Monday, October 6, 2025







“মেঘনাদ”পর্ব ৮

“মেঘনাদ”পর্ব ৮

সাবরিনা আর আদিল প্রতিদিনই এখানে আসেন। বিশেষ করে যখন থেকে সাবিলার অসুস্থতা শুরু হয়েছে। এই যাবৎ আমি অহেতুকই তাঁদের ভয় পেয়ে আসছিলাম। কিন্তু ভয় পাওয়ার তো কিছুই নেই। আলিয়া যেন আমার ওপর থেকে অনেক বোঝা সরাল। সে যদি আমায় এখানে না আনত, তবে আমি শীঘ্রই হয়তো পালানোর বন্দোবস্ত করতাম। এই বাড়ির বাকি সদস্যও মোটামুটি ভালো। সবাই আমার সাথে অতিথির মতো আচরণ করছে না, বরং এরচেয়ে বেশি করছে। সাবিলাকে এখনও দেখা হলো না। সেই মিস্ট্রিয়াস অর্ধপরী এবং অর্ধমানব সন্তান। এতদিন তার ডানা ছিল না। কয়েক সপ্তাহ আগে ডানা উঠেছিল। মনে হয় না, সেই ডানা পুরোপুরিই পরীদের মতো হবে। কারণ, শুনেছি তার ডানা বেরুনোর পর রক্ত লেগেছিল। অনেক বিস্ময়কর একটি ব্যাপার!
আমি সাবরিনার হাত ধরে এমন অনেককিছুই জানলাম, যা সবাই জানে না। তাঁর স্মৃতির এমন সব ছোট মুহূর্তও দেখলাম, যেগুলো কাউকে বলার কথা মাথায় আসে না। তাঁদের অমর প্রেমকাহিনি আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। ক’জনের এমন প্রেম পাওয়ার সৌভাগ্য আছে? মাঝখানে একটুখানি মর্মস্পর্শী অধ্যায়ের পরে তারা যুগ-যুগের জন্য সঙ্গী হয়ে গেল। আমাদের ভুবনের প্রেমকাহিনি তো খুব সাদামাটা আর সাধারণ। আদিল আর সাবরিনার প্রেমকাহিনিই ভিন্ন; বৈচিত্র্যপূর্ণ। এক পরীর একটি মানবের সাথে থাকার এবং এক মানবের একটি পরীর সাথে থাকার অভিজ্ঞতায় মধ্য দিয়ে বাহিত হওয়া এই প্রেমকাহিনি না মনুষ্য জাতে ছিল, না- আমাদের।
আমি একপাশে দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে তিনটা মানুষকে নামতে দেখি। আলিয়া খুব দ্রুত নিচে নেমে এলো। সাবিলা আমাকে দেখে ধীরভাবেই নামছে।
“এই ছেলেটি মায়ের মতোই।”
“ভুল মনে করোনি।”
“সে আমার মস্তিষ্ক পড়তে পারল? নাকি আমিই ওর আওয়াজকে কল্পনা করছি?”
“এটা সত্যই, সাবিলা। আমি তোমাদের সম্বন্ধে জানি। তোমরাও হয়তো জানো, আট বছর আগে তোমার মায়েদের ভুবন থেকে একটি ছেলে পালিয়ে গিয়েছিল।”
সে বিস্ময় প্রকাশ করল, “তুমি কি সেই?”
“হু।”
“খুব ভালো লাগল তোমাকে দেখে। আমি তো মা-বাবা আর সর্দার ব্যতীত তোমাদের জগতের আর কাউকেই দেখিনি।”
“আমিও তোমার মতো কাউকে দেখিনি।”
দু’জনই মৃদু হাসলাম। মানুষেরা কেউই আমাদের মনঃকথোপকথন বুঝেনি। কেবল আবিরের সাথে পরিচিত হওয়া বাকি। সে তো আমাকে সন্দেহ করেছিলই। সে আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো প্রাধান্য দিলো। অথচ পৃথিবীর দিক থেকে বৃদ্ধি আর পরিপক্বতার ক্ষেত্রে আমি তার সমানই।
সবাইকে এতটা আপন করে পাব ভাবিনি। পৃথিবীতে আসার পর এটিই ভিন্ন একটা অভিজ্ঞতা।
মানুষেরা খাবারের প্রস্তুতি নেয়। সাবিলা অবশ্য একবেলাই খায়। আলিয়া টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। তাকে হঠাৎ অন্য ধরনের দেখাচ্ছে, যেন.. যেন তার মাঝে অনেকগুলো অনুভূতি মিশ্রিত হয়ে গেছে। সে কি অসুস্থ? মনে হয়, চক্কর খাচ্ছে সে। আমি, সাবিলা, আদিল আর সাবরিনা ব্যাপারটা একসাথেই লক্ষ করে সাথে সাথে তার পাশে গিয়ে তাকে সবাই ধরলাম। তাকে পড়তে দিলাম না। সে হুঁশ হারিয়েছে দেখে আমি তাকে কোলে নিয়ে ফেললাম।
সাবিলা বলল, ‘ওকে আমার রুমে নিয়ে যাও।’
‘ও প্রচণ্ড দুর্বল।’ আমি বললাম, ‘মনে হয় না, এখন আর হুঁশ ফিরবে। ওকে ওর বাসায় নিয়ে যাওয়া উচিত। আঙ্কেল চিন্তা করবেন।’
‘কিছুক্ষণ তো তাকে এখানে রাখো।”
বাকিরা সমর্থন করলে আমি আলিয়াকে নিয়ে রুমে শুইয়ে দিলাম। এরপর তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তাকে আধাঘণ্টাও কোলে নিয়ে থাকা আমার জন্য কোনো ব্যাপার নয়। কারণটা হলো আমার দ্রুতি ও আমার বল। কিন্তু সমস্যা হলো, ওর কাছ থেকে একটা বিকর্ষণ শক্তি কাজ করে। অবশ্য এটাকে আমি বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকতে দিই না। আর দুর্গন্ধটা… আমার অগত্যা ঘ্রাণ নেওয়া বন্ধ করতে হয়। আমি একপ্রকার আলিয়ার আসল সুগন্ধ থেকে বঞ্চিত। এটা খুবই অন্যায় মনে হয়। মনে হয়, এই দুর্গন্ধটা যেন কোথা থেকে উড়ে এসে জোরে বসেছে। আক্ষেপ একটাই, আলিয়ার ওপরই কেন? তার কী দোষ?
ওকে বাসায় আনলে আঙ্কেল দরজা খুললেন। আলিয়ার জন্যই চিন্তিত ছিলেন। ‘ওর কী হয়েছে?’
আমি আলিয়াকে রুমে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পাশে ছিলেন। ‘ও আমার সাথেই ছিল। একসময় মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেছে।’ সত্যটা বললাম। কিন্তু কিছুটা লুকিয়ে।

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

তিনি ভাবলেন, “আলিয়ার এতক্ষণ ওর সাথে থাকা মানে তারা দু’জন অন্য সম্পর্কে জড়িয়েছে। থাক, আমার মেয়েটা ঠিকভাবে বাসায় তো এলো! অন্য কেউ হলে কি এতটা আর দয়ালু হতো?”
আমি অবাক হলাম। তিনি সত্যিই মাইন্ড করছেন না, আমার ব্যাপারে, আলিয়ার সাথে আমার থাকা না- থাকা নিয়ে, যদিও তাঁর ভাবনাটা ভুল। আমি আমার হাতটা তাঁর হাতের ওপর রাখলাম, ‘আঙ্কেল, ও আমার বন্ধু। আমি যতদিন ওর সাথে আছি, ওর কিছু হতে দেবো না। তাছাড়া ও একটু অসুস্থ।’
তিনি যেগুলো ভাবছেন তা আমি এক সেকেন্ডের দশভাগের একভাগ সময়ে জেনে ফেললাম এবং এও তাঁর মস্তিষ্কে ঘেঁটে দেখলাম, তিনি আমায় নিয়ে কী ভাবেন। ভাবেন, আমি সবসময় আলিয়ার পাশে একটা ভালো পার্টনারের ন্যায় থেকেছি। আমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়।
কিছু মানুষ এতটা ভালো কী করে হয় আমি বুঝি না। তাঁর হাতটা আমার হাতের সংস্পর্শে এলে তার জীবনী সম্বন্ধেও জেনে ফেললাম। তিনি দারুণ এক লোক। সংগ্রাম করেই মানুষ হয়েছেন বিধায় যতটুকু শক্ত, ঠিক ততটুকুই জ্ঞানী। আলিয়ার জীবনে যা ঘটে গেল, তদানুসারে বলা যায়, আসগর আঙ্কেলকে বাবারূপে পেয়ে সে সৌভাগ্য ফিরে পেয়েছে।
আঙ্কেল কিছুক্ষণ পর চলে গেলেন। আমায় যেতে বললেন না। আবার থাকতেও না। আমি আলিয়ার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। আমি ধীরে ধীরে তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছি। কেন যে সে অসুস্থ হলো? এই অসুস্থতার কারণেই আমি একটা মানুষের সাথে এতদূর বন্ধুত্ব রাখছি। আমার বিবেকে একটা সুরেলা কণ্ঠ উঁকি দিলো, “ধ্রুব.. কী করছ? তুমি আমাকে বলেছিলে, এমন কিছু করবে না।”
“আমি কিছু করছি না।”
“তাহলে এসব কী?”
“বন্ধুত্ব। আপনাকে নিশ্চয় জানাতে হবে না যে, আমরা প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ফেলি। এটা আমাদের ভুল নয়; চরিত্রের একটা অংশ। যদি তার জায়গায় অন্য কেউ হতো, তবে আমি এতটাই তার কেয়ার করতাম।”
“জেনে খুশি হলাম। নিজের খেয়াল রেখো। উল্টাপাল্টা কিছু করো না।”
মায়ের চেহারাটা মুছে গেল। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। কাল কলেজে যাব না। পড়ালেখা কোথাও চলে যাচ্ছে না। আমার জন্য তো কোনো ব্যাপারই নয়। আলিয়া অসুস্থ। তার পাশে তেমন কেউ নেই। আমি সকাল হলে জঙ্গল থেকে সোজা তার রুমের বেলকনিতেই গেলাম, অদৃশ্য হয়ে। দরজাটা খোলা রেখেছিলাম। তার হুঁশ হয়তো এখনও ফেরেনি। গিয়ে বিছানায় তার পাশে কিছুক্ষণ বসে রইলাম।
সে কিছুক্ষণ পর চোখ খুলল।
‘ক্ষিধে পেয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
সে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নিল। আমি এক জায়গায় একইভাবে পুরোটা সময় বসে ছিলাম।
‘কালরাত…’ সে এবার আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল।
‘অনেকক্ষণ ওখানে ছিলে। শেষে তোমাকে এখানে নিয়ে আসা উচিত বলে মনে করলাম। তুমি সারারাত বেহুঁশ ছিলে।’ এটা একদমই ভালো লাগেনি।
‘এভাবে বলছ কেন?’
‘তোমার দুঃখে আমিও দুঃখ পাচ্ছি। তুমি ঘুমে কেঁপেছ, কেঁদেছ।’
‘তুমি সারারাত এখানে ছিলে?’
‘চলে গিয়েছিলাম। বেলকনি দিয়ে আবার এসেছি।’
‘তুমি ঘুমাও না?’
‘ঘুমাই। কিন্তু মানুষের সাথে থাকতে থাকতে অভ্যাসে কেবল ছয় ঘণ্টাই আছে। বাকিটা সময় এদিক-ওদিক ঘুরি।’
‘কোথায় কোথায়?’
‘জঙ্গলটা আমার অধিক প্রিয়। কিন্তু জানতাম না, এরই বামপাশটায় সাবিলারা বাস করে। শোন, তুমি একটু বেশিই হুঁশ হারাচ্ছ। তুমি বাসায়ই থাক। আবির কেস প্রায় হেন্ডেল করে ফেলেছে। কেবল খুনির কাছে পৌঁছার দেরি। আমিও তার সাথে যাব।’
‘এখানে থাকার জন্যই কাল সাবিলাকে একেবারের জন্য দেখে আসতে গিয়েছিলাম।’
‘একেবারের জন্য মানে?’
সে কিছুক্ষণ পর বলল, ‘ধ্রুব, আমি অনেক কষ্ট পাচ্ছি। সত্য বলতে তোমাদের খুশবোটা আমি সইতে পারি না। মাথা ঝিমঝিম করে। আমার ভেতরে উদ্ভট এক রাগের তৈরি হয়েছে, যা আগে ছিল না। আমি সামান্য ঘৃণার রেশকেও অনেক লম্বা করে টানি। কেন এমনটা হয় জানি না।’
আমি তাকে আশ্বস্ত করতে তার হাতটা ধরলাম। কয়েক সেকেন্ড পেরুলে সে ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নেয়, ‘ধ্রুব, তোমার এই হাত আমি বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারি না।’
এমনটা কেন হচ্ছে? ‘তোমার অনেক বড় একটা সমস্যা হয়েছে। তোমাকে আমি সুস্থ দেখতে চাই। আমার লাগছে না, ডাক্তার তোমাকে সারাতে পারবে। রোগটা তোমার মনের, মস্তিষ্কের।’
‘হুঁ।’ সে হঠাৎ বলল, ‘প্লিজ, আমায় একটু জড়িয়ে ধরবে?’
আমি তার অবস্থা বুঝতে পারলাম। সে খুব বিষণ্ণ বোধ করছে। আর… তাকে দেখে আমিও। আমি প্রথমবারের মতো কোনো মানুষকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। কি কোমল এই রক্তমাংসের শরীর! অবশ্য আমার মতো হালকা নয়। তাই সেই শক্ত করে ধরাতেও কিছু কোমলতা রেখেছি। সে অনেক ঠান্ডা। মানুষ কি এমনই থাকে? তাদের রক্ত তো গরম। তার প্রতি আমার বিকর্ষণ কাজ করছে। তার ক্ষেত্রে হয়তো আরও বেশি। পাঁচ-ছয় সেকেন্ড অতিবাহিত হলে নিজ দায়িত্বেই ততাকে ছেড়ে দিই। তাকে এখন অনেকটাই ভালো দেখাচ্ছে। সে.. অন্য মানুষের চেয়ে অনেক ভিন্ন। আমাকে ভয় করে না। কিংবা আমার কোনো অপব্যবহার করে না। হয়তো আমাকে এখনও মানুষ ভাবে। সে বন্ধু হিসেবে গভীর ভালোবাসা নিয়ে আমার দিকে তাকাল। সে দীর্ঘতম এক শ্বাস নিলো। হঠাৎ কী যেন হলো.. সে আমায় ধাক্কা দিলো! কি শক্তি এই ধাক্কায়! আমি টাল সামলাতে না পেরে ড্রেসিং টেবিলের জিনিসসুদ্ধ নিচে একটু দূরে পড়ে গেলাম। এমন শক্তি আমি কোনো মানুষে দেখিনি। অসম্ভব! আমি হালকা হলেও মাটিতে এতই বল প্রয়োগ করে থাকি যে, একসাথে কয়েকটা মানুষও আমাকে ওই জায়গা থেকে সরাতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি ওই বল কমাই। আলিয়া বিছানা থেকে উঠার আগেই আঙ্কেল দৌড়ে এসে দরজা খুললেন। আমি তড়িঘড়ি করে নিজেকে আরও হালকা করে হাওয়ায় পরিণত করলাম। কারণ তিনি হলরুমে ছিলেন। আমাকে এখানে আসতে দেখেননি। আলিয়া অসম্ভব ঘাবড়ে গেছে আমাকে ধাক্কা দেওয়ায়।
‘কী হয়েছে?’ আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলেন।
আলিয়া কিছু বলার আগেই আমি জায়গাটা ত্যাগ করলাম। কারণ আমার এতো ক্ষমতাসম্পন্ন মাথাটা কাজ করছে না। আমার ভাবার সময় লাগবে। আলিয়া.. একটা সামান্য মেয়ে আমাকে এতো অসুর শক্তি দিয়ে কীভাবে সরাতে পারে যে, আমি নিচেই পড়ে যাই? তার রাগ উঠেছিল। ওহহো, সে বলেছে, আমার সুগন্ধটা সে সইতে পারে না। এজন্যই কি ধাক্কা দিয়েছিল? এখন থেকে হিসাব করে পদক্ষেপ নিতে হবে। একটা মানুষ কিন্তু সারাক্ষণ মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে পারে না।
আমি ভাবতে ভাবতে কখন দুপুর হয়ে গেল, টেরই পারিনি। তড়িঘড়ি করে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আলিয়ার বাসার উদ্দেশ্যে গেলাম। ভেতর থেকে আঙ্কেলের চিৎকার শুনলাম। তড়িঘড়ি করে আমি ভেতরে গেলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, রান্নাঘরে আলিয়া একহাতেই মজিদ ভাইকে গলা চেপে ধরে শূন্যে তুলে ফেলেছে। এসব কী দেখছি আমি? আঙ্কেল তাকে থামাতেই পারছে না। আমি এসে মুহূর্তের মধ্যেই মানুষের মতো করে ধেয়ে গেলাম তাদের কাছে। আমি আলিয়াকে ছাড়াতে লেগে পড়লাম। তার মাঝে এখন অসুর ক্ষমতা! বিশটা শক্তিশালী মানুষের চেয়েও বেশি! আমি ঠিক ওই আন্দাজেই বল প্রয়োগ করে ওকে ঠেললাম। মজিদ ভাই রক্ষা পেল। তার পাশে আঙ্কেল থাকায়, সে তাঁর বাহুতে হুঁশ হারিয়ে পড়ে গেল। আমি মজিদ ভাইকে ফ্লোর থেকে তুললাম। আঙ্কেল আলিয়াকে কোলে নিয়ে তার রুমের দিকে গেলেন।
তিনি হলে আসার পর আমরা তিনজনই ডাইনিং টেবিলে কিছুক্ষণ নীরব বসে রইলাম। সে নীরবতা আঙ্কেলের কান্নায় ভাঙল। আমরা তাঁকে সামলাম।
‘আমার মেয়েটার যে কী হচ্ছে?’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার লাগছে না, ডাক্তার কিছু করতে পারবে।’
‘তাহলে কি সাইকিয়াট্রিস্ট আনব?”
‘হয়তো… তাই ভালো হবে।’ বেশ কিছুক্ষণ পর বললাম, ‘আমার মনে হয়, মজিদ ভাইকে ছুটি দেওয়া উচিত। এখন থেকে আমি তার পাশে থাকার চেষ্টা করব।’
আমি বেশিক্ষণ বাসায় থাকতে পারলাম না। আবিরের সাথে খুনির কাছে পৌঁছনোর জন্য তাগাদা দিয়ে আলিয়া বিকেলেই বার করে দিলো। আরিয়ান আর আবিরের সাথে আমি তাদের বাসায় দেখা করলাম, যখন আবির কলেজ থেকে এলো। এরপর আমরা আলিয়ার ফুফির বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। মাহিনকে গ্রেফতার করা হলো। কীভাবে এই কাজটা ওরা করেছে, আমি দেখলাম না। খেয়ালও করলাম না। যেভাবে ওদের সাথে গিয়েছিলাম। সেভাবেই ওদের সাথে এসেছি। কেবল একটা দৃশ্যই মাথায় আছে। মাহিনকে আর তার মা’কে হাতকড়ি পরিয়ে গাড়িতে পুলিস ফোর্স বসাল। ওদের দুজনের কারও মস্তিষ্ক আমি পড়তে পারলাম না। আমি আলিয়াকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম, আজ তার বাসায় যাব না। কারণ রাতটা আবিরদের সাথেই কেটে যাচ্ছিল। আমি রাতে ঘুমালাম। সকাল চারটায় উঠে একটু জঙ্গলে ঘুরলাম। এরপর আলিয়াকে দেখতে গেলাম। সে বসে থেকে বালিশে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মাঝে খুব ছটফট করছে। মনে হয়, ভালো করে ঘুমাচ্ছে না। সে খুব ভোরেই ঘুম থেকে ওঠে গেল। বাকিটা রাত হয়তো ঘুমায়নি। বসেই থেকেছিল।
আমি বেলকনিতে অদৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। সে ওঠল, ব্রেকফাস্ট সারল। একসময় তার রুমে এক লোকও এলো। তার সাথে আঙ্কেলও আছেন। ওহ্, সাইকিয়াট্রিস্ট! তিনি এসে সুন্দরভাবে আলিয়ার সাথে কথা বলতে লাগলেন। জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, তার বায়োডাটা, তার অভ্যাস ইত্যাদি। এরপর বর্তমান ঘটনায় এলেন, ‘তুমি জিনিস ভাঙচুর কেন করো?’
‘আমি আপনদের ওপর আঘাত করতে চাই না।’ আমার ধারণা কিছুটা এমনই ছিল।
‘কেমন আঘাত? আর এই আঘাত তুমি কেন করতে চাও?’
‘আমি কেন কাউকে আঘাত করতে যাব!’
‘তবে কাল মজিদের গলা চেপে ধরেছিলে কেন?’
‘কারণ.. শুনুন, আমি সত্যিই কারও ক্ষতি করতে চাই না। বাবাকে কিছু করব ভেবেও তার পাশে যাই না। মজিদ ভাইকে আমি অনেক রেসপেক্ট করি।’
‘কেমন? সে তো কাজের লোক।’
‘আপনার লাগতে পারে। কিন্তু তিনি আমাদের পরিবারের অংশ।’
‘তুমি বললে তুমি কাউকে আঘাত করতে চাও না…’
‘সত্যিই চাই না। আমি এমনটা নই। আমি মায়ের মতো কোমলমনা আর বাবার মতোই… শান্ত। ওইসব রাগ, জেদ আমার চরিত্রে নেই। আমার কেবলই লাগে, এসব কেউ আমার মাধ্যমে করাচ্ছে।’
‘কে করাচ্ছে?’
‘আমি জানি না।’
‘তোমার চোখের নিচে কালচে হয়ে আছে। রাতে কি ঘুমাও না?’
‘না।’
‘কেন?’
‘আমি দুঃস্বপ্ন দেখি। এক বীভৎস দুর্গন্ধময় লোককে দেখি। স্বপ্নে সে আমায় বারবারই বলে, আমি যাতে সকলকে আঘাত দিয়ে দূরে ঠেলে দিই। এমনটা বললে আমি ওর ওপর আক্রমণ করতে যাই। কিন্তু আমি তার বিরুদ্ধে বেশিক্ষণ লড়তে পারি না। সে জিতে যায়।’ আলিয়া সত্যিই সুস্থ হতে চায়। নইলে এসব কথা সে সাইকিয়াট্রিস্টকে সত্যি সত্যি বলত না। আমাকে তো বলেইনি। আহ্! মেয়েটা তার কাছের লোকের কথাই ভাবছে। খুব খারাপ লাগল।
‘তোমার কী মনে হয়, বাস্তবে যেসব করছ ওই লোকটিরই ইশারায়?’
‘জানি না।’
‘তুমি কি মিষ্টি কিংবা কম ঝাল খাবার পছন্দ কর না?’
‘দেখুন,’ সে তার জিহ্বা দেখাল। কি সাদা! ‘কম ঝালেও পানসে ভাবটা আমি পাই।’
আলিয়ার হাত অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। তা লোকটিও লক্ষ করলেন।
‘এসব বাদ দাও। এটা বলো, তোমার মাইন্ডে এখন কী চলছে?’
সে জোরপূর্বক বলল, ‘কেউ যেন বলছে, আমি যাতে আপনাকে লাথি দিই।’
আমরা সবাই আতঙ্কিত হই। কিন্তু লোকটি অবাক হলেন, ‘তোমার হাত-পা আমাকে লাথি দেওয়ার জন্য কাঁপছে। তবে দিচ্ছ না কেন?’
সে ঠোঁট কামড়িয়ে বলল, ‘কন্ট্রোল করছি। আমি আপনাকে অপছন্দ করি না!’
‘ইউ আর সাচ অ্যা স্ট্রং গার্ল।’ এই ব্যাপারটা কোথাও যেন শুনেছি। ওহ্! সাবরিনার স্মৃতি পড়ার সময়। সেই স্মৃতিতে দেখেছিলাম, আমাদের আলিয়ার মাইন্ড পড়তে না পারার কথা নিয়ে সবাই ডিসকাস করছিল। হয়তো সাবিলাই বলেছিল, আলিয়া আরেকজনের ব্যথা নিজের মতো করেই অনুভব করতে পারে। এটা ওর দুর্বলতা হলেও শক্তির চেয়ে কম নয়, কারণ ও এটা সবল আর তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক দিয়ে করে থাকে। ‘তুমি কীভাবে করছ এই কাজ?’
সে ধৈর্য হারাচ্ছে। ‘বাবা, উনাকে এখনই যেতে বলুন।’ সে ঠোঁট কামড়াল, যেন ব্যথা পেয়েছে।
লোকটি হাত দেখিয়ে আঙ্কেলকে বলল, ‘না থাক।’
আলিয়া কপাল কুঁচকাল। সাইকিয়াট্রিস্ট আর কিছু বলতে যাবে, তখনই তাঁকে আলিয়া লাথি দিলো। তিনি তার মুখোমুখি দেয়ালে গিয়ে ছিটকে পড়লেন। তিনি ব্যথা কিছুটা পাওয়ার সত্ত্বে আঙ্কেলকে বললেন, ‘ইটস ওকে।’
তিনি আবারও আলিয়ার কাছে যেতে চাইলে সে দাঁত বের করে হিসহিস করতে লাগল, যেন তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে, আর এখনই কামড়ে বসবে। আমি দৃশ্যমান হতেও পারছি না। আলিয়া এগিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় আঙ্কেল আর মজিদ ভাই দৌড়ে গেল। সে নিজেকে থামানোর পর হুঁশ হারিয়ে পড়ে গেল। আমি অস্ফুট একটা শব্দ করলাম। ভাগ্যিস, বাকিরা আলিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ