#মন_বিনিময়
#পর্বঃ১৬
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
পরেরদিন সকাল। যথারীতি স্বপ্নিলের আগে ঘুম ভাঙে রাহিতার। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতেই নিজের পাশে ঘুমন্ত স্বপ্নিলের দিকে চোখ যায় তার। এক হাতে বালিশ জড়িয়ে উবুড় হয়ে শুয়ে আছে সে, সামনের কয়েকটা বড় চুল এগিয়ে এসে কপালের উপর নির্বিঘ্নে খেলা করছে। টিশার্ট উপরে উঠে হলদেটে ফর্সা বাহু দৃশ্যমান, ভীষণ আদুরে লাগছে ওকে। সদ্য ঘুম ভেঙে চোখের সামনে এহেন পুরুষালি সৌন্দর্য দেখে মনে মনে বিমোহিত হয় রাহিতা। আরও একবার প্রেমে পড়ে তার স্বপ্নপুরুষের। ঘোরের মাঝেই হাত এগিয়ে কপালের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিতে চায়, পরমুহূর্তেই কি যেন ভেবে হুট করে হাত গুটিয়ে নেয়। স্বপ্নিলের গায়ের উপর কাথা ভালোভাবে টেনে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়।
ফ্রেশ হয়ে রুম ছেড়ে নিচে নামতেই শাশুড়ির সাথে দেখা মেলে তার। সোফায় বসে কুরআন শরীফ পড়ছিলেন দিলারা বেগম। তাকে দেখে রাহিতা মুচকি হেসে তার পাশের সোফায় বসে পড়ে। আরও কিছুক্ষণ সময় নিয়ে পবিত্র গ্রন্থের তিলাওয়াত শেষ করেন তিনি। এরপর সামনে বসা রাহিতাকে হাসি উপহার দিয়ে বলেন,
—ঘুম হয়েছে, রাহি? কাল তো অনেক রাত পর্যন্ত পড়েছিস।
—হ্যাঁ, মা। হয়েছে ঘুম। পরীক্ষা একদম হাতের কাছেই তাই পড়ছি মন দিয়ে, বিয়ের ক’দিনে বেশ কিছু টপিক জমে গিয়েছিলো সেগুলোই পড়ছিলাম।
—হুম। ভালোমতো লেখাপড়া কর। তারপর বল, তোর মন ভালো হয়েছে?
—মানে? আমার আবার কি হবে?
—দেখ রাহি, লুকিয়ে লাভ নেই৷ আমি কাল খেয়াল করেছি তোর আচরণ, তোর যে মন খারাপ ছিলো তা স্পষ্ট বুঝেছিলাম। কিন্তু পরে তোর চুপচাপ থাকা দেখে আর ইচ্ছে করেই জিজ্ঞেস করিনি। এবার বল, আমার হতচ্ছাড়াটা আবার কি করেছে?
শাশুড়ির কথার ধরনে হাসি পেলো রাহিতার। মনে মনে ভাবে সে একাই বুঝি কপাল করে এমন এক শাশুড়ি পেয়েছে যে সবসময় নিজের ছেলের আগে ছেলের বউয়ের কথা ভাবেন। উনার অগোচরে তার ছেলে ওর সাথে কোনো খারাপ আচরণ করছে কিনা জানার জন্য তটস্থ থাকেন।
—এমন কিছুই হয়নি, মা। আপনি চিন্তা করবেন না। আমার বাসার কথা মনে পড়ছিলো তাই একটু মন খারাপ ছিলো। উনি কিছুই করেননি৷
—ওহ, এই ব্যাপার? এর জন্য আমার বউমার মন খারাপ? তুই ভার্সিটি থেকে আয়, চল আজকেই তোকে নিয়ে তোর মার বাসায় থেকে ঘুরে আসি। এমন ছোটখাট কারণে আমার একমাত্র পুত্রবধূর চোখের পানি আমি পড়তেই দেবোনা!
শাশুড়ির কথাগুলো শুনে একরাশ ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো ওর অন্তর। এমন মায়ের মতো শাশুড়ি পেয়ে নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবতী মনে হলো তার। মুহুর্তেই স্বপ্নিলের উপর করা অভিমান ভুলে গেলো সে। প্রফুল্লচিত্তে বললো,
—আপনি আমায় অনেক ভালোবাসেন, তাই না মা?
—এটাও কি বলে বুঝাতে হবে পাগলি? তুই আর সামি দুজনই আমার মেয়ে।
রাহিতার গালে হাত রেখে বললেন তিনি। খুশিতে আপ্লূত হয়ে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটা। এরপর উনার তাড়া পেয়ে স্বপ্নিলকে ডাকার জন্য উপরে গেলো সে। এরপর তড়িঘড়ি করে ব্রেকফাস্ট সেড়ে যথারীতি ভার্সিটি ও অফিসের জন্য রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো দুজনে!
_____________________
ভার্সিটির সামনে গাড়ি এসে আছে দাড়িয়েছে। সেদিক চেয়ে রাহিতা গাড়ি থেকে নামতে যাবে ওমনি বা হাতে ওর ডান হাত চেপে ধরে স্বপ্নিল। হাতে টান পড়ায় বিস্ময় নিয়ে পাশ ফিরতেই শুনে,
—কি বলেছি কাল মনে থাকবে তো?
—কিসের কথা বলছেন?
ইচ্ছে করেই অবুঝের ন্যায় প্রশ্ন করে রাহিতা। ওর প্রশ্নে দাতে দাত চেপে স্বপ্নিল বলে,
—অযথাই কারও সাথে পড়া বুঝানোর নামে যেন আড্ডা না দেওয়া হয়। ক্লাস শেষে সুন্দরমতো বাসায় চলে আসবে। মনে থাকে যেন।
—আর মনে না থাকলে?
—দেখো আমায় রাগিয়ে দিয়ো না, রাহি।
—এ সামান্য বিষয়ে আপনি রাগবেনই বা কেন সেটাই তো বুঝলাম না। আমি যার থেকে ইচ্ছা পড়া বুঝে নিবো, ইচ্ছেমতো আড্ডা দিবো। এতে আপনার কি সমস্যা? আপনি কেন নিষেধ করছেন আমায়?
—জানিনা। তাছাড়াও এত কিছুর উত্তর দিতে পারবোনা। যা বলছি সেটা করবে ভালোমতো। বাই দ্যা ওয়ে, আজ নাকি মায়ের সাথে তোমাদের বাসায় বেড়াতে যাবে শুনলাম?
—জি। বাসায় যাবো। আর একটা কথা, ভাইয়ার সাথে দেখা হবে আমার, ও আজ বাসায় আছে। ওর থেকেই পড়া বুঝে নিয়ে আসবো। আপনার আর কস্ট করে পড়াতে হবেনা আমায়।
—এত বেশি কথা বলছো কেন, রাহি? আমি কি একবারো বলেছি আমার কস্ট হবে?
—আপনি না বললেও আমি তো বুঝি নাকি? সব কথা কি মুখে বলতে হয়? নেহাৎ ভাইয়া বলেছে দেখেই তো আপনি বাধ্য হয়ে পড়াচ্ছেন আমায়। নয়তো আপনি রেস্ট নেন ওই সময়। আমি ভাইয়াকে ম্যানেজ করে নেবো, কোনো অসুবিধা নেই।
ওর কথায় বিরক্ত হয় স্বপ্নিল। মেয়েটা এত বেশি বুঝে কেন? সে কি বলেছে ওর কস্ট হবে পড়াতে? বরং রাহিতাকে কে বুঝাবে আজকাল স্বপ্নিলের ওর সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে, ওর সাথে ঝগড়ার বাহানায় কথা বলতেও ভাল্লাগে! একিসাথে মনে জাগে শংকা, রাহিতা যদি রওনক-কে জিজ্ঞেস করে ও স্বপ্নিলকে পড়াতে বলেছে কিনা তখন রওনক যদি অস্বীকার করে? তাহলে তো স্বপ্নিল ধরা পড়ে যাবে। রাহিতা জানতে পারবে ওর ভাই ওকে পড়াতে বলেনি বরং স্বপ্নিল নিজে থেকেই পড়াতে চেয়েছে ওকে। বিষয়টা লজ্জাজনক হবে! তাইতো আগপাছ না ভেবেই স্বপ্নিল জোরেশোরে বলে বসে,
—খুব বুঝা শিখে গেছো সব? এতকিছু করতে হবেনা তোমার বুঝেছো? আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ এখন নামো। তোমার ক্লাসের জন্য লেট হবে আবার।
এতক্ষণ চুপ থাকলেও নামার কথা শুনে আড়চোখে ওর দিক তাকিয়ে ইতস্তত ভাবে রাহিতা বলে,
—নামবো তো। হাতটা আগে ছাড়ুন।
চমকে উঠে ওর দিক তাকিয়ে আরেকবার নিজেদের হাতের দিক তাকায় স্বপ্নিল। কথার মাঝখানে আলতোভাবে ধরা হাতের বন্ধন কখন যে জোরেশোরেই চেপে ধরেছে ও নিজেও বুঝেনি। এখন নিজের করা কাজে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে সে নিজেও। ধীরেসুস্থে ছেড়ে দেয় রাহিতার হাত। স্বপ্নিলকে এভাবে দেখে আনমনে হাসে রাহিতা। অতঃপর নেমে যায় নিঃশব্দে গাড়ি থেকে।
ভার্সিটির গেটের সামনে যেতেই নিবিড়ের সাথে দেখা হয় রাহিতার। ওকে দেখে হাস্যোজ্জ্বলভাবে কুশল বিনিময় করে নিবিড়। ইতস্তত রাহিতা নিজেও জোরপূর্বক হাসি বিনিময় করে। দুজন টুকটাক কথা বলে ভার্সিটির ভেতর ঢুকার আগমুহূর্তে টুং করে ফোনে মেসেজ আসে রাহিতার। স্ক্রিনে স্বপ্নিলের নাম দেখে কপালে ভাজ পড়ে ওর। মাত্রই না গাড়ি থেকে বের হলো, এখন আবার কি বলছে স্বপ্নিল? ফোনের সাউন্ড কমিয়ে কানের কাছে ফোন ধরতেই স্বপ্নিলের ভারী আওয়াজ কানে ভাসে,
—আমি মানি আর না মানি, তুমি আমার বউ। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তোমার সবকিছুর দায়িত্ব যেহেতু আমি নিয়েছি তাই সেখানে অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করুক এটা আমার পছন্দ না। খবরদার যদি রওনককে পড়ার বিষয়ে কিছু বলেছো। এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা দেওয়া বাদ দিয়ে ক্লাসে যাও। আর যেন না দেখি এসব।
শুরু থেকে সবকিছু ভালোভাবে বল্লেও শেষের কথাটা ধমকে বলেছে স্বপ্নিল যে ধমকে ফোনের এপাশ থেকেই ইষত কেপে উঠলো রাহিতা। তবে ওর এহেন আচরণের মানে খুজে পেলোনা সে। স্বপ্নিল ক’দিন ধরে এমন করছে কেন? ওর কি সমস্যা সে অন্য কারও সাথে মেলামেশা করলে? তবে কি স্বপ্নিল ওর উপর অধিকার খাটানো শুরু করে দিয়েছে? আনমনেই ভাবে রাহিতা।
ভার্সিটির ভেতরে প্রবেশ করার আগে কি মনে করে যেন এক পলক পেছন ফিরে সে। গাড়ি আগের জায়গাতেই আছে। জানালার কাচ নামানো, সেখান হতে শক্ত চোয়ালে স্টিয়ারিং ধরে থাকা স্বপ্নিল স্পষ্ট চোখে পড়লো তার। সেদিক কিছুক্ষণ নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকতেই পুনরায় টুং করে মেসেজ এলো রাহিতার ফোনে,
—আমি তোমারই হাজবেন্ড। বাসায় আমায় দেখার যথেষ্ট সময় পাবে। কিন্তু এখন ভেতরে না গেলে ক্লাস মিস করবে। গো!
আচমকা স্বপ্নিলের এমন গভীর কণ্ঠে বুকের মাঝে ধক করে উঠে রাহিতার। স্বপ্নিলটার কি হলো আজ? সে কিনা সদা ওকে বউ হিসেবে মানতে নারাজ ছিলো, সে আজ নিজমুখে স্বীকার করছে ওদের মধ্যেকার পবিত্র সম্পর্ক? অদ্ভুত! এসব ভেবেই একটা ঘোরে চলে যায় রাহিতা। কানে বারংবার বাজতে থাকে ওর বলা প্রথম লাইন দুটো! মুহুর্তেই দু’গালে ছড়িয়ে পড়ে রক্তিম আভা। টলমলে পায়ে দ্রুতকদমে ঢুকে যায় ভার্সিটির ভেতরে। এদিকে রাহিতাকে ওভাবে থমকাতে দেখে কিছু একটা ভেবে ঠোঁটযুগল বাকিয়ে হাসে স্বপ্নিল। আজকাল হুটহাট রাহিতাকে রাগাতে, ওকে চমকে দিতে ওর ভীষণ মজা লাগে। কিন্তু কেন লাগে তা ওর অজানা। তবে সেটাকে বিশেষ পাত্তা দেয়না স্বপ্নিল। সে শুধু জানে রাহিতা ওর কাছে একটা মানসিক প্রশান্তির মতো, দুঃসময়ে পাশে থেকে ভরসার হাত বাড়িয়ে রাখা বন্ধুর মতো। তাই অন্যকিছু ভেবে এ মুহুর্তে ওদের সম্পর্ককে নস্ট করতে ভয় পায় স্বপ্নিল। আপাতত রাহিতার সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠে, ওর হাত আকড়ে ধরে নিজের পুরনো স্বাভাবিক হাস্যোজ্জ্বল জীবনে ফিরে যেতে চায় সে। তাই এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর কিছু না ভেবে সে নিজেও গাড়ি চালিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
অফিসে পৌঁছে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্বপ্নিল, আজ বাড়ি ফেরার এক অদ্ভুত পিছুটান অনুভব করে সে। তবে অজানা তাড়ায় ব্যস্ত হাতে সবকাজ করতে থাকা স্বপ্নিল বুঝলোনা তার এ পিছুটানের কারণ! কখন নিজের অজান্তেই ওর অবাধ্য মন অফিস থেকে বাসায় ফিরে রাহিতাকে পুনরায় দেখার অপেক্ষায় থাকে সে ভাবনা স্বপ্নিলের কাজে ডুবে থাকা মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছে না, একান্তে নিভৃতে ওর মনের অগোচরেই লুকিয়ে থাকে!
#চলবে