মেঘের বাড়ি পর্ব-১৫

0
659

#মেঘের বাড়ি☁
#পর্ব-১৫
#লেখনীতে_ফারহানা_আক্তার_ছবি
.
.
দু’দিন পর সন্ধ্যার দিকে চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেয়ে মেঘের ঘুম ভেঙে যায়৷ উঠে ধীরে সুস্থে বারান্দায় আসতেই মেঘ হতবাক হয়ে যায়৷ মেঘ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে৷ তাদের গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে ইয়ামিন মির্জা যে কিনা এক সময় তাকে বিরক্ত করতো৷ সে আর তার পরিবার৷ মেঘ বুঝতে পারছে কিছু একটা গন্ডগোল নির্ঘাত হয়েছে৷ নাহলে তার ঠান্ডা মাথার সেজভাই এভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ইয়ামিন আর তার পরিবারের সাথে কথা বলতো না৷

” সেজভাই ছোটভাই কি হয়েছে তোমরা চেঁচামেচি করছো কেন? আর ওনারা বা এখন এখানে কেন?”

সেজভাই আবদুল্লাহ মেঘ কে এখানে আসতে দেখে রাগি গলায় বললো,” মেঘ অসুস্থ শরীর নিয়ে এখানে কেন এসেছিস ভেতরে যা৷”

মেঘ আর কোন প্রশ্ন না করে সেজভাইয়ের কথা মত ভেতরে যেতে নিলে ইয়ামিনের মা নাজরিন বেগম মেঘের হাত ধরে বলে,” বাহ আমার পোলার দেখি পছন্দ আছে৷ কি সুন্দর মাইয়া এককালে চান্দের লাহান৷” মেঘ হতবিহ্বল হয়ে নাজরিন বেগমের কথা শুনে বলে ,” মানে! কি বলছেন এই সব আপনি?”

মেঘ তার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাতে দেখে৷ রক্ত চক্ষু দিয়ে নাজরিন বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে৷ অবস্থার বেগতিক হতে দেখে সুর্বনা আর তনয়া এসে মহিলার হাত থেকে মেঘ কে ছাড়িয়ে ভেতরে নিয়ে চলে যায়৷ এদিকে সোহাগ রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ,” আপনাদের কত বার বলবো আমরা আমাদের বোন কে এখন বিয়ে দিবো না৷ আপনাদের কানে কী কোন সমস্যা আছে? বাংলা কথা বুঝতে পারেন না?” সোহাগের কথা শুনে চেয়ারম্যান ইমান মির্জা কিছু বলার আগে ইয়ামিন বলে ওঠে,” দেখেন ভাই আমি মেঘকে পছন্দ করি৷ ওর আগে একটা বিয়া হয়ছে তাতে আমার কোন সমস্যা নাই আর না ওর সন্তানকে নিয়ে৷ আমি দুজনকেই চাই৷ আপনারা দয়া করে না বলবেন না৷ আমি মেঘকে বিয়ে করবো৷” ইয়ামিনের প্রত্যেকটা কথা মেঘ শুনতে পায়৷ রাগে তেরে ইয়ামিনের সামনে দাড়িয়ে বলে,” কি বললি তুই? আমাকে বিয়ে করবি?” আচমকা মেঘ সামনে আসতে ঘাবড়ে যায় ইয়ামিন৷ তোতলাতে তোতলাতে বলে,” আমি তোমাকে ভালোবাসি মেঘ৷ তোমার সন্তানকে আমি নিজের সন্তানের মত মানুষ করবো৷ শুধু তুমি বিয়েতে রাজি হয়ে যাও৷”

মেঘ আর রাগ সামলাতে পারলো না চিৎকার করে সোহাগকে বললো,” ছোটভাই এই কু*ত্তার বাচ্চাটাকে ঘর থেকে বের করো৷ নয়তো আমি একে কিছু একটা করে বসবো৷”

মেঘের কথা আর রাগ দেখে চেয়ারম্যান ইমান বলে ওঠে ,” এই মাইয়া মুখ সামলাইয়া কথা কও৷ ভুইলা যাইও না আমি এ গ্রামের চেয়ারম্যান আর ইয়ামিন আমার পোলা৷”

মেঘ চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে বললো,” আপনি এই মুহূর্তে আপনার ছেলে পরিবার নিয়ে আমার বাড়ি থেকে বার হোন নয়তো এবার আমি লোক ডাকবো আর আপনার ছেলের কু*কর্ম গুলো সবার সামনে ফাঁস করবো৷”

ইয়ামিন সহ তার বার বাবা ইমান একটু ঘাবড়ে যায়৷ কারণ ইয়ামিনের চরিত্র যে খুব একটা ভালো না সেটা তিনি ভালো করেই জানে৷ ইমান মেঘের ভাইদের সামনে দাড়িয়ে বলে,” আবদুল্লাহ সোহাগ আমি মেঘের নামে দুই বিঘা জমি লেখে দিমু৷ মাইয়াডারে আমার পোলার লগে বিয়া দেও৷”

সোহাগ হাত শক্ত করে মুষ্ঠি বদ্ধ করে রাখলো৷ রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না তখনি আবদুল্লাহ বলে উঠলো,” আপনি এই মুহূর্তে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যান চাচা নয়তো আমি বা আমার ভাই আপনার সন্মান রাখতে পারবো না৷” ইয়ামিন মেঘের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে ইশারায় বোঝালো,” তোকে তো আমি বিয়ে করবোই নয়তো আমার নাম ইয়ামিন মির্জা না৷”

আর কেউ দাড়ালো না তারা যেতে নিলে সুবর্না তাদের থামিয়ে তাদের আনা ফল মিষ্টির প্যাকেট তাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,” এবার আপনারা যেতে পারেন৷” ইয়ামিন সহ তার পুরো পরিবার অপমানিত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল৷

২৯.
রাগে পাইচারি করছে মেঘ৷ চেয়ারম্যানের ছেলে ইয়ামিন পথে ঘাটে মেয়েদের বিরক্ত করে বেড়ায়৷ নেশাখোর ছেলে ইয়ামিন৷ কয়েকবার মেঘকে প্রেমের প্রস্তাব দিলে মেঘ বরাবর না বলে দেয়৷ ইয়ামিন মেঘের থেকে পাত্তা না পেয়ে বিরক্ত করতো প্রচুর তবে তার বাবার কাছে নালিশ করতে কিছুদিন বিরক্ত করা কমিয়ে দেয়৷ তারপর পর মেঘ জানতে পারে তাদের পাশের বাড়ি সাজিয়ার সাথে ইয়ামিনের সম্পর্ক হয়৷ তারা এক সাথে রাত ও কাটায়৷ তাতে মেঘের কিছু এসে যায় না কিন্তু যেখানে ওকে নিয়ে টানাটানি করবে তাকে মেঘ ছেড়ে দিবে না৷ শেফালী বেগম বাড়ি না থাকায় তিনি কিছু জানতেন না৷ বাড়ি আসার পর পরই জানতে পারে৷ সবটা শুনে তিনিও খুব রেগে যান৷ রাতে মেঘ খেতে না চাইলে শেফালী বেগম নিজে এসে মেঘকে খাইয়ে দেয়৷

অন্যদিকে সোহেল কাজ ঠিকমত করলেও খাওয়া দাওয়ায় একদম অনিয়মিত৷ মনি একা কতদিক সামলাবে? সাথী তার ছেলে মেয়ে স্বামীকে নিয়ে খুলনা চলে গেছে৷ এখানে যে পুলিশ তাদের খুজঁছে ধরতে পারলে জেল৷ সেই ভয়ে খুলনা চলে গেলো৷ মনি একা হাতে কতদিক সামলাবে৷ মিলা আর আখির ছেলে মেয়ে তারপর নিজের তিন ছেলে মেয়ে , তিন বেলা রান্না, ঘর সামলানো , গরুর জন্য খড় কাটা একা হাতে কত দিক সামলাবে? মনি সবুজকে বলবে কিন্তু সবুজ তার নতুন দোকানে থাকে৷ এমাসে বাজারে মুদির দোকান দিয়েছে সবুজ৷ সোহেলই তাকে সাহায্য করেছে দোকান দিতে৷ প্রায় তিন লক্ষ টাকার মাল কিনে দেয় সোহেল৷ আর সোহেল হাস মুরগি গরু ছাগলের খামার দেখা শুনা করে৷

রাতে সবুজ বাড়ি আসলে রাতের খাবার খাওয়ার সময় মনি তার স্বামী আর ভাসুর কে বলতে লাগলো,” ভাইজান আপনাদের সাথে আমার কিছু কথা আছিলো৷”

” কি কথা মনি?” খেতে খেতে সবুজ জ্বিজ্ঞাসা করলো৷

” আসলে আমি একা হাতে এত কাজ করে উঠতে পারছি না৷ তাই বলছিলাম যে একজন কাজের লোক রাখলে হতো না যে আমার হাতে হাতে কাজ গুলা কইরা দিবো?”

” হ্যাঁ বউমা আমিও এই কথাটা ভাবছিলাম৷ আগে তোমার বড়ভাবি ছিলো হাতে হাতে কাজ গুলো এগিয়ে দিতো কিন্তু এখন তো সে নেই৷” বলতে বলতে মন খারাপ করে ফেলে সোহেল৷

সবুজ তার ভাইয়ের মন খারাপ হতে দেখে বললো,” চিন্তা করো না ভাইজান আমি কালকে আইরামের মাকে পাঠায় দিমু৷ উনারে দেখি অনেক বাড়িতে কাম করে৷”

” সেটাই কর৷ তাহলে বউমার একজন হেল্পিংহ্যান্ড পাবো৷”

” হেল হেলপিংহ্যান্ড মানে কী ভাইজান?” মনিকে প্রশ্ন করতে দেখে সবুজ বলে,” এই তোমার কাম নাই যাও দেখো গিয়া পোলামাইয়ারা ঘুমায়ছে কীনা৷ আমার ভাইজানের লগে কথা আছে৷”

মনি ভেঙচি কেটে চলে যাওয়ার পর সবুজ বলে,” ভাইজান বড় আপা ছোট আপার পোলাপান গুলা তাগোরে দেখতে চায় বার বার৷ কী করমু আমি৷ কেমনে ওগোরে বুঝাই ওদের বাপ মা আসতে পারবো না?”

” পাপ না করলে আজ তারা মুক্ত থাকতো তাই না সবুজ?”

” হ ভাইজান৷ তাগো পাপের ফল তাগো সাথে সাথে পোলা মাইয়া গুলাও ভুগতাছে৷ মনি একা সবাইকে সামলাতে পারতাছে না ভাইজান৷ আচ্ছা ভাইজান এখন তো মা বাবা আপারা নাই এখন তো ভাবির কোন সমস্যা হওয়ার কথা না৷ তুমি দেহো ভাবিরে ফিরায় আনা যায় কীনা?”

সবুজের কথা শুনে সোহেলের চোখ গুলো খুশিতে চকচক করে উঠলো৷ মেঘকে আর একবার নিজের করে পাওয়ার তিব্র ইচ্ছে গুলো যেন ভাইয়ের কথা শুনে ডানা মেলতে চাইছে৷ সোহেল মনে মনে ভাবছে সত্যি তো এখন তো আর এমন কেউ নেই যে মেঘের ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তাহলে মেঘ কেন ফিরে আসবে না?”

_______________

পরেরদিন সকালে মেঘ উঠানে বসে আচার খাচ্ছিলো৷ হঠাৎ রাস্তার দিকে চোখ পড়তে দেখে ইয়ামিন তার চামচা নিয়ে দাড়িয়ে আছে৷ মেঘ তাদের দেখে ওঠানে আর বসলো না ঘরের ভেতরে চলে গেলো৷ সোহাগ বাজার থেকে ফিরে এসে ইয়ামিন কে বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ রেগে যায় সোহাগ৷ ইয়ামিনের কাছে গিয়ে বলে,” ইয়ামিন এখানটা কী আড্ডা দেওয়ার জায়গা?”

“না সোহাগ ভাই আসলে আমি মেঘ কে দেখতে আসছিলাম৷”

সোহাগের হাতে বাজারের ব্যাগ থাকায়৷ সোহাগ ইয়ামিনকে বলে,” ইয়ামিন আমি বাজারের ব্যাগ রেখে আসছি যাস্ট দুই মিনিট তোরা কিন্তু কোথাও যাবি না৷” এই বলে সোহাগ তার বাড়িতে ঢুকতে ইয়ামিন তার দলবল নিয়ে দৌরে এলাকা ছাড়া হয়৷ সোহাগ আর তার রাগকে ইয়ামিন ভালো করেই চিনে ওখানে আর এক মিনিট দাড়ালে তাহলে তাদের কে আর বাড়ি ফিরতে হতো না সোজা হাসপাতালে পৌছে দিতো৷

সোহাগ মোটা লাঠি হাতে ফিরে এসে ইয়ামিন আর তার দলবল দেখতে না পেয়ে বুঝতে পারে তারা পালিয়েছে৷

কয়েকদিন বেশ ভালো ভাবেই কেটে যায়৷ মেজভাই, ভাবি, আর সেজভাই ফিরে যায় ঢাকা৷ আর বাড়ি শেফালী বেগম , নুর, মেঘ সোহাগ আর সুর্বনা থেকে যায়৷

দুইমাস সুন্দর ভাবেই কাটতে থাকে তবে মাঝে মাঝে সোহেলকে ভীষণ রকমের মনে পড়ে মেঘের৷ তবে মেঘ খুব ভালো করেই নিজেকে সামলে নিয়েছে৷ ছোট বেলা থেকেই সেলাই মেশিনের কাজ দূর্দান্ত৷ বড় বোনের মেয়ে আলিয়ার ছোট থেকে সব ড্রেস মেঘই বানিয়ে দিতো৷ মেঘ আর সময় নষ্ট করলো না৷ ড্রেস বানানোর কাজ আবারও শুরু করলো৷ মেঘের হাতের কাজও দারুণ নকশী কাঁথা, জামায় পুথি বা ডিজাইন করা সব রকম কাজই পারে৷ আশে পাশে মহিলারা তেমন সেলাই মেশিনের কাজ ভালো না জানায় মেঘের কাছে ড্রেস বানাতে আসতো৷ মেঘের হাত কখনো ফাঁকা থাকতো না৷ সংসারে ভাইদের ঘাড়ের উপর বসে খাচ্ছে এটা না কেউ বলতে পারে তাই মেঘ সংসারে টাকা দেয়৷ তবে মেঘের ভাইয়েরা সে টাকা নিতে বারণ করে দিয়েছে৷ তবে মেঘ জোড় করে টাকা তার ভাবির হাতে দিয়ে দেয়৷ সুর্বনা সে টাকা আবার মেঘের ড্রয়ারে রেখে দিতো৷

মেঘের পেট আগের থেকে অনেকটা বড় হওয়ায় হাটা চলা করতে কষ্ট হতো৷ নিচু হয়েও কাজ করতে পারতো না৷ তবে নুর আর সুর্বনা নিজেদের বাচ্চার মত মেঘকে ট্রিট করেছে৷ বিন্দুমাত্র কষ্ট পেতে হয়নি মেঘের৷

অন্যদিকে সোহেল মেঘের স্মৃতির তাড়নায় পারছে না থাকতে৷ এক ছুটে মেঘের কাছে যেতে মন চাইছে৷ কয়েকমাস ধরে সবুজ তার ভাইয়ের কষ্ট গুলো দেখে যেন নিজেও আর সহ্য করতে পারছে না তাই সির্ধান্ত নিলো সে তার ভাইকে আবারও বিয়ে করাবে৷
.
.
#চলবে………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে