মন বিনিময় পর্ব-৩৭

0
675

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৩৭
#লেখনী- তাসফিয়া হাসান তুরফা

দিলারা বেগম ও সামিরা চলে এসেছেন বাসায়। তার আগের দুটো দিন ছিলো স্বপ্নিল ও রাহিতার ছোট্ট বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে একান্ত ও মধুর সময়। কথায় আছে সুখের দ্রুত চলে যায়। হলোও তাই। আগামীকাল স্বপ্নিল চলে যাবে মালেশিয়া। যার দরুন এ ক’দিনে অফিসের কাজে বেশ ব্যস্ত থেকেছে সে। রাহিতারও ভার্সিটি খুলেছে। সে-ও পড়াশুনা ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ সবমিলিয়ে সে রাতের পর স্বপ্নিল-রাহিতার খুব একটা একাকী সময় কাটেনি। তবু স্বপ্নিলের যাওয়ার দিন যত ঘনিয়ে এসেছে দুজনের মন খারাপ ততই প্রখর হয়েছে। একিসাথে দুজনের মাঝে দৃশ্যমানরুপে একে-অপরের প্রতি টান বেড়েছে৷ দূরত্বের আগে কাছে আসা যাকে বলে। কাল চলে যাবে বলে আজ তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসেছে স্বপ্নিল। আসার পথে কি মনে করে যেন রাহিতার জন্য সাদা গোলাপ নিয়ে এসেছে৷ সেদিন কথায় কথায় রাহিতা বলেছিলো ওর ফুল ভীষণ পছন্দ। বলাবাহুল্য, কথাটা মাথায় রেখেই স্বপ্নিলের এ কাজ। কেননা আজকাল রাহিতার ছোট ছোট খুশির কারণ হতে পারলেও যেন অদ্ভুত প্রশান্তিতে মেতে উঠে তার অন্তর!

স্বপ্নিল রুমে, অফিস থেকে এসে গোসল করছে। এদিকে নিচে ওর জন্য চা করতে এসেছিলো রাহিতা। রহিমা খালা বানিয়ে দিতে চাইলেও রাহিতা নিজেই স্বপ্নিলের জন্য এসব করতে ভালোবাসে। তা দেখে কেউ আর দ্বিমত করেনা। চায়ের পানি চুলোয় বসে দিয়ে শাশুড়ির কাছে ড্রয়িংরুমে আসে রাহিতা। দিলারা বেগম পারতপক্ষে টিভি দেখলেও ছেলের তাড়াতাড়ি বাসায় আসা, পকেটে লুকিয়ে রাখা গোলাপ এসব ঠিকি নজরে পড়েছে তার। দুজনের সম্পর্কে এমন উন্নতি দেখে মনে মনে অত্যন্ত খুশি হয়ে বারকয়েক “মাশাল্লাহ” বল্লেও মুখ ফুটে কাউকে বুঝতে দেননি কিছু! মা হয়ে তিনি বুঝেন তার ছেলে কতটা চেস্টা করছে রাহিতার সাথে ভালো থাকার, ওকে ভালোবাসার। তাই এ মুহুর্তে কোনোকিছু বলে স্বপ্নিলকে বিব্রত করতে চাননি তিনি। তবে রাহিতা এবং ওর অনুভূতি সম্পর্কে আগে থেকে অবগত হওয়ায় ওকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করাই যায় বলে উচিত মনে করলেন তিনি। তাইতো পাশে বসা রাহিতার উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,

—কি ব্যাপার বউমা, আমার ছেলেকে পুরোপুরি পটিয়ে নিয়েছো বুঝি?

শাশুড়ির এমন কথায় চমকে উঠে রাহিতা। লজ্জা পেয়ে বলে,

—কিসব বলছেন, মা!

—ঠিকি তো বলছি। তোরা দুটো বুঝিস আর না-ই বুঝিস আমার যা বুঝার সব কিন্তু ঠিকি বুঝে ফেলেছি। তারপর বল, দাদি কবে হচ্ছি?

এবার উনার কথায় লজ্জায় কুকড়ে যায় রাহিতা। পরক্ষণেই অজানা বিষাদে ছেয়ে যায় ওর অন্তর। স্বপ্নিলের সাথে যে এখনো ওর সম্পর্ক ততটা গভীর হয়নি এটা কি মুখে বলা যায়? দ্বিধান্বিত সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভাবে শাশুড়িকে কি বলবে। উনি হয়তো ভাবছেন ওদের মধ্যে স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য শুধু দিলারা বেগম কেন, এখন ওদের দুজনকে বাহিরে থেকে দেখলে যেকেউ-ই ভাববে ওরা একটা সুখী স্বাভাবিক দম্পতি। কিন্তু দুজনের ভেতরে যে এখনো জড়তার দেয়াল পুরোটা ভাঙেনি সেটা স্বপ্নিল-রাহিতা ছাড়া আর কেউ জানেনা! তবুও রাহিতা আশা হারায়না এবং রাহিতার এ আশার প্রদীপ জ্ব’লে থাকার কারণ স্বপ্নিল নিজেই!

কেননা আজকাল স্বপ্নিলের হুটহাট ওর জন্য বাসায় জলদি চলে আসা, মাঝেমধ্যে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, রাহিতার পছন্দ বলে মাঝেমধ্যে ফুল নিয়ে আসা এসব কিসের লক্ষণ রাহিতার বুঝতে অসুবিধে হয়না। স্বপ্নিল যে এতদিনে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে, রাহিতা সেটা এখন বুঝে ঠিকি। কিন্তু ওর মুখ থেকে কি করে স্বীকার করাবে তা ভেবে পায়না। যে নিজে ভালোবাসে সে-ই যদি স্বীকার না করতে চায় তবে তাকে কিভাবে বলানো যায়? স্বপ্নিলের মতো ত্যাড়া ছেলেকে কিভাবে লাইনে আনা যাবে ভেবে রাহিতা হয়রান! এসব ভাবনার মাঝেই পুনরায় শাশুড়ির কথায় ভ্যান ভাঙ্গে তার।

—কি রে, কই হারিয়ে গেলি?

—কোথাও না, মা। আমি একটু আসছি, উনার চা হয়ে গেছে। দিয়ে আসি!

কথাটা বলেই রাহিতা উঠে চলে যায়। ওর এভাবে লজ্জা পেয়ে উঠে চলে যাওয়া দেখে মনে মনে হাসেন দিলারা বেগম। কিন্তু একিসাথে তিনি অদেখা করতে পারেন না, তার প্রশ্ন শুনে রাহিতার মুখটা কিভাবে মেঘে ঢেকে গিয়েছিলো। আর এতেই উনার মনে খানিকটা খটকা লাগে! আসলেই ওদের দুজনের মাঝে সবকিছু ঠিক আছে তো? নাকি তিনি যা দেখছেন তার সবটাই মরিচিকা? যদি এমনটাই হয় তবে তো এটা হতে দেওয়া যাবেনা। আর কতদিন ওরা এভাবে অনিশ্চিত সম্পর্কে ঝু’লে থাকবে? স্বপ্নিল কাল চলে গেলে পুনরায় রাহিতার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবেন তিনি। এরপর শীঘ্রই কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে। কঠিন মনে ভাবেন দিলারা বেগম।

__________________

আজ রাতে বেশ জলদিই খেতে বসেছে সবাই। ডাইনিং টেবিলে পরিবারের সাথে খাওয়াদাওয়া ও গল্পগুজবের আসর জমেছে। আগামী দু’সপ্তাহ কাছের মানুষদের দেখবেনা তাই আজ একটু বেশিই সময় নিয়ে ডিনার করে স্বপ্নিল। আসল উদ্দেশ্য পরিবারের সাথে বেশিক্ষণ সময় কাটানো, কেননা খাবার পরেই যে যার রুমে চলে যাবে সকলে।
এরই এক ফাকে ছেলের উদ্দেশ্যে দিলারা বেগম বলেন,

—বাবা, তোর ফ্লাইট যেন কয়টায় কাল?

—ভোর ৬.৩০ টায়, মা।

—আচ্ছা। রহিমা, ফজরের নামাজের আগে আগেই উঠে যেয়ো কাল। আমি ডেকে দিবোনি। রুটি বানিয়ো…

—শুধু শুধু খালাকে কস্ট দিচ্ছো কেন, মা? আমি নাস্তা করবোনা এত সকালে। প্লেনেই খাবার দিবে তখন খেয়ে নিবোনি।

মায়ের কথা থামিয়ে জবাব দেয় স্বপ্নিল। ওর উত্তরে সন্তুষ্ট হন না দিলারা বেগম। ছেলেকে থামিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেন,

—তোর থেকে আমি শুনতে চেয়েছি? আমি যা বলেছি সেটাই হবে। তুই খেয়েই যাবি কাল।

—কিন্তু মা, তুমি..

—একবার বলেছিনা স্বপ্নিল? আমি তর্ক করতে চাইনা আর এ ব্যাপারে।

মায়ের শক্ত কথায় স্বপ্নিলের মেজাজ বি’গ’ড়ে যায়। হুট করে রেগে যাওয়া তার পুরনো স্বভাব, আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। গজগজ করতে করতে মুখ ফস্কে সে বলে,

—হ্যাঁ, তোমার কথা শুনা ছাড়া আর উপায় আছেও নাকি আমার কাছে। সারাজীবন তো তোমার ইচ্ছামতোই চলেছি। নিজের ইচ্ছের কি আদৌ দাম আছে আমার? তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী চলতেই তো আমার জীবন কেটে গেলো!

হুট করে বলে ফেলা স্বপ্নিলের এ কথায় পরিবেশ নিরব হয়ে যায়। চুপচাপ খেতে থাকা রাহিতাও হঠাৎ করে খাবার মুখে রেখেই থেমে যায়। দিলারা বেগম আগের ন্যায় একিভাবে চেয়ে আছেন ছেলের দিকে, নিজের ছেলের এ স্বভাব সম্পর্কে তিনি চির অবগত। তাই স্বপ্নিলের রাগকে বিশেষভাবে গায়ে না মাখলেও ওর বলা শেষের কথাটা আচমকা উনাকে ভাবিয়ে তুলে। তবে কি স্বপ্নিল তার বিয়ে নিয়ে ইনডাইরেক্টলি এভাবে বললো? সে কি এখনো খুশি নয়? একদিকে সকালে রাহিতার আধারঘন মুখ, অপরদিকে স্বপ্নিলের মুখের এমন কথা না চাইতেও তার মনের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিলো। জোর করে একটা সম্পর্ককে কখনোই টিকে রাখা যায়না এটা দিলারা বেগম জানেন এবং তিনি এটার পক্ষেও নন। তবুও তিনি রিস্ক নিয়ে পরিস্থিতির খাতিরে স্বপ্নিলের সাথে রাহিতার বিয়ে করে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এতদিনে দুজনের মাঝে সব ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু আজ তার মনে হলো তিনি ভুল ভেবেছিলেন। এসব ভেবেই চিন্তার পারদ ভারী হয় তার।

এদিকে হঠাৎ এভাবে সবাইকে চুপ থাকতে দেখে স্বপ্নিল বুঝে সে মায়ের সাথে এভাবে রিয়েক্ট করে ভুল করে ফেলেছে। তাই পরিস্থিতি সামলাতে সামিরার উদ্দেশ্যে বলে,

—কিরে বাদর, তোর জন্য কি নিয়ে আসবো মালেশিয়া থেকে? এখনো বললিনা যে?

স্বপ্নিলের কথায় চকচক করে উঠে সামিরার চোখ। যেন ভাইয়ের মুখ থেকে এতক্ষণ এ কথাটাই শোনার অপেক্ষায় ছিলো সেভাবে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,

—আরে ভাই, এতক্ষণে একটা কাজের কথা বললে তুমি। আমি তো সেই সন্ধ্যা থেকে লিস্ট করে বসে আছি কি কি নিবে। তোমার দিবো খাওয়া শেষে।

—তোর লিস্টের সব আনতে আমার বয়েই গেছে! যেটা যেটা পছন্দ হবে শুধু সেটাই আনবো। লিস্ট তোর কিন্তু ইচ্ছা আমার।

স্বপ্নিলের কথায় বিরক্ত সহিত চোখমুখ কুচকায় সামিরা। মুখ বাকিয়ে বলে,

—তুমি সবসময় আমার সাথে এরকম করো, ভাই। তুমি কি কোনোদিন ভালো হবেনা?

—হবোনা। মা, তোমার জন্য কি নিয়ে আসবো?

—তুই সহি-সালামতে ফিরে আয়। তাহলেই হবে আমার। আমার কিছু লাগবেনা।

স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দেন দিলারা বেগম। মায়ের এত শান্ত স্বর শুনে খানিকটা অবাক হয় স্বপ্নিল, সে ভেবেছিল ওর কথায় মা রাগ করবেন নয়তো কস্ট পাবেন। কিন্তু তার কণ্ঠ এত স্বাভাবিক শুনে সে অবাক না হয়ে পারেনা। তবু বিষয়টা আর ঘাটতে মন চায়না ওর। যাওয়ার আগে মায়ের মন খারাপ করানোর কোনো ইচ্ছেই নেই স্বপ্নিলের। তাই হাসি মুখে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,

—জানতাম তুমি এটাই বলবে। আচ্ছা যাও তোমার বলা লাগবেনা। আমি আমার ইচ্ছেমতোন কিছু নিয়ে আসবো। ঠিক আছে?

স্বপ্নিলের কথার আর প্রত্যুত্তর করেন না দিলারা বেগম। মাথা নাড়িয়ে সায় দেন শুধু। অতঃপর আরও টুকটাক কথাবার্তা শেষে যে যার মতো রুমে চলে যায় খাওয়া শেষে।

_____________

রাত ১২টা। নির্ঘুম চোখে বিছানার দু-প্রান্তে শুয়ে আছে স্বপ্নিল রাহিতা। পাশ ফিরে স্বপ্নিলের দিক তাকাতেই রাহিতা চমকায়। স্বপ্নিলের নিষ্পলক দৃষ্টি ওর দিকেই তাক করা। সে বিস্মিত সুরে বলে,

—আপনি এখনো ঘুমান নি কেন? আমি তো ভেবেছি আপনি ঘুমিয়ে গেছেন!

—তুমিও তো জেগে আছো!

স্বপ্নিলের ত্যাড়া উত্তর। রাহিতা বিরক্ত হয়। চোখ পাকিয়ে বলে,

—ভোরের ফ্লাইট আমার নয়, এ জার্নিটা আপনার। তাই এখন কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়ুন! আমার চেয়ে বেশি ঘুম আপনার প্রয়োজন।

কথাটা বলেই রাহিতা চোখ সরায়। ভাবে স্বপ্নিল এবারো ত্যাড়া কথা বলবে কোন নয়তো ঘুমিয়ে যাবে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে স্বপ্নিল নরম কণ্ঠে বলে ওঠে,

—ঘুম আসছেনা, রাহি!

—কেন?

—হয়তো ঘুমের চেয়েও বেশি আমার তোমায় প্রয়োজন তাই!

#চলবে

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৩৭ (বর্ধিতাংশ)
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

গোল গোল চোখে স্বপ্নিলের দিক চেয়ে আছে রাহিতা। নিজের কানকে একবার জিজ্ঞেস করে স্বপ্নিল কি সত্যিই এটা বলেছে নাকি সে ভুল শুনলো? কিন্তু ঘড়ির কাটা শব্দ করে ডেকে উঠার সাথে সাথেই ওর ভাবনায় ছেদ পড়ে। অনুভব করে যা শুনলো সবটাই সত্যি। প্রায় সাথে সাথেই ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। কম্পিত কণ্ঠে সুধালো,

—ম,মানে?

স্বপ্নিল সাথে সাথে জবাব দিলোনা। বরং নিজ জায়গা থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে এলো। রাহিতার নিকটে এসে ওর পানে চেয়ে বললো,

—তুমি আমায় মিস করবে, রাহি?

রাহিতা হাসলো। দুস্টু বুদ্ধি চাপলো মাথায়। স্বপ্নিলকে একটু রাগাতে মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে বললো,

—উহু। আপনাকে মিস করতে যাবো কোন দুঃখে?

রাহিতার এমন গা-ছাড়া উত্তরে স্বপ্নিল বেজায় চটে গেল। ভ্রু যুগলের মাঝে গাঢ় ভাজ ফেলে বললো,

—কেন? আমি এতদিন কাছে থাকবোনা, তোমার সাথে দেখা হবেন কতগুলো দিন আর তুমি আমায় একটুও মিস করবেনা? মনে পড়বেনা বুঝি আমায়?

—আপনি মিস করবেন আমায়?

স্বপ্নিলকে রাগতে দেখে রাহিতা কথা ঘুরায়। প্রশ্নের জবাবে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে ওর দিকে। স্বপ্নিল কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়। রাহিতার মতো সে-ও মুখ বাকিয়ে উত্তর দেয়,

—মোটেও নাহ। যে আমায় মিস করেনা আমিও তাকে মিস করিনা। বুঝেছো?

ওর কথা শুনে শব্দ করে হেসে ফেলে রাহিতা। ওর হাসির শব্দে চোখ পাকিয়ে ওর দিক তাকায় স্বপ্নিল। মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে। রাহিতা উঠে বসে। স্বপ্নিলের দিক ঝুকে বেশ কিছুক্ষণ ডাকে ওকে।

—এই যে শুনছেন? উঠুন না। আমি তো মজা করছিলাম। শুনছেন?

রাহিতার এতবার ডাকার পরেও স্বপ্নিল আগেকার ন্যায় ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে অপরদিক হয়ে। এক পর্যায়ে ক্লান্ত রাহিতা হাল ছেড়ে দেয়। খেয়াল করে দেখে স্বপ্নিল শান্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। সে ভাবে ও হয়তো ঘুমিয়ে গেছে তাই জবাব দিচ্ছেনা। বভাবা, স্বপ্নিল বেশ দ্রুত ঘুমিয়ে যেতে পারে, এ ব্যাপারে ওর আগেকার রেকর্ড আছে। বিয়ের পর থেকেই বিষয়টা দেখে আসছে রাহিতা। যতই দুঃখ হোক আর যতই কিছু হোক স্বপ্নিল বেশিক্ষণ না ঘুমিয়ে থাকতেই পারেনা! ওর ঘুম লাগবেই! তাই রাহিতাও এ ব্যাপারে বিশেষ মাথা ঘামালোনা, ঘুমন্ত স্বপ্নিলের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আলতোভাবে ওর হাত ধরে রাখলো বেশ কিছুক্ষণ। স্বপ্নিলের গালে হাত ছুয়ে ধীর স্বরে বললো,

—আমি জানিনা আপনাকে কখনো সরাসরি বলার সুযোগ পাবো কিনা। কিন্তু আপনি হয়তো জানেনও না আমি আপনাকে ঠিক কতটা মিস করবো। জলদি ফিরে আসবেন আমার কাছে।

কথাগুলো বলেই ধীরেসুস্থে স্বপ্নিলের হাত ছেড়ে দেয় রাহিতা। চুপচাপ নিজের স্থানে ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়ে আগের ন্যায়। এদিকে রাহিতা চোখ বুজতেই অপরপাশে হুট করে চোখ মেলে তাকায় স্বপ্নিল। এতক্ষণ সে জেগেই ছিলো, মূলত ইচ্ছা করেই রাহিতার রিয়েকশন দেখার জন্য সে ঘুমের ভান করে পড়ে ছিলো। এবার রাহিতার এমন ইতিবাচক রিয়েকশন দেখে মনে মনে যারপরনাই খুশি হয় স্বপ্নিল, হৃদয়রাজ্যে সুখের প্রজাপতিরা ডানা মেলে উড়তে থাকে! ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে প্রশস্ত হাসি। রাহিতার দিক চেয়ে সন্তুষ্ট অন্তরে শুয়ে পড়ে সে নিজেও! যাক অন্তত চলে যাওয়ার আগে মনে শান্তি নিয়ে যেতে পারবে সে!

___________________

ভোর ৫টার মতোন বাজে। এয়ারপোর্টের সামনে গাড়ি থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নিল-রাহিতা। বাসার সবার থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে স্বপ্নিল। দিলারা বেগম আসতে চেয়েছিলেন প্রথমে, কিন্তু পরে ভাবলেন স্বপ্নিলের সাথে এর আগেও এয়ারপোর্টে এসেছেন তিনি। কিন্তু বিয়ের পর এ প্রথম বউকে রেখে কোথাও যাচ্ছে ছেলে। তাই পরবর্তীতে দুজনের প্রাইভেসির ব্যাপারটা মাথায় রেখে তিনি আর আসেননি। আশেপাশের সবাই ভীষণ ব্যস্ত, খুব সকালে ফ্লাইট হওয়ায় যাদের ফ্লাইট তারা ছাড়া তেমন একটা মানুষ নেই। সবাই যে যার মতোন ছুটছে। আশেপাশের কাউকে দেখার যেন সময়ই নেই তাদের। সেভাবেই এক কোণায় দাড়িয়ে আছে স্বপ্নিল-রাহিতা। একটু পরেই স্বপ্নিল ভেতরে চলে যাবে। তবে রাহিতা বেশ কিছুক্ষণ থেকে খেয়াল করছে স্বপ্নিল কেমন যেন উশখুশ করছে কখন থেকে। যেন কিছু বলবে কিন্তু ইতস্ততায় বলতে পারছেনা। রাহিতা ভাবলো জিজ্ঞেস করবে, এমন সময় স্বপ্নিল ধরা গলায় বলে,

—রাহি, একটা কথা বলি?

—বলুন না। কখন থেকেই তো দেখছি আপনি কিছু বলার জন্য উশখুশ করছেন কিন্তু বলতে পারছেন না। কি হয়েছে আমায় নির্দ্বিধায় বলে ফেলুন, স্বপ্নিল।

ওর কাধে হাত রেখে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে রাহিতা। যেন খানিকটা আশ্বাস দেয় নির্ভরতার, যাতে স্বপ্নিল দ্বিধাহীনভাবে নিজের অনুভুতি প্রকাশ করতে পারে ওর সামনে। রাহিতার আশ্বাসে কাজ হলো। স্বপ্নিলের এতক্ষণের অস্থির ভাব বেশ খানিকটা কমে গেলো। কিছুক্ষণ অবিচলভাবে রাহিতার দিক চেয়ে অবশেষে মনের কথা মুখে এনে সে বললো,

—আমাদের মাঝে সবকিছু আগেকার মতোই থাকবেনা, রাহি? আমাদের সম্পর্ক আমি ফিরে আসার পরও ঠিক এমনই থাকবে, বলো?

স্বপ্নিলের হঠাৎ এমন প্রশ্নে আকাশ থেকে পড়ে রাহিতা। চমকে উঠে সে প্রশ্ন করে,

—মানে? এসব কি বলছেন? আমাদের সম্পর্কের আবার পরিবর্তন হবে কেন?

—আমি জানিনা। আমার যা মনে হলো তাই বললাম। কথা দাও, আমাদের সম্পর্ক ঠিক এমনই থাকবে। এ সাময়িক দূরত্ব আমাদের মধ্যকার সম্পর্কে কোনোরুপ প্রভাব ফেলতে পারবেনা। কথা দাও আমায়।

রাহিতার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে স্বপ্নিল। বিস্মিত বিমূঢ় রাহিতা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে স্বপ্নিলের পানে। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবে। হঠাৎ কিছু মাথায় আসতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় রাহিতার কাছে। সে বুঝে স্বপ্নিল আচমকা কেন এ প্রশ্ন করছে। হয়তো অতীতের কথা মনে হয়ে তার এ দ্বিধা। বিচলিত স্বপ্নিলকে আশ্বাস দিতে রাহিতা হেসে বলে,

—আপনি কি আমাদের সম্পর্ক নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছেন? ভাবছেন আমরা আলাদা থাকলে আমি আপনাকে ভুলে যাবো?

ধরা পড়ে যাওয়ায় স্বপ্নিল খানিকটা লজ্জাবোধ করে। ইতস্ততভাবে এদিক-সেদিক তাকায়। ওকে লক্ষ্য করেই রাহিতা বলে,

—দেখুন স্বপ্নিল, আমি জানিনা আপনার মাথায় এমন চিন্তা কেন এসেছে। হয়তো আপনি এখনো অতীত নিয়ে চিন্তা করেন বলে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমায় নিয়ে আপনার ইনসিকিউর হওয়ার কোনো কারণ নেই। আপনার আমার সম্পর্কটা কোনো ঠুনকো সম্পর্ক নয় যে সামান্য বিচ্ছেদেই আমাদের সম্পর্ক বা একে-অপরের প্রতি অনুভূতি পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমাদের সম্পর্ক সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে উপরে। আল্লাহ স্বয়ং আমাদের একে-অপরের জন্য নির্বাচন করেছেন সেখানে এসব অনর্থক চিন্তা মাথাতেও আনবেন না। আপনি যতদূরেই থাকেন না কেন, আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা ও সম্মান ঠিক আগের মতোই থাকবে। যদি কোন পরিবর্তন হতেই হয়, তবে সম্পর্কটা সময়ের সাথে সাথে আরও জোরালো হবে। কেননা, যেখানে মনের টান থাকে সেখানে তো অনেক বছরের দূরত্বও কিছু নয়, আমরা তো কিছুদিনের জন্য আলাদা থাকছি মাত্র। তাই আমায় ও আমাদের সম্পর্ক নিয়ে একদমই চিন্তা করবেন না। যা করতে যাচ্ছেন ভালোভাবে সেটা করে ফিরে আসুন আমার কাছে। আমি অপেক্ষায় থাকবো।

রাহিতার কথায় ও চিন্তাধারায় স্বপ্নিলের গর্ববোধ হয়। মনে মনে আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া আদায় করে তার জীবনে এমন জীবনসঙ্গী পাঠানোর জন্য। রাহিতা কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর দু’বাহু ধরে টেনে নেয় নিজের দিকে। বলিষ্ঠ হাতের দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় প্রেয়সীকে। রাহিতাও সহাস্যে জড়িয়ে ধরে স্বপ্নিলকে। কিছুক্ষণ সেভাবেই কেটে যায় একে-অপরের সান্নিধ্যে। এরপর স্বপ্নিল রাহিতাকে ছেড়ে দিয়ে ওর দু’হাত মুঠোয় নিয়ে বলে,

—আম সরি রাহি, এমন অবিবেচক কথাবার্তা মাথায় আনার জন্য। আমি আর কখনো আমাদের সম্পর্ক নিয়ে এমন চিন্তাভাবনা করবোনা। আই প্রমিস।

—ইটস ওকে। আমি কিছু মনে করিনি। আপনার ফ্লাইটের জন্য লেট হয়ে যাবে। এখন যান।

—হ্যাঁ, যাচ্ছি। ভালো থেকো, সাবধানে থেকো। আল্লাহ হাফেজ।

রাহিতাও হাত নেড়ে বিদায় জানায় স্বপ্নিলকে। বেশ কিছুদূর হেটে যায় স্বপ্নিল। রাহিতাও পেছন ফিরে গাড়ির কাছে যাওয়ার জন্য হাটতে আরম্ভ করবে। ঠিক এমন সময় হাতে টান পড়ায় পেছন ফিরে তাকায় সে। স্বপ্নিলকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দুজনের মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে রাহিতার মুখ আজলায় ভরিয়ে অতিদ্রুত এক প্রগাঢ় চুম্বন করে স্বপ্নিল। বিস্মিত রাহিতাকে অবাক করে দিয়ে হাসিমুখে ফেরত যেতে যেতে বলে,

—আমি তোমায় অনেক মিস করবো, রাহি। সব কাজ সেরে খুব জলদিই তোমার কাছে ফিরে আসবো, আমার বউ।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে