#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
মায়াবী হরিণী পর্ব ২
লিখাঃ জামিয়া পারভীন তানি
আশেপাশে চিৎকার শুনে ফুয়াদ পিছনে ঘুরে দেখে। মেয়েটা রাস্তায় পড়ে আছে। মানবিকতার খাতিরে পিছনে ফিরে গেলো। ছোঁয়া রাস্তার উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে৷ একটা লোক ছোঁয়ার হাত ধরে টান দেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন ফুয়াদ লোকটার হাত থেকে ছোঁয়ার হাত ছাড়িয়ে নেয়।
“ একটা মেয়ের গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন? লজ্জা করে না!”
“ আরেএএ, বেঁচে আছে কি মরে গেছে দেখবোনা!” লোকটা অবাক হয়ে বললো।
“ ও মরে গেলে পুলিশ কেস হবে, আর ফিঙ্গার প্রিন্ট পেয়ে আপনি ফেঁসে যাবেন। সো ছোঁবেন না ওকে। ”
লোকটা ভয়ে হাত সরিয়ে ফেলে। ফুয়াদ ব্যাগের ভেতর থেকে পানি বের করে ছোঁয়ার মুখে ছিটা দেয়। ছোঁয়া কিছুক্ষণ পর চোখ পিটপিট করে তাকায়৷ ফুয়াদ রাগী গলায় বললো ,
“ মেয়ে নাটক করছো তুমি! অজ্ঞান হবার ভান ধরো! যাতে সদয় হয়ে তোমাকে নিয়ে যায়!”
ছোঁয়া কাঁদতে শুরু করে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
“ কাল রাত থেকে কিছুই খাইনি৷ ”
“ ইসস, ন্যাকামি করছো৷ খাওনি বুঝি! ভনিতা বুঝি আমি। ”
“ আপনি চলে যান, আসলেন কেনো আবার!”
ফুয়াদ রাগ করে হাটা শুরু করে। লোকজন কিছু বুঝতে না পেরে ছোঁয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ছোঁয়া বলল,
“ কোথাও যাবার জায়গা না পেয়ে উনার পিছু নিছিলাম। তাই উনি রাগ করে বকাবকি করছে৷ ”
নীচু মনের লোক একজন বলেই বসলো,
“ তাহলে আমার বাসায় চলো। কোন কিছুই অভাব হবেনা। ”
ফুয়াদের কানে কথা টা যায়। বিবেক বাঁধা দেয়, ছোঁয়া কে ফেলে যেতে। আবার ফিরে এসে বললো,
“ চলে এসো ছোঁয়া। ”
ছোঁয়া আশেপাশে কিছুই না দেখে ফুয়াদের পিছু নেয়। ফুয়াদ হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়, ফুটপাতের দোকান থেকে পাউরুটি কিনে ছোঁয়া কে দেয়। ছোঁয়া না খেয়ে তাকিয়ে আছে ফুয়াদের দিকে। অদৃশ্য এক মায়া কাজ করছে। এটা কি পবিত্র বন্ধনের টান! ছোট বেঞ্চের উপর বসে, ছোঁয়া ও বসে পড়ে। অনেক রাস্তা হেটেছে, ক্লান্ত বড্ড। ফুয়াদের দিকে একবার তাকিয়ে পাউরুটি চিবাতে শুরু করে। মনে হচ্ছে কতো দিনের ক্ষুধার্ত ।
ফুয়াদ ও বিস্কুট নেয় একটা। ছোঁয়ার পাউরুটি খাওয়া হলে দাম শোধ করে উঠে দাঁড়ায় ফুয়াদ। ছোঁয়া কে বলল,
“ তুমি এখানেই বসে থাকবে। কোথাও যাবে না৷ আমি একটা টিউশনি করে আসছি। ”
ছোঁয়া ভীত গলায় বলল,
“ আসবেন তো!”
“ না এসে উপায় আছে! টিউশনি না করলে তো পেটে ভাত জুটবে না। আজ বেশী পড়াবোনা, আধা ঘন্টা অপেক্ষা করো প্লিজ। ”
ফুয়াদ একটা বাড়িতে ঢুকে যায়। ছোঁয়া একটা গাছের গুড়িতে গিয়ে বসে। জানেনা ফুয়াদ ফিরে আসবে কিনা! তবুও অপেক্ষা, একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর৷
ফুয়াদ আলী, মাত্রই এইচএসসি দিয়েছে। ছোঁয়ার থেকে দুই বছরের বড়। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, পড়াশোনার খরচ চলে টিউশনির টাকা তে। বাবা ছোট চাকুরী করে, বেতন মাত্র ১০০০০ টাকা। এ দিয়ে চিটাগং এর মতো শহরে তিন ভাই বোন কে পড়ানো কষ্ট সাধ্য ব্যপার। তাও কুলিয়ে যেতো, যখন বাচ্চারা ছোট ছিল। কিন্তু এখন ওদের পড়াশোনা খরচ বেড়ে গেছে। সম্ভব হয় না ফারুক আলীর পক্ষে সব কিছু সামলানো। বড় মেয়েটা অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে। বিবাহ উপযুক্ত, তবে চিটাগং এর মতো শহরে যৌতুক ছাড়া বিয়ে ভাবা অসম্ভব। ছোট ছেলে ফাহাদ আলী এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার এ উঠে গেছে। দুই ভাই ই ছোট ক্লাসের টিউশনি করে নিজেদের খরচ চালায়। মেয়েটাও কম পরিশ্রম করে না! আশেপাশে তিন টা বাচ্চাকে পড়ায়, সাথে নিজের পড়াশোনা কন্টিনিউ করছে। এক কথায় সংগ্রামী পরিবার, নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন এর যুদ্ধে অবিরাম লড়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের সাগর পেরিয়ে সুখের ভেলায় ওঠা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছেনা।
প্রায়ই ৪৫ মিনিট পরে ফুয়াদ আসে, এসে দেখে ছোঁয়া এখনো গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা মেয়ে কতটা নিরুপায় হলে এমন হয়ে বসে থাকে! বাস্তবতা অজানা ফুয়াদের কাছে। কাছে গিয়ে ছোঁয়ার হাতে থাকা পোটলা টা নিজের ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়। এরপর একটা লোকাল বাসে ছোঁয়া কে আগে উঠিয়ে দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থাকে। যেনো ছোঁয়া কে কোনো পরপুরুষ ছুঁতে না পারে।
লালখান বাজার থেকে ২নং গেট পর্যন্ত আসতে প্রায়ই আধাঘন্টা লাগিয়ে দিলো। খুব জ্যাম ছিলো বৈকি। লোকাল বাসে উঠলে কখন পৌছাবে কোন ঠিক নেই। দুজনেই ঘেমে নেয়ে একাকার। বাস থেকে আগে ছোঁয়া কে নামিয়ে নিজেও নেমে যায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে চললো। তবুও রোদের তেজ কমেনা। সারাদিন ভালোই তাপ সরবরাহের সার্ভিস দিচ্ছে।
অলিগলি হাটার পর ফুয়াদ একটা বাসায় ঢুকে। পাঁচ তলা পর্যন্ত সিড়ি বেয়ে উঠতে পা যায় যায় অবস্থা। সারাদিন কষ্ট, এরপর কি-না এতো লম্বা সিড়ি। কলিংবেল চাপতে একটা ছেলে দরজা খুলে দেয়। খুলেই জোরে করে বলল,
“ বাবা দেখো, ভাইয়া মেয়ে নিয়ে এসেছে। ”
ফুয়াদ রেগে গিয়ে বলল,
“ এই তুই থামবি। ”
“ মেয়েটা কে বল ভাইয়া। ”
এরি মধ্যে ফারুক আলী এসে দাঁড়ায়। ফুয়াদ ভয়ে ভয়ে বলল,
“ আমার ছাত্রী, ওর বাবা মা কাল এক্সিডেন্ট করে মরে গেছে। আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। তাই এখানে নিয়ে এসেছি। ”
ফারুক আলী মুখ ভার করে বলল,
“ খুবই দুঃখের সংবাদ বাবা। কিন্তু আমাদের অভাবের সংসারে কিভাবে আরেকজনের দায়িত্ব নিবো বল? ”
ছোঁয়া বুঝতে পারছে এই বাড়ি তার জন্য নয়৷ কোথায় যাবে এখন সে! মামী তো কখনো ওই বাড়িতে ঢুকতে দিবেনা।
এরই মাঝে ফারুক আলীর স্ত্রী সারা এসে বলল,
“ মেহমান তাড়িয়ে দিলে আল্লাহ নারাজ হন।”
এই বলে ছোঁয়া কে বলল,
“ এসো মা, ভিতরে চলো। ”
ছোঁয়া একটা ভরসার হাত পেলো। ছোঁয়া আবেগে সারা কে মা বলে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে।
দুই রুমের বাসা, ভাড়া ৮০০০ টাকা। ছেলে মেয়েরা একটু আধটু সাহায্য করে বিধায় শহরে দুই রুমের বাসাটা ভাড়া নিয়েছে। গ্রামে থাকলে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করানো অসুবিধা, আবার শহরে টিউশনি করে আয় করা যায় ভালো। ফুয়াদ তিনটা টিউশনি করে ১০৫০০ আয় করে। তার মাঝে আজ একটা বাদ চলে গেলো। নতুন একটা টিউশনি না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই ফুয়াদের।
এক রুমে মা বাবা, আরেক রুমে মাঝখানে পর্দা দিয়ে একপাশে বোন, অন্যপাশে দুই ভাই থাকে। পরিবারে ছোঁয়া এক্সট্রা যোগ হলো। নেহার সিঙ্গেল তোষকে দু’জন কে কষ্ট করে ঘুমাতে হবে।
একটু বিছানা পেয়ে ছোঁয়া ঘুমিয়ে পড়ে। ফুয়াদ আড়চোখে একবার খেয়াল করে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“ মা, ও কাল থেকে ক্ষুধার্ত, ঘরে খাবার থাকলে দিও। আমার আরেকটা টিউশনি আছে। ”
এই বলে মা কে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ে ফুয়াদ৷
রাত ৮ টা নাগাদ নেহা ফিরে আসে, এসেই বলল,
“ মা ক্ষুধা লেগেছে, খাবার রেডি করো৷ আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। ”
ঘরে ড্রেস নিতে গিয়ে ছোঁয়া কে দেখে বাইরে ফিরে এসে বলল,
“ ওই মেয়েটা কে মা ?”
“ কোন এক অনাথ মেয়ে, ফুয়াদের সাথে এসেছে। ”
“ ভাই চুপেচাপে বিয়ে করলো নাকি আবার!”
“ আরে না, ওর বাপ মা কাল এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে নাকি। কেউ নেই আত্মীয় স্বজন। ”
“ ভাই চিনলো কিভাবে আবার!”
“ ওর ছাত্রী ছিলো নাকি!”
“ হায় আল্লাহ! তাহলে ভাইয়ের একটা স্টুডেন্ট কমে গেলো! ”
হতাশার ছাপ কাটিয়ে নেহা বলল,
“ ব্যপার না মা, আমার খোঁজে আরেকটা ছাত্র আছে। ভাই না হয় ওকেই পড়াবে কাল থেকে। ”
সারা বললেন,
“ রিজিকের মালিক আল্লাহ, তিনিই ব্যবস্থা করবেন। ” মা এর নির্লিপ্ত জবাব।
সারা মেয়ের বেডে বসে ছোঁয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ছোঁয়া খুব ভীতু ছোট থেকেই। এক লাফে উঠে বসে। ভীত গলায় বলল,
“ মাফ করবেন, কখন যে ঘুমিয়ে গেছিলাম, বুঝতেই পারিনি। ”
“ আরে আরে, ক্ষমা চাওয়ার কি আছে। চলো খাবে, চোখ মুখ একেবারে শুকিয়ে গেছে তোমার। ”
ছোঁয়ার লজ্জা পাচ্ছে, এরা এমনিতেই মধ্যবিত্ত পরিবার। এদের খাবারে কিভাবে ভাগ বসাবে সে! তাই বলল,
“ আমার ক্ষুধা নেই, আপনারা এখন খেয়ে নিন প্লিজ। ”
“ অতিথি কে অভুক্ত রেখে কখনো খেতে নেই, আল্লাহ পাপ দিবে।”
ছোঁয়া আর কথা না বাড়িয়ে বলল,
“ ওয়াশরুম কোন দিকে? একটু গোসল করে নিলে ভালো লাগতো। ”
“ আচ্ছা, ১০ মিনিট পরে যেও। আমার মেয়ে নেহা এখন গোসলে গেছে। ”
“ আচ্ছা মা, সরি ভুলে মা ডেকে ফেলেছি। ” ছোঁয়া কে থামিয়ে দেয় সারা। এরপর বলে,
“ তুমি আমার মেয়ের মতই, মা বলেই ডেকো কেমন।”
ছোঁয়া অস্পষ্ট স্বরে মা ডেকে সারা কে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে। উনি অনেক ভালো মহিলা, উনার সাথে কি মিথ্যা বলা ঠিক হচ্ছে! নিজের মাঝে আবার অপরাধ বোধ জেগে উঠে ছোঁয়ার।
চলবে….