মেঘ বিয়োগের মৌসুম পর্ব-১৪

0
633

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৪

পাঁচ মাসের মাথায় প্রাক্তন স্বামী ধ্রুবর কাছে থেকে ফোনকল পায় বেলা। এই সময়টাতে প্রাক্তন স্বামীর কল পাওয়া হয়তো খুব একটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার না। একটা সময় এসে ছেড়ে যাওয়া মানুষটা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারে তার করা কাজটা ঠিক ছিল না।

ফোনস্ক্রিনে ‘ধ্রুব’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। ইচ্ছে তো করছে ফোনটা রিসিভ করে গলাটা শুনতে কিন্তু স্মৃতি যেন ধিক্কার জানাচ্ছে এরকম ইচ্ছেকে। স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল বেলা। কল যতক্ষণ না কেটে গেল সে ততক্ষণ দেখতে থাকল। কলটা কেটে গেলে ফোনটা উলটো করে বিছানায় রেখে দিল সে।

দরজা নক করার শব্দ পেয়ে বেলা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। বাহিরে ওয়াহাজ দাঁড়িয়ে আছে। বেলা ভেতর থেকে বলে ওঠে,” ভাইয়া, কিছু বলবে? ভেতরে এসো।”

ওয়াহাজ ভেতরে এসে বিছানায় বসে। মাথানিচু করে বেলাকে বলে,” আমি তোমাকে যা যা বলেছি সেগুলো তুমি ভুলে যাও। তোমাকে আমি আর এসবে জড়াতে দেব না। আমার এখন মনে হচ্ছে আমি কাজটা ঠিক করিনি। আমি এসবের সাথে জড়িয়ে ছিলাম আমিই শেষ পর্যন্ত থাকব আর তাছাড়া এখানে কম মানুষ নেই। আমি আমার বোনকে বিপদে ফেলতে চাই না।”

বেলা চুপচাপ তার ভাইয়ের কথা শুনছিল। সে নিজেও প্রথমদিকে এসব থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতে থাকতে শুধু তথ্য যোগাড় করে দিতে হতো তাকে আর তার জন্য কিছু টাকা পেত সে৷ তার মনে হয়, প্রতিটা মানুষের উচিৎ নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যা*য়ের শা*স্তি দেওয়া। যেমন তার মা করেছিল।

বেলা তার ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসে। নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,” ভাইয়া তোমার মনে আছে, আম্মা যখন ছোটোমায়ের ভাইকে শা*স্তি দিয়েছিল তখন তুমি কত খুশি হয়েছিলে? আম্মাকে একা পেয়ে যখন ওই মামা, আম্মার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিল তখন কিন্তু আম্মা নিজেকে রক্ষা করেছিল। দা দিয়ে হাতের খানিকটা কে*টে দিয়েছিল তারপর? তারপর ধীরে ধীরে যখন সবকিছু জানাজানি শুরু হলো গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই আম্মাকে দোষ দিতে শুরু করল৷ তারপর কী হলো? আমাদের শৈশব নষ্ট করে আম্মা নিজে ম*রে গিয়ে বেঁচে গেল। ”

” আমার জীবনের প্রথম নারীকে হারিয়েছি এখন আর তোকে হারাতে চাই না বোন। আমি আজ বুঝতে পেরেছি এ সমাজের সবক’টা মানুষ ভেতরে ভেতরে প*শু। তাদের সাহায্য করলে ভালো তবে সেটা কোনোভাবে তাদের মনের মতো না হলে আসল রূপ দেখা যায়। আমি নিজেই ভেবেছি আর দেশে থাকব না।”
” কী হয়েছে ভাইয়া? তুমি এরকম কেন বলছ?”
” কিছু হয়নি। আমি ভেবেছি তোকে নিয়ে বাহিরে চলে যাব।”
” হঠাৎ এরকম চিন্তাভাবনা কেন ভাইয়া?”
” আজ যারা তিনজন শা*স্তি না পেয়ে বেরিয়ে গেল তাদের আইনের মানুষই সাহায্য করেছে বের হতে। যাদের এতো বিশ্বাস করে কাজ করছিলাম তারাই কি না এভাবে বদলে গেল! যদি কখনো নিজে একা কিছু করতে পারি তাহলে করব। এই অন্ধকার জগতে তোকে কিছুতেই নিতে আসব না আমি।

ওয়াহাজ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ওয়াজিহা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে কখনোই ঝামেলায় জড়াতে চায়নি তবে ঝামেলায় যদি জড়িয়েই যায় তাহলে সেটার মোকাবেলা অবশ্যই করা প্রয়োজন।
***
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে প্রতিদিনের মতো ছাদে যায় বেলা। রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। হাতের ফোনটা তৎক্ষণাৎ বেজে ওঠে। অপরিচিত নম্বর দেখে প্রথমে রিসিভ করবে না ভেবেও পরিচিত কেউ হতে পারে ভেবে কলটা রিসিভ করে সে।

ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিজেই বলে ওঠে,” আসসালামু আলাইকুম। কে বলছিলেন?”

ওপাশের ব্যক্তি তখনো নিরব দেখে বেলা আবারও বলে, ” চুপ করে আছেন কেন? কল দিয়েছেন কি মজা করার জন্য? আমি ফোন রাখছি।”

তড়িঘড়ি করে ওপাশে থেকে জবাব আসে,” প্লিজ কল কেটো না।”

বেলা বুঝতে পারে এটা ধ্রুবর গলা। শক্তগলায় বলে,” কল দিয়েছেন কেন আপনি?”
” তোমাকে খুব মিস করছিলাম বেলা।”
” বিষয়টা হাস্যকর হয়ে গেল না?”
” হয়তো হলো তবুও সত্যি কথাটাই বললাম। তুমিও হয়তো চেয়েছিলে আমি তোমাকে কল করি তার জন্য এখনো নম্বর চেঞ্জ করোনি। ”
” লিসেন, এটা আমার ব্যবহার করা প্রথম নম্বর। সবার সাথে যোগাযোগ এই নম্বরে, আমার কোনো পিছুটান নেই। আপনার মতো পুরুষের জন্য তো একদমই না। দ্বিতীয়বার যোগাযোগ করার মতো ভুল আর করবেন না।”
” বেলা প্লিজ শোনো।”
” যাকে ভালোবেসে বিয়ে করলেন তাকে দিয়ে চলছে না এখন? সে তো খুবই সুন্দরী। আপনি যা চেয়েছিলেন তাই হয়েছে। আপনার বউ ছিলাম তখন আমি তাই আপনার ইচ্ছেটা পূরণ করেছি এখন আমি আপনার কেউ না। আমি আপনাকে ওই সময়টাতেও চেয়েছি যখন আপনার কেউ ছিল না। এমন একটা সময় এলো যখন আপনি ছাড়া আমার কেউ ছিল না, আপনি আমাকে ছুড়ে ফেলে দিলেন!

বেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে,” ভালো হবে আপনি আর কখনো আমাকে ফোন না দিলে। নিজের চরিত্র আর খারাপ করবেন না। বউকে ভালো রাখুন।”

বেলা দেরি না করে কল কেটে ফোন বন্ধ করে ফেলে। খোলা আকাশের দিকে চেয়ে রবকে কিছু বলতে থাকে।

পিছন থেকে কেউ ভারী গলায় বলে ওঠে,” আপনি এখন ছাদে!”

বেলা পিছনে তাকিয়ে দেখে ফারাজ একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। ভ্রু বিস্তৃত করে বলে,” আপনি সিগারেট খান? আপনি তো ডাক্তার। শরীরের বিষয়ে আপনার বেশি সচেতন থাকা উচিৎ। ”
” ডাক্তারও তো মানুষ। ”
” সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষ*তিকর, জানেন না? ক’দিন পর দেখবেন স্ত্রী,ছেলে-মেয়ের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই শ্বাস নিতে পারছেন না।”

ফারাজ হাতের জ্ব*লন্ত সিগারেটের টুকরো অংশ রেলিংয়েই চেপে ঘষে আ*গুন নিভিয়ে দেয়। অন্ধকারে বেলাকে আবছায়া দেখা যাচ্ছে। সেদিকেই তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে ফারাজ। রেলিংয়ে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে আ*গুন দিয়ে সেটা জ্বা*লিয়ে নেয়। আরও একবার সিগারেটে ঠোঁট ছুঁইয়ে নেয় সে।

ছাই হালকা ঝেড়ে ফেলে বলে ওঠে,” নারী যে পুরুষের মস্তিষ্কের জন্য ক্ষ*তিকর সেটা কেউ বলে না কেন?”

বেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,” কোন কোন পুরুষ যে নারীর জন্য স্বয়ং ক্যা*ন্সারের ভূমিকা পালন করে সেটা জানেন? আমি,আপনি, আমরা যদি বিরো*ধিতা শুরু করি তাহলে শেষ হবে না। মোট কথা, মানুষ সঠিক না হলে সবকিছুই ভুল।”
” আপনি আমার জন্য কতটুকু সঠিক?”

বেলা ফারাজের কথার অর্থটা আন্দাজ করতে পারে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সেখান থেকে চলে আসবে এমন সময় ফারাজ আবার বলে ওঠে,” বললেন না তো?”

বেলা থেমে যায়। পিছনে ঘুরে বলে,” আপনার হয়তো আমার সামনে আসা উচিৎ না। নারী যেকোনো পুরুষের তাকানো দেখেও বুঝতে পারে সে কী বলতে চাইছে। আমি যতটুকু বুঝেছি, ততটুকু বুঝে মনে হচ্ছে আমার সামনে আপনার আসা উচিৎ না।”
” বুঝেও তাহলে কেন নিষেধ করছেন? আপনি একটা পুরুষের মনের শান্তি চান না?”
” আপনাকে মাথায় রাখতে হবে আমি ডিভোর্সি। আমার পাঁচ বছরের সংসার ছিল।”
” আমি কাপুরষ নই।”
” মানে?”
” ভালোবাসব, হৃদয় পো*ড়াবো আর অতীত ভেবে পিছিয়ে যাব? এমন কাপুরষ আমি নই।”
” আমি আস্ত একটা বিষের শিশি, হাত থেকে মেঝেতে পড়লে ভেঙে গুড়িয়ে যাব, ভেঙে ফেলা মানুষের গতি থামিয়ে দেব। ভালোবেসে কেউ গ্রহণ করলে বিষের মতো শিরা উপশিরায় পৌঁছে মৃ*ত্যু ঘটাবো।”

বেলা আর দাঁড়াল না। ছাদ থেকে নেমে সোজা নিজের রুমে চলে আসে। এতদিন একা একটু সময় পার করার জন্য ছাদে যেত সে। আজকের মতো ঘটনা যদি প্রতিদিন ঘটতে থাকে তবে শুধু ছাদ নয় এই বাসাটা চেঞ্জ করতে হবে। জীবনে দ্বিতীয় পুরুষের আগমন সুখকর হয় না।

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে