেছেন অপর্ণাকে ছাড়া আর এ সংসার ও চলবে না আর মৈনাক বসু ও চলবে না | কাজেই অগত্যা ইন্দ্রানী আর সুপ্রতীককে ফোনে করে সব জানিয়েছেন | পুজোয় তার ঘরের লক্ষ্মীকে এবার ঘরে ফেরাতে চান |

বেশ কয়েকদিন পর পুজোর ছুটিতে ইন্দ্রানী আর সুপ্রতীক এসেছে মৈনাককে দেখতে | বিকেলে বারান্দায় শালা জামাইবাবুর চা পর্ব চলছে সাথে চুটিয়ে আড্ডা | কিন্তু মাঝেমধ্যে মৈনাক উদাস ভাবে আকাশ দেখছে | সুপ্রতীকের নজর এড়ায় না | সুপ্রতীক আলাদা করে শালাবাবুকে নিজের ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবিটি দিয়ে বলেছে “এই সুযোগ শালাবাবু, সংযুক্তা একা আছে, হৃদয় হরণটা করে নাও, বাড়িতে নাহয় জানাবো কয়েকদিন একটু কাজেই গিয়েছ” বলে চোখ টিপে ইশারা করে রসিকতা করলো | তারপর বললো “জীবন একটাই শালাবাবু অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকলে বাঁচতে পারবে না, সেটাকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে চলো এগিয়ে চলার নামই জীবন, তুমি যদি বিয়ে না করতে সেদিন তাহলে আমি তোমায় কিছুই বলতাম না কিন্তু বিয়ে করে একটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট করো না, সে সত্যিই তোমায় ভীষণ ভালোবাসে, এমন ভালোবাসা পেয়েও হারিয়ে যেতে দিও না, ও খুব অভিমানী, ওর অভিমান তোমাকেই ভাঙাতে হবে |” মৈনাক বারান্দায় বসে দূরের রঙবেরঙের বিকেলের আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো | সাথে সাথে ওর মনে হলো দূরের আকাশে যেন মলির সদাহাস্য মুখখানা ভেসে উঠলো |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

পঞ্চমীর সকাল অপর্ণার ফ্ল্যাটের সামনেই ঠাকুর এসে গেছে প্রত্যেক বছর পুজোর মতো এবারেও সে একা | মা ছিল যখন তখনকার কথা গ্রামের কথা মনে পড়ে যায় | হঠাৎ কলিং বেলটা বাজতেই অপর্ণা “কে?” জিজ্ঞেস করে, চুল এর একটা আলতো খোঁপা করতে করতে এসে খোলে দরজাটা | দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে অপর্ণার চোখ স্থির | এই প্রথম পুজোর সময় সে মৈনাককে দেখছে | মুখের দাড়ির জঙ্গল সাফ করে চোখে সানগ্লাস পড়ে অদ্ভুতভাবে সুপুরুষ লাগছে মৈনাককে এতবছর পর |

… খানিক ইতস্তত হয়ে জিজ্ঞেস করলো “আপনি? এই শরীর নিয়ে এসেছেন?”, মৈনাক মৃদু হেসে বললো, “এখানেই সব উত্তর দেবো? ভেতরে আসতে দেবে না?” অপর্ণা খানিক লজ্জায় বললো “ও, হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আসুন | ” মৈনাক ঢোকার পর অপর্ণা লক্ষ্য করল মৈনাকের হাতে একটা ব্যাগ, সে ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কোথাও যাচ্ছেন? জানি বলার অধিকার আপনি আমাকে দেননি তাও বলছি এই শরীরে ধকল পড়বে বাইরে গেলে |”
মৈনাক বললো “কই না তো, আমি এখানেই থাকবো বলে এসেছি,” বলে সরাসরি অপর্ণার দিকে তাকালো | অপর্ণা এই উত্তর পাবে আশা করেনি | এই অপ্রত্যাশিত উত্তরে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মৈনাকের দিকে |
হালকা গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজে অপর্ণাকে বেশ মিষ্টি লাগছে | মৈনাক ভালো করে দেখলো তারপর খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো, “থাকতে দেবে আমাকে তোমার কাছে, অপু? আমার যে আর ভালো লাগছে না তোমায় ছাড়া |”

অপর্ণা যেন আকাশ থেকে পড়ছে এটা স্বপ্ন না সত্যি সে বুঝতে পারছে না | ফেরার পর থেকে কোর্টে আর দেখা হয়নি দুজনের | হঠাৎ খেয়াল পড়তে সে বললো, “আপনি দাঁড়ান, আমি একটু আসছি |” অপর্ণা যেতে গেলে হাতটা ধরে টেনে কাছে নিয়ে আসে মৈনাক, তারপর অপর্ণার কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলটা সরিয়ে দিয়ে বললো, “কোথাও যেতে দেবো না, মলিকে হারিয়েছি তোমাকে হারাতে পারবো না অপু, তুমি মলির বিকল্প নও কিন্তু আজ আমার মনের অনেকখানি জুড়ে জায়গা করে নিয়েছ | যা শাস্তি দেবে দাও কিন্তু ফিরিয়ে দিও না, আমি তোমায় নিয়ে বসু ভিলায় ফিরতে চাই |” অপর্ণার দুচোখ বেয়ে জল নেমেছে মৈনাক চোখের জল মুছিয়ে বললো, ” তুমি আমাকে ক্ষমা করো অপু, তোমার ভালোবাসার কাছে আমি হেরে গেছি, আমি অন্যায় করেছি, আসলে মলির চলে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারিনি তার সব শাস্তি তোমায় দিয়েছি, আমাকে একবার সুযোগ দাও তোমার স্বামীর হওয়ার ফিরিয়ে দিও না |” অপর্ণা শুধু বলে ” আমাকে আর কষ্ট দেবেন না |” মৈনাক শুধু বলে, ” আর আপনি নয় তুমি বলো বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা |”

অপর্ণা যেন এই দিনটারই প্রতীক্ষায় ছিল, অপর্ণা কোনও কথা বলতে পারছে না এত কাছ থেকে কখনো মৈনাককে সে দেখতে পায়নি | মানুষটার মধ্যে এতো ভালোবাসা তার জন্যে! অপর্ণা চোখ বুজে ফেলেছে, সে চায়না এ স্বপ্ন ভেঙে যাক | চোখ বন্ধ করা অপর্ণাকে কাছে টেনে মন দিয়ে দেখতে থাকে মৈনাক | অপর্ণার চোখ খোলার সাহস নেই যদি স্বপ্নভঙ্গ হয় তার | সে শুধু মৈনাক এর গভীর নিশ্বাস অনুভব করতে পারছে | মৈনাক এর ঠোঁট ধীরে ধীরে অপর্ণার ঠোঁট ছুঁয়েছে গভীর প্রেমঘন মুহূর্তে অপর্ণার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে | এ মুহূর্ত যেন দীর্ঘস্থায়ী হয় | বাইরে ঢাকের আওয়াজে বোঝা যাচ্ছে মা দুর্গা আসছে |

তিনদিন পর মৈনাক তার অপুকে সাথে নিয়ে বসু ভিলায় ফেরে | বৌমাকে নতুন করে বরণ করে ঘরে তোলেন মনপ্রভা | ইন্দ্রানী আর সুপ্রতীক দুজনেই খুব খুশি | বাড়িতে ঢোকার পরেই চোখের ইশারায় শালাবাবুকে রসিকতার ইঙ্গিত | অপর্ণা লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে | অপর্ণা মৈনাকের সাথে নিজেদের ঘরে ঢুকলে তার চোখ সামনে আটকে যায় | দেওয়ালে তার একটা ছবি, মৈনাকের আঁকা | মৈনাক আবার আঁকা শুরু করেছে |

❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

একবছর পর…

অপর্ণা সন্তানসম্ভবা | কোর্টে প্রতিদিন যেতে পারে না | মৈনাক তার যাবতীয় খেয়াল রাখার জন্যে লোক রেখেছে সাথে মৈনাক তো আছেই | কোর্ট থেকে ফিরে যাবতীয় চেম্বার এর কাজা তাড়াতাড়ি সেরে অপর্ণার সাথে সময় কাটায় | মনপ্রভাও ভীষণ খুশি | ঘরে বসে টিভিতে খবরে দেখছে সত্যেন ঘটক, তার ছেলে সুবীর ঘটককে জেল হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে | সবাই মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে যাচ্ছে | অপর্ণা মৃদু হাসলো |

তীর্থ বেকসুর খালাস | এই ঘটনার সাথে তীর্থ কোনোভাবে জড়িত নয় সেটা প্রমাণিত হয় আদালতের কাছে | ঘটনার তদন্ত করে জানা যায় সত্যেন ঘটক আর তার ছেলে ও তার বন্ধুদের দোষী সাব্যস্ত করা হয় | সেদিন সন্ধেবেলা দীঘির পাড় থেকে মুখে বেঁধে তারা রেবাকে এনে চা বাগানের মধ্যেই ধর্ষণ করে মেরে ফেলতে যাচ্ছিলো পাথর দিয়ে কিন্তু সেই সময় তীর্থর সাইকেলের শব্দে রেবাকে আধমরা করে ফেলে রেখে পালায় | যখন তীর্থ সেখানে পৌছায় তখন রেবা তাকে জানায় এটা এম এল এ র ছেলের কান্ড | এরপর রাজ্য পুলিশের তরফ থেকে তদন্ড চালিয়ে জানা যায় তীর্থকে ফাঁসানোর জন্যেই এই প্ল্যান করে এ কাজ করেছিল এম এলে এ সত্যেন ঘটক আর তার ছেলে |

সুপ্রতীক অনেকভাবে মামলায় সাহায্য করেছিল | সাথে মৈনাক ও অনেক চেষ্টা করে তীর্থকে ন্যায় দেওয়ার জন্যে | মৈনাক নিজেকে এই মামলা থেকে সরিয়ে নিয়েছিল | তীর্থর সাথে নিজেই আলাপ করেছিল | মৈনাকের মনে হয় তীর্থর মতো সৎ ছেলেকে আজ রাজনীতির কাজে ভীষণ প্রয়োজন | তাই ওকে মুক্তি দেবার জন্যে পেছন থেকে মৈনাক ও অনেকভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছে | তাছাড়া তীর্থ ওর অপূর
বন্ধু |

এই খবরটা ইন্দ্রানীর থেকে অপর্ণা পেয়েছে | মৈনাকের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দুইই বেড়ে যায় অপর্ণার | বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের আসন্ন সন্তানের কথা ভেবে দুচোখ ভরে ওঠে অপর্ণার | যে আসছে সে যে তার আর মৈনাক এর ভালোবাসার ফসল |
❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে