Monday, October 6, 2025







মন বিনিময় পর্ব-৩৮+৩৯

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৩৮
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

স্বপ্নিল চলে গেছে বহুক্ষণ। অথচ রাহিতা আগের জায়গায় ঠাই দাঁড়িয়ে, যেভাবে ছিলো ঠিক সেভাবেই। যেন একটু আগে কি হলো বুঝে উঠতে পারছেনা সে! স্বপ্নিল কি সত্যিই এত ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো নাকি সে সাত সকালে এমন আকাশকুসুম কল্পনা করেছে? বিষয়টা উপলব্ধি করতে ডান হাতে নিজের বড়সড় নখ দ্বারা চিমটি কাটলো রাহিতা। সূচালো ব্যথা অনুভব হতেই এটা যে বাস্তব তা পরিষ্কার হলো! নিমিষেই চোখ দুটো বৃহদাকার ধারণ করলো। হুট করে কি থেকে কি হয়ে গেলো রাহিতা ভেবে পায়না! অথচ এ প্রথম স্বপ্নিলের এত কাছে আসার অনুভূতি এখনো গ্রাস করে রেখেছে ওকে। মিশ্র অনুভূতিতে স্তব্ধ রাহিতা ঠোঁটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় ড্রাইভার ফোন দেওয়ায় হুশ ফিরে আসে ওর! ফোন রিসিভ করে দ্রুতপায়ে হেটে গাড়ির কাছে চলে যায় সে।

স্বপ্নিল পৌঁছে ফোন করেছে মায়ের কাছে। ও রাহিতাকেও ফোন দিয়েছিলো কিন্তু সে ইচ্ছে করেই ফোন রিসিভ করেনি। কেন করেনি তা স্বপ্নিল মনে মনে ঠিকই বুঝেছে! এয়ারপোর্টে চলে আসার আগে ও যা করেছে, তাতে নির্ঘাত ভীষণ লজ্জা পেয়েছে রাহিতা। যে লাজুক মেয়েটা! এখন তো আরও বাহানা পেয়েছে পালিয়ে বেড়ানোর, তাই ইচ্ছে করেই ওকে জ্বা’লাচ্ছে। সামনে থাকলে তো আর এটা করতে পারতোনা! স্বপ্নিল সুযোগই দিতোনা!
মনে মনে ভাবে স্বপ্নিল।
এখন ক’দিন যে রাহিতা এমন করবে কে জানে?

এভাবেই কেটে গেলো তিনদিন৷ এ ক’দিনে রাহিতা ইচ্ছে করেই স্বপ্নিলের ফোন/মেসেজ অদেখা করছে। মনে মনে সে দেখতে চাইছে স্বপ্নিল ওর জন্য ছটফট করে কিনা, সে-ও ঠিক একিভাবে ওর জন্য অস্থির হয় কিনা! অপরদিকে রাহিতার এ কাজে ভীষণ বিরক্ত স্বপ্নিল। কোথায় সারাদিন ক্লায়েন্টদের সাথে ব্যস্ততা শেষে হোটেলে ফিরে যে একটু বউয়ের সাথে একান্তে কথা বলে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করবে, অথচ ওর বউ ওকে পাত্তাই দিচ্ছেনা। এতবার ফোন দিলো মেসেজ দিলো তবুও রাহিতা একটারও জবাব দিলোনা, এটা কি বেশি বেশি হচ্ছেনা? কেন এমন করছে সে স্বপ্নিলের সাথে? মনে মনে রাহিতার প্রতি বেশ রাগ হয় স্বপ্নিলের। যে রাগের চোটে সে আর ইচ্ছে করেই রাহিতাকে ফোন-মেসেজ দেয়না। স্বপ্নিলও দেখতে চায় রাহিতার ক’দিন ওকে এভাবে ইগ্নোর করতে পারে! দু-সপ্তাহ পর তো এমনিতেই দেশে যাচ্ছে সে। তখন একেবারে সুদে-আসলে সব ফেরত নিবে রাহিতার থেকে!

পরক্ষণেই আবার স্বপ্নিল ভাবে, একটা সামান্য কিস করাতেই যদি রাহিতা এমন করে তবে সে সামনে এগোবে কি করে? এ তো বড্ড ভাবনার বিষয়! এই লজ্জাবতীকে নিয়ে সে কি করবে? এমনই সব অদ্ভুত সব চিন্তাভাবনা করে দিন কাটে স্বপ্নিলের।
একদিকে স্বপ্নিল-রাহিতার এই লুকোচুরি প্রেম, অন্যদিকে দুজনেই একে-অপরের খোজ নিতে থাকলো দিলারা বেগমের থেকে। যা পারতপক্ষে উনার দুশ্চিন্তার পারদ আরও বাড়িয়ে দিলো। স্বামী প্রথমবার বিদেশ গেলো অথচ বউ ওর সাথে ফোনে কথা বলছেনা, আবার স্বপ্নিলও মায়ের থেকেই রাহিতার খোজ নিচ্ছে যার অর্থ দাঁড়ায় ওর নিজেরও এ ব্যাপারে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। দুজনে এভাবেই বেশ আছে। তবে কি এ দূরত্ব ওদের মধ্যকার দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে দিলো? এমন হলে তো মুশকিল! এভাবে চললে কি করে হয়? দিলারা বেগম ভেবে পাননা।

সপ্তাহখানেক পেরোনোর এক ফাঁকে দিলারা বেগম কথা বলার সুযোগ খুজছিলেন রাহিতার সাথে। আজ সুযোগ পেয়ে কাজেও লাগালেন। রাত ৮.৩০টার মতোন হবে। সামিরা পড়ছে আর রাহিতা পড়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে ফোন টিপছিলো। এমন সময় তেলের বাটি নিয়ে রুমে চলে এলেন দিলারা বেগম। শাশুড়িকে আসতে দেখে উঠে বসে রাহিতা। উনার হাতে তেলের বাটি দেখে বলে,

—মাথায় তেল দিবেন, মা? দিয়ে দেবো?

—না রে। রহিমা ঘুমানোর আগে দিয়ে দেবে আমায়। আমি তো এখন তোর মাথায় দিয়ে দেবো বলেই তেল গরম করে আনলাম।

উনার কথায় রাহিতা হাসে। হাসিমুখেই নম্র সুরে বলে,

—কেন এত কস্ট করতে গেলেন, মা? আমি একাই দিতাম পরে।

—এটাতে আবার কিসের কস্ট? তুই আমার একমাত্র ছেলের বউ। তোর জন্য এটুক করতেই পারি নাকি? আয় বোস এখন। আমি খাটে বসছি।

এবার আর না করতে পারেনা রাহিতা। বলাবাহুল্য, শাশুড়িকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে সে। তার এত মায়াময় কথায় সে কখনোই মানা করতে পারবেনা! তাইতো চুপচাপ বসে পড়ে পেছন ফিরে, দিলারা বেগমের সামনে। তেল দেওয়ার ফাকে ফাকেই টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছিলো দুজনের। এমন সময় প্রসঙ্গ বুঝে হঠাৎ দিলারা বেগম বলেন,

—আচ্ছা রাহি, একটা কথা বল তো!

—হ্যাঁ, বলুন না মা।

—তোর লাস্ট কবে স্বপ্নিলের সাথে কথা হয়েছিলো রে? না মানে আমি কাল রাতে কথা বলেছি তো। ছেলেটা আজ ফোন দিলোনা সারাদিন একবারও। কি করছে কে জানে? তোর সাথে কথা হয়েছে রে?

শাশুড়ির কথায় শুষ্ক ঢোক গিলে রাহিতা। মনে মনে ভাবে সে কি করে বলবে তার সাথে স্বপ্নিলের শেষ কথা হয়েছিলো যেদিন স্বপ্নিল দেশ ছেড়েছে সেদিনই। আর ওইদিন ওদের মাঝে যা হয়েছে তারপর থেকেই যে সে ইচ্ছে করে স্বপ্নিলের সাথে কথা বলছেনা, ওকে জ্বা’লাচ্ছে এটা তো আর শাশুড়িকে মুখে বলা যাবেনা তাইনা! রাহিতা পড়লো দোটানায়। একদিকে শাশুড়িকে মিথ্যে বলতে সায় দিলোনা মন, অপরদিকে সত্যটা বলার মতো ঠোঁটকাটা সে নয়। তাই কথা পাল্টাতে কোনোমতে সে বললো,

—আজকে ফোন দিয়েছিলাম উনাকে। ধরেননি ফোন। হয়তো খুব ব্যস্ত। আপনি চিন্তা করবেন না, মা। ফ্রি হলে তিনি ঠিকই ফোন দিবেন।

—ওহ। এটা হতে পারে৷ এখন এক কাজ কর তো। ফোন দে স্বপ্নিলকে। দেখি এখন ধরে কিনা। আমার ফোন তো রুমে রেখে এসেছি। তোরটা থেকেই দে তো।

দিলারা বেগমের কথায় রাহিতা পড়ে বিপাকে। এই যে সে খুব সন্তপর্ণে সপ্তাহখানেক ধরে স্বপ্নিলকে এড়িয়ে চললো, এরপর এখন হঠাৎ করে কিভাবে ফোন দিবে? কিন্তু রাহিতার ভাবনা ওর মনের মাঝেই চাপা পড়ে গেলো, কেননা দিলারা বেগম বারবার তাগিদ দিতে লাগলেন ওকে ফোন দেওয়ার। শেষমেশ রাহিতা একপ্রকার বাধ্য হয়েই ফোন হাতে নিলো। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে ভাবলো, স্বপ্নিল যে রেগে আছে ওর উপর! ফোন তো ধরবেনা নিশ্চিত। তাই এ রিস্ক নেওয়াই যায়। এরপর কল কেটে গেলে শাশুড়িকে বলে দেবে ফ্রি আছে তাই ধরছেনা ফোন।
মনে মনে নিজের নির্বোধ ভাবনায় হেসে রাহিতা মেসেঞ্জারে কল দিলো স্বপ্নিলকে। কিছুক্ষণ টুংটুং করে রিং হলো, বুঝা গেলো স্বপ্নিল অনলাইনে আছে। শ্বাসরোধ করে স্বপ্নিলের ফোন না ধরার অপেক্ষায় রইলো রাহিতা এবং খানিকবাদে ওর ধারণাই সঠিক প্রমাণ হলো। স্বপ্নিল ফোন ধরেনি। ফোস করে এক শ্বাস ফেলে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে রাহিতা বললো,

—উনি তো ফোন ধরলেন না, মা। হয়তো বাইরে আছেন। আপনি টেনশন করেন না। পরে কথা হবে।

দিলারা বেগম রাহিতার সামনে মাথা নাড়লেও মনে মনে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন। নির্ঘাত বড়সড় কোনো ঝামেলা হয়েছে স্বপ্নিল-রাহিতার মাঝে। নয়তো দুজন এভাবে দুজনকে ইগ্নোর করতোনা। এই যে রাহিতা প্রথমে ফোন দিতে চাইছিলোনা, পরে আবার স্বপ্নিল ইচ্ছে করেই ওর ফোন ধরলোনা এটাও তিনি ঠিকি বুঝলেন। অতএব তার ধারণা ঠিক। অতঃপর কি করবেন ভাবতে লাগলেন! এভাবেই এক মাথা ভর্তি দুশ্চিন্তা নিয়ে রুম ত্যাগ করলেন তিনি। হাফ ছেড়ে বাচলো রাহিতা নিজেও!

_________________

গভীর রাত। নিভৃতে ঘুমোচ্ছে রাহিতা। এরই মাঝে কর্কশ শব্দে ফোন বেজে উঠে। চমকে উঠে ঘুম থেকে জাগে রাহিতা। ফোন হাতে নিতেই দেখে স্বপ্নিল ফোন করছে। তা দেখে একপলক ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে নেয় রাহিতা। এতদিন মনের বিরুদ্ধে যেয়ে স্বপ্নিলকে ইগ্নোর করলেও আজ এ মাঝরাতে স্বপ্নিলের ফোন আর উপেক্ষা করতে পারলোনা সে! বুকের মাঝে ছলাৎ করে উঠলো রক্ত, একরাশ বাজে চিন্তা ভর করলো মাথায়। সেদিনের পর থেকে তো স্বপ্নিল আর ফোন দেয়নি ওকে একবারো। তবে আজ এ সময় ফোন দিলো কেন? স্বপ্নিল ঠিক আছে তো? ওর কিছু হলোনা তো! ব্যস্ত হাতে দ্রুতভংগিতে রাহিতা ফোন রিসিভ করে। অস্থির কণ্ঠে বলে,

—হ্যালো?

কিছুক্ষণ অতিক্রম হয়। ওপাশ থেকে স্বপ্নিলের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়না। মাঝেমাঝে গাড়ির আওয়াজ আসে শুধু। এবার রাহিতার বুক কাপে। একরাশ বাজে চিন্তায় ঘেমে যায় সে। স্বপ্নিল কথা বলছেনা কেন? সে ঠিক আছে তো? মনে মনে নিজেকে হাজারো গালি দিতে থাকে এতদিন স্বপ্নিলকে ইগ্নোর করার জন্য। বুকে ভয়, চোখে পানি নিয়ে কম্পিত কণ্ঠে পুনরায় শুধায়,

—হ্যালো, আপনি কথা বলছেন না কেন? শুনতে পারছেন? স্বপ্নিল, আপনি ঠিক আছেন?

রাহিতার ক্রন্দনরত কণ্ঠে কাজ হয়। এবার ফোনের ওপাশ থেকে স্বপ্নিলের আওয়াজ ভেসে আসে কানে,

—ঠিক রেখেছো যে থাকবো?

স্বপ্নিলের কণ্ঠ শুনে রাহিতার ভয় কাটে। এতক্ষণের চিন্তাভাবনা সব জানালা দিয়ে পালায়। এতদিন পর প্রিয়তমের কণ্ঠ শুনে কলিজা ঠান্ডা হয় রাহিতার। আবেগে ভাসে সে, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না থামায়। দু-একবার ওর নাক টানার আওয়াজ শুনা যায় শুধু। স্বপ্নিল এখনো নিশ্চুপ। রাহিতা ভাবলো স্বপ্নিল হয়তো আর কথা বলবেনা ওর সাথে, ঠিক সে সময় স্বপ্নিলের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ওর হৃদয় এফোড় ওফোঁড় করে দেয়।

—খুব সাহস বেড়েছে তোমার তাইনা? বড্ড বেশি বেশি করেছো এ কয়দিন! আমায় ইগ্নোর করেছো, তাইনা? শুধু দেশের বাইরে জরুরি কাজে আটকে আছি বলে কিছু বলছিনা। একবার শুধু দেশে ফিরতে দাও আমায়, আই স্যোয়ার রাহি, সব সাহস বের করে দিবো তোমার। জাস্ট একবার হাতের নাগালে পাই তোমায়, তারপর…

স্বপ্নিল থামে। ওর কথার তেজে রাহিতা বিষম খায়। নিজেকে সামলে কোনোভাবে শুধায়,

—তারপর?

—খে’য়ে ফে’লবো তোমায়!

#চলবে

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৩৯
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

সেই রাতে স্বপ্নিলের সাথে কথা হওয়ার পর কেটে গেছে সাতটা দিন। এ ক’দিনে আর একবারও রাহিতার কথা হয়নি স্বপ্নিলের সাথে। বলাবাহুল্য, সে রাতে নিজের কথা বলার পর রাহিতার প্রতিক্রিয়া শুনার অপেক্ষা না করেই ফোন কেটে দিয়েছিলো স্বপ্নিল। ফলস্বরুপ, রাহিতা সে রাতের পর নিজ থেকেই ওকে ফোন দিয়েছিলো বেশ কয়েকবার কিন্তু স্বপ্নিল ফোন ধরেনি। এমনকি একটা মেসেজেরও জবাব দেয়নি। যার অর্থ দাঁড়ায় সে অভিমান করেছে, এতদিন রাহিতা মজার ছলে ওকে যেভাবে ইগ্নোর করেছে এবার স্বপ্নিল ইচ্ছে করেই সেটা করছে। হয়তো রাহিতার এহেন আচরণে বেচারা অনেক কস্ট পেয়েছে মনে। এসব ভেবে মনে মনে অপ’রাধবোধে দ’গ্ধ হয় মেয়েটা।

তবে আর যাই হোক, রাহিতার দিনকাল এতটাও খারাপ কাটছেনা। কেননা ভার্সিটি যেয়ে সে এক নতুন বিষয় উপলব্ধি করেছে এ ক’দিনে। ওর সাথে ঘোরার মতো বন্ধু বলতে রিমি ও নিবিড়-ই ছিলো শুরু থেকে। আর এদের মাঝে এখন আর আগের মতো দ্বন্দ নেই, দুজনের মধ্যে মা’রকাট সম্পর্ক কিছুটা হলেও কমে গেছে। ওরা আগের মতো ঝগড়া করলেও একে-অপরকে নিয়ে বেশ খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে ইদানিং। সম্পর্কের এ পালাবদল আর কারও চোখে পড়ুক না পড়ুক, নিবিড় ও রিমি মুখে না বললেও, সবসময় ওদের দুটোকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার দরুন রাহিতা ঠিকি বুঝে গেছে। তবে যেকোনো সম্পর্কেই সময় থাকতেই দুজনের মাঝে সব স্পষ্ট করা দরকার, নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করা দরকার। অন্যথা এ দ্বিধাদ্বন্দেই অর্ধেক জীবন কেটে যায়। তাইতো ভার্সিটি শেষে বের হতে হতে রাহিতা রিমিকে ডেকে বললো,

—তুই কি নিবিড়কে পছন্দ করিস?

রাহিতার প্রশ্নে রিমি চমকায়। ইতস্ততভাবে এদিক-সেদিক চায়। ওকে চমকাতে দেখে রাহিতা হেসে বলে,

—ভালোবাসিস, তাইতো?

—ন,না। এমন কিছুই তো না।

—দেখ রিমি, বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে তোকে একটা পরামর্শ দিতে চাই। মন দিয়ে শুনবি, ঠিকাছে?

রাহিতার সিরিয়াস ভাবভঙ্গি দেখে রিমি মাথা নাড়ে। ওর মনোযোগ পেতেই রাহিতা বলে,

—যদি কাউকে ভালোবাসিস এবং তাকে পাওয়ার ইচ্ছে থাকে, তবে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে ওকে মনের ভাব জানা। নয়তো পরে তাকে হারিয়ে ফেললে আজীবন আফসোস করবি যে আগে কেন বললাম না!

রাহিতার কথার মাঝে বিষাদের সুর খুজে পেলো রিমি। করুণ চোখে বললো,

—কিন্তু সে যদি মানা করে তাহলে? রিজেক্ট হতে ভয় পাই আমি!

—আগে বলেই তো দেখ! যদি রিজেক্ট করে তবে বিনাবাক্যে সরে যাবে। যদি ও তোকে ভালোবাসে তবে হয় সময়ের সাথে নিজের ভালোবাসা বুঝবে, তোর কমতি অনুভব করবে নিজের জীবনে। তখন ঠিকি কাছে আসবে। আর যদি ভালো না-ই বাসে তবে তো দূরে দূরেই থাকবে। কিন্তু অন্তত তোর আফসোস তো হবেনা কখনো মনের কথা মুখে না বলার!

এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে রাহিতা। ওর কথায় রিমি মাথা নাড়ায়, কিছুক্ষণ কি যেন ভাবে। তারপর হঠাৎ করে বলে,

—আচ্ছা, তোর আর স্বপ্নিল ভাইয়ার মাঝে সব ঠিক হয়ে, রাহি?

রাহিতা জানতো রিমি ঠিক এ প্রশ্নটাই করবে। তাই নিজেকে প্রস্তুতও রেখেছিলো এ কথার জবাব দেওয়ার জন্য। সেভাবেই বলে,

—আমার কথা শুনেও তুই বুঝলিনা আমি কেন তোকে এসব বলছি?

রিমি উৎসুক চোখে তাকাতেই রাহিতা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

—আমি তাকে ভালোবাসি এটা তো উনি ছাড়া আর সবাই জানে৷ আর এ জায়গাটাতেই আমার আফসোস হয় রে, রিমি। কেন আমি তাকে এতদিনেও মনের কথা বলতে পারলাম না? উনার ভয় কাটাতে গিয়ে, উনার খুশির কথা চিন্তা করতে যেয়ে তো আমি নিজের খুশিটাই ভুলে গিয়েছিলাম এতদিনে। সময় থাকতে তাকে ভালোবাসার কথাটা বলা উচিত ছিলো। তাহলে এখনো এতকিছুর পরেও আমাদের দুজনের মাঝে এত জড়তা, এত দূরত্ব এর কোনোটাই থাকতোনা!

রাহিতার কথায় কস্ট লাগে রিমির। মেয়েটা অনেক সরল, সবসময় অন্যের ভালোটাই দেখে গেছে, অন্যের জন্যই সব করে গেছে। দিনশেষে ও নিজে কি পেয়েছে? রিমির মন খারাপ হয়। তবে পরক্ষণেই স্বপ্নিলের কথা মনে হতেই ওর মনে মেঘের পরিবর্তে রোদের আলোর ঝিলিক খেলে উঠে৷ স্বপ্নিলের সম্পর্কে যতকিছু সে রাহিতার থেকে এ ক’দিনে জেনেছে ও শুনেছে, তাতে সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে স্বপ্নিল রাহিতাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এইতো সেদিনই যখন ওদের শেষ ফোনকলের কথাটা রাহিতা একভরি দুশ্চিন্তা নিয়ে ওকে জানালো তখনো রিমি হাসছিলো। কেননা স্বপ্নিলের কথাবার্তা ওকে নিঃসন্দেহে রাহিতার পাগল প্রেমিক মনে হচ্ছিলো। প্রেমিকার বিরহে যে কাতর, প্রেমিকার থেকে এক রত্বি দূরত্বও যার সয়না, এমন প্রেমিক লাগে স্বপ্নিলকে রিমির কাছে। সুতরাং, এখন থেকে যে স্বপ্নিল নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে আর কোনো কার্পণ্য করবেনা, এটা এখন স্বচ্ছ পানির ন্যায় ঝকঝকে রিমির কাছে।
কিন্তু আফসোস! বোকা রাহিতা এটা বুঝলোনা, স্বপ্নিলের কথার মর্ম না বুঝে ওর অভিমানের চিন্তায় কাতর হয়ে আছে সে! লোকে ঠিকি বলে, অন্যের বেলায় মানুষ যতটা না সেয়ানা, নিজের বেলায় তার একটুও না! রাহিতার ক্ষেত্রেও যেন এর ব্যতিক্রম নয়। তাইতো মেয়েটার উদাস মুখের দিক চেয়ে রিমি বলে,

—স্বপ্নিল ভাইয়া কবে আসছে যেন?

—আগামীকাল দুপুরে ইনশা আল্লাহ।

—উম, কালকের জন্য বেস্ট অফ লাক, বেবি।

রাহিতা বিরক্ত হয়। চোখ পাকিয়ে বলে,

—কিসের বেস্ট অফ লাক?

—ভাইয়া এতদিন পর আসছে। তোকে দেখেনি কতগুলো দিন, তার মধ্যে আবার রে’গে আছে তোর উপর! উফ, কাল তো খেলা হবে মামা!

রিমির কথায় কপট রাগ দেখালেও মুহুর্তেই স্বপ্নিলের কথা ভেবে চুপসে যায় রাহিতা! সেদিন যেভাবে ধমক দিয়েছিলো ফোনে, আজেবাজে কিসব হু’মকি-টু’মকি দিচ্ছিলো দেশে ফিরে ওকে দেখে নেওয়ার, না জানি এসে সে কি করে?
এসব ভেবেই ভয়ে-লজ্জায় মনে মনে লাল আভায় রে’ঙে যায় রাহিতা।

______________

অবশেষে এলো সেই কাংক্ষিত দিন। স্বপ্নিল ফিরছে আজ দেশে। দুপুর ২.৩০ টায় ফ্লাইট ল্যান্ড করবে ওর। আপাতত এয়ারপোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাহিতা। সামিরা কলেজে থাকায় দিলারা বেগমকে সাথে আসতে জিদ করেছিলো সে। কিন্তু দিলারা বেগম নিজ দুশ্চিন্তায় বিভোর হয়ে আসতে রাজি হননি মোটেও! এবারও জোর করেই একা একা পাঠিয়ে দিয়েছেন রাহিতাকে। অগত্যা এয়ারপোর্টের বাহিরে একা একাই স্বপ্নিলের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে রাহিতা। আজ আকাশের অবস্থা ভালো নেই। বৃষ্টি হতে পারে যেকোনো সময়।

কিছুক্ষণ পেরোলো, স্বপ্নিল এলো। এতদিন পর প্রিয়তমের সাক্ষাৎ পেয়ে রাহিতার মন শান্তি ও আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠলো! অবশ্য স্বপ্নিলের চেহারায় এর ছিটেফোঁটাও দেখা গেলোনা। তার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক, ওর তী’ক্ষ্ণ ধারা’লো দৃষ্টি একনজরে রাহিতার শুষ্ক মুখ পরখ করছে। এহেন ছু’রির ন্যায় ধারালো গভীর দৃষ্টিতে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না। রাহিতাও পারলোনা! আড়চোখে স্বপ্নিলকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। স্বপ্নিল কাছে এসেই লাগেজ রেখে রাহিতার হাত থেকে ছো মেরে ওর ফোন নিয়ে নিলো। চমকে উঠে সেদিকে তাকাতেই স্বপ্নিল ওর দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে রাহিতার ফোন থেকে ড্রাইভারকে ফোন দিলো।
ড্রাইভার আসতেই তার উদ্দেশ্যে বললো,

—চাচা, আপনি লাগেজপত্র গাড়িতে নিয়ে বাসায় চলে যান।

স্বপ্নিলের কথায় ড্রাইভার ও রাহিতা উভয়েই বিস্মিত হলো। ড্রাইভার অবাক কণ্ঠে বললেন,

—কিন্তু সাহেব, আপনি ও ম্যাডাম বাসায় যাইবেন না? খালি লাগেজ নিয়া যাবো?

—জি। আপাতত শুধু লাগেজ নিয়েই যান। আমাদের একটু কাজ আছে। মা-কে বলবেন, টেনশন না করতে। আমি ঠিকভাবে পৌঁছে গেছি, রাহিতাও আমার সাথেই আছে। আমরা একসাথেই বাসায় যাবো।

স্বপ্নিলের শীতল কণ্ঠে বলা কথায় ড্রাইভারও আর কিছু বলার সাহস পেলোনা। শুধু মাথা নেড়ে লাগেজ নিয়ে চলে গেলো। এদিকে রাহিতা পড়লো চরম বিপাকে, মন ও মস্তিষ্ক উভয়ই দিশেহারা তার। একদিকে আকাশের বুকে জমে থাকা কালো কালো মেঘগুলো যেকোনো মুহুর্তে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে পারে ধরনীর বুকে। অপরদিকে, সদা হাস্যোজ্জ্বল স্বপ্নিলের এ আধারে ঢাকা মুখ যেন তার চেয়েও ভয়ংকর ঠেকলো রাহিতার নিকট!

#চলবে

রিচেক করা হয়নি। ভুলত্রুটি মার্জনীয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ