#মোহমেঘ -পর্ব ০৩/শেষ
-সুহাসিনী
আহির হঠাৎ বলে ওঠে,
-আরোশী, ওয়েট এ সেকেন্ড। আজকে কত তারিখ জানো তুমি? ঠিক আজকের এই দিনে কী ঘটেছিল, মনে আছে তোমার?
আরোশী থমকে দাঁড়ায়। একবার আহিরের দিকে, আরেকবার দেওয়ালের দিকে তাকায়।
-কত তারিখ? আর আজ কী হয়েছিল?
-আজকের এই দিনেই তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা। ভার্সিটিতে সেদিন তুমি মেরুন রঙের একটা থ্রি-পিস পরেছিল। মেইন গেট পার হয়েই যে সেগুন গাছ, ওখানটাতে দাঁড়িয়ে তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে-বিজনেস ম্যানেজমেন্ট বিভাগটা কোনদিকে, বলতে পারবেন?
আরোশী ভাবনার গভীরে গিয়ে স্মৃতি হাতড়ানোর চেষ্টা করে। অনেক ভেবেও সে অতীতের মুহুর্তগুলো খুঁজে পায় না।
-আমি কি মেরুন রঙের থ্রি-পিস পরেছিলাম? মিথ্যে কথা। ভার্সিটির প্রথম দিন আমি হলুদ রঙের একটি গাউন পরে এসেছিলাম। তুমি ভুলে গেছো। আমার সব কথাই তুমি ভুলে গেছো। তুমি আমাকে ভালোবাসো না, আহির। এসব তোমার নাটক, সব নাটক। এখন আমাকে থামানোর জন্য এই মিথ্যে বললে, তাই না? তোমার চালাকি আমি ঠিকই বুঝতে পারছি।
আহির ধরা পড়ে যায়। থার্ড ইয়ার থেকে সে আরোশীকে কিছুটা পছন্দ করতো-একথা সত্য। সত্য স্বীকার করতে তার আপত্তি নেই। অন্তত ভালোবাসা না হলেও এতদিনের দীর্ঘ অভ্যস্ততা তো ছিলোই। কিন্তু এরমধ্যে আরোশী তাকে বিশেষ সুযোগ দিয়ে আপন করে নেয়নি।
-তুমি আমাকে প্রতারক ভাবো? আমাকে? যেই ছেলেটা সাড়ে চার বছর তোমার সঙ্গ দিয়েছে, তাকে তুমি কীভাবে অবিশ্বাস করতে পারো? আচ্ছা, তুমি আমার সাথে শারিরীক সম্পর্ক করবে, এরপর আমাকে মারবে-এই তো! ঠিক আছে, আমাকে তুমি মে*রে ফেলো। আমি তোমার ভালোবাসায় ম*রতে প্রস্তুত।
আরোশী কিছুটা হতভম্ব হয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকে। কিছুটা আমতা আমতা করে সে জিজ্ঞাসা করে,
-আমার সব আবদারই তুমি মেনে নেবে?
-হ্যাঁ,নেবো। আমাকে ভালোবেসে তুমি এত বেশি কষ্ট পেয়েছো, আর তোমার জন্য আমি এই সামান্যটুকু করতে পারি না? আমি তোমার মত করেই তোমাকে খুশি করতে চাই। আচ্ছা আরোশী, একটা কাজ করবে? তুমি বরং আমার হাতের বাঁধন খুলে দাও। আমি তোমাকে মুক্তভাবে একবার শেষ ভালোবাসবো।
-খুলে দিলে যদি পালিয়ে যাও?
আরোশী যেন ছোট বোকা বাচ্চাটির মত প্রশ্ন করলো। আহিরের ভীষণ খারাপ লাগছে এমন সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু এই মুহুর্তে ওর হাত থেকে বাঁচার জন্য এ ভিন্ন আর কোনো উপায় নেই।
-পালাবো না। আমাকে বিশ্বাস করো। এর আগেও তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছিলে, আমি কি তোমার হাত ধরে শুধু তোমার সাথে পালাইনি, বলো?
-হুম, তা ঠিক। আচ্ছা, দিচ্ছি। একদম পালাবে না কিন্তু। তুমি পালালে আমি তোমাকে মেরেই ফেলবো। আমি ছাড়া এই পৃথিবীর কেউ তোমাকে ভালোবাসতে পারবে না।
আরোশী ভয়ে ভয়ে ওর হাতের বাধঁন খুলে দেয়। চেয়ারের সাথে শক্ত করে বাধাঁর কারণে দুই হাতে যেন রক্ত জমাট বেঁধে গেছে আহিরের। সে নিজের দুটি হাত ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
-আরোশী, এই দেখো, আমি তোমাকে ফেলে পালাচ্ছি না। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি, তাই না?
আরোশী সহজমনে বিশ্বাস করে নেয়। অথচ সে জানে না-খুব প্রিয় মানুষগুলোই ভয়ংকরভাবে আমাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করে। খুব করে কারো প্রতি নির্ভরশীল হলেই সে আমাদের ছেড়ে চলে যায়।
আহীর তার দুই বাহুর মধ্যে আরোশীকে টেনে নেয়। আরোশীও মনের অজান্তেই তার কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
কিন্তু এবার আর আহির কাল বিলম্ব করে না। সে দ্রুত পাশ থেকে দড়ি নিয়ে আরোশীকে জাপ্টে ধরে বেঁধে ফেলে। মেয়েটা কিছু বুঝে উঠার আগেই সে তাকে কাবু করে ফেলেছে।
-আহির, আহির, কী করছ তুমি? আরে, ছাড়ো। আমার লাগছে তো।
কিন্তু আহির এবার তার মায়াকান্নার আর বিন্দুমাত্রও কর্ণপাত করে না। নিষ্ঠুরতম মানুষদের মতই সে নিজের ভয়ংকর চরিত্রের পরিচয় দিতে বাধ্য হয়।
এই ঘটনার প্রায় চার ঘন্টা পর আহির আরোশীকে তার বাসায় নিয়ে আসে। আরোশীর বাবা জনাব হামিদ শরীফ সেই বিকাল থেকেই মেয়ের খোঁজ পাচ্ছিলেন না। অন্যদিকে বিয়েবাড়িতে আহিরের অনুপস্থিতি। একরকম সম্ভাবনা তার হয়েছিল, তবে সেটা যে আসলেই সত্যি-তা এখন বুঝতে পারছেন। আহিরকে দেখামাত্রই ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,
-তোমার সাহস কী করে হলো, তুমি আমার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছিলে!
-কেন আংকেল? পাত্র হিসেবে আমি কি অযোগ্য ছিলাম? নাকি আপনার মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছি?
হামিদ শরীফ তাকিয়ে দেখলেন, আরোশীর হাত বাঁধা।
-ওর হাত কেন বেঁধেছো?
-সেটা বলতেই এখানে এসেছি। পুরুষ মাত্রই দোষী, এই ধারণা করলে আপনিও কম দোষী নন, আংকেল। আমাকে আপনি বিগত প্রায় চার বছর ধরে চিনেন। আপনি এও জানেন, আমার পক্ষে অন্তত এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।
-কিন্তু তোমাদের ভিতর হচ্ছেটা কী?
-আপনি বসুন। আমি সব খুলে বলছি।
হামিদ শরীফ সোফায় গিয়ে বসলেন। অশান্ত নয়, বরং শান্ত হয়ে। মেয়ে নিখোঁজ হয়ে আবার হাত পা বেঁধে ফিরে আসা সন্তানের বাবা এমন শান্ত হয় কীভাবে, তা একমাত্র হামিদ সাহেবই বলতে পারবেন। এ জগতের মানুষের মন বোঝা বড্ড দায়। আর তিনি যদি হন- বয়স্ক পুরুষ। আহির বললো,
-আমি মনে মনে আরোশীকে পছন্দ করতাম। পছন্দটা দূর্বলতার দিকেও অবশ্য গড়িয়েছিল। ভালোবাসা কি-না জানি না। তবে হতে পারে দীর্ঘদিন একজন নারীর সঙ্গ পেয়ে তার প্রতি মায়া। হ্যাঁ, আমি আরোশীকে সেই অনুভূতির কথা বলতে পারিনি। কিন্তু আরোশীও যে মনে মনে আমাকে পছন্দ করত, এটা আমি বুঝে উঠতে পারিনি। আংকেল, আমি পড়াশোনা শেষ করেই বাবার ব্যবসা ধরেছি। এরপর পরিবারের মতে বিয়ে করতে যাচ্ছিলাম। কারণ, আরোশীর পক্ষ থেকে আমি বিশেষ রেস্পন্স এতদিনে পাইনি। নিশাত নামের যে মেয়েটির সাথে আমার আজ বিয়ে হবার কথা ছিল, আমি ওর সাথে দীর্ঘদিন কথা বলেছি। মেয়েটি আমাকে ভয়ংকর রকম ভালোবাসে, জানেন? আমি তবুও আরোশীর কথা জানার পর ওকে নিয়ে পালিয়েছি। কিন্তু আংকেল, ও আমার সেই বেস্টফ্রেন্ড আরোশী নয়। ও এখন একটা সাইকো। আপনি জানেন? আরোশী আমাকে খুন করতে চেয়েছিল, এমনকি… আমাকে মাফ করুন। ওসব আমি বলতে পারবো না। পারলে আপনার মেয়েকে একটা ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান। ভালোবাসা দিয়ে তাকেই সুস্থ করা যায়, যে ভালোবাসার মর্ম বোঝে। কিন্তু যেই মানুষটা কাউকে পেলাম না ভেবে তাকে খুন করার কথা মস্তিষ্কে আনে, সে প্রেমিকা নয়; সাইকো খুনী।
আহির আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায় না। নিজের কথা শেষ করে বাইরে বের হবার জন্য পা বাড়ায়। বের হবার আগে সে আরোশীর চোখের দিকে তাকালো। সেখানে তখনও ভীষণ চাপা ক্ষোভ জমে আছে। আহির তাকে বললো,
-ভালোবাসার সঠিক সঙ্গা যে মানুষটি আমাকে শিখিয়েছে, তাকে আমি ঠকিয়েছি। কিন্তু একই ভুল আর নয়। আরোশী, হয়তো ঠিক আর ভুল মানুষের পার্থক্য বুঝতেই এতদিন তোমার প্রতি দুর্বলতা থেকেও আমি সাহস করে বলতে পারিনি। এখন বুঝতে পারছি- মাঝে মাঝে সাহস করে পদক্ষেপ না নেওয়াই উত্তম। ভালো থেকো।
আহির রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। সে জানে, এই মুহুর্তে বাড়ি ফিরে বিশেষ লাভ নেই। তাকে এখন যেতে হবে তার প্রিয়তমা নিশাতের কাছে। হয়তো সে ক্ষমা করবে না। তবুও বিশাল ভালোবাসার জলরাশি যে সাজাতে জানে, তার কাছে ক্ষমাপ্রাপ্তিও অনেকখানি প্রাপ্তি। বাসার সামনের সরু বাগান বিলাস গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রশ্নি। আহিরকে দেখামাত্রই মেয়েটা সাংঘাতিক রকম চমকে উঠলো।
-আহির!
-জ্বি ভাবি, আমি। নিশাত কোথায়?
-ঘরে। কথা বলবে বলে মনে হয় না।
আহির একবার বুক ভরে শ্বাস নেয়। তারপর চুপচাপ নিশাতের ঘরের ভিতর ঢোকে। মেয়েটা বারান্দার মুখোমুখি দরজার কাছে একটি চেয়ার পেতে বসে আছে।
-নিশাত!
-ক্ষমা চাইতে এসেছো?
-ইয়ে মানে… নিশাত, আমি ভুল করেছি। আমি জানি না কীভাবে ক্ষমা চাইবো। তবে তোমার সাথে যা করেছি, তা অন্যায়।
-জানতাম, বুঝতে পারবে। তবে তোমার সাথে এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ক্ষমা চাইতে হলে এখনও বেশ কিছুদিন আমার কাছে ধন্যা দিতে হবে। সাথে এও লিখিত চুক্তি দিতে হবে-পরবর্তীতে আমাকে ফেলে ভিন্ন কোনো নারীর চিন্তা মাথায় আনলে ভালোবাসার দ্বারে আমি কপাট দেবো।
আহির চমকে গেল। নিশাত তাকে এখনও গ্রহণ করতে ইচ্ছুক! এই মেয়েটা তাকে এত ভালোবেসেছে, অথচ সে জানতেই পারেনি।
-আমি ফিরবো-তুমি জানতে?
-না, জানতাম না। তবে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস ছিল। আহির, তোমার মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না। যাও তো এখন। বাবাকে অনেক কষ্টে বুঝিয়েছি।
আহির কথা বাড়ায় না। নিশাতের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বাগানবিলাস গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায় সে। এই গাছটা নিশাতের ভীষণ প্রিয়। গাছের বা’দিকে হেলান দিয়ে দাঁড়ালে নিশাতের ঘর দেখা যায়। আহির নিশ্চুপ সেদিকে তাকিয়ে ভাবে-
“ঠিক মানুষটিকে চিনতে কতগুলো বছর আমরা ভুল করে যাই! অথচ জীবনের সঠিক মানুষটিকেই সবটুকু ভালোবাসা দেওয়া হয় না আর!”
––সমাপ্ত—