Sunday, October 5, 2025







মা’ওয়া পর্ব-০৩

~মা’ওয়া~
মোর্শেদা হোসেন রুবি
পর্ব-০৩

ইশারাকে দেখেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন ময়না বিবি। ইশারার নিজেও কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। তবে এবার সে নিজেকে সামলে নিতে পারলো।
মৃদু অনুযোগের সুরে বললো , “এবার একটু কিছু খাও আম্মা। দাঁড়াও, আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি। ”

ময়না বিবি ধীরে ধীরে দুপাশে মাথা নাড়লেন। খাবেননা।
ইশারা কিছুটা তড়পে উঠলো, ” না খেয়ে থাকলে কার উপকার হবে শুনি ? বাবার যাবার সময় হয়েছে সে চলে গেছে। তোমাকে তো বাঁচতে হবে। না খেয়ে মরবে নাকি ? ”
ময়না ছলছলে চোখে ইশারার দিকে তাকালেন। চোখের পানিতে অন্যরকম দ্যুতি। হাত বাড়িয়ে ইশারাকে কাছে টেনে ফের হু হু করে কাঁদলেন। ইশারার কেন যেন হঠাৎ বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে সবকিছু। উষ্মা চাপতে না পেরে বলেই ফেললো, ” তুমি এভাবে কাঁদলে আমি কাল পরশুই হোস্টেলে চলে যাবো। থাকবো না এখানে। কাঁদো তুমি সারাদিন বসে বসে ।”

রাগটা কাজে দিলো। এতোক্ষণে কথা বলে উঠলেন ময়না বিবি। দ্রুত বলে উঠলেন,” না, মা। তুমি যায়োনা। তুমি গেলে আমি একলা হইয়া যামু। এই দুইন্যাত আমার অহন তুমি ছাড়া আর কেউ নাই গো মা। আমি যে অহন এতিম।’ বলতে বলতে ময়নার চোখে পানিতে ভরে গেলো।

ইশারা এবার উঠে দাঁড়ালো। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার আগে ঘাড় ফিরিয়ে বললো, ” স্বামী মরলে মানুষ এতিম হয়না আম্মা, হয় বিধবা। আর আমি যদি সত্যিই তোমার মেয়ে হয়ে থাকি তাহলে আমার কথা তোমাকে শুনতে হবে। অল্প হলেও খেতে হবে। পাশের বাড়ি রাহিমা চাচি আমাকে বলেছেন যে তুমি গতরাত থেকে না খেয়ে আছো। এদিকে এখন বাজে বেলা তিনটা। উঠো, হাত মুখ ধোও। আমি তোমার জন্য অল্প করে বিরিয়ানী নিয়ে আসি।”

” বিরানি খামু না মা। কয় আহে। আমারে তুমি দুইটা বিস্কুট দ্যাও, তাইতেই হইবো।”

” অসম্ভব। খালি পেটে বিস্কুট খেতে পারবে না তুমি । পেটে গ্যাস হবে। তারমধ্যে এখানকার বিস্কুটগুলোতে আটা আর ডালডা ছাড়া কিচ্ছু নেই। আমি দেখছি তোমার জন্য অন্য কিছুর ব্যবস্থা করা যায় কিনা। এ বাড়িতে তো নাকি চুলা জ্বালানো যাবেনা। এই নিয়মটা কেন তুমি জানো আম্মা ? ”

ইশারা চাইছে ময়না স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বলুক। তার আচরণ ইশারার ভালো লাগছে না। বিছানা থেকে উঠে বসতে গিয়েই থরথর করে কাঁপছে। তাকাচ্ছেও কেমন ব্ল্যাঙ্ক চোখে। অনেক সময় বড় ধরণের শক পেলে মানুষ এমন ভারসম্যহীন আচরণ করে। ছোটমা কী আসলেই ভয়ঙ্কর শক খেয়েছেন ? নাকি বাইরে সবাই যা বলছে সেটাই ঠিক ? ছোটমা কী আসলেই অভিনয় করছেন ?

ইশারা বেরিয়ে এসে ঘরের পেছন দিয়ে রাহিমা চাচিদের বাড়ি চলে এলো। চাচির ঘরে ঢোকার মুখেই গতকালকের মুশকো জোয়ান পালোয়ানটাকে দেখে থমকে গেলো ইশারা। তবে ওরচেয়ে বেশি থমকালো ঐ পালোয়ানটা নিজেই। চাচির সাথে কোন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো সে। কথা অসমাপ্ত রেখেই দ্রুত ঘর ছাড়লো সে। ইশারাকে দেখে রাহিমা নিজেই এগিয়ে এলেন।

” কী রে মা ? কিছু বলবি ? ”

” চাচি একটু সাদা ভাত আর ডাল হবে ? আম্মার জন্য নিতাম। বাড়িতে চুলা জ্বালানো নিষেধ। আগামী তিনদিন চুলা জ্বালানো যাবেনা। বুঝতে পারছিনা কীভাবে কী করবো। আমার তো একটু গার্গেলও করা দরকার। গলাটা খুশখুশ করছে। ”

রাহিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ” চুলা জ্বালাতে পারবে না কেন মা? এমন তো কোন নিয়ম নেই। তুমি বাড়ি গিয়েই চুলা জ্বালবে।”

“তাহলে গোধূলি যে বলছিলো…!”।

রাহিমাকে মাথা নেড়ে ফ্রিজের দিকে যেতে দেখে অর্ধেক বলেই থেমে গেলো ইশারা। রাহিমা ফ্রিজ থেকে খাবারের বাটি বের করতে করতে বললেন,” আমাদের দেশের মানুষজন সব কিছু নিয়ে একটা রহস্য রহস্য খেলতে ভালবাসে। নবী সাঃ বললেন, যাদের আপনজন মারা গেছে তাদের জন্য দিনটা কষ্টের। রেঁধে খাবার মানসিকতা থাকেনা। তোমাদের (আত্মীয়) উচিত তাদের খাবার পাঠানো। ব্যাস্, সেই ‘উচিত’ শব্দটাকেই এরা এভাবে নিয়েছে আর চুলা জ্বালানোকে হারাম করে দিয়েছে। কী আর বলবো রে মা !” বলতে বলতে ছোট্ট একটা টিফিন ক্যারিয়ারে তিনি সাদা ভাত, লাউয়ের বিচির ভর্তা, করলা ভাজি আর ডিমের দোঁপেয়াজা সাজিয়ে ফেললেন। ইশারা চোখ কপালে তুলে কিছু বলতে যাচ্ছিল। রাহিমার মৃদু ধমকে সে থেমে গেলো।

” এটা তুমি আর তোমার ছোট আম্মা দুজনেই খাবে। ভর্তাটা ভালো হয়েছে। খেয়ে দেখো। লায়লার মায়ের ভর্তার হাত অসাধারণ।”

” লায়লা কে ? ঐযে তখন যে মেয়েটাকে দেখলাম সেই মেয়েটা? ”

” হ্যাঁ। ঐটাই লায়লা। ”

” ওহ। চাচি আপনি এতো খাবার দিয়েছেন। সবটা তো খেতে পারবো না। রয়ে যাবে অনেকটা।

” সমস্যা নাই। বাকি খাবার ফ্রিজে রেখে দিও, রাতে গরম করে খেয়ে নেবে। আর গোধূলি চুলা জ্বালাতে মানা করলে ওকে জিজ্ঞেশ করবে চুলার পরিবর্তে ওভেন বা হিটার জ্বালানো যাবে কিনা। এটার হুকুম কী। ” বলেই চাচি মুচকি হাসলেন। আর তা সংক্রমিত হলো ইশারার মাঝেও। সারাদিনে এই প্রথম ইশারা হাসলো। বললো, ” আমি তাহলে যাই চাচি।”

” আচ্ছা এসো। ”

” ওহ , চাচি আরেকটা কথা জানতে চাচ্ছিলাম।” বলতে বলতে গেট থেকে ফিরে এলো ইশারা।

” দুপুরে দেখলাম একজন চাচাজানকে গোসল করিয়ে দিচ্ছেন। ওনাকে আমার খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো। আপনাকে জিজ্ঞেস করবো কিন্তু কথার তোড়ে একদম ভুলে গেছি তখন। কে উনি ? ”

” ওমাহ, উনি মানে কী। ও তো আমাদের ইনজি…!” রাহিমার কোঁচকানো মুখ উজ্জ্বল হাসিতে ভরে গেলো । ইশারার অবস্থা আরো শোচনীয়। অস্ফুটে উচ্চারণ করলো সে।

” ইনজি মানে ? আপনি কী আপনাদের ইনজিমামের কথা বলছেন ? মানে ঐ যে চশমা পরতো, শুকনো মতো…? ”

সুহাসিনী রাহিমাকে এবার দেখা গেলো আসল রূপে। তিনি হেসে গড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন ইশারার বলার ভঙ্গি দেখে। কী ভেবে নিজেকে সংযত করে নিলেন। ইশারার কাঁধ ছুঁয়ে বললেন,” ওর গল্প পড়ে অন্যসময় করা যাবে। এখন তোমার মায়ের কাছে যাও মা। তাকে একটু কিছু খাওয়াও।”

” ওহ হ্যাঁ। আচ্ছা, আমি যাই চাচি। ” বিস্ময়ের প্রবল রেশটুকু নিয়েই বাড়ি ফিরলো ইশারা। ওর মাথায় কোনভাবেই আসছে না একজন মানুষ এমন আমূল বদলে যেতে পারে কীভাবে। কোথায় পাঁচ বছর আগের সেই তালপাতার সেপাই। আর কোথায় এ ? এ তো যে দেখা যায় রীতিমত তাগড়া যুবক।

ঘরে ঢোকার মুখেই রুমানার মুখোমুখি পড়ে গেলো ইশারা। যদিও সে পেছনের পথ দিয়েই বাড়িতে ঢুকেছে। সেকারণেই হয়তো রুমানা টের পায়নি। ইশারাকে দেখে খানিক চমকে গেলেও দৃশ্যত নির্লিপ্ত রইলো।

ইশারা ঘরে ঢুকে রুমানাকে মায়ের সামনে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাকই হলো। মাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য যে সে আসেনি তা তো নিশ্চিত। তাহলে ঘটনা কী ! কৌতুহল চেপে মুখোভাব স্বাভাবিক রেখেই হাতের টিফিন ক্যারিয়ারটা টেবিলের ওপর রাখলো ইশারা। ঘাড় ফেরাতে দেখলো ছোটমা একটা হলদে কাগজে টিপসই দিচ্ছেন।

ইশারাকে তাকাতে দেখে ওকে দুচোখের ঝাপটায় কিছু বোঝাবার চেষ্টা করলো রুমানা। ইশারা সেটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলো না। কাছে গিয়ে বললো, ” এটা কী রুমানা আপা ? ”

ততক্ষণে টিপসই দেবার কাজ শেষ। ইশারা কাগজটা হাতে নিতেই দেখলো সেটি একটি না-দাবি নামা। তাতে প্রথম পক্ষ এবং দ্বিতীয় পক্ষের দুটো কলাম রয়েছে। ছোট মায়ের টিপ সইটা প্রথম পক্ষের কলামে। নিচে ব্রাকেটে সনাক্তকারীর স্বাক্ষর রয়েছে। ইশারার বিস্ময় খানিক আগের বিস্ময়কে ছাড়িয়ে গেলো যা ইনজিমামের কথা জানার পর হয়েছিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” বাহ্, টিপসই দেবার আগেই সনাক্তকারী সই করে ফেলেছে ? সে জানলো কীভাবে এখানে কার সই হবে? ” ইশারা হাতের কাগজটা মেলে ধরলো রুমানার দিকে। সে ওটাকে ছোঁ মেরে নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে বললো, ” সেটা তোর না বুঝলেও চলবে ইশারা।”

” হ্যাঁ, তা তো চলবেই। বাবা মারা যাবার পর তোমরা সবাই মিলে যা শুরু করেছো তা তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। দুটো দিনও যেতে দিলেনা। আজই তোমাদের সব ফায়সালা হওয়া চাই ? তোমরা এমন কেন করছো আপা ? সম্পত্তি কী পালিয়ে যাচ্ছে ? আর তোমরা কেন ছোটমাকে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করতে চাইছো ? তিনি কী বাবার কেউ নন ? ”

” চুপ কর। চ্যাঁচাবি না। সে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে আমার বাপের ভিটেতে। বিয়ে করে এখন ওয়ারিশ বনে গেছে। আমরা লালমিয়ার রক্ত। আমরা তার ওয়ারিশ। আর কেউ না। তাছাড়া তাকে তো আমরা ঠকাচ্ছি না। একটা ভালো এমাউন্ট তাকে দিয়ে দেয়া হবে। আর কী চাই ? ”

” এটা কত বড় অন্যায় ভাবতেও পারছো না। এতো তাড়াতাড়ি তোমরা এভাবে সবকিছু করতে পারছো কী করে রুমানাপু ? ” কান্না এসে কণ্ঠরোধ করলো ইশারার। ছোট মায়ের দিকে তাকালো। পাথরের মুর্তির মতো বসে আছেন ময়না বিবি।রুমানা ততক্ষণে চলে গিয়েছে। ইশারা ময়নার সামনে বসলো।

” তুমি টিপসই দিলে কেন মা ? ”

” ওরা চাইলো। ” অথর্বের ভঙ্গিতে কথাটা বললেন ময়না। শেষ করলেন ‘তাই দিলাম’ শব্দ দিয়ে।

” চাইলেই দিয়ে দেবে ? জানতে চাইবে না কিসের সই দিচ্ছো ? ”
ময়না তাকালেন। কিছু বলতে গিয়েও মুখ নামিয়ে নিলেন। ইশারা বিরক্তিচেপে উঠে গেল। একটা প্লেট ধুয়ে তাতে সামান্য ভাত আর ভাজি ভর্তা সাজিয়ে ছোটমায়ের সামনে ধরলো। তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেটা হাতে নিলেন। ইশারা পানি ঢালতে ঢালতেই তার নির্লিপ্ত আচরণ লক্ষ্য করছিলো।

একপর্যায়ে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ” খাচ্ছোনা কেন মা? খাও।”

ময়না ভাতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, ” লোকটা না খাইয়া আছে।”

ইশারা প্রথমে কথাটা ধরতে না পারলেও পরক্ষণে বুঝতে পেরে বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” খাও তো আম্মা। বাবা এখন খাওয়া খাদ্য গ্রহন করার অবস্থাতে নেই। এসময় কী হয় তা আমি পুরোপুরি জানি না। তবে যতটুকু বুঝি মৃতদের খাবারের দরকার হয়না। কাজেই এসব চিন্তা বাদ দাও আর ভাতটুকু খাও। অল্প করে দিয়েছি। সবটুকু খাবে। ”

ময়না ইশারার দিকে তাকালেন। ইশারার মনে হলো ছোটমা তাকিয়েও ওকে দেখছেন না। দৃষ্টিটা ফাঁকা।
বিড়বিড় করে বললেন, “জানো মা, আমার প্রথম স্বামী আমারে অনেক মারতো। রুজ মারতো। খারাপভাবে মারতো। আমি বাঞ্জা না মা। আমার পয়লা বাচ্চা হের ঘুষিতে প্যাটেই মরসে। আমি কোন দোষঘাট করলে আমারে সারা রাইত খাটের কিনারে খাড়া করায়া থুইতো। মাইর খাইতে আমার ততটা খারাপ লাগতো না, ক্যান, সৎমায়ের ঘরে বহুত মাইর খাইছি তো। সইয়া গেছে কিন্তুক সারারাইত খাড়ায়া থাকতে বড় কষ্ট অইতো। ঘুমে চোখ ভাইঙ্গা আইতো। একদিন মাটিতে বইস্যা দেওয়ালে ঠেস দিয়া ঘুমায়া পড়ছিলাম। তানি উইঠা আমারে দেইক্কা চেইত্যা গেলেন। আমারে না ডাইক্যা আচক্কা আইস্যা সিনার মইদ্যে ইমুন লাত্থি দিলেন যে আমার বামদিকের বুকে জখম অইয়া গেলো। আমি উয়াশ লইতে পারতাছিলাম না। হেই ব্যাথা আমার জখমে চাক্কা বানলো। ইমুন বিষ…!”

” আম্মা। প্লিজ থামো। এসব শুনতে চাচ্ছিনা। ”

” তুমার বাবার লগে বিয়ার পর তানি আমারে চিকিৎসা করাইলেন। ঢাকায় হইলোনা বইলা ইন্ডিয়াত নিলেন। আমার ব্যাদনা কমলো। আমারে তানি অবসর পাইলেই তুমার মায়ের গল্প শুনাইতেন।” ইশারা দেখলো বাবার কথা বলতে গিয়ে মুখটা কেমন আদুরে হয়ে গেছে ছোটমায়ের। ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধার চোখে কিশোরীর হাসি। ইশারা বিস্ময় নিয়ে ছোটমার চেহারা আর চোখগুলো দেখতে লাগলো। কেমন চকচক করছে ওগুলো।

” তানি বলতো, কেমনে কইরা তুমার মায় আর তানি ভাব ভালোবাসা করছে। শুইন্যা আমিও তুমার মায়ের মতোন কইরা তারে খেদমত করনের চ্যাষ্টা করতাম। তানি একদিন হাইস্যা কইলেন। এইসব বাদ দ্যাও। তুমি আয়নার মতো পারবানা। ডাইন হাতের কাম বাও হাতে অয় না। শুইন্যা আমি মুখ কালা করলে তানি বলতো, তয় বাও হাতের কামও ডাইন হাতে অয় না। তুমি তুমার মতোন থাকো। আয়নারে তার জায়গায় থাকতে দ্যাও। আল্লা সাক্ষী আমি পরতেক দিন নিজেরে আয়না বিবি বানাইয়া তানির খেদমত করনের চ্যাষ্টা করসি। তানি হাসতেন। তবু আমারে কিছু কইতেন না। কোনদিন বকাবাজি করতেন না। তুইমুই করতেন না। অামি আমার জীবনে এত সরমান পাইনাই যা তুমার বাপে আমারে দিসিল। ফকিন্নি থিকা রাজরানী হইসিলাম। তয় আমি আয়না হইতে পারিনাই। গতকাইল রাইতে কী হইসে জানো ? তুমার বাজান, আমারে ডাইক্কা কয়, তুমারে ছাইড়া যাইতে কষ্ট লাগতাসে ময়না পাখি। তুমি তো পুলাহান মানুষ। কেমনে সব সামলাইবা। শুইন্যা আমি তো বুবা হইয়া গেছি। ষাইট বচ্ছরের বুড়ি আমি। আমি পুলাহান কেমনে অইলাম। তানি কইলেন, মনে হয় বাঁচুম না। তুমার কাছে সত্য কই, তোমারে অামি অনেক ভালো পাইছি ময়না পাখি। তুমি অনেক ভালো মাইয়া। আল্লায় যিমুন তুমারে বেহেস্তে ফাডায়। আমি কইছি আফনে লগে থাইক্কেন তাইলেই অইব। সেয় কী জানি কইতে চাইলো তারপর চুপ মাইরা গেলো। এমুন চুপ মারলো। আর কতা কইলো না।” বলেই হাতের প্লেটটা সরিয়ে রাখলেন ময়না বিবি।

বললেন,” আমি ভাত খামুনা মা। আমার গলা দিয়া ভাত নামবো না।”

ইশারার চোখ ভিজে এসেছিলো। বারকয়েক ঢোক গিলে খুব হালকা গলায় বললো,” বাবার এখন তার প্রথম স্ত্রী আয়নাবিবির সাথে দেখা হবে। দুজনে কথা হবে। তোমার কথা এখন তার মনে থাকবে না। কাজেই না খেয়ে থাকাটা একদম অনর্থক । তারচে ঠিকমতো খেয়ে নাও আর বাবার জন্য দোয়া করো। তুমি না খেলে আমিও খাবো না বলে দিচ্ছি।”

কথাগুলো বলে ইশারা ময়না বিবির পাশে এসে বসলো। মৃদু স্বরে বললো ,” আচ্ছা, আমি কী তোমার কেউ না ? ”

ময়না বিবির চোখ এখন ভরা বর্ষার পশ্চিমাকাশ। কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ইশারা তাড়া দিলো,” আর কোন কথা না। আগে চুপচাপ খেয়ে নাও। এতো
বারবার আর সাধতে পারবো না বলে দিলাম।”

জমাট কান্নাগুলোকে কলজে নিংড়ানো দীর্ঘশ্বাসের সাথে বাষ্পাকারে বাইরে বের করে দিলেন ময়না। নিতান্ত অনীহাভরে ভাতের দানাগুলো নাড়াচাড়া শুরু করলেন। নিকট অতীতের সোনালী স্মৃতিগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। দিনগুলোর আকর্ষণ কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে যাচ্ছে কপালপোড়া ময়নাবিবির জন্য।

======

পরদিন রাহিমা চাচি নিজেই এলেন ইশারাদের বাসায়। ময়নাবিবির সাথে দেখা করতে। তাকে দেখে দু গ্লাস শরবত বানালো ইশারা। ইশারার ইচ্ছে চাচির সুবাদে ছোটমাও একগ্লাস শরবত খেয়ে নিন। ইশারার চালাকিটা ময়না বুঝতে পারলেও কিছু বললেন না। নির্বিবাদে খেয়ে নিলেন শরবতটা।

রাহিমা ইশারার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” আজ সকালে আখতার গিয়েছিলো আমার বাসায়। আজ রাতেই নাকি সালিশ বসাবে ? ”

ইশারা বিস্মিত হলো, ” কিসের সালিশ ? ভাইয়া তো আমাকে কিছুই বলে নি।”

” সেকি,, তুমি তাহলে কিছু জানো না ?

” না তো। কী বলেছে ভাইয়া ? ”

” না তেমন কিছু না। সালিশে যেন তোমার চাচাজান উপস্থিত থাকে সেটাই অনুরোধ করলো। এদিকে আরেক ঝামেলা বেঁধেছে। তোমার চাচাজান আজ তোমাদের বিচারে থাকতে পারবে না। আমাদের বাড়িতেই আজ এক মস্ত বিচার বসবে। তাকে ঐ বিচারে থাকতে হবে। তোমাদের বাড়ির সালিশটা কাল রাখলে ভালো হতো। আজ রাতের বিচারটা বেশি জরুরী। ”

” আমি তো কিছু জানিই না চাচি। আমাকে কেউ কিছু জানায়ও নাই। আপনি একটু কষ্ট করে যাবার আগে ভাইজানকে বলে যাবেন চাচি।”

” হ্যাঁ, তা তো বলতেই হবে। ঐ বিচারটা খুব জরুরী। ”

” ওহ্, কী নিয়ে ঐ বিচার চাচি ? জায়গা জমি? ”

” না রে মা। বিচারটা বড় জটিল। এক ছেলে তার নিজের মায়ের নামেই বিচার চেয়েছে।”

” মায়ের বিচার ? ঠিক বুঝলাম না চাচি।” ইশারা আগ্রহী হলো।

” আমাদের কিতাবখানারই একটা ছেলে। সেই তার মায়ের নামে বিচার চেয়েছে। ” বলে সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাহিমা। ইশারার কৌতুহল বাড়লো।

” মায়ের বিচার? কীসের ? ”

রাহিমা কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেন। তারপর বললেন,
” ছেলেটার বাবা আমাদের এই গ্রামেরই একটা ছোটখাট মসজিদের ইমাম। বয়স কম, স্ত্রীও অল্পবয়সী। তাদের দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে এই ছেলেটাই বড়। মেয়ে অনেক ছোট। দুই ভাই বোন। মাত্র দুই মাস আগে ইমাম সাহেব মারা গেছেন। ছেলেটা হঠাৎ তার মায়ের চারিত্রিক সমস্যা নিয়ে বিচার চাইতে এসেছে তোমার চাচাজানের কাছে। সবাই বলছে, ইমামের বৌ কে দোররা মারা উচিত। সেই নিয়েই সালিশ। আমাদের বাড়িতেই বসবে এই সালিশটা।”

ইশারার কষ্ট বাড়লো। চারিদিকে এসব কী হচ্ছে। একজন ইমামের স্ত্রী হয়ে পদস্খলন ঘটবে এটা কেমন ধরণের কথা !

ইশারা ছটফটিয়ে উঠে বললো, ” চাচি, আমি কী এই বিচারের সময় উপস্থিত থাকতে পারি ? ”

” না, মা। মহিলাদের তো বিচারে থাকার অনুমতি নেই।”

” তাহলে ইমামপত্নী নিজের পক্ষের সাফাই দিবেন কীভাবে। ছেলে যদি তার নামে মিথ্যে অপবাদ দেয় ?”

” নিজের ছেলে মিথ্যে অপবাদ দিবে ? ” রাহিমা প্রশ্ন করলেন। তারপরই বললেন, ” ইমামের স্ত্রীকে আসতে বলেছে তোমার চাচা। সে আমার ঘরে বসে থাকবে। তার যা বক্তব্য সে আমাকে বলবে। আমার কাছ থেকে শুনে ইনজি ওর বাবাকে জানাবে। এভাবেই হবে সালিশটা।”

” চাচি প্লিজ আমি থাকতে চাই আজকের সালিশটাতে। আমাকে থাকার অনুমতি দিন।”

রাহিমা খানিক ইতস্তত করলেন। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন,” ইনজিটা বড় রাগ করে এসব বিচারে বাইরের কাউকে রাখলে।”

” আশ্চর্য, ইনজির এতো বড় সাহস সে আমাকে বাইরের মানুষ মনে করে ? ওকে বলবেন, তোর ইশারা বুবু থাকতে চাইছে বিচারে। তুই ঝামেলা করলে তোর কান মলে দেবে সে। ”

চলবে,,

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ