#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
মায়াবী হরিণী পর্ব ৩
লিখাঃ জামিয়া পারভীন তানি
“ ছোঁয়া মেয়েটা তোর বউ তাইনা! ” যেই ফুয়াদ টিউশনি শেষ করে বাসায় পা রেখেছে, ওমনি সারা ছেলেকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে।
ফুয়াদ মায়ের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। সারা আবার বলল,
“ মায়েরা সব বুঝতে পারে, কখন ছেলে মিথ্যে বলে। বুঝেছি বাবার ভয়ে কিছুই বলিস নি। ”
শুকনো মুখে ফুয়াদ বলল,
“ মাফ করো মা, এক স্টুডেন্ট এর বাড়িতে ফেঁসে গেছি৷ ও মেয়ে মানুষ, রাস্তায় ফেলে আসতে পারিনা। তাই আমার মহীয়সী মায়ের দরবারে হাজির করেছি। ” ফুয়াদ কথা গুলো আস্তে করে বলে ফ্রেস হতে ঢুকে গেলো৷
মাত্রই সবার খাওয়া শেষ করে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। ফুয়াদ প্রতিদিনই লেট করে আসে, তাই মা ছেলের জন্য প্রতিদিন না খেয়ে অপেক্ষা করে। ছেলের কাছে কনফার্ম হয়ে খাবার বাড়ে সারা। যেভাবেই হোক, মেয়েটা কে খুব মনে ধরেছে সারার। বিপদে যখন পড়েছে, তখন মেয়ের মতই থাকুক। একটা সময় না হয় বউ করে নিবো, আগে ফুয়াদের গতি তো হোক৷ কিন্তু ফুয়াদের বাবা কি মানবে! ভয় মনের মাঝে চাপা রেখে ফুয়াদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ফুয়াদ আসলে একসাথে খেয়ে নেয়। সারা বেশী কথা বাড়ায় না, ফারুক শুনলে রাগারাগি করবে। তাছাড়া ফুয়াদের পড়াশোনা ও অনেক বাকি৷
ফুয়াদ ঘরে ঢুকে দেখলো নেহাপু পড়ছে। আর ছোঁয়া নেহাপুর পাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। পর্দার ওপারে ভাই ও পড়াশোনা করছে। একপলক দেখেই নিজের বই খুলে পড়তে শুরু করে। ঘন্টা খানিক পড়ার পর ছোট ভাই ফাহাদ ফিসফিস করে বলল,
“ ভাই, মেয়েটা তো ভালোই। মনে ধরেছে নাকি!”
“ কুনজর দিবিনা। পড়া শেষ করে ঘুমা। ”
ভাইকে এই প্রথম রেগে যেতে দেখলো ফাহাদ৷ বুঝতে পারলো না কি এমন হয়ে গেলো। তাই সম্মান দিয়েই বলল,
“ সরি ভাই, বুঝতে পারিনি। ”
নেহাও এপাশ থেকে উঠে আসলো ভাইদের কাছে। ভাইদের মাঝখানে বসে ফিসফিস করে বলল,
“ ভাই তো আমার বড় হয়ে গেছে, ভাবী হিসেবে মেয়েটা মন্দ নয়। ”
ফুয়াদ চোখ বড় বড় করে তাকায়, ছোঁয়া সব বলে দেয়নি তো আবার! নেহা আবার বলল,
“ মেয়েটাকে প্রথম দেখেই বুঝেছি অসহায়, তবে ভাই কে তো চিনি, সে কখনো অচেনা মেয়েকে বাসায় আনবেনা জানি৷ সে থেকেই বুঝে নিয়েছি যেভাবেই হোক ও তোর বউ। ”
ফুয়াদ ফিসফিস করে বলল,
“ ফেঁসে গেছি আপু, বিয়ে করতে চাইনি। একটা ছাত্রী আমাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে ওদের বাসার কাজের মেয়েকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। বাবা কে বলিস না প্লিজ, বাবা জানলে খুব রাগ করবে৷ ”
“ ও কাজের মেয়ে! দেখে মনেই হচ্ছেনা। হয়তো ওর অন্য কোনো পরিচয় থাকতেও পারে! “
“ জানিনা আপু, আমি ওর নাম ছাড়া আর কিছুই জানিনা। ”
“ ওই ছাত্রীর বাসায় ভালো করে খোঁজ লাগাতে হবে। তাহলেই বুঝতে পারবি ওর পরিচয়। ”
“ ওরা মা আর মেয়ে ছাড়া ওই বাসাতে আর কেউ নেই। ”
“ ছোঁয়া নিশ্চয়ই বলবে। ”
“ ওকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করিও না। বাবা বুঝে ফেলবে৷ কাল রাতে চারজন একসাথে ছাদে যাবো, এরপর না হয় ওর থেকে কথা নিবো৷ ”
ফাহাদ বলল,
“ তাহলে ওকে কি বলে ডাকবো? ”
“ খবরদার ভাবী বলিস না, ছোট আপু ডাকবি। ” ফুয়াদ সাথে সাথে বলল।
“ কেন?”
“ আরে গাধা, বাবা জানলে কি হবে বুঝতে পারছিস?”
ফাহাদ সম্মতি দেয়৷
সেদিনের মতো পড়ার বই খাতা গুটিয়ে যে যার মত ঘুমিয়ে পড়ে। পরেরদিন আবার কার্যক্ষেত্রে যেতে হবে। প্রয়োজন মতো না ঘুমালে এনার্জি পাবে না।
ফজরের ওয়াক্তে ছোঁয়ার আগে ঘুম ভাঙে। আগে থেকেই নামাজ পড়ার অভ্যাস আছে। ছোঁয়া উঠে নেহা কে ডাক দেয়,
“ আপু উঠুন, নামাযের সময় হয়ে গেছে। ”
নেহা চোখ কচলিয়ে উঠে পড়ে। মেয়েটা তো খুব ভালো, কাল রাতে গল্প করতে গিয়ে ঘুমাতে দেরি হয়ে গেছে বলে ফজরের নামাজ পড়তেও দেরি হয়ে গেছে । ছোঁয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে নেহা বলল,
“ অনেক শুকরিয়া ছোটাপু। ”
ছোঁয়া অবাক হয়, নেহা কত বড়, তবুও তাকে আপু ডাকছে দেখে। ছোঁয়া তাকিয়ে আছে দেখে নেহা বলল,
“ তাড়াতাড়ি নামায পড়ে নাও, এরপর কোরআন শরিফ পড়ে যে যার মত কাজ করবো। ”
ছোঁয়া খেয়াল করলো ফুয়াদ আর ফাহাদ নেই, ওরা আগেই মসজিদে চলে গেছে হয়তো। ওজু করে এসে যে যার মত নামাজ সেরে নেয় । এরপর কোরআন শরিফ পড়ে নেহা বাইরে যায়। ছোঁয়া ও পিছু পিছু যায়৷ নেহা বলল,
“ মা এর শরীর টা ভালো নেই, আজ আমিই নাস্তা বানাবো। তুমি চাইলে রেষ্ট নাও। ”
“ নেহাপু তুমি দেখিয়ে দাও, আমিই নাস্তা তৈরি করি। ”
“ তুমি নতুন মানুষ, তোমাকে এতো দায়িত্ব দিই কিভাবে বলো! শুতে না চাইলে চুপচাপ দেখো কি করছি। ”
নেহা আটা মাখালো, তখন ছোঁয়া নেহার হাত থেকে বেলন পিড়া কেড়ে নিয়ে নিজেই রুটি বেলতে শুরু করে। দুজনের ভালোই ভাব জমে গেছে৷ ছোঁয়ার রুটি হতে হতে নেহা আরেকটা চুলায় আলুভাজি তৈরী করে ফেলে৷ সকাল সকাল দুইজন মিলে নাস্তা মায়ের ঘরে নিয়ে যায়। সারা নামাজ পড়ে আরেকটু ঘুমিয়েছিলো৷ নাস্তা দেখে বলল,
“ আমায় বললেই হতো, তোরা খুব বড় হয়ে গেছিস তাইনা! আমি কি নাস্তা করতে পারিনা নাকি!”
নেহা বলল,
“ হ্যাঁ পারো, দুপুরের খাবার রেডি করে পারো কিনা দেখিয়ে দিও। এখন তোমার মেয়েরা যা করেছে সেগুলো খাও দেখি। ”
সারা হাসলো, নেহার সাথে কখনো কথায় পারে না। তিনজন মিলে খেয়ে নেয়। ততক্ষণে ফাহাদ আর ফুয়াদ ও চলে আসে। সারা জিজ্ঞেস করলো,
“ এতক্ষণ কোথায় গিয়েছিলিস?”
“ মসজিদে নামাজ পড়ে , কোরআন পড়া শেষ করে বারান্দায় কোচিং এর পড়া করছিলাম। ” ফুয়াদ বললো।
ফাহাদ ও বলল ওরা একসাথেই পড়ছিলো।
সকালের পড়া ভালো মনে থাকে। সেজন্য প্রতিদিন ই ওরা পড়ে। বাড়ি টা গলির ভিতর, আলো বাতাস কম। তাই মসজিদের বারান্দায় পড়া টা কেই নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত করেছে দুই ভাই।
ফাহাদ খেয়ে নিয়ে কলেজ বের হয়, আর ফুয়াদ কোচিং এর উদ্দেশ্যে। নেহা ও ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হয়। নেহা সপ্তাহে তিন দিন বা দুই দিন ভার্সিটি যায়। প্রতিদিন ক্লাস থাকেনা, নইলে কষ্ট হতো প্রচুর। নেহা বেরিয়ে যাওয়ার পর ফারুক আলী আসে বাজার নিয়ে।
ডায়াবেটিস আছে, নামাজ শেষ করে হাটার পর একেবারে বাজার নিয়েই উঠে। ঘেমে গেছে ৫ তলা পর্যন্ত এত ভারী বাজারের ব্যাগ বহন করে আনতে গিয়ে।
সারা শাড়ির আঁচল দিয়ে ফারুকের মুখ মুছে দেয়। ওই মুহুর্তে কারেন্ট চলে গেছিলো দেখে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করা শুরু করে। ছোঁয়া দূর থেকে এই দম্পতির ভালোবাসা দেখে অবাক।
ফারুক বলল,
“ মেয়েটা কি এখানেই থাকবে? ”
“ আহা, অনাথ কে আশ্রয় দিলে আল্লাহ খুশি হন। ”
“ তাহলে বাসায় অনাথ আশ্রম খুলি!”
“ আরে, রাগ করো কেন? উঠতি বয়সের মেয়ে কে তাড়িয়ে দিই কিভাবে বলো! ওর যদি বিপদ হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহ কি আমাদের মাফ করবেন?”
“ উঁহু, সারা, পারোও ইমোশনাল ব্লাকমেইল করতে। বলো, মেয়েটা কে মনে ধরেছে। কাছেই রাখতে চাও। ”
“ সেটা নয়। যাও ফ্রেস হয়ে খেয়ে অফিসে যাও। ”
ফারুক এই একজনের কাছেই নরম। কিন্তু ছেলে মেয়েদের সামনে সবসময় গরম দেখায়। বাবা হিসেবে কখনো ছেলে মেয়েদের একটু আদর দেয় না। হয়তো আর্থিক সংকটের জন্য ছেলে মেয়েদের সামনে হাসিখুশি থাকতে লজ্জা বোধ করে।
ফারুক চলে যাবার পর ছোঁয়া আসে সারার সামনে। সারা হাতের কাজ করছে।
“ মা এটা কি করছেন? ”
“ আর বলো না মা, নিচের ফ্লাটে বিয়ের অনুষ্ঠান ৫ দিন পর। তাই ব্লাউজ আর পেটিকোট সেলাই এর অর্ডার নিয়েছি। ”
“ আপনি অর্ডারে কাজ নেন?”
“ এইতো, শুধুমাত্র হাতখরচ এর জন্য যতটুকু সম্ভব করি৷ ”
“ আচ্ছা মা, ওই আপুরা নিশ্চয়ই শাড়ির সাথে অর্নামেন্টস ও কিনবে! ”
“ কিনতেই পারে। কেন বলতো?”
“ আপনি আমার সাথে বাজারে যাবেন? তাহলে কিছু হাতের কাজ আমিও করতাম। ওরা যদি পছন্দ করে কিনে নেয়!”
“ তুমি কি বানাতে চাচ্ছো!”
“ প্লাস্টিকের ফুল দিয়ে হলুদের সাজের জন্য গয়না৷ ”
“ তুমি ওগুলো পারো!”
“ এর আগে তারানা কে বানিয়ে দিয়েছিলাম। তখন ওগুলো দেখে অনেকে পছন্দ করেছিলো। কিন্তু অর্ডার নিতে দেয় নি মামী৷ ”
“ মামীর বাসায় থাকতে!”
“ মা, পরে বলবো এসব। উনি বলতে না করেছেন। ”
“ ও সব বলেছে, তুমি যে ওর বউ ও সেটা বলেছে। ”
ছোঁয়া অবাক হয়, ছেলেটা সত্যিই বলে দিলো! তাহলে কি বউ হিসেবে তাকে মেনে নিবে? নাকি আবার তাকে তাড়িয়ে দিবে? মনের ভেতর অনেক প্রশ্ন জাগে। সেগুলো দমিয়ে রেখে সারা কে সব খুলে বলে কি ঘটেছিলো কাল৷ অতঃপর সারা কে রাজি করিয়ে কর্ণফুলী মার্কেট এ যায়। প্রয়োজনীয় সব কিনে নিয়ে ফিরে আসে প্রায়ই দেড় ঘন্টা পর। কাজ করতে হবে ছোঁয়া কে, এভাবে এই মধ্যবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষ গুলোর মাথার বোঝা হবার কোন মানেই হয়না।
চলবে….
অনেক বড় করে দিচ্ছি প্রতিটি পর্ব দিনে দুইটা করে। যেন তাড়াতাড়ি শেষ করা যায়। যাই হোক কেমন লাগছে ওদের জীবন?