“মেঘনাদ”পর্ব ৯
সারাদিন আলিয়া ঘুম থেকে উঠেনি। আঙ্কেল আমায় এবার যেতে দিলেন না। রাতটাও আমি এখানে রয়ে গেলাম। আলিয়ার ঘুম দেখে লাগছে, তার ওপর যে দখলটা গিয়েছে, তারই প্রতিক্রিয়া। সকাল নয়টায় আলিয়ার জন্য রান্না সারলাম। মজিদ ভাইয়ের হাত ধরায় সবই ইজি হয়ে পড়েছিল। এরপর আলিয়ার রুমে আঙ্কেলের সাথে গিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললাম। এতক্ষণে আলিয়া একটু নড়াচড়া করছে। তার ওঠার লক্ষণ দেখে আমরা বাইরে চলে এলাম। মজিদ ভাই খাবার দিয়ে এলো। আলিয়া ওঠলে আঙ্কেল তাকে দেখতে দরজার কাছে দাঁড়ালেন। আমি তাঁর পেছনেই দরজা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। হয়তো সে আমায় দেখছে না।
‘মা, তোমার ভালো লাগছে?’ আমার সাথে তার এবার চোখাচোখি হলো।
‘হ্যাঁ।’ তার খাওয়ার গোটা সময় আমরা ওখানে ছিলাম, ‘আজ খাবার কে রান্না করেছে?’
‘এগুলো ধ্রুবই রান্না করেছে। হয়েছে তো তোর স্বাদের মতো?’
‘হু।’
‘জানিস, আসিয়ার খুনিরা ধরা পড়েছে।’
‘মাহিন ভাই?’
‘কীভাবে জানলি?’
‘সন্দেহ হয়েছিল। তিনি কিছুটা মাতাল টাইপ, তারপর ছেলে.. আর কে ছিল তার সাথে?’
আঙ্কেল বাকশক্তি হারালেন। আমিই বললাম, ‘তোমার ফুফি, আঙ্কেলের চাচাতো বোন। ভেবেছে, আসিয়াকে মেরে ফেললে তার সন্তানদের আঙ্কেল তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করবেন।
বাড়িটি বাঁধার সময় তারা প্রায়ই এখানে থাকত। গোপন পথটির সম্বন্ধে তিনিও জানতেন। সম্পদের প্রতি তার লোভ সবসময় ছিল। উপায় না পেয়ে কিছু করেনি। কিন্তু যেই আসিয়ার মা মারা যান, তিনি প্ল্যান আঁটতে শুরু করেন, কীভাবে আসিয়াকে সরানো যায়। কিন্তু আসিয়া আগে থেকেই তাদের পছন্দ করত না, মুনতাহার কারণে। আসিয়ার ইচ্ছার কারণেই আঙ্কেল তাদের এখানে আসা-যাওয়া কমিয়ে দিলেন। তারা সুযোগ পাচ্ছিল না। অবশেষে আসিয়ার বার্থডে’তে এবার অনেক গেস্ট দেখে পেয়েছে। ভেবেছে, একবার খুনটা করে লাশ গোপন পথ দিয়ে বাইরে নিয়ে জঙ্গলে ফেলে এলে কেউ খুঁজেও পাবে না। কেসও পড়বে না। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্যক্রমে লাশকে আবির পেয়ে যায়। তারা আসিয়ার বার্থডে অবধি জানতও না, আঙ্কেলের অন্য মেয়ে মানে তুমি ফিরে এসেছ। তারা নির্দিষ্টতই তোমাকেও সরানোর প্ল্যান করেছিল। কিন্তু তোমার অসুস্থতা দেখে ধারণা করল তাদের কিছু করার দরকার নেই। এমন সময় গোপন পথের তত্ত্বও বেরিয়ে আসায় তারা ধরা পড়ে। ব্যস!
আবিরের মতে সেইরাত মাহিন আসিয়ার রুমে লুকিয়ে থেকে মদ খেয়েছিল। সেই বোতল হয়তো গোপন পথ খোলা রেখে ওখানে রাখে। তারপর আসিয়া রুমে ঢুকে। সে অফ করা লাইট আর অন করল না। বসে কাঁদতে লাগল। এমন সময়ই হয়তো আসিয়ার মুখ চেপে ধরে তার খুন করে গোপন পথে নিয়ে যাওয়া হয়। আসিয়া হয়তো তখনও জীবিত ছিল। লড়ার জন্য সে ওই মদের বোতল ফ্লোরে ফেলে কিংবা মাহিনের মাথায় ভেঙেছে। মাহিন অবশ্য ব্যথা পায়নি। এরপর আসিয়ার প্রাণ চলে যায়। তাকে বস্তায় ভরে মাহিন গ্যারেজের কাছে আনে। তার মা হয়তো আগে থেকেই গাড়িতে বসেছিল। ইঙ্গিত পেয়ে তিনি বাঁধাই করা গ্লাসটা সরালেন এবং মাহিন গাড়িতে বস্তাটি ঢোকালে তারা জঙ্গলের দিকে চলে যায়।
এসবের জন্য তারা শাস্তি পেয়েছে। তুমি আর চিন্তা করো না। যা হওয়ার তা হয়েই যায়, কেউ নিয়তিকে পাল্টাতে পারে না। আসিয়া তোমার মনে সবসময় জীবিত থাকবে।’
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
তাকে শান্ত দেখে আঙ্কেল ভেতর যাচ্ছেন।
আলিয়া মিনতি করল, ‘বাবা, প্লিজ দূরে থাকুন।’
আঙ্কেল শুনলেন না। তার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, ‘আমার একটি মেয়েকে আমি হারিয়েছি। আমি তোকে হারাতে চাই না। তোর যাই প্রয়োজন হয় আমায় বল। কেমন ডাক্তারের কাছে তুই সুস্থ হতে চাস? আমি শুনেছি, মানুষ যে লোকটির কাছে গিয়ে সুস্থতা পাবে বলে ভাবে, তার কাছেই পায়।’
‘আমাকে বাঁচাতে পারবে এমন কেউই নেই।’
‘এমনটা বলিস না।’
সে কি সত্য বলছে? যদি এটাই সত্যই হয়? এমনই তো লাগছে। আমি আলিয়াকে হারাতে চাই না। আর ও এতো কম বয়সে.. এতো খারাপ অসুখের শিকার.. আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি দেয়াল ঘেঁষে এককোণে দাঁড়িয়ে রইলাম। পৃথিবীতে আসার পর আমার দ্বিতীয় জীবন শুরু হয়েছে। কোনো না কোনোভাবে আলিয়াই এটাকে অর্থবহ বানিয়েছে। মানুষের একটা সুবিধা হলো, তাদের দুঃখ লাগলে কান্না করে তার বোঝা কমাতে পারে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, শরীরে পানি না থাকায় কাঁদতে পারি না।
আলিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার হাত কাঁপতে শুরু করেছে। ব্যস, এটুকুই তার ধৈর্যশক্তির সীমা। সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে ব্যাডশিট চেপে ধরলাম। আমার দিকে তাকিয়ে সে নীরব ভাষায় কথা বলল। তার আগেই আমি এগিয়ে গিয়ে আঙ্কেলকে তার থেকে দূরে নিয়ে যেতে থাকলাম। কিন্তু সে ঠিকই আক্রমণ করতে এলো। আমি আঙ্কেলের সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আমার আসল শক্তির কিছুটা দিয়ে তাকে থামালাম। এখানে আঙ্কেল থাকায় সরাসরি কিছুই করতে পারছি না। আমি তো মানুষের মতো ভান করতে পারি। এবার আলিয়ার দুই ঘাড় ধরে তার অসুর শক্তির বিরুদ্ধে লড়লাম, আঙ্কেল না বুঝেন মতোই। সে আঙ্কেলের কাছে যেতে না পারায় হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। কিন্তু এইবার পেরে উঠল না। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, আমার একমাত্র কাছের “মানুষটার” বিরুদ্ধে আমি লড়াই করছি! আহ্! আলিয়া, তুমি যাতে আঘাত না পাও। আমায় ক্ষমা করো। সে আমার আসল বলে পিছিয়ে যেতে লাগল, যেন আমি শক্তিশালী এক মানুষ আর আলিয়া মামুলি এক মেয়ে। কেউ হয়তো বাহির থেকে বুঝবে না, এই মুহূর্তে আলিয়ার নরম শরীরে বিশটি বলশালী মানুষের মতো শক্তি বাহিত হচ্ছে আর আমি এক এমন অমানব, যার শক্তি আলিয়ার বর্তমান শক্তির দ্বিগুণ। আমি ওইভাবে তাকে ঠেলে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলাম। তার একইভাবে হাত-পা ব্যর্থ আক্রমণ করে চলেছে। তাকে শান্ত করার জন্য ইতোমধ্যে মজিদ ভাই রশি আনলে আঙ্কেল ও সে আলিয়ার হাত খাটে বাঁধতে লাগল। এই কয়েকটা মুহূর্তটা আমার মুখটা তার কাছাকাছিই রেখেছি, যাতে সে হাত-পা বাঁধার দৃশ্যটা না দেখে। কিন্তু আচমকা সে শান্ত হয়ে গেল। বলতে গেলে তাকে বিছানায় শোয়ানোর সাথে সাথেই আঙ্কেলরা তাকে বাঁধতে লেগে পড়েছে। কিন্তু আলিয়া শোয়ার পরক্ষণেই শান্ত হয়ে গেল। ওর চোখেমুখে অবসাদ ছেয়ে গেছে। আজ এই পরিস্থিতি দেখতে হবে কখনও ভাবিনি। তার ঘাড়ে থাকা হাতগুলো দিয়েই আমি তার হৃদকম্পন ভালোভাবে অনুভব করছি। অনেক দ্রুত! তাকে বাঁধা হলে ছেড়ে দিলাম। ওর তো আরও কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করার কথা! আঙ্কেল আবারও দরজার কাছে দাঁড়ালেন।
সে বলল, ‘বাবা, ধ্রুব ঠিকই বলছিল। আপনার এখানে না থাকাই উচিত। আমার চিন্তা বারবার আপনাকে আমার পাশে আসতে বাধ্য করবে। আমি নিজের ওপর বেশিক্ষণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারব না। আমি কখনও আপনার কাছে কিছু চাইনি। আজ চাইছি। এটাই চাইছি, আপনি নিজেকে আমার কাছ থেকে দূরে থাকুন। আপনার কিছু করে বসলে নিজেকে আমি কখনও ক্ষমা করতে পারব না।’
তিনি বিরস মুখে বললেন, ‘কিন্তু তোর খেয়াল কে রাখবে?’
আমি দ্রুত জবাব দিই, ‘আঙ্কেল, আমি রাখব। আমার পরিবারের কেউ কিছু বলবে না।’
‘তুমি একা ওকে কেমনে সামলাবে?’
‘ট্রাস্ট মি। এখন যেভাবে পেরেছি, সেভাবেই পারব।’
‘ধ্রুব..’ আলিয়া বাধা দিতে চাইছে। আমি শুনলাম না। কারণ এই পরিস্থিতিকে আমি ঠিক করতে চাই।
বলে গেলাম, ‘আমি কেবল ওর দেখাশোনাই নয়, পারলে ওর সমস্যাটা উদ্ধার করে ঠিক করারও চেষ্টা করব। আপনি যোগাযোগ রাখলেই হবে।’
আঙ্কেলকে আরও অনেক কিছু বলে শেষে রাজি করলাম। মজিদ ভাইকে তিনি ছুটি দিলেন। এরপর তিনি সন্ধ্যার দিকে আলিয়ার দায়িত্ব অগত্যা আমার ওপর দিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন।
আমি এসে বললাম, ‘মুখ দিয়ে তোমার শ্বাস নিতে হয়তো অনেক কষ্ট হয়। আমি বেলকনিতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবো। তুমি যাস্ট আর কিছুক্ষণ মুখে শ্বাস নাও।’ কথাটি বলে আমি তার রশিগুলো খুলে দিলাম, ‘এগুলোর দরকার ছিল না। তুমি তখন কী ভেবে শান্ত হয়ে গেলে বলো তো?’
সে আমতা আমতা করল। সে হয়তো নিজেই জানে না। আমি না হেঁটেই বেলকনিতে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। এটাই ভালো, থাইগ্লাসের এপারে থেকে তার খেয়ালও রাখতে পারব, তার নাক দিয়ে শ্বাস নিতেও সুবিধা হবে।
সে আমায় ওখান থেকে বলল, ‘ধ্রুব, তুমি এতো ভালো কেন? আচ্ছা, তোমার নাকে কি আমার দুর্গন্ধটা লাগে না?’
‘লাগতে দিই না। ইউ নো, আমার অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না। ঘ্রাণ না নিয়ে থাকতে পারি।’
শুয়ে থেকে সে আমার দিকেই তাকিয়ে রইল। আজ আমি ছাড়া তার আশেপাশে কেউই রইল না, হয়তো এটাই ভাবছে। হয়তো ভাবছে, একসময় আমরা একে অপরের সম্বন্ধে জানতাম না। আর এখন সে কিনা আমার জীবনের অংশ হয়ে গেল। আলিয়া মানুষ হলেও তার বোঝ-ব্যবস্থা, ভদ্রতা, নম্রতা, নির্দোষিতা সবই আছে, যা “আমরা” বন্ধুতে খুঁজে থাকি। কিন্তু আমার এই একটা বন্ধুর সাথেই এমনটা হতে হলো! সে কবে ঠিক হবে? আমি আহতের ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে হয়তো একটু শান্তিই চাইছে।
আমি বললাম, ‘আমি আমার কাপড়-চোপড় আনতে যাচ্ছি। দশ মিনিটের মধ্যেই চলে আসব।’
সে ওঠে দরজার ওপাশে এলো। হয়তো আমার যাওয়া দেখার জন্যই। আমি হেসে বেলকনি থেকে আমার হালকা কর্কশিটের ন্যায় শরীর নিয়ে সুইফটলি লাফ দিলাম। তারপর মজিদ ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া গ্যারেজের চাবি বের করে বাইক নিয়ে রওনা দিলাম। শো-অফ! বাইকের প্রয়োজন হয় না। লোক দেখানোই! কর্তা বাসায় ছিলেন। তাকে বললাম, কিছু বন্ধুদের সাথে বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে বেশ কয়েকদিন লাগবে। তিনি মাথাও নাড়ালেন না। কিন্তু আশ্চর্যভাবে এই স্বার্থপর লোকই বাগানের শখ রাখেন! শখ বুঝি শ্রেণিভেদ দেখে না। আমি ব্যাগ গুছিয়ে বেরুলাম। আর কেউ নাক গলালো না।
যখন বেলকনির নিচে এলাম, তখন আসিয়াকে দেখতে পেলাম। আলিয়া ওপাশ থেকে বলছে, ‘তোর খুনিরা তো ধরা পড়েছে। আমি ভেবেছি…’
‘আমি আসব। কারণ আমি খুনিদের জন্য আসিনি। যারা অপরাধী, তারা অবশ্যই একসময় শাস্তি পায়। আমি তোর জন্যই রয়ে গিয়েছি। তুই অনেক সুখই পাসনি, সুখ কিছু দেওয়ার তেষ্টায় হয়তো আমার আত্মা অতৃপ্ত রয়ে গেছে। দেখ, তোর অবস্থা। আমি হয়তো তোকে ঠিক করার জন্যই আছি। কিন্তু তোর সমস্যাটাই ধরতে পারছি না।’
‘আমি জানি না, আমার কী হয়েছে।’
তাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ সে অন্য মানুষকে দেখা দেয় না। আমার সম্বন্ধে সে জানলে ক্ষতি হবে না। আমি বেলকনিতে লাফ দিয়ে উঠার পর আসিয়াকে হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘তুমি মুক্তি পাওনি?’ সে উত্তরটা বলার আগেই বুঝে ফেললাম, ‘ওহ্, আই সি।’
আমি দরজা খুললাম। আসিয়া নাক কুঁচকিয়ে উধাও হয়ে গেল। আলিয়ার গন্ধ সে সইতে পারছিল না। আমি অন্যরুমে ব্যাগ রেখে রান্না করতে চলে গেলাম। তার স্বাদ মোতাবেক খাবার তৈরি করলাম। এগুলো জিহ্বা জ্বলে যাওয়ার মতোই। কিন্তু..
হঠাৎ মা বললেন, “তুমি শিওর, তুমি ওকে বন্ধুই ভাবো?”
“হা মা।”
“আর সে?”
“সেও।”
“আমার লাগছে না। কারণ তুমি বেলকনিতে বসে থাকার সময় সে যেভাবে তোমার দিকে তাকাচ্ছিল.. আমার মনে হলো, আমি বিষণ্ণ মনে ভালোবাসা নিয়ে তোমার বাবার দিকে ঠিক সেভাবেই তাকাই, তাকে যেন দেখা কখনও ফোরায় না।”
“সে মানুষ। এতদিন আমার সাথে থাকায় আমাকে পছন্দ করতেই পারে। আমি শিওর, এটাকে সে আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে আসতে দেবে না। সে জানে, আমি তার কেবল বন্ধুই হবার যোগ্য।”
মা আর কিছু বললেন না। সে খাবার খেয়ে শোয়ার পর আমি বেলকনিতে বসে রইলাম, তার আপত্তি সত্ত্বেও। সে ঘুমিয়ে পড়ল। এটা একদমই শান্তির ঘুম নয়। কেউ যেন তাকে মারছে, তার পিঠে বেলট দিয়ে মেরে চলেছে কিংবা তাকে কেউ যেন তাড়াচ্ছে। সে দুঃস্বপ্ন দেখলেও অনেক পীড়ায় আছে। কারণ মানুষ তার স্বপ্নকে বাস্তবতার ন্যায় উপলব্ধি করে। আশ্চর্যভাবে কল্পনার এই জগতকে ওই স্বপ্নের সময় সত্যিই মনে করে। নিজের হাত-পাও অনুভব করতে পারে, বাস্তবের ন্যায়। আমার ইচ্ছে হলো, আলিয়ার কাছে যাই। যদি সে আমার উপস্থিতি লক্ষ করে? আমিও একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। সময়টা হয়তো প্রায় দু’টা। আমার ঘুমে মাঝরাতে ব্যাঘাত ঘটেছিল। কিন্তু কী কারণে টের পাইনি। আমি যখন উঠি, তখন নিজেকে তার রুমের বিছানায় আবিষ্কার করলাম। তড়িঘড়ি করে উঠে তার সন্ধান করে তাকে অন্য রুমে পেলাম। আমি দুপুরেরও খাবার রেডি করে ফেললাম। সে ওঠল না। তার ঘুম ভাঙল বিকেল চারটার দিকে। সে হলে এলে বললাম, ‘বাপরে! এতো ঘুম?’
তার মুখটা এখন সত্যিই একটা রোগীর মতো দেখাচ্ছে। কালরাত একদমই ঘুমাতে পারেনি। আজই ঘুমিয়েছে। তাও অতৃপ্তি নিয়ে।
‘কাল কি আমায় কোলে নিয়েছিলে?’ একটু আগে বুঝতে পারলাম।
‘না, ফ্লোর থেকে সামান্য করে তুলেছিলাম। তোমাকে কোলে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।’
‘আমি ওখানেই ঘুমাতে পারতাম।’
‘আমি মানুষ হিসেবে স্বার্থপর নই যে, তোমাকে ওখানেই মশার সাথে ঘুমাতে দেব।’
‘ওরা শান্তি পায়নি, কারণ রক্ত পায়নি।’
দু’জনই হাসলাম। ‘তুমি যে এখানে থাকছ, কেউ কিছু বলবে না?’
‘না। ওই পরিবারে অনেক টাকা থাকায় সবাই বেপরোয়া। তারা ড্রিংকস এই সেই নিয়ে মেতে থাকে। বুঝতেই পারছ। এমনকি জিসান কয়েকদিন বাইরে থাকলেও কারও কিছু যায় আসে না। ওরা শাসন একদমই করে না। আমরা যাই চাই, তাই করতে দেয়। ওখানে কেবল মা’ই আমাকে পছন্দ করেন, তাও মানুষকে আমার ন্যায় রূপবান একটি ছেলেকে গর্ব সহকারে নিজের করে দেখাতে পারায়।’
‘তোমার বাসায় আমার যাওয়া হয়নি।’
ওখানে কিছু নেই। ‘সুস্থ হয়ে উঠ।’
আমাদের দিনগুলো এভাবেই চলতে লাগল। সে ঘুমায়, ওঠে, খায়। আমি দূরত্ব বজায় রাখি। এক সপ্তাহ কেটে গেল। আমি তাকে বেশিক্ষণ ছুঁতে পারি না। সে ভাঙচুর অবশ্য করেছে। কেন, তা আমায় বলতে চায় না।
আমায় আজ সকাল আঙ্কেল ফোন করে আলিয়ার জন্মদিনের কথা বলে কেক আনতে বললেন। আমি একটা কেক নিয়ে এলাম। সুর করে বললাম, ‘হ্যাপী বার্থডে..’
‘ওহ্, আঠারোতে বুঝি পড়ে গেলাম।’
‘হ্যাঁ। তোমার বয়স কিন্তু শ্রেণির তুলনায় কম পড়েছে।’
‘আমি পড়াশোনা একটু তাড়াতাড়ি শুরু করি।’
‘করারই কথা। এতো শার্প যে তোমার মাইন্ড!’
‘হা হা হা.. আমি কিন্তু কেক খেতে পারব না।’
‘স্বাদ না নিয়ে গিলে ফেললে শেষ! এঞ্জয় দ্যা মোমেন্ট।’ আমি তাকে খাইয়ে দিলাম। সেও আমায় খাইয়ে দিলো, ‘খেতে পেরেছ!’
আমি হাসলাম, ‘ওয়েট। বাসায়ও খাই, এবং সারি।’ আমি বাথরুমে গিয়ে গলায় ওপর থেকে হাত দিয়ে ওই খাবার বেরিয়ে এনে ওয়্যাক ওয়্যাক করে ফেললাম, একদম যেভাবে খেয়েছিলাম, সেভাবেই। তার কাছে এসে বললাম, ‘ঠিক এভাবেই।’
আলিয়া ভুলে নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে ফেলল। আমি তাড়াতাড়ি সরে পড়লাম। অবাক হয়ে দেখলাম, তবে এবার সে কিছু করেনি। সে মূর্তির রূপ ত্যাগ করে শুয়ে পড়লাম। সে কি সুস্থ হয়ে গেছে? সে শান্ত আছে! আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। খুশি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু এমন সময়, সে সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠল। তাকে কোনোকিছু ভেতরে আঘাত করেছে? আমি তার কাছে যেতেও ভয় পাচ্ছি। সে ওই ব্যথায় শোয়া থেকে বসে গেল। পেট চেপে সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। কেন আমি ওর পাশে এসেছিলাম? যদি আমি কাঁদতে পারতাম? তার ব্যথা দেখে কাঁদতে না পারায় নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম। আমার সুগন্ধই দায়ী। আমি তাড়াতাড়ি সরে পড়লাম। সে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল।
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার