মায়াবী হরিণী পর্ব ৬

0
1939

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
মায়াবী হরিণী পর্ব ৬
লিখাঃ জামিয়া পারভীন তানি

ছোঁয়া খুশিতে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে৷ সিজদাহ্ থেকে উঠে ফুয়াদের উদ্দেশ্যে বলল,
“ আজ এসএসসি রেজাল্ট দিয়েছে জানেন? ”
“ হুম, কেউ ছিলো তোমার পরিচিত? ”
“ আমি গোল্ডেন এ+ পেয়েছি। ”
ফুয়াদ চরম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। ছোঁয়া আবার বলল,
“ অনেক কষ্ট করে এই ফলাফল অর্জন করেছি। বলতে পারেন স্বপ্ন গুলোর একটা ধাপ পার করলাম। ”

ফুয়াদ বলল,
“ তুমি পরীক্ষা দিয়েছিলে?”
“ জ্বি, দিয়েছিলাম। ”
“ কোন স্কুল থেকে পড়তে?”
“ বাসার কাছে বলে বাওয়া স্কুলে পড়েছিলাম। ”
“ প্রাইভেট পড়তে কার কাছে? ”
“ স্কুলেই মন দিয়ে পড়া বুঝে নিতাম, আর এরপরেও না বুঝতে পারলে আড়ালে দাঁড়িয়ে আপনার পড়ানো শুনতাম। ”
ফুয়াদের চোখ ছলছল করছে। হয়তো পানি বেরিয়ে পড়বে। সেইজন্য ইচ্ছেকৃত ছোঁয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। একে তো ওকে কাজের মেয়ে ভেবেছিলো ওই বাসার, এরপরে ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করতো বলে একটা সময় খারাপ মেয়েও ভেবে নিয়েছিলো। অথচ এই মেয়ের অন্তরে ছিলো অন্য উদ্দেশ্য। আবার ছোঁয়া কে অশিক্ষিত ও ভেবেছিলো। নিজের বউ শিক্ষিত হোক কে না চায় এই আধুনিক যুগে! এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে ফুয়াদের । কিছুটা সময় একা থেকে ওয়াশরুম থেকে বের হলো ফুয়াদ। এসেই দেখলো মা মেয়ে তে পরীক্ষা পাশের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। ফুয়াদ ছোঁয়ার দিকে একনজর দেখে বাইরে চলে গেলো। ছোঁয়া একটু অবাক হলো, উনি এভাবে এড়িয়ে চলে গেলেন কেন!

২ ঘন্টা পর ফুয়াদ ফিরে আসলো, হাতে এক প্যাকেট মিষ্টি। এসেই প্রথমে মিষ্টির প্যাকেট খুলে নিজ হাতে ছোঁয়ার দিকে মিষ্টি এগিয়ে দেয়। ছোঁয়া একটু লজ্জা করছিলো বলে ফুয়াদ বলল,
“ লজ্জার কি হলো! আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো!”
ছোঁয়া মিষ্টি মুখে নেওয়ার সময় ফুয়াদের হাত ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়৷ ছোঁয়া লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে। অন্যরকম শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তার ভিতরে। ধ্যান ভাঙলো ফারুকের কথায়,
“ কিরে, কিসের মিষ্টি খাওয়াচ্ছিস ওকে?”
ফুয়াদ খুশি মনে জবাব দেয়,
“ বাবা, আমার এই ছাত্রী গোল্ডেন পেয়েছে। সেইজন্যই…”
ফুয়াদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ফারুক বলল,
“ বাহ বাহ, এতো দুঃসংবাদের মধ্যে একটা ভালো খবর আসলো তাহলে। ”
সারা হাসিমুখে বলল,
“ এখন আগে খেয়ে নাও৷ পরে মিষ্টি খেও। ”
ফারুক ও মুচকি হেসে বলল,
“ হ্যাঁ তাই তো, ক্ষুধায় পেট জ্বলছে। ” বলেই হাতমুখ ধুতে চলে যায়।
ছোঁয়া মনে মনে ভাবলো,
“ একটা পরিবার, এতো অমায়িক। এতো ভালোবাসা পেতে ভাগ্য লাগে৷ মানুষের টাকা থাকলেও সুখ থাকে না। অথচ এরা অভাব কে পাত্তা না দিয়ে সব কিছু তে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলেই হয়তো এতো সুখে আছে। সবই আল্লাহর মেহেরবানী ”
রাত্রে ফারুক ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ৫ জন একসাথে গল্প করতে বসে৷ সারা ছোঁয়া কে বলল,
“ আচ্ছা তুই যে পরীক্ষা দিয়েছিস, কখনো বলিস নি কেন?”
ছোঁয়া একটু লজ্জা পেয়ে বলল,
“ ভেবেছিলাম রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাবে! তাই লজ্জায় বলিনি৷ ”
ফুয়াদ ও বলল,
“ আমি নিজেও জানতাম না, ও নিজের মাঝে এতো রহস্য লুকিয়ে রাখে!”
নেহাও ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বলল,
“ ভালোই হয়েছে, আমরা সারপ্রাইজড হয়েছি বটে৷ মাঝে মাঝে অন্যরকম বিনোদন লাগে। তাহলে মন ভালো থাকে। ”
ফাহাদ ভাবীর ভালো রেজাল্ট শুনে আজ একটু খুশিই হয়েছে বটে৷ সেজন্যই বলল,
“ তা ভাই, ছোটাপু কে আর পড়াশোনা করাবি না?”
“কেন করাবোনা, ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট করার আমি কে?” ফুয়াদ বলল
নেহা ও বলল,
“ হ্যাঁ পড়াবি, তবে ও যেখানে পড়তে চাইবে সেখানেই দিস। ”
এবার ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ তা ছোটাপু, তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী কেউই নেই দুনিয়ায়? ”
“ মামা খুব ভালো, কিন্তু উনি দেশে নেই৷ ”
“ কোথায় থাকে? কি করে?”
“ দেড় বছর আগে উনি ইতালি চলে গেছিলো। এখন ওখানে বিল্ডিং বানানোর কাজ করে। জানি খুব কষ্ট হপ্য উনার, তবে বাসায় এখন ভালোই টাকা পাঠাতো। ”
“ আর তোমার বাবা মা?”
নেহার কাছে বাবা মায়ের কথা শুনতেই একদম চুপসে যায়। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তবুও বলল,
“ আমি বাবা মা কে কখনো দেখিনি৷ আমার নানীর কোলে বড় হয়েছি । নানী মারা যাবার পর থেকে মামা আমার কাছে চলে আসে। ”
“ মা বাবা কি মারা গেছে? ”
“ বাবা মারা গেছেন, গ্যাস সিলিন্ডার নাকি বিস্ফোরণ হয়েছিলো। সে আমার জন্মের কিছুদিন পর। বাবাকে বাঁচানো যায়নি৷ নাকি পুরো দগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। বাবার পোড়া লাশ দেখে দাদী স্ট্রোক করে মারা যায় সেদিনই। বাবাই দাদীর একমাত্র ছেলে ছিলো বলেই হয়তো সহ্য করতে পারেনি । আর দাদা তো আগেই মারা গিয়েছিলো। ব্যস, হয়ে গেলাম এতিম৷ আপন সবাই একসাথে চলে গেছে আল্লাহর কাছে। ”

ছোঁয়া খুব কাঁদতে লাগলো। সারা ওর মাথা নিজের ঘাড়ের ওপর নিয়ে শান্তনা দিচ্ছে। এসময় ফুয়াদ আবার জিজ্ঞেস করলো,
“ আর মা, কি হয়েছে উনার?”
ছোঁয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদ বুঝতে পারছে ছোঁয়া কষ্ট পাচ্ছে, তবুও বলল,
“ জানা টা দরকার ছোঁয়া। ”
“ মা জেলে আছে, দেখতে ইচ্ছে করে না তাই দেখিনি। ” কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে গেছে ছোঁয়ার।
সারা বলল,
“ থাক, মায়ের কথা বলতে না চাইলে বলিস না, কিন্তু কি অপরাধ যে জেলে যেতে হলো?”

ছোঁয়া আর কিছু বললো না। সারার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। ফাহাদ আগেই বেরিয়ে যায়, তাই ফুয়াদ ও বেরিয়ে যায় রুম থেকে, ঘুম আসবেনা হয়তো, মেয়েটার দুঃখী মুখ টা চোখের সামনে ভাসছে। কত কিছু সহ্য করছে ছোট্ট জীবনে, হয়তো ওর জন্মদাত্রী আরও কষ্ট দিয়েছে, যেটা বলতে চাইছেনা সে৷ কিন্তু জানার জন্য মন টা ছটফট করতে থাকে ফুয়াদের।
°°°
পরের দিন থেকে যে যার মতো কাজ শুরু করে। ছোঁয়া ও রাতে ঘন্টা খানিক কেঁদে ঘুমিয়ে গেছিলো। ঘুম থেকে উঠে আবারও স্বাভাবিক জীবন শুরু করে, যেন গত রাতে কিছুই হয়নি। আবার সবাই হাসিখুশি সব সামলাতে থাকে। ১০ টা দিন ভালোই কেটে যায়। সেদিন কাজ করছে সারা আর ছোঁয়া৷ বাসায় কেউ ছিলো না এমন সময় কলিংবেলের শব্দে সারা দেখতে গেলো কে এসেছে। মুখ পরিচিত বলে দরজা খুলে ভিতরে আসতে দেয় সারা। কথা বার্তার এক পর্যায়ে মেয়েটা বললো,
“ গয়না গুলো কি এই পিচ্চি টা বানায়?”
সারা খুশি হয়ে বলল,
“ ও ই করে। ধৈর্য আছে ওর৷ ”
“ কে হয় ও আপনার? ”
“ আমার ছোট মেয়ে। ”
মেয়েটা তখন বলল,
“ বাহহ, আপনার সব ছেলে মেয়েই দেখছি কাজের। “
“ আল্লাহর রহমতে সবাই অনেক ভালো। ”
মেয়েটা আবার বলল,
“ গয়নার ডিজাইন গুলো ভালো লেগেছে, একদম নতুন নতুন স্টাইলের। ও কে আমার বুটিকের শোরুমের গয়না বানানোর কাজ দিতে চাচ্ছি। বিভিন্ন জামা বা শাড়ির সাথে ম্যাচিং গয়না পেলে আমাদের ও বিক্রি ভালো হবে। আর ন্যায্য মূল্য ও দিবো আপনাদের। ”
সারা একটু ভেবে বললো,
“ ওর বাবা বাসায় আসুক, আগে কথা বলি। এরপর না হয় ভাবা যাবে এই প্রস্তাব সমন্ধে৷ ”
ছোঁয়া একটু খুশি হয়েছে, তবুও মনে একটা ভয় ফুয়াদ রাজি হবে কিনা!

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে