#যদি প্রেম দিলে না প্রাণে
পর্ব ৩
🖋️রিয়া সেন দত্ত 🖋️
—- কোর্ট থেকে ফেরার পর দরজায় ননদ আর নন্দাই কে দেখে ভীষণ খুশি হলো অপর্ণা | কতদিন পর দেখা! সেই কবে আলিপুরদুয়ার থেকে অপর্ণা এসেছে | তারপর তো শুধু ফোনেই কথা হয় | এই মানুষ দুটোর গুরুত্ব অপর্ণার জীবনে অপরিসীম |
-ঘরে ঢুকেই অপর্ণাকে জড়িয়ে ধরে ইন্দ্রানী বললো “তু্ই পারবি, আমি জানতাম “,
অপর্ণা বললো “দিদি! আজ তুমি আর জামাইবাবু সাথে না থাকলে আমি কবেই হেরে যেতাম – তোমাদের এই অবদান কোনও দিনও ভোলার নয়…”
ইন্দ্রানী অপর্ণার গাল টিপে ধরে ঠাট্টার সুরে বললো “বাব্বা! মেয়ে একেবারে কত বড়ো হয়ে গেছে !”
সুপ্রতীক বেশ রসিক মানুষ, পেছনে দাঁড়িয়ে মজা করে বললো, “আমাকে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে দুই গিন্নী গল্প জুড়লো, বলি বসতেও কি বলবে না ছোট গিন্নী?”
অপর্ণা কপট রাগ দেখিয়ে বললো “এতদিন পর এসেছেন তাই বসতেই দেবো না ঠিক করেছি..”, অপর্ণার কথায় তিনজনেই হেসে উঠলো |
❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤
সন্ধেবেলা চা নিয়ে সুপ্রতীক – ইন্দ্রানী বসে আছে বসার ঘরে, অপর্ণা গরম গরম পকোড়া ভেজে নিয়ে এসে বসলো, সুপ্রতীক বললো “তাহলে ছোট গিন্নী চা খেতে খেতেই আলোচনাটা হোক…”
অপর্ণা বললো “হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম, তীর্থর জামিনটা আদৌ হবে তো ? রেবা সোরেন এর মা বাবা কে সামনের তারিখে কোর্টে তোলা হবে…”
সুপ্রতীক বললো, “তোমার কি মনে হচ্ছে উকিল সাহেবা ?”, অপর্ণা বললো, “তীর্থ এমন করতে পারে না জামাইবাবু!…”
সুপ্রতীক অপর্ণার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো “তুমি আমার থেকে কি সাহায্য চাও?”,
অপর্ণা মৃদু হেসে বললো, “আমি জানি এ বিষয়ে আপনি ছাড়া আর কেউ আমাকে সাহায্য করতেই পারবে না, কলকাতা পুলিশ এর ক্রাইম ব্রাঞ্চ এ আপনার অনেক চেনাশোনা আছে” ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিলো অপর্ণা, সুপ্রতীকের বুঝতে অসুবিধা হলো না অপর্ণা কি বলতে চাইছে, |
অপর্ণা বললো “ফালাকাটা পুলিশ একটা মিথ্যে গল্প সাজিয়ে একজন নির্দোষকে দোষী প্রমাণিত করতে চাইছে- তার ওপর এ বিষয়ে ওখানকার এম এল এ সত্যেন ঘটকের মদত আছে, আমি একশো ভাগ নিশ্চিত, লোকটা যে দুনম্বরি সেটাতো বলাই বাহুল্য ,,,”,
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অপর্ণা বলতে থাকলো,
” জেলা আদালতে তীর্থর জামিন না মঞ্জুর হওয়ার খবরটা পেপারে দেখতে পেয়েই ভেবেছিলাম কিছু করতে হবে | ওর বয়স্কা মা ছাড়া আর কেউ নেই – ও কলেজ থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল, ওর মতো সৎ ছেলে এমনটা করতেই পারে না | “,
সুপ্রতীক অপর্ণাকে পরীক্ষা করার জন্যে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি তো অনেকদিন যোগাযোগ রাখনি তীর্থর সাথে তাহলে এই কবছরে যে ওর পরিবর্তন হয়নি, তা বুঝলে কিকরে? এমন অনেক সময়তেই হতে পারে যাকে দোষী ভাবছ না সে-ই হয়তো আসল দোষী |”
অপর্ণা আস্তে বলতে শুরু করলো,
এ বছর তীর্থর ভোটে টিকিট পাওয়ার কথা ছিল | দলের হয়ে খুব সক্রিয়ভাবে মানুষের জন্যে কাজ করছিল | গোটা আলিপুরদুয়ারে ওর নাম হতে শুরু করেছিল | মানুষের মধ্যে ওর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছিলো | চা বাগানের শ্রমিকদের বস্তিগুলোর উন্নতির জন্যে অনেক করেছে | ওখানকার আদিবাসীদের জন্যেও ও কাজ করছিলো | কিন্তু এসবই দলের ভেতরে অনেকের মনে জ্বালা ধরাচ্ছিলো | শত্রুর সংখ্যাও তলে তলে বাড়ছিলো | তাদের মধ্যে লোকাল এম এল এ সত্যেন ঘটক একজন, লোকটা রেশন কারচুপি থেকে শুরু করে বেআইনি কনস্ট্রাকশন সবই চালাতো | এগুলো তীর্থর নজরে আসলে ও দলের উপর মহলে বিষয়টা জানানোর চেষ্টা করে | দলের উপর মহলের নজর সত্যেন ঘটকের ওপর পড়ে | এতেই আরো বিপত্তি বাধে | দল থেকে এবারের নির্বাচনে সত্যেন ঘটককে সরিয়ে তীর্থকেই টিকিট দেওয়ার কথা ভাবা হয় | ব্যাস রাস্তার কাঁটা সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সত্যেন |
যেদিন ঘটনাটা ঘটে সেদিন দলের কাজ সেরে রাতের অন্ধকারে তীর্থ যখন লাল বস্তি চা বাগানের পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ফিরছিলো | হঠাৎ গোঙানীর শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে | ওর টর্চটা চা বাগানের ওপর ফেলতেই দেখে একটি মেয়ে নগ্ন অবস্থায় পড়ে গোঙাচ্ছে পাশে রক্ত ভেসে যাচ্ছে | বোঝাই যাচ্ছে ধর্ষণ করা হয়েছে |
তীর্থ দৌড়ে গিয়ে মেয়েটার মাথাটা কোলে তুলে ধরতেই বুঝতে পারে মেয়েটি লাল বস্তির, তীর্থ জিজ্ঞেস করে, “রেবা তু্ই! কে করলো এমন?”, তখনো একটু প্রাণ রয়েছে, রেবা শুধু বলেছিলো “এম. এল. এ -র ব্যাটা ” |
মুহূর্তের মধ্যে কিছু লোকজন এসে টর্চ ফেলে দেখে তীর্থ রেবাকে নিয়ে বসে আছে ওভাবে | প্রথমে তীর্থ ভেবেছিলো গ্রামের লোকেরা হয়তো ভুল বুঝে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেয় পরে অবশ্য বুঝেছে এতে এম এল এ সত্যেন ঘটক এর হাত আছে | তীর্থ দলের ভেতরের গন্ডগোলের শিকার | দল থেকে ওকে বহিস্কার করা হয় | দল থেকে কোনওপ্রকার সাহায্য করা হবে না জানিয়ে দেওয়া হয় |
ওদিকে এম. এল. এ সত্যেন ঘটক কলকাতার স্বনামধন্য উকিল মৈনাক বসুকে এই কাজে নিযুক্ত করে, কারণ রেবার বাবা- মা এর পক্ষে সেটা করা কখনোই সম্ভব নয় | ওরা চা বাগানে খেটে খাওয়া শ্রমিক | সহজ সরল | যা বোঝায় তাই বোঝে | অভাবের সংসার |
“তীর্থ ভালো ছেলে, ও আর যাই করুক খুন বা এধরণের কাজ করতে পারে না, আমি কলেজ থেকে ওকে চিনি ” অপর্ণা জোর গলায় বলে |
সুপ্রতীক আর ইন্দ্রানী একে অপরকে একবার দেখলো |
সুপ্রতীক এতক্ষন খুব মন দিয়ে সব শুনছিলো তারপর বললো “সবই তো বুঝলাম কিন্তু নিম্ন আদালতে একবার জামিন না মঞ্জুর হলে উচ্চ আদালতে পাওয়াটা খুব চাপের, তবু দেখছি কি করতে পারি আমার ছোট গিন্নির জন্যে |”
ইন্দ্রানী বললো “তু্ই ছেলেটিকে কলেজ থেকে চিনিস? কই ফোনে আগে বলিসনি তো?” অপর্ণা বললো, “শুধু চিনি বললে ভুল হবে, কলেজে আমরা দুজন খুব ভালো বন্ধু ছিলাম, আর ফোনে অতো বলতে পারিনি ” বলে অপর্ণা থামলো |
অপর্ণাকে তীর্থ প্রেম নিবেদন করেছিল একসময় | তীর্থকে সে ভালো না বাসলেও তীর্থ ওকে ভালবেসেছিলো | অপর্ণার প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও তীর্থ নিজেদের বন্ধুত্বকে কখনোই অসম্মান করেনি |
❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤
মৈনাক রাতে খেতে পর্যন্ত ওঠেনি | লোককে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছে চেম্বারে |
“দিদি জামাইবাবু বাবু কলকাতায় এসেছে কিন্তু এখানে আসেনি | ওদের ফ্ল্যাটেই অপর্ণা আছে, তাহলে কি জামাইবাবু এ বিষয়ে অপর্ণাকে সাহায্য করতেই কলকাতায় এসেছেন!” এসব চিন্তা মৈনাকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে |
ওদিকে এম. এল. এ সত্যেন ঘটক তাকে এ কাজে নিযুক্ত করেছে ভিক্টিম এর হয়ে লড়ার জন্যে | কিন্তু সত্যেন এর ছেলেই ধর্ষণ আর খুন করেছে | ছেলেটা গুণধর বললেও কম বলা হবে | এসব কেস মৈনাকের কাছে জলভাত | সে জানে কি করে এসব কেসে মক্কেল কে বাঁচাতে হয় | পেশার জন্যে সে সব পারে | কিন্তু আজ বিবেকে বাঁধছে | তার লড়াইটা যে এবার তার নিজের বিবেকের সঙ্গে |
নিজেই মনকে প্রশ্ন করে অপর্ণাকে তো সে ভালোবাসে না তবে তাকে সামনে দেখে বুকের ভেতর কেন এমন হলো? এই তীর্থই কি সেই ছেলে যে অপর্ণাকে ভালোবাসতে চেয়েছিলো? ইন্দ্রানী কি এর কথাই বলেছিলো, তখন মনে হয়েছিল অপর্ণা যদি ছেলেটির সাথে প্রেম করেও তাকে ডিভোর্স দেয় সে শান্তি পাবে | কিন্তু অপর্ণা তা করেনি | তবে কি অপর্ণা তাকে ভালোবাসে?
মৈনাক জেনেছিলো পরে অপর্ণার কোনও দোষ ছিল না বিয়েতে তার মতামত টুকু নেয়নি তার বাবা, শুধু টাকার লোভে মা হারা মেয়েটাকে মৈনাকের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে | এতো বছর ধরে মেয়েটা শাস্তি পাচ্ছে তার থেকে |
প্রশ্নে নিজেকে জর্জরিত করে তুললো, আজ যখন ছেলেটার হয়ে লড়ছিলো মনে হচ্ছিলো একবার বলি “অপর্ণা তুমি আমার, তোমার ওপর সব অধিকার শুধু আমার |”
কিন্তু যে আঘাত সে দিয়েছে অপর্ণাকে, তার জন্যে কি কখনো অপর্ণা তাকে ভালোবাসবে?
মল্লিকাকে হারানোর যন্ত্রণাটা আজও আছে কিন্তু ওইটুকু মেয়েকে দূরে সরানোর ক্ষমতা বা সাহস কোনোটাই নেই মৈনাকের | অপর্ণা ওর স্ত্রী, এতগুলো বছর ধরে সে মৈনাকের যোগ্য হবার পরীক্ষা দিচ্ছে | সে একবার আসুক আর একবার আসুক |
মনে মনে বললো “কিন্তু তীর্থকে কি করবো, ওর জামিন করা যাবে না | ” মৈনাকের জেদ চেপে বসেছে | তীর্থকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বি ভাবতে শুরু করেছে |
❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤
সেদিন রাতে সুপ্রতীক আর ইন্দ্রানী অপর্ণার সাথে থেকে গিয়েছিলো | ফ্ল্যাটের একটা ঘরে স্বামী -স্ত্রী অন্য ঘরে অপর্ণা একা | ইন্দ্রানীর কোনও কারণে ঘুমিয়ে আসছিলো না | সে এপাশ ওপাশ করছে দেখে সুপ্রতীক জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে বলতো? সেই কখন থেকে এপাশ ওপাশ করছ | “, ইন্দ্রানী বললো ” আচ্ছা তীর্থ বলে ছেলেটি তো আমাদের ওখানকার,ওকে কি তুমি চেনো? “, সুপ্রতীক আলতো করে হেসে বললো, “আলাপ নেই তবে মুখ চিনি – ভয় পেয়ো না তুমি যা চিন্তা করছ সেটা অমূলক -ও মেয়ে খাঁটি সোনা ” ইন্দ্রানীর মনোভাব ধরা পড়ে যাওয়ায় একটু লজ্জিত হয়ে পড়লো সে |
পরদিন সকালে অপর্ণা যখন চা করছিলো ইন্দ্রানী ঘুম থেকে উঠে সোজা রান্না ঘরে এলো | ইন্দ্রানীকে দেখে অপর্ণা এক গাল হেসে বললো “সুপ্রভাত, জামাইবাবু কি উঠেছে?- তাহলে চা -টা দিয়ে আসি ” সাথে সাথে ইন্দ্রানী বললো “না এখনো ওঠেনি তু্ই আর আমি বরং বারান্দায় গিয়ে বসি ” আজ ছুটির দিন কোনও তাড়া নেই অপর্ণার | দুটো চেয়ার এনে বসলো দুজনে | এই ফ্ল্যাটটা সুপ্রতীকের | কলকাতায় কাজে এলে কয়েকদিনের জন্যে যাতে সবসময় শশুরবাড়ি উঠতে না হয় তাই বেশ কয়েক বছর আগে কিনে রেখেছে | এখন সেখানেই অপর্ণা থাকে |
ইন্দ্রানী চা খেতে খেতে অপর্ণাকে তীর্থর কেসটা নিয়ে এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে থাকে | তারপর হঠাৎ অপর্ণার হাত দুটো ধরে বলে , “অপু, একটা সত্যি কথা বলবি? তু্ই কি উত্তরবঙ্গে থাকার সময় এই ছেলেটির কথাই বলেছিলি? তু্ই বলেছিলি একজন তোকে ভালোবাসে – এ কি সেই ছেলেটা?” , অপর্ণা এতক্ষনে ইন্দ্রানীর এতো প্রশ্নের আসল কারণ বুঝলো, শুধু মুচকি হেসে বললো, “এই কেসটায় যেমন তীর্থকে নির্দোষ প্রমাণ করা আমার লক্ষ্য তেমনই এটা আমার জন্যে মৈনাক বসুর যোগ্য স্ত্রী হয়ে ওঠার লড়াই, যদিও আমি চাইলে এই পরীক্ষা নাও দিতে পারতাম, কিন্তু আমি তোমার ভাইকে ভালোবাসি দিদি, – সেই দিন থেকে বাসি যেদিন আমাকে উনি ঘৃণা করা শুরু করেছেন – আমি শুধুই ওনাকে ভালোবাসি, আমার এতো লড়াই ওনার জন্যে | তীর্থ আমার খুব ভালো বন্ধু | ” ইন্দ্রানীর চোখে জল চলে এসেছে, এতো ঘৃণার পরেও অপর্ণা যেন সত্যিই অপর্ণা | তার ধ্যান জ্ঞান শুধুই তার মনের পরমেশ্বরকে পাওয়া | অপর্ণা সত্যিই ভালোবাসে মৈনাককে | আজ অপর্ণার মতো লেখাপড়া জানা সুশিক্ষিতা মেয়ে শুধু ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে লড়ছে | ও চাইলে অনায়াসে অন্যকাউকে এতো বছরে ভালোবাসতে পারতো, কিন্তু বাসেনি | অন্য কোনও পুরুষকে সীমা লঙ্ঘন করতে দেয় নি | এ ভালোবাসার তল খুঁজে পাওয়া মুশকিল | মৈনাক এ ভালোবাসাকে আবার আঘাত করলে নিজেই বোকামি করবে | যে গেছে তাকে মনে রেখেই এগিয়ে যাওয়ার নাম জীবন | মল্লিকা মৈনাকের অতীত, অপর্ণাই বর্তমান |
❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤❤
(চলবে )