#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৪৬
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
খাবার টেবিলে বসে স্বপ্নিল পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। জামাই আদর কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি- আজ প্রকৃত অর্থে সে টের পেলো যেন! শাশুড়ি একটার পর একটা খাবার তুলে দিতেই আছেন তার প্লেটে, থামার কোন লক্ষণও যেন দূর-দূরান্ত অব্দি দেখা যাচ্ছেনা তার মধ্যে। দিশেহারা স্বপ্নিল একবার অসহায় চোখে শাশুড়ির দিকে তো আরেকবার রাহিতার দিকে তাকাচ্ছে৷ চোখের ইশারায় বুঝাচ্ছে ওকে এ আদর নামক অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু রাহিতা, সে আর রিদিতা দুজনে স্বপ্নিলের অবস্থা দেখে হেসেই একাকার হয়ে যাচ্ছে! স্বপ্নিল সেদিকে চোখ পাকিয়ে তাকালে রাহিতার মা খেয়াল করেন ব্যাপারটা। দুই মেয়েকে রাম’ধম’ক দিয়ে বলেন,
—এই তোদের সমস্যা কি? পাগলের মতো হাসছিস কেন খেতে বসে? ছেলেটাকে ঠিকমতো খেতেও দিচ্ছেনা৷ স্বপ্নিল বাবা, তুমি ওদের দিকে চোখ দিও না তো। তুমি শান্তিমতো খাও। শুরুতে এই একটু দিলাম। কোনোকিছু লাগলে অবশ্যই বলবে, কেমন?
শাশুড়ির কথায় স্বপ্নিল মুখে জোরপূর্বক হাসি ঠেলে দাতে দাত চেপে বলে,
—শুরুতেই যত কিছু দিয়েছেন, মা। এটুকুই আগে শেষ করি কোনোমতে। তারপর না নিবো!
স্বপ্নিলের কথায় শাশুড়িও একগাল হেসে মাথা নাড়িয়ে বাকিদের খাবার পরিবেশনে লেগে গেলেন। কোনোভাবে খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে রওনকের সাথে কথা বলছিলো স্বপ্নিল। এরই মাঝে অফিসের ফোন আসায় সে উঠে যায়। সে সময় রিদিতা আসে ওখানে। ওকে দেখে দুপুরের ঘটনা স্মরণে আসে স্বপ্নিলের। ইতস্তত করে কথাটা বলার জন্য উশখুশ করে। তবে কিভাবে বলবে ভেবে পায়না। এর মাঝে রিদিতা ওর অবস্থা লক্ষ্য করে শুধায়,
—কিছু বলবেন, ভাইয়া?
—না, মানে হ্যাঁ। আসলে…
স্বপ্নিলের ইতস্ততা দেখে কিছুটা আন্দাজ করে রিদিতা। সেভাবেই বলে ওঠে,
—ফাহিমের বিষয়ে বলতে চাইছেন তো? তখনকার ঘটনার ব্যাপারে?
রিদিতার কথায় খানিকটা চমকে উঠে স্বপ্নিল। তবে কি ফাহিম ওকে সবটা বলে দিয়েছে? আবার পরক্ষণেই ভাবলো দুজনের তো প্রেমের সম্পর্ক, একে-অপরের কাছে লুকোবেই বা কেন! বলাটাই স্বাভাবিক এক্ষেত্রে। নিজ কৃতকর্মে লজ্জিত স্বপ্নিল গলা ঝেড়ে নিজের সাফাই গেয়ে বলে,
—আর বলোনা শা’লী সাহেবা, তোমার বোন যে কি প্যারায় রেখেছে আমায়! ঝগড়া করে বেড়িয়ে এসেছিলো বাড়ি থেকে, ঠিকমতো কথা বলছিলোনা। আমি বেচারা জ্বর সেড়ে মাত্র এলাম তোমাদের বাসায়, এমন সময় রাস্তায় ফাহিমের সাথে দেখা। ওর মুখেই শুনি সে মেয়ে দেখতে আসছে এ বাসায়, সব মিলিয়ে আমার মাথায় তখন আমার বউ-ই ঘুরছিলো! একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম আমার শশুড়বাড়িতে বিবাহযোগ্য একখান শালিকাও আছে। তাইতো তোমার বোনের কথা ভেবে ফাহিমের সাথে ওমন বাজে আচরণ করে ফেলি। ওকে প্লিজ সবটা বুঝিয়ে বলো? কিছু মনে যেন না করে। আই এম ভেরি ইমব্যারাসড।
স্বপ্নিলের কথায় প্রথমে অবাক হলেও এক পর্যায়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে খানিকটা উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। তাতে স্বপ্নিল আরেকটু অস্বস্তিতে পড়লো। শা’লিটাও পেয়েছে একটা বাদর৷ ইচ্ছে করে হেসে ওকে আরও লজ্জায় ফেলছে! ইশ, সবাই তার বউয়ের মতো ভালো নয় কেন? স্বপ্নিল আনমনে ভাবে। এরপর নিজের ভাবনায় নিজেই বেকুব বনে! ওর তনে মনে যে পুরোপুরি রাহিতা জায়গা করে নিয়েছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যেন! সময় কতই না অদ্ভুত! একটা সময় যে মানুষকে নিজের পাশে সহ্যই হতোনা, জীবনসংগী হিসেবে তো দূরে থাক। আর এখন দু’বেলা সেই মানুষটাকে না দেখলেই মনের মাঝে কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে! স্বপ্নিলের ভাবনার মাঝেই রিদিতা বলে,
—ইটস ওকে, ভাইয়া। আপনার এত অস্বস্তিতে পড়তে হবেনা। ফাহিম অনেক বুঝদার ছেলে। আশা রাখছি ও নিশ্চয় আপনার পরিস্থিতি বুঝে নিবে।
এবার রিদিতার কথায় আশ্বস্ত হয়ে হেসে ফেলে স্বপ্নিল। ওর নিজের কাছেও ফাহিমকে যথেষ্ট ঠান্ডা মাথার ও বুঝদার ছেলে মনে হয়েছে। কেননা তখন যতটা স্বাভাবিকভাবে রাহিতার এক কথায় ও সবটা মেনে নিলো তখনই ওর প্রতি একটা ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয় স্বপ্নিলের মনে। এখন রিদিতার দৃঢ় কথায় যেন তা আরও পরিপক্ক হলো। ওদের কথার মাঝেই রওনক ফিরে আসে। দুজনের উদ্দেশ্যে বলে,
—কি ব্যাপার? দুলাভাই ও শালির কিসের এত হাসাহাসি? শালাবাবুকেও একটু বলো।
ওর কথার ধরনে স্বপ্নিল হেসে বলে,
—তেমন কিছুই না। এমনিই গল্প করছিলাম দুজনে। তবে আমি একটা ব্যাপারে কনফিউজড, রওনক। তুমি এখনো বিয়ে করছোনা অথচ ছোটবোন দুটোকে বিদায় দিয়ে দিচ্ছো। রাহিতারটা না হয় বুঝলাম তবে রিদিতাকে এত তাড়াতাড়ি কেন? ও তো এইচএসসিও পার করেনি এখনো! অন্তত ভার্সিটি উঠার পর বিয়ে দিতে পারতে?
স্বপ্নিলের কথায় রওনক ওকে ফাহিম-রিদিতার ব্যাপারে সবটা খুলে বলে। ফাহিম বিদেশ চলে যাবে মাস্টার্স করতে এজন্যই এত তাড়াতাড়ি আকদ করে রাখবে। ও কয়েক বছর পর দেশে ফিরলে তখন বড় করে রিসেপশন করে রিদিতাকে তুলে নিবে, এসব বলে। সবকিছু শুনার মাঝেই রাহিতা চলে আসে। সবাই কথাবার্তা শেষে যে যার মতো চলে যায় রুমে।
শ্বশুড়-শাশুড়ির জোরাজুরিতে আজ রাত স্বপ্নিল এখানেই থাকছে। কাল যেহেতু অফিসও নেই, তাই সকালে খেয়ে রাহিতার সাথে বাসায় চলে যাবে। দিলারা বেগমকেও ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে এ ব্যাপারে রাহিতার মা। আপাতত বেশ অনেকক্ষণ হলো রাহিতার রুমে স্বপ্নিল চুপচাপ বিছানায় বসে আছে। আর রাহিতা দাঁড়িয়ে রয়েছে জানালার ধারে। মেয়েটা কেন যে এত চুপচাপ হয়ে গেলো রুমে আসার পর থেকে স্বপ্নিল বুঝছেনা। মেয়ে মানুষদের সেন্টিমেন্টস সে এমনিতেই কম বুঝে, তার মধ্যে রাহিতার হুটহাট একেকবার একেকরকম মুড পরিবর্তন স্বপ্নিলের মাথার উপর দিয়ে যায় একপ্রকার। তবুও বউ তো! ওর ভালোমন্দের খবর তো স্বপ্নিলকেই রাখতে হবে। তাই সে বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে যায় রাহিতার নিকট। একদৃষ্টে জানালার বাইরে সুদূর আকাশে অবস্থিত চাঁদটার দিকে তাকিয়ে থাকা রাহিতাকে আচমকা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর চুলে মুখ ডুবে দেয় স্বপ্নিল। রাহিতা খানিকটা নড়ে উঠতেই মুখ তুলে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আকাশের দিক তাকিয়ে বললো,
—কি হয়েছে আমার বউয়ের? আকাশের দিক তাকিয়ে এত কি দেখো?
—চাঁদ দেখছি। আপনিও দেখুন।
—আমার ব্যক্তিগত চাঁদ থাকতে আমি আকাশের চাঁদ কেন দেখবো বলো? আমি শুধু তোমায় দেখবো!
রাহিতার গালে টুপ করে চুমু খেয়ে বলে স্বপ্নিল। লাজুক হাসিতে ফেপে ওঠে রাহিতার দুই গাল। সে গালের ইষত রক্তিম আভা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে স্বপ্নিল। দু’চোখে ঘোর লাগে। আরেকটু কাছে অগ্রসর হতেই রাহিতার কথায় থেমে যায় সে।
—কতদিন আমি আপনার মুখে এসব শুনার অপেক্ষা করেছি জানেন? আজ সত্যিই আপনার এমন আচরণে বাস্তবতাকেও কল্পনার ন্যায় মনে হচ্ছে পুরোটা।
ওর কথার ভাবার্থ ধরতে পারেনা স্বপ্নিল। ভাবে, হয়তো বিয়ের পরের কথা বলছে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে খানিকবাদে রাহিতা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় স্বপ্নিলের কাছ থেকে। দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে নিজের পুরনো আলমারি হাতড়ে কিছু একটা খুজতে লাগলো। স্বপ্নিল সেখানেই দাঁড়িয়ে এক ভ্রু তুলে দেখতে লাগলো রাহিতার কাজকর্ম। তবে বাধা দিলোনা ওকে। সে যা করছে, তাই করতে দিলো। বেশ কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি শেষে একটি পুরনো ডায়েরি খুজে বের করে রাহিতা। তা হাতে নিয়ে এগিয়ে যায় স্বপ্নিলের দিকে। ডায়েরিটা স্বপ্নিলের দিক বাড়াতেই হাত বাড়িয়ে নিয়ে নেয় সে। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ডায়েরিটা পড়ে উৎসুক রাহিতার দিকে ফের তাকায় সে। দু চোখে বিরক্তি ভাব এনে বলে,
—তুমি কৈশোরে কারও প্রেমে পড়েছিলে, তাকে নিয়ে ডায়েরিতে মনের ভাব লিখে রেখেছো। ভালো কথা। অতীত সবার থাকতেই পারে, আমারও ছিলো। তোমারও আছে দেখে একটু অবাকই হলাম বটে। কিন্তু থাকাটা অস্বাভাবিক নয় তাই মেনে নিলাম। তবে এটা আমায় দেখাচ্ছো কেন?
স্বপ্নিলের কথায় কিছুক্ষণ বোকা বোকা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো রাহিতা। অতঃপর বুঝলো সে শুধু প্রথম পেজ পড়েই এমন কথা বলছে। তাই তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,
—এত অধৈর্য কেন আপনি? এক পেজ না পড়তেই হাপিয়ে গেলেন? আপনার পড়াই লাগবেনা থাক। ডায়েরিটা দিন আমায়।
বলে যেই না ডায়েরিটা নিতে যাবে এমন সময় স্বপ্নিল ডায়েরিওয়ালা হাতটা উপরে উচিয়ে ধরে চোখ ছোট ছোট করে বললো,
—আচ্ছা, ঠিক আছে। বাকিগুলোও পড়ছি। রিল্যাক্স!
বলে স্বপ্নিল এবার ধৈর্য ধরে পুরো লেখাটুকু পড়লো। বহুবছর পুরনো ডায়েরির ভাজে ভাজে কিশোরী রাহিতার ছোট্ট মনের বিশাল অনুভূতিগুলো গুটিগুটি অক্ষরে লিখে রেখেছে। কিন্তু এত খুজেও স্বপ্নিল সেই কাংক্ষিত পুরুষের নাম খুজে না পাওয়ায় রাগ হলো। রাহিতার মনে সে ব্যতীত অন্য কারও জন্য এরকম গভীর অনুভূতি থাকায় অজানা হিং’সায় তনুমন জ্ব’লে উঠলো। তবে স্বপ্নিলের প্রতীক্ষা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা। কিছুদূর এগোতেই এতক্ষণের কালো কালির লেখাগুলোর মাঝে নীল রঙের কালিতে জ্বলজ্বল করতে থাকা নিজের নামটা দেখে এক মুহুর্তের জন্য একটা হার্টবিট মিস করলো স্বপ্নিল। বিস্ময়, ভালোলাগা সব অনুভূতির জোয়ারে একত্রে ভেসে গেলো সে। বড় বড় নয়নে ডায়েরিটা বন্ধ করে তাকালো নতমস্তকে ওর সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রাহিতার দিকে। স্বপ্নিল সবসময় অনুভব করতো রাহিতা ওর প্রতি দূর্বল, মেয়েটার মনে ওর জন্য একটা সফট কর্ণার আছে। কিন্তু সেটা এত আগে থেকে? তা মোটেও ভাবেনি স্বপ্নিল! সে যখন অন্য কাউকে নিয়ে ভালোবাসার স্বপ্ন বুনছিলো তখন এই মেয়েটি শুধু চোখের পলকে দেখেই ওকে ভালোবেসে ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলো! কারও এতদিনের ভালোবাসা হতে পেরে স্বপ্নিলের অন্তর পুলকিত হয়! হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে রাহিতার জন্য ভালোবাসা বেরিয়ে আসে।
ওকে এতটা ভালোবাসার পরেও বিয়ের পর ওর থেকে প্রত্যাখ্যান পেয়ে রাহিতার তবে কতটা খারাপ লেগেছিলো? এসব ভাবলেও স্বপ্নিলের হৃদয়ে ব্যথা হয় আজকাল। ডায়েরিটা বিছানায় রেখে আলগোছে রাহিতার মুখ দু হাতে তুলে ওর চোখে চোখ রাখে। ওর কপালে ভালোবাসার স্নিগ্ধ পরশ দিয়ে মধুর কণ্ঠে বলে,
—তুমি আমায় ভালোবাসতে আমি সবসময় বুঝতাম, কিন্তু এতটা? তা তো কখনো জানতাম না, রাহি সোনা।
রাহিতা হাস্যোজ্জ্বল নয়নে চেয়ে রয়। আজ সে স্বপ্নিলের চোখে ওই ভালোবাসার জোয়ার দেখতে পারছে নিজের জন্য, যা সে সবসময় দেখতে চেয়েছিলো। আজ রাহিতার মনে হচ্ছে ওর ভালোবাসা সার্থক। সন্তুষ্টচিত্তে নিজের গালে রাখা স্বপ্নিলের হাতের উপর হাত রেখে মিস্টি হেসে বলে,
—ভালোবাসি, স্বপ্নিল। খুব ভালোবাসি। জানেন আমি কত্তগুলো দিন অপেক্ষা করেছি আমাদের মন বিনিময়ের?
—আমাদের মন বিনিময় হয়ে গেছে। আর কোনো ভুল বুঝাবুঝি নয়, এবার শুধু ভালোবাসাবাসি হবে। আই লাভ ইউ, রাহি।
লাজুক হেসে রাহিতা মুখ লুকোয় স্বপ্নিলের প্রশস্ত বুকে। অতঃপর ওকে পাজাকোলে তুলে নিয়ে বিছানার দিকে অগ্রসর হয় স্বপ্নিল। স্বপ্নিলের আধার জীবনের আলো হয়ে যেভাবে রাহিতা এসেছিলো, সেভাবেই এক পূর্ণিমা রাতে একে-অপরের ভালোবাসায় তৃষ্ণার্ত দুজনের হৃদয় ভালোবাসার নতুন ধাপ অতিক্রম করলো। তনে ও মনে দুজন প্রকৃত অর্থে দুজনার হয়ে ওঠে!
#চলবে