#মিঠা_রোদ
#পর্ব:১
#লেখা:সামিয়া খান প্রিয়া
পনের বছর বয়সে আমি পঁয়ত্রিশ বছরের এক বলিষ্ঠ পুরুষের প্রেমে মজেছিলাম।গুণে গুণে আমার থেকে বিশটা বছরের বড় ছিল।কীভাবে হলো প্রেমটা সেই বিষয়ে আজও আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।ব্যক্তিটার ভালো নাম কবীর শাহ।যার নাম শুনলে আম্মুর প্রিয় স্বপ্নের নায়ক সালমান শাহ এর কথা মনে পড়ে যায় আমার।দেখতে কিন্তু সে নায়ক বটে।গমরঙা দেহ,সুললিত কণ্ঠ,অকম্প ত্বক।ঠোঁটে সবসময় তির্যক হাসি।কবীরের আমার প্রতি কীভাবে ভালোবাসা তৈরী হয়েছিল সেই গল্প আমাকে কোনো এক বিকেলে শুনিয়েছিল সে।ভালোবাসার গল্প,ঘৃ ণা র গল্প,হারিয়ে গিয়েও হারিয়ে যাওয়ার গল্প।কিন্তু পরিশেষে এটা আমার গল্প।
(আরম্ভ)
কোনো এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর মেয়ে বিয়ের উপলক্ষে আশেপাশের যতো প্রকারের দরিদ্র মানুষ রয়েছে তাদের দাওয়াত করেছে সে।শ’য়ে শ’য়ে মানুষেরা টেবিলে খাওয়া দাওয়া করছে।অপর পাশে আত্নীয়দের জন্য খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে।সবেমাত্র মায়ের হাতে খেয়ে চেয়ারে বসে পা দুলাচ্ছে তোশামণি।অসহায় মানুষদের খাওয়া দেখতে ভীষণ ভালো লাগে তার।যখন সে বড় হবে তখন এমন একটা রেস্ট্রুরেন্ট খুলবে যেখানে তিনবেলা এরকম টেবিল সাজিয়ে দাওয়াত খাওয়াবে মানুষদের।দুই টাকার বিনিময়ে।পরবর্তীতে সেই টাকা দিয়ে একটা গাছ রোপণ করবে?এরপর..।ভাবনা এগুতে পারলো না তোশা।তার বয়সী একটা ছেলে চেয়ার নিয়ে পাশে বসলো। হালকা কেশে বলল,
“তুমি ভাইয়ার চাচাতো শালী তাইনা?”
তোশা নিশ্চুপে মাথা নাড়িয়ে নাবোধক অর্থ প্রকাশ করলো।ছেলেটা পুনরায় উৎসাহী হয়ে বলল,
“আমাদের পক্ষ থেকে কেউ?বাসে তো দেখিনি।”
“আমি ছেলে পক্ষও না।মেয়ে পক্ষও না।”
ছেলেটা ভ্রুঁ কুঞ্চিত করলো।এই সুন্দর গোলগাল পরীর মতোন ফর্সা দেখতে মেয়েটাকে কোনোমতে অসহায় মনে হচ্ছে না।উল্টো ছিমছাম শরীরে সুন্দর দামী একটি ফ্রক।ছেলেটি পুনরায় শুধালো,
“তুমি তবে কার পক্ষ থেকে এসেছো?”
“আমার আম্মু এই পুরো বিয়েটা দেখছে।মানে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে।”
“ওহ বুঝেছি।অনুষ্ঠানটা অন্য লোকেরা সাজিয়েছে?এজন্য সব জায়গায় এভাবে শাহ লেখা।তাইতো বলি বিয়েটা আমার বড় ভাইয়ের।অথচ অন্য ছেলের নাম কেন?আচ্ছা শাহ কে হয়?”
তোশা মাথা দুলিয়ে বলল,
“চিনিনা।কখনো দেখিনি।তবে শুনেছি আম্মুর পার্টনার।”
“বাই দ্য ওয়ে তোমার নাম কী?”
“তাইয়ুবা চৌধুরী তোশা।ক্লাস নাইনে পড়ি।তোমার নাম কী?”
“মেহরাব খান।তুমি চৌধুরী, আমি খান।দুজনে কিন্তু শত্রু।আমিও ক্লাস নাইনে পড়ি।”
তোশার চোখদুটো ছোট ছোট হয়ে গেলো।প্রথম দেখায় মেহরাবকে খারাপ লাগেনি তার।আলাপ করার ইচ্ছা আছে।কিন্তু সে নিজে থেকে কিছু বলবেনা।মেহরাব অবশ্য এটা ওটা বলে খুব অল্প সময়ে তার সঙ্গে সখ্যতা করে নিলো।দুজনে নানা বিষয়ে আলাপ করছে।এমন সময় মেহরাব বলল,
“আচ্ছা তোশা এভাবে বসে থাকলে কোনো মজা পাবেনা।চলো ওদিকটায় আমরা সবাই কিছু একটা করবো।”
কৌতূহলী হয়ে তোশা বলল,
“কী করবে?”
“চলো তো আগে।”
“দাঁড়াও আম্মুকে বলে নেই।”
উঠে দাঁড়ালো মেহরাব।উপহাস করে বলল,
“তুমি ছোট বাচ্চা?আন্টিকে বলে যেতে হবে?”
নতুন তৈরী হওয়া এই বন্ধুর মুখে নিজেকে ছোট বাচ্চা বলা শুনতে মটেও ভালো লাগলো না তোশামণির।তাইতো মায়ের সবসময় বাধ্যগত সন্তান মাকে না জানিয়ে মেহরাবের সঙ্গে কমিউনিটি সেন্টারের নির্জন পাশটায় চলে গেলো।
(***)
তাহিয়ার শুভ্র নাকটায় শিশির দানার মতোন ঘাম জমে আছে।পরনে জামদানী শাড়ীটা ঈষৎ এলেমেলো হয়ে গিয়েছে।চিকন, সরু দেহ তার।মসৃণ ত্বক।মাত্র বিশ বছরে মা হয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ছাঁপ তার মধ্যে নেই।গত মাসে পঁয়ত্রিশ তম জন্মদিনের সাথে নিজের একমাত্র মেয়ে তোশারও পনের তম জন্মদিন পালন করলো।অথচ চেহারায় পঁচিশ বছরের যুবতীর ছাঁপ।বছর দশেক আগে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে নিজেই সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছে।আপাতত শিল্পপতীর মেয়ের এই বিয়েটা পার করতে পারলে সে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে।তার টিমের সবথেকে বয়স্ক লোকটি তড়িঘড়ি করে এসে বলল,
“ম্যাম,এখনও লাইটিং ঠিক হচ্ছে না।লাইনেই সমস্যা।এভাবে চললে সন্ধ্যায় রাস্তা দিয়ে ধোঁয়াও তৈরী করা যাবে না।”
“পাপন আঙকেল বিষয়টা আপনি দুই ঘন্টাতেও সমাধান করতে পারেননি?ওদিকে কবীর ফোনের উপর ফোন করছে।পুরো বিষয়টা পার্ফেক্ট না হলে প্রচুর সম্মানহানী হবে।”
“ম্যাম, আমরা তো চেষ্টা করছি।”
“বর-বউয়ের এন্ট্রি সন্ধ্যায় এমন হবে সেটা ছয় মাস ধরে ঠিক করা।আর আপনি আজ বলছেন যে চেষ্টা করছি?আফসোস।”
বিরক্তির ফলে তাহিয়ার কপাল কুঁচকে এলো।ইদানীং সাধারণ বিষয়ে রাগ উঠে যায়।তোশা পেটে থাকাকালীনও এতোটা মুড সুইং হয়নি।ফোন ভাইব্রেট হলো।স্ত্রীনে কবীর নামটা ভেসে উঠছে।ব্যক্তিটার ফ্রেন্ডের ছোট ভাইয়ের বিয়ে।এজন্য সব যেন পার্ফেক্ট হওয়া চাই।তাহিয়া জানে এখন ফোন রিসিভ করলে কথা কাটাকাটি হবে দুজনের।এজন্য আস্তে করে ব্যাগে ভরে রাখলো।উষ্ণ শ্বাস ফেলে নিজের এসিস্ট্যান্টকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোশা কোথায় দ্বীপা?”
“খাবারের ওখানে তো বসে ছিল।”
“মানে?তোমাকে না বলেছিলাম সবসময় ওর খোঁজ রাখতে?যাও খুঁজে নিয়ে এসো।”
“জি ম্যাম।’
ক্ষণবাদে দ্বীপা শূন্য ফিরে এসে বলল,
“তোশামণি ওখানে নেই ম্যাডাম।আশেপাশে কোথাও দেখিনি।”
তাহিয়ার আত্নাটা কেমন যেন করে উঠলো।একমাত্র মেয়েকে সে চোখে হারায়।
“নেই মানে?কোথায় গিয়েছে?”
“জানিনা।”
“ই ডি য় ট।ওকে খুঁজো।আমার মেয়েটা বোকাসোকা।”
তাহিরা হন্তদন্ত হয়ে আশে পাশে দেখতে লাগলো।মনে প্রাণে চাচ্ছে তার সন্তান যেন সুস্থ থাকে।
(***)
দিনের আলো কমে আসছে ক্রমশ।তোশা ভারী লেহেঙ্গাটি ধরে এদিক ওদিক তাঁকাচ্ছে।মেহরাব তাকে অচেনা এই রাস্তাটা ধরে কোথায় নিয়ে এসেছে বুঝতে পারছেনা।এই জায়গাটি তার জন্য নতুন।গাজীপুরে আগে কখনো আসা হয়নি।তোশার খুব আফসোস হচ্ছে কেন সে নতুন কিছু দেখার লোভে গেটের বাহিরে চলে এলো।রাস্তা দিয়ে লোকেরা নামাজের জন্য মসজিদে যাচ্ছে।তাদের কয়েকজনকে কমিউনিটি সেন্টারের কথা জিজ্ঞেস করেছিল।কিন্তু সে ছোট বেলা থেকে পূর্ব পশ্চিম চিনেনা।ফল স্বরুপ পূর্ব ভেবে পশ্চিমে চলে এসেছে।তোশা একসময় হতাশ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লো।পাশে একজন মহিলা যাচ্ছিলো।তাকে দাঁড়া করিয়ে বলল,
“আন্টি একটু শুনুন।”
মহিলাটি তার উপর থেকে নিচে একবার তাঁকিয়ে দেখলো।কাঠকাঠ হয়ে জবাব দিলো,
“কী চাই?”
“আপনার কাছে ফোন থাকলে একটু দিবেন?আম্মুকে কল করবো।”
“টাকা নাই ফোনে।”
কথাটি খুব দ্রুতবেগে বলে মহিলাটি চলে গেলো।তোশার কান্না পাচ্ছে এখন।অন্যদিকে রাস্তাটি নির্জন হয়ে আসছে।হঠাৎ একটা কুকুর ডেকে উঠলো।সঙ্গে আরো কয়েকটি কুকুরের ডাক।দলবদ্ধ হয়ে প্রাণী গুলো ঝগড়া করতে করতে এগিয়ে আসছে।তোশা এই প্রাণীটিকে খুব ভয় না পেলে অচেনা পরিবেশে মন যেন কেমন করে উঠলো তার।মৃদু সুরে কান্না করতে করতে দৌড় লাগালো।পিছন পিছন কুকুর গুলোও যেন আসছে।প্রচন্ড ভয়ের মুহুর্তে একটা গাড়ী তাকে অতিক্রম করে থেমে গেলো।সেখান থেকে একজন ছায়ামূর্তি নামলো।তোশা বলে দৃঢ় কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো।মেয়েটা থামলো।কুকুর গুলোর বিষয়টা আগুন্তক বুঝতে পেরে এগিয়ে গেলো।
“তোশা অবশেষে তোমাকে পেলাম।তাহিয়ার অবস্থা খুব খারাপ।এতদূরে কীভাবে এলে?”
অচেনা কণ্ঠ।কখনো শুনেনি মেয়েটা।তবে পরিচিত কিংবা অপরিচিত দেখলো না।ছুটে গিয়ে লোকটার উপর ঝাপিয়ে পড়লো।ভাগ্যিস ব্যক্তিটা শক্ত করে ধরেছিল মেয়েটিকে।তোশা একদম তার পেটানো দেহের সঙ্গে মিশে গেলো।মিষ্টি সুবাস নাকে এসে ঠেকলো আগুন্তকের।শান্তসুরে বলল,
“বেবী গার্ল।সব ঠিক আছে তো।আমি আছি।”
কম্পমান কণ্ঠে তোশা শুধালো,
“কে আপনি?আম্মুর কাছে নিয়ে চলেন।”
আগুন্তক নরম সুরে বলল,
“আমি কবীর শাহ।ভয় নেই আমার সাথে।”
কবীর শাহ নামটি তোশা নিজেও একবার উচ্চারণ করলো।নির্জন রাস্তায় তোশার নিকট নামের শব্দগুলো কেমন অদ্ভূত মধুর শুনালো।সে পুরুষটির সঙ্গে আরেকটু মিশে গেলো।
চলবে।