#মেঘের বাড়ি☁
#পর্ব-০৯
#লেখনীতে_ফারহানা_আক্তার_ছবি
.
.
মেঘ দুপুরের রান্না শেষ করে পুকুর পাড়ের সিড়িতে পা রাখতেই হঠাৎ পা পিচলে পুকুরে পড়ে যায়৷ মেঘ সাতার না জানায় পানিতে হাবুডুবু খেতে লাগলো আর গাছের আড়ালে দাড়িয়ে মা মেয়ে সেটা দেখছে আর হাসছে৷ হঠাৎ করে তখনি হুট করে মনি দৌড়ে এসে পুকুরে ঝাঁপ মারে৷ মেঘের অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ার আগেই মনি মেঘকে পানি থেকে টেনে তুলে৷
” ভাবি ঠিক আছো? কথা কও? ও আম্মা আপনে কই দেহেন সর্বনাশ হইয়া গেল৷” মনির চিৎকার শুনে সবুজ দৌড়ে এসে মেঘকে অজ্ঞান দেখে মনিকে বলে,” কী হয়ছে ভাবির?”
” আমি ভাবিরে ডাকতে আইসা দেখি ভাবি পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে৷ আমি তাড়াতাড়ি পুকুরে নেমে ভাবিরে তুলে আনছি৷ কিন্তু ভাবি তো এহনো চোখ মেইলা তাকালো না৷”
” সর আমি দেখতাছি৷” মনি সরার আগে শুকনো গামছা দিয়ে মেঘের ভেজা শরীর ঢেকে দিয়ে সরে যায়৷ সবুজ মেঘের গালে আস্তে করে কয়েকটা থাপ্পর মেরে ডাকতে লাগলো ভাগ্য ভালো ছিলো বিধায় মেঘের জ্ঞান ফিরে আসে৷
আড়ালে দাড়িয়ে সব দেখছিলো মা মেয়ে কিন্তু মেঘের জ্ঞান ফিরে আসতে দেখে বুঝতে পারলো তাদের প্লান কাজ করে নি৷
” আম্মা তোমার ছোট পোলার বউয়ের জন্য আইজা বড় বউ বাইচা গেল৷”
” কৈ মাছের জান এত সহজে যাইবো না আর এই জায়েদা এত সহজে মানবো না৷”
১৮.
মনি নিজের হাতে মেঘকে খাবার খাইয়ে দিয়ে চলে গেল৷ মেঘের এখনো সেই ঘটনা ভাবতেই পুরো শরীর শিউরে উঠছে৷ পুকুর ঘাটে কেউ কেন সাবান মেখে রাখবে এটাই বুঝতে পারছে না মেঘ৷ এটা কি শুধুই সামান্য ঘটনা নাকি কারোর ষরযন্ত্র!
মেঘের সাথে এত বড় ঘটনা ঘটে গেলো অথচ তার শাশুড়ি বা ননদরা কেউ একটি বারের জন্যও খোঁজ নিতে আসেনি৷ তার শশুর আর দেবর এসে ছিলো খোঁজ নিতে তা ছাড়া আর কেউ আসে নি৷ মেঘ তেমন কিছু না ভেবেই ঘুমিয়ে পড়ে৷
সন্ধ্যায় শাশুড়ির গলার আওয়াজ শুনে মেঘের ঘুম ভেঙে যায়৷ মেঘ ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ বসে রইল৷ হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে যাওয়ায় মেঘের শরীর যেন কাঁপছে ৷ মেঘ ধীরে ধীরে রুম থেকে বের হয়ে শাশুড়ির রুমের সামনে যেতে শুনতে পেলো৷
” আল্লাহ কপাল কইরা এব বউ পাইছি৷ পোয়াতি হওনের পর দিয়া শুইয়া বইয়া কাটায়৷ আমরাও তো পোয়াতি হয়ছি কই আমরা তো কাম করা বন্ধ করি নাই৷ আর দুপুরে শুরু করছে আর এক নাটক৷ গ্রামের মাইয়া সাতার জানে না? এইডাও বিশ্বাস করন লাগবো?”
” আম্মা ভাবি মনে হয় নাটক করতাছে বুঝছো৷”(আখি)
” তা নয়তো কী? নাটক ছাড়া বড় ভাবি আর কী করতে পারে?”(মিলা)
” দেখ নীলা ভাবির সম্পর্কে আমরা তেমন কিছুই জানি না তাই হুদাই কথা বলিস না৷ ভাবি হুনতে পারলে কষ্ট পাইবো৷”(সাথী)
” তো আমি কী করমু? সত্য কথা কইতে মুই ডরাই না৷”
মেঘ চাইলে তার ননদ শাশুড়ী ননদকেও উচিত জবাব দিতে পারতো কিন্তু মেঘ এখন এসব ঝামেলা এরাতে চায়৷ ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে মাথা ব্যাথা করছে খুব৷ এই মুহূর্তে চায়ের খুব প্রয়োজন মেঘের৷ তাই দেরি না করে রান্না ঘরে গিয়ে নিজের জন্য এবং বাকি সবার জন্য চা বানিয়ে নিলো৷ সাথে কিছু বিস্কুট নিয়ে তার শাশুড়ির রুমে হাজির হলো৷ মেঘকে হঠাৎ চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেল৷
” আম্মা চা নিয়ে আসছি৷ গরম থাকতে থাকতে খেয়ে নিন৷ আর আখি আপা বাচ্চাদের জন্য কিছু চিপস ভাজা আছে বোয়ামে৷ আপনি একটু বার করে ওদের দিয়ে দেন৷”
আখি মুখ বাঁকিয়ে ঢং বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল৷ জায়েদা ভাবছে মেঘের কথা৷ মেয়েটাকে এত কথা বললো তবুও মেয়েটা মুখে রা কাটলো না৷ জায়েদা এই কথা ভাবতে ভাবতে গরম চাঁয়ে চুমুক দিতে তার জিব্হা পুড়ে গেল৷ মেঘ বিষয় টা বুঝতে পেরে সরিষার তৈল নিয়ে এসে বলে আম্মা দ্রুত পুড়ে যাওয়া জায়গায় তৈল লাগিয়ে দিন৷ কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বলন ভাব কমে যাবে৷
জায়েদা কিছু না ভেবেই দ্রুত মুখে তৈল লাগিয়ে নিলো৷
________
দুদিন পর শুরু হচ্ছে মাহে রমজান মাস৷ মেঘের সাথে এই দু-তিনদিন ধরে সোহেলের সাথে কথা হচ্ছে না৷ সোহেল কল দিলেই কোথায় থেকে তার শাশুড়ী এসে ফোন নিয়ে চলে যায়৷ এটা দেখে মেঘ ভিষণ কষ্ট পায়৷ পুরো দুপুর কাজ করে কিছু খেয়ে মেঘ শুতে যাবে তখনি ফোন টা বেজে ওঠে ফোন সাইলেন্ট মুডে থাকায় রিংটনের শব্দ হয় না৷ মেঘ ফোন নিয়ে দ্রুত তার চাচা শশুরের বাড়ির উঠোনে চলে৷
” হ্যালো আসসালামু আলাইকুম ৷”
” ওয়ালাইকুম আসসালাম৷ কেমন আছো বউ?”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো৷ আপনি কেমন আছেন?”
” আলহামদুলিল্লাহ৷ বউ তোমার প্রতি আমার অভিযোগ আছে৷”
” আমার প্রতি অভিযোগ! তা শুনি কী অভিযোগ?”
” এই যে গত কয়েকদিন ধরে আমার সাথে কথা বলছো না? কল দিলে মা নয়তো বোনেরা কল রিসিভ করে৷”
মেঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ,” আপনি কল দিলেই ঈগল পাখির ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে যায় আপনার বোনেরা৷ ”
সোহেল বুঝতে পারলো আসল কাহিনী৷
“সরি বউ তোমাকে ভুল বোঝার জন্য৷”
কয়েক মিনিট সোহেলের সাথে কথা বলে মেঘ বাড়িতে ফিরে দেখে তার শাশুড়ী উঠানে দাড়িয়ে আছে৷ মেঘ কে দেখে বললো,” ওই দিকে কেন গেছিলা বউ? কার লগে দেখা করতে গেছিলা?”
” কী সব বলছেন আম্মা? আমি কার সাথে দেখা করতে যাবো?”
” কার লগে আবার তোমার নাগরের লগে৷”
মেঘ এবার রাগ না সামলাতে পেরে বলে,” জ্বী আম্মা আমি আমার নাগরের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম৷ এখন আপনি চাইলে আমার নাগরের সাথে কথা বলতে পারেন৷ কী বলবেন?”
” নষ্টা মেয়ে ছেলে লজ্জা করে না আমার মুখের উপর কথা বলতে?”
” নিজের স্বামীর সাথে কথা বললে যদি আমি নষ্টা হয়ে যাই তাহলে আমি নষ্টা৷” মেঘের কথা শুনে একমিনিট লাগলো জায়েদার বুঝতে যখন বুঝলো তখন বলে উঠলো,” অসভ্য মাইয়া ধরা পইড়া এখন আমার পোলার নাম কইতাছো তাই না?”
” আপনি যা ভালো বোঝেন আর যদি বিশ্বাস না হয় আপনার ছেলেকে কল দিয়া জিজ্ঞাসা করেন৷”
মেঘ আর কথা বাড়ালো না চলে গেল ঘরে৷
১৯.
গতকাল রোজা হবে যেহেতু তাই আজ ভোর রাতে সবাই সেহেরী খাবে তাই আজ কে রান্নার আইটেমের সংখ্যা বেশি৷ ইলিশ মাছ ভাজা, মুরগির মাংস, চার রকমের সবজি, খিচড়ি, সেমাই, পুটি মাছের চরচরি৷ মনি আর মেঘ বেশ হিমসিম খাচ্ছে রান্না করতে গিয়ে৷ তবুও দুজনে মিলে প্রায় সব আইটেম রান্না করে ফেলেছে এখন শুধু সেমাই খিচুড়ি আর মাছ ভাজা করতে হবে৷
তাদের শাশুড়ী বার বার এসে তদারকি করে যাচ্ছে৷ মেঘ মনি বেশ বিরক্ত হচ্ছে তবুও চুপ করে রইল৷ দুপুর তিনটায় রান্না শেষ করে মনি আর মেঘ গোছল করে এসে সবাই কে খেতে দেয়৷
প্রায় চারটার দিকে মেঘ কোন রকম খেয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়৷ কিন্তু হঠাৎ করে মেঘের পেটে ব্যাথা শুরু হয়৷ ধীরে ধীরে ব্যাথাটা যেন বাড়ছে৷ মেঘ আর সহ্য করতে না পেরে তার শাশুড়ীকে ডাকতে লাগলো৷
” আম্মা আম্মা একটু এদিকে আসেন৷”
জায়েদা বেগম সবে মাত্র বিছানায় শুয়ে ছিলো৷ কিন্তু মেঘের চিৎকার শুনে শোয়া থেকে উঠে মেঘের রুমের দিকে এসে বলে,” কি হয়ছে বউ এমন কইরা চিল্লাইতাছো ক্যান? জানো না ঘরে জামাই আছে৷”
” আম্মা আমার পেটে খুব ব্যাথা করছে৷ আর সহ্য করতে পারছি না৷ ”
” ঢং কইরো না বউ৷ এই সময় একটু আকটু পেটে ব্যাথা হয়৷ আমি ঘুমাতে গেলাম আর চিৎকার করে ডাইকো না৷”
মেঘকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায় জায়েদা৷
মেঘ গোঙানির আওয়াজ শুনে মনি ছুটে আসে৷
” ভাবি কি হয়ছে তোমার?”
” পেটে ব্যাথা করছে মনি৷”
” কি কইতাছেন ভাবি৷ আমি এখুনি আপনার দেবরকে বলতাছি৷ ও আপনারে ডাক্তারের কাছে লইয়া যাইবো৷”
মনি দেরি না করে সবুজকে বিষয় টা জানাতে সবুজ দ্রুত উঠে এলাকার ডাক্তারকে কল করে জানাতে ডাক্তার আসতে রাজি হয়৷ আধাঘন্টা পর ডাক্তার এসে মেঘকে চেকয়াপ করে বলে,” মা আপনি জানেন আপনি পোয়াতি তাহলে এত পেশার কেন নিচ্ছেন৷ আপনার শরীরের ভেতর যে আর একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে৷ সবুজ মিয়া দ্রুত গিয়া এই ঔষধ নিয়া আসো৷ আর আম্মা আপনারে একটা ইনজেকশন দিয়ে দিচ্ছে এখন আপাতত ব্যাথা কমে যাবে তবে নিজের দিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ আর আগামীকাল থেকে যেহেতু রোজা আপনি কিন্তু রোজা থাকতে পারবেন না৷ একটু সুস্থ হলে রোজা থাকবেন৷” বলতে বলতে মেঘের হাতে ইনজেকশন দিয়ে দিলো৷ ইনজেকশন দেওয়ার কিছুক্ষণ পর মেঘ ঘুমিয়ে পড়ে৷ এদিকে সবুজ শহরে গিয়ে ঔষধ গুলো নিয়ে আসে৷ এত সময় ধরে এত কিছু হয়ে গেছে তার বিন্দু মাত্র মা মেয়েরা জানে না৷
সবুজ এক ঘন্টার ভেতর ঔষধ নিয়ে এসে ডাক্তারের কাছে দেয়৷ ডাক্তার মনিকে বুঝিয়ে দেয় কখন কোন ঔষধ খেতে হবে৷ সবুজ ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে চলে যায়৷ মনি ঔষধ গুলো গুছিয়ে রেখে মেঘের পাশে বসে থাকে৷
সন্ধ্যায় চা নাস্তা পেতে দেরি হতে জায়েদা আর তার মেয়েরা চেঁচামেচি শুরু করলে মনি দ্রুত গিয়ে চা নাস্তা বানিয়ে তাদের দিয়ে আসে৷ মেঘ তখনও রুম থেকে বের হয় না৷ পেটে ব্যাথা কমে গেলেও দূর্বলতা কাজ করছে৷ মনি রাতের অপেক্ষা না করে৷ ভাত সবজি আর মাংস প্লেটে নিয়ে মেঘের রুমে চলে যায়৷ সাথী মনিকে প্লেট হাতে দেখলেও কিছু বলে না৷ নিজের কাজে চলে যায়৷ মেঘ এখন খেতে না চাইলেও মনি জোর করে খাইয়ে দেয়৷
রাতে খাবার পরিবেশনে মেঘকে না দেখে তার ননদেরা মুখ বাঁকিয়ে নানা রকম কথা বলতে থাকে যা মেঘের শুনতে ভুল হয় না৷ মনির হাতে হাতে সাথী সবাইকে খাবার বেড়ে দিয়ে খেতে বসে৷
ভোর রাতে মেঘকে উঠতে না দেখে আখি মিলা আর তাদের মা দরজায় আঘাত করে মেঘ কে ডাকতে থাকে তখনি সবুজ এসে বলে,” আম্মা ভাবিরে ডাইকেন না ডাক্তার ভাবিরে বিশ্রাম নিতে কইছে৷ আর কয়েকটা রোজা রাখতে বারণ করছে৷”
” বউ না উঠলে তরকারি গুলা গরম করবো কেডা সবুজ?”
” কেন তোমার মাইয়ারা আছে না? তাদের বলো তরকারি গরম করতে৷ এত বেশি মাইয়াগো লাই দিও না আম্মা যাতে পরে পস্তাতে হয়৷”
কথা গুলো বলে সবুজ হাত মুখ ধুতে চলে গেলো আর মা মেয়েরা রাগে কটমট করতে করতে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো৷
২০.
রোজা না থেকেও কোরআন পড়া বন্ধ করেনি মেঘ৷ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং কোরআন পড়তো তবে তার শাশুড়ি বা ননদ কে কখনো নামাজ বা কোরআন পড়তে দেখেনি৷ মনি মেঘের থেকে কোরআন শিক্ষা নিতে থাকে৷ নামাজ পড়ার নিয়ম জেনে সেও মেঘের সাথে রেগুলার নামাজ আদায় করে৷ মেঘকে তেমন কোন কাজ করতে দেয় না মনি৷ তবে শাশুড়ি ননদের খোঁটা শুনতে হয় তাকে৷ দেখতে দেখতে দশটি রোজা শেষ হয়৷ মেঘ ও মোটামুটি সুস্থ তাই এগারোতম থেকে রোজা থাকার সীর্ধান্ত নেয়৷ তবে এগারোতম রোজায় ঘটে যায় সেই অনাকাঙ্খিত ঘটনা৷ গরুর জন্য খড় কাটতে গিয়ে যেই না ঘরের চৌকাঠে পা ফেললো তখনি মেঘের মনে হলো তাকে কেউ পেছন থেকে ধাক্কা দিলো৷ মেঘ মাটিতে পড়ে গেলো৷ পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে সেই ব্যাথা আবার শুরু হতেই মেঘ চিৎকার করে মনি কে ডাকতে লাগলো৷ মনি মেঘের চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে মেঘ কে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে শাশুড়ী ননদ আর তার স্বামীকে ডাকতে লাগলো৷ সবুজ দৌড়ে এসে মেঘ কে তুলতে মেঘ বলে,” ভাই আমার বাচ্চাটা…..” বলতে বলতে মেঘ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷
.
.
.
#চলবে………..