মেঘের বাড়ি পর্ব-১৩

0
630

#মেঘের বাড়ি☁
#পর্ব-১৩
#লেখনীতে_ফারহানা_আক্তার_ছবি
.
.
তিনদিন পর পুলিশ আখি আর মিলার জামাইকে একসাথে জুয়া খেলার সময় এরেস্ট করে৷ কথাটা বাড়িতে পৌছানো মাত্র আখি মিলা কান্নায় ভেঙে পড়ে৷ জায়েদা কী করবে না করবে ভেবে না পেয়ে থানায় যাবে বলে মনস্থির করে কিন্তু পরক্ষণে সে চিন্তা বাদ দেয় কারণ একবার থানায় গেলে তাদের আর ফিরতে হবে না৷ তাদেরকেও আটক করবে৷ তাই তারা উকিল খোঁজার জন্য সাথীর জামাইকে বললে তিনি সোজা না বলে দেয়৷ কারণ তাকেও পুলিশ খুঁজছে৷ একবার খুঁজে পেলে বাকি দুই জামাইয়ের মত তাকেও জেলে ঢুকতে হবে৷

জায়েদা চিন্তায় পড়ে গেলো৷ আর তার দুই মেয়ে মরা কান্না জুড়ে দিলো৷

সবুজ তার বাড়িতে রয়েছে৷ বাড়িতে কেউ না থাকায় গরু, ছাগল, হাস মুরগির দেখা শোনা তাকেই করতে হচ্ছে৷ পুলিশ যখন এসেছিলো তখন সবুজ গরুকে নিয়ে মাঠে গিয়ে ছিলো বিধায় তখন কিছু জানতে পারেনি তবে পরে মাতব্বর চাচা এসে তাকে সবটা জানায়৷ সব শুনে সবুজ চুপচাপ নিজের বাসায় চলে আসে৷ তবে ভুল করেও বাবা মায়ের খোঁজ একবারও নেয় নি সবুজ৷ বরং মনির সাথে ফোনে কথা বলতো খোঁজ খবর নিতো৷ আর কেস যেহেতু সবুজ মনিকে বাদ দিয়ে বাকিদের নামে হয়েছে তাই তারা নিশ্চিন্তে রইল৷

কেটে গেলো দুইদিন৷ মেঘকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে ৷ মেজভাই এবং সেজভাইয়ের বউরা মেঘ কে ধরে তার রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ে মেজভাইয়ের স্ত্রী তনয়া বলে,” মেঘ এখন একটু বিশ্রাম নেও আমি তোমার জন্য গরম গরম ভাত আর ইলিশ মাছ ভাজা নিয়ে আসছি৷”

মেঘ তার দুই ভাবির হাত ধরে বলে,” পরে খাবো এখন বলো তোমরা কেমন আছো?”

” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি৷ কিন্তু তোমার জন্য সবাই চিন্তিত৷ তবে তুমি চিন্তা করো না আল্লাহ আছে আর আমরাও আছি ৷”

” তোমরাই তো আমার ভরশা ভাবি৷”

সেজভাইয়ের বউ সুবর্না বলে ওঠে,” মেঘ এখন আর কথা বলো না মেজভাবি তুমি খাবার নিয়ে আসো৷ মেঘ খেয়ে একটু ঘুমাক৷ সন্ধ্যায় না হয় ভাবি ননদ মিলে আড্ডা দিবো৷”

” হুম ঠিক বলেছো সুবর্না আমি এখনি যাচ্ছি৷” মেঘ মনে মনে তার পরিবারকে নিয়ে বেশ গর্ব হয়৷ এমন পরিবার তেমন কোথাও দেখা যায় না৷ যেখানে পাঁচ ভাই তিন বোন মিলে মিশে থাকে৷ ভাইদের বউরা কখনো নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ করে না৷ মিলে মিশে থাকে৷ আর ননদের কে নিজের বোনের মত করে দেখে৷ কত আদর করে৷ সুবর্না মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,” চিন্তা করো না বোন আল্লাহ সব ঠিক করে দিবে৷ শুধু একটু ধর্য্য ধরো৷ ”

” তাই যেন হয় ভাবি৷”

তনয়া খাবার এনে নিজের হাতে মেঘকে খাইয়ে দিয়ে ঔষধ খাইয়ে চলে আসে৷ ঔষধের ভেতর ঘুমের ঔষধ থাকায় মেঘ ঘুমিয়ে পড়ে৷ অন্যদিকে মেঘের ভাইয়েরা খাবার খেয়ে তাদের মা, বউ আর ভাইয়েরা মিলে আলোচনা করে এর পরের পদক্ষেপ তারা কী নিবে৷ মেঘের শশুড়বাড়ির সবাইকে যে জেলে পাঠাতেই হবে এতে তারা একমত আর সোহেলের সাথে ডিভোর্সের বিষয়টা তারা মেঘের উপর ছেড়ে দিয়েছে৷ আপাতত সবাইকে চুপ থাকতে বলা হয়েছে কারণ মেঘ নিজে থেকে যে সীধার্ন্ত নিবে তাই হবে৷

২৬.
মেঘ কে বাসায় নিয়ে আসার পর কয়েক দিনে মেঘ খানিকটা সুস্থ হয়ে যায়৷ হাটাচলা করা টুকটাক কাজ করতে পারে তবে নুর, সুবর্না,তনয়া, কেউ মেঘকে কাজ করতে দেয় না৷ তারা মেঘকে খুবই যত্ন করে৷

এদিকে মেঘ যে তার শশুড়বাড়ির সবাই এর নামে কেস করেছে এবং খুব শীগ্রই ডিভোর্স ও হয়ে যাবে কথাটা কী ভাবে যেন প্রতিবেশিরা জেনে যায়৷ প্রত্যেকদিন কেউ না কেউ এসে শেফালী বেগম কে এটা সেটা জ্বিজ্ঞাসা করে খোঁচা মেরে কথা বলে৷ যে ছয় মাস পাড় হতে না হতে কেস ডিভোর্স হওয়ার কারণ কী খালী নির্যা*তন নাকী স্বামী পর*কিয়া করে? উৎভট কথা বলতে থাকে৷ মেঘের সেজভাবি মুখের উপর সত্যি কথা বলতে কখনো ভয় পায় না আর না এর কথা ওর কাছে বলতে পছন্দ করে৷ কিন্তু দিনকে দিন তার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়৷ কয়েকজন পাড়া প্রতিবেশী আবারও মেঘকে নিয়ে বাজে কিছু বলতে নিলে সুবর্না সেখানে এসে হাজির হয়ে বলে,” আপনাদের চা নাস্তা হয়ে গেলে আপনারা আসতে পারেন৷”

প্রতিবেশীদের মধ্যে একজন বলে উঠলো,” সেজ বউ এগুলা কী কইতাছো? আমরা কী খালি নাস্তা খাওনের লিগ্গা আসি?”

” শুনেন খালাম্মা আপনারা কী কারণে এবাড়িতে আসেন তা আমার ভালো করেই জানা আছে৷ আপনারা হলেন এক প্রজাতির মানুষ জারা নিজের খেয়ে বনের মহিস তাড়ায়৷ কী বুঝলেন না? বুঝিয়ে বলছি আপনারা এখানে দলবদ্ধ হয়ে আসে মেঘের দোষ গুন খুঁজে মসলা দিয়ে বানিয়ে ছড়িয়ে দিতে৷ আর আসেন শুধু কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিয়ে কিন্তু কেন বলতে পারেন?”

” শেফালী তোমার বউ কিন্তু আমাগো অপমান করতাছে৷” প্রতিবেশির কথা শুনে শেফালী বেগম সুবর্নাকে ধমক দিয়ে বলে,” বউ কি করতাছো ওনারা তোমার গুরুজন৷”

” আম্মু আপনি ভেতরে যান৷ আর কাদের গুরুজন বলছেন এদের? (হাতের ইশারায় সুবর্না প্রতিবেশীদের দেখিয়ে বললো) আম্মু এরা যদি সত্যি গুরুজন হতো তাহলে প্রতিদিন এখানে এসে মেঘের সম্পর্কে উল্টাপাল্টা কথা বলতো না৷ আর কিছু না পারলেও সান্তনামূলক কিছু কথা বলতো৷ কিন্তু না তারা তো মজা নিতে আসে৷ আমরা কী করছি না করছি তা সবাই কে জানাতে হবে না? আর আপনাদের বলছি নেক্সট টাইম আপনাদের যেন আমার শশুড়বাড়ির আশে পাশে যেন না দেখি৷ ”

অপমানে থমথমে মুখ নিয়ে প্রতিবেশী মহিলা গুলো শেফালী বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,” এভাবে ছেলে বউকে দিয়ে অপমান না করালেও পারতে৷” বলেই গট গট করে হেটে চলে গেলো৷

শেফালী বেগম তার ছেলের বউকে কিছু বলতে গিয়েও বললো না৷ কারণ সুবর্নার প্রত্যেকটা কথা ঠিক৷ সুবর্না তার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,” আম্মু এখন কী আপনি আমাকে বকা দিবেন?” বাচ্চাদের মত করে বললো সুবর্না তা দেখে শেফালী বেগম বলেন,” হ্যাঁ বলবো তুমি যা করেছো তা একদম ঠিক ৷ এই কয়দিন দাঁতে দাঁত চেপে এদের বাজে কথা সহ্য করে গেছি কিছু বলতে পারি নি৷”

” তাহলে তখন কেন ধমক দিলেন?”

” বোকা মেয়ে তখন একটু ধমক না দিলে বলতো৷ দেখছো দেখছো শেফালী এখন তার বউগো ভয় পায়৷ ভয়ে ধমকও দেয় না৷” সুবর্না হেসে দিলো তার শাশুড়ির কথা শুনে৷

” অনেক হাসাহাসি হলো এখন রান্না ঘরে চলো পোলা মাইয়া নাতি নাতনীদের জন্য নাস্তা বানানো লাগবো৷ মাগরিবের নামাজ পড়ে এসেই আবদুল্লাহ খাবার চাইবে৷”

” আম্মা আজকে কিছু বানাতে হবে না শুধু চা বানালে হবে৷”

” কেন?”

” মেঘ যে চাইনিজ খাবার পছন্দ করে৷ তাই আজ আপনার ছেলেরা চাইনিজ খাবার নিয়ে আসবে৷”

” কী দরকার বউ এত টাকা খরচ করার?”

” কী যে বলেন আম্মু এতে টাকা নষ্ট করার কথা আসছে কেন? টাকা কেন আয় করে আপনার ছেলেরা বলুন তো?”

” এটা কেমন প্রশ্ন বউ?”

” দেখেন আম্মু টাকা আজ আছে কাল নেই৷ তাই ইচ্ছে গুলো পূরণ করা দরকার কে বলতে পারে হয়তো ভবিষ্যৎ ইচ্ছে শখ পূরণ নাও হতে পারে আবার পূরণ হতেও পারে৷”

” আল্লাহ তোমার সাথে কথা পারবো না বউ৷ আচ্ছা ভেতরে চলো মাহাদী কী করছে দেখে আসি৷”

” চলুন আম্মু৷”

মেঘের সাথে তার পরিবারের কয়েকদিন ভিষণ সুন্দর ভাবে কেটে গেলো৷ এর ভেতর খবর পেলো সোহেলের পুরো পরিবারকে পুলিশ এরেস্ট করেছে৷ শুধু মাত্র সবুজ আর মনিকে বাদ দিয়ে৷ সোহেল সবটা জানার পর রেগে মেঘকে কয়েকবার কল করে কিন্তু মেঘ বাহিরের নাম্বার দেখে কল আর রিসিভ করে না৷

এদিকে সোহেলের চাচা উকিল ঠিক করে সোহেলের বাবা মায়ের জামিন ধরতে চাইলে কোট রিজেক্ট করে দেয়৷ কোর্টে কয়েকদিন পর কেসটা উঠবে৷ সোহেল আর পারলো না বাহিরে পড়ে থাকতে৷ চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ কোর্টে কেস ওঠার আগেই তাকে দেশে ফিরতে হবে৷

মেঘের সাথে মনির যোগাযোগ আছে৷ মনি দুদিন পর পর মেঘকে কল দিয়ে তার খবর নেয়৷ মেঘ মনির কাছেই জানতে পারে সোহেলের দেশে ফিরে আসার কথা৷ মেঘ বিষয়টা তার ভাইদের জানায়৷ তারা উকিলের সাথে কথা ডিভোর্সের কাগজ পত্র তৈরী করে ফেলে৷

সপ্তাহ খানিকের মাঝে সোহেল দেশে ফিরে আসে৷ সবুজ তার বড় ভাইয়ের সাথে কোন রুপ বাক্যলাপ না করে ইগনোর করতে থাকে৷ ততদিনে মনিও তার বাচ্চাদের নিয়ে ফিরে আসে৷ মনি বা তার বাচ্চারা কেউ সোহেলের কাছে যায় না৷ সোহেল বেশ অবাক হয় তার ভাই আর তার স্ত্রীকে দেখে৷ হঠাৎ তাদের এমন পরিবর্তণ চোখে পড়ার মত৷ দুপুরে খাবার খাওয়ার সময় সোহেল সবুজের সাথে কেসের বিষয় কথা বলতে গেলে সবুজ বলে,” ভাইজান এই বিষয়ে আমাকে জড়াবেন না৷”

” মানে কী বলছিস সবুজ? মা বাবা বোন জামাই জেলে আর তারপরও তুই এই কথা বলছিস কী করে?”

” শোন ভাইয়া তারা তাদের কর্ম দোষের ফলে আজ হাজতে৷ ভাবির উপর যদি এমন নির্মম অ*ত্যা*চা*র মে*রে ফেলার চেষ্টা না করতো তাহলে হয়তো তাদের জেলে যাওয়ার কোন প্রয়োজন পড়তো না৷”

সোহেল তার ভাইয়ের কথা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখে তার ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে৷ সে কি ভুল শুনছে না কী ঠিক শুনছে৷ সোহেল কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,” কী বলছিস সবুজ? এগুলো সত্যি?” পাশ থেকে মনি বলে উঠলো,” জ্বী ভাইজান আপনার ভাই আপনারে যা বলছে তা সত্যি বলছে৷ ভাবিরে হাসপাতালে যাইতে সাহায্য করতে চাইলে আপনার আম্মা আর আপনার বইনেরা আমারেও মারতে বাকি রাখে নাই৷ দেহেন না আমার চোখের নিচ টা এখনো কালসিটে হয়ে আছে৷”

সোহেল মনির দিকে ভালো করে তাকাতে দেখে সত্যি মনির চোখের নিচে আঘাতের চিহ্ন বিদ্যমান৷ সোহেলের গলা দিয়ে ভাত আর নামলো না৷ হাত ধুয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো৷

অন্যদিকে মেঘ ডিভোর্সের পেপারসে সাইন করে দেয়৷ সোহাগ তার বন্ধুদের নিয়ে সোহেলের বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে৷ সন্ধ্যা নাগাত তারা বাড়ি পৌছে সোহেলকে দেখে গরুকে খর কেটে দিচ্ছে৷ সোহেল হঠাৎ সোহাগ কে দেখে অবাক হলো সোহেল উঠে তাদের দিকে যেতে লাগলো ৷ সোহেল তাদের ভেতরে ঢুকে বসতে বললে সোহাগ বলে,” কোন খুনির বাড়িতে আমরা বসতে আসি নি৷ আমরা এসেছি কাজে৷” সোহাগ এনভেলাপ সোহেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে আর মাত্র কয়েক মাস বাকি সোহেল৷ তারপর তোদের ডিভোর্স হয়ে যাবে৷ এটাতে মেঘের সাইন করা ডির্ভোস পেপারস আছে৷ সাইন করে রাখবি৷ সময় মত আমি এসে নিয়ে যাবো৷ আর বাকি কথা কোর্টে হবে৷ ” এতটুকু বলেই সোহাগ আর তার বন্ধুরা চলে গেলো৷ এতক্ষণ দুরে দাড়িয়ে মনি সবটাই দেখলো৷ হঠাৎ সোহেলকে মাটিতে বসে পড়তে দেখে মনি সোহেলের কাছে এসে বলে,” জানেন তো ভাইজান মোরা এমন মানুষ যে দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য দি না৷ আর যখহ সে দাঁত থাকে না তহন আমরা এর মূল্য বুঝতে পারি৷ আর আমনেও বুঝবেন আমনে কী ভুল করেছেন৷ পস্তায়বেন ভাইজান পস্তায়বেন৷”

২৭.
আগামীকাল মেঘের কেসটা কোর্টে উঠবে৷ মেঘের উকিলের সব রকম প্রস্তুতি নেওয়া শেষ৷ এখন শুধু আগামীকাল আসার পালা৷ উত্তেজনায় মেঘের ঘুম উড়ে গেছে যেন৷ তবুও ঘুমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ অন্যদিকে সোহেলের চোখে ঘুম নেই আগামীকাল কোর্টে কী হবে সেই চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে৷

পরেরদিন……….
.
.
.
#চলবে……………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে