#মন_বিনিময়
#পর্বঃ১০
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
রাহিতা ও স্বপ্নিলকে একসাথে বাসায় প্রবেশ করতে দেখে বেশ খানিকটা চমকে উঠেন দিলারা বেগম। তার মধ্যে স্বপ্নিল রাহিতার হাত ধরে আছে বিষয়টা খেয়াল করে তিনি আরও অবাক হন! মনে মনে খুশিও হন বটে৷ তবে কি সবকিছু মিটমাট হয়েছে দুজনের মাঝে? এরই মাঝে নিজেদের হাতের দিকে শাশুড়ির দৃষ্টি উপলব্ধি করে লজ্জায় পড়ে যায় রাহিতা৷ খানিকটা জোর প্রয়োগ করেই স্বপ্নিলের বন্ধন থেকে মুক্ত করে নিজের হাত। নত মুখে চেয়ে থাকে নিচে। এক পলক ওর দিক তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজের রুমে চলে যায় স্বপ্নিল।
স্বপ্নিল চলে যেতেই রাহিতার নিকট এগিয়ে আসেন দিলারা বেগম। স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে ওর গালে হাত রেখে বলেন,
—তোরা একসাথে এলি যে? স্বপ্নিলকে কই পেলি? আমার ছেলে দেখি আজ তোর হাত-ই ছাড়ছিলো না! এসব কিভাবে হলো?
—পরে বলি, মা? এখন ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিবো।
শাশুড়ি মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই ফ্রেশ হওয়ার বাহানা দিয়ে কেটে পড়লো রাহিতা৷ বস্তুত তার খানিকটা লজ্জা লাগছিলো এ মুহুর্তে তার সামনে থাকতে! ওকে এভাবে পালিয়ে যেতে দেখে মনে মনে হাসেন দিলারা বেগম। মেয়েটা একটুতেই লজ্জা পায়!
রুমে প্রবেশ করতেই রাহিতা খেয়াল করলো স্বপ্নিল ইতিমধ্যে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে, চোখজোড়া বন্ধ। বুঝা যাচ্ছে ঘুমানোর প্রয়াস! জানালা ভেদ করে কক্ষে প্রবেশ করা সূর্যের আলো চোখের উপর পড়ায় একহাত চোখের উপর দিয়ে রেখেছে সে। বিষয়টা খেয়াল করে রাহিতা আলগোছে এগিয়ে গেলো জানালার কাছে৷ শব্দহীনভাবে পর্দা টেনে দিলো যেন রোদ চোখে লেগে স্বপ্নিলের ঘুমাতে অসুবিধে না হয়! এসব করে রাহিতা নিজেও হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। রুম ত্যাগ করার আগে সে খেয়াল করে স্বপ্নিল এখনো ঘুমায়নি, এদিক ওদিক করছে। প্রত্যক্ষমান উশখুশ ভাব। ধীরপায়ে বিছানার দিক এগিয়ে গিয়ে স্বপ্নিলের মাথায় হাত রাখতেই ইষৎ গরম অনুভব করে সে, তবে কিছু বলার আগেই চোখ মেলে তাকায় স্বপ্নিল। ওকে তাকাতে দেখে প্রথমে খানিকটা ভয় পেলেও পরমুহূর্তে মনে পড়ে স্বপ্নিল এখন আগের মতো নেই, এবার নিশ্চয়ই বকবেনা ওকে। তাই মনে সাহস সঞ্চার করে রাহিতা বলে,
—আপনার কি মাথা ব্যাথা করছে? মাথা টিপে দিবো?
নিষ্পলক ওকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে পুনরায় চোখ বন্ধ করে স্বপ্নিল। অতঃপর নিচু স্বরে বলে,
—দিলে মন্দ হয়না।
সম্মতি পেয়ে ওর পাশে বসে আলতো হাতে মাথায় – চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে রাহিতা। ওর নরম হাতের স্পর্শে প্রশান্তির ছাপ ভাসে স্বপ্নিলের চোখেমুখে। কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। স্বপ্নিল ঘুমানোর পর কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে রাহিতা। ত্রিশ বছরের জীবনে কতটা ধকল-ই না সহ্য করেছে ছেলেটা। এখন যেখানে ওর নিশ্চিন্তে চাকরি করে সুখে-শান্তিতে সংসার করার কথা, সেখানে ওর মাথায় পুরো পরিবারের দায়িত্ব পড়েছে। আবার জীবনে প্রথম কাউকে ভালোবেসে বিনিময়ে তার থেকেও ধোকা পেয়েছে। স্বপ্নিল মুখে তখন আনিকাকে মাফ করে দেওয়ার কথা বললেও রাহিতা জানে মনে মনে স্বপ্নিল ঠিক কতটাই না আঘাত পেয়েছে সত্যিটা জানতে পেরে! যতই হোক ভালোবাসায় আঘাত পেলে সেটা ভুলা কি এতই সহজ নাকি? জীবনটা কেন এত নিষ্ঠুর হলো ওর সাথে? রাহিতার কোমল মনে ভীষণ কস্ট হয় স্বপ্নিলের জন্য।
ও ঠিক করে স্বপ্নিলকে আর কখনো কস্ট দিবেনা। স্বপ্নিল ওকে ভালোবাসুক আর না-ই বাসুক, ও ঠিকই নিজের ভালোবাসায় ভরে দিবে তার নিঃসঙ্গ জীবন! এসব ভেবেই অতি সাবধানে টুপ করে চুমু খায় স্বপ্নিলের কপালে। এরপর কিছুক্ষণ শ্বাস আটকে অপেক্ষা করে, স্বপ্নিল টের পেলোনা তো? কিন্তু ওর স্থির বুকের ভারী নিশ্বাস দেখে ছেলেটার ঘুমন্ত অবস্থার প্রমাণ পায় সে! এরপর
খুব ধীরেসুস্থে বিছানা থেকে নামছিলো রাহিতা। তারই মাঝে হঠাৎ হাতে বাধা পায় সে। স্বপ্নিল জেগে উঠেছে মনে করে ভয়ে ভয়ে পেছন ফিরতেই খেয়াল করে ঘুমের ঘোরেই ওর হাত চেপে ধরেছে স্বপ্নিল। তা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটা। এরই মাঝে ঘুমন্ত স্বপ্নিলের অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ওর কানে আসে,
—আমায় ছেড়ে যেয়োনা…প্লিজ। তুমিও…
এটুক বলা হতেই হালকা গোঙানোর আওয়াজ করে সে পুনরায় ঘুমে তলিয়ে যায়! এদিকে স্বপ্নিলের মুখে পুরো বাক্য শোনার আকাংক্ষায় অপেক্ষা করলেও ওকে পুনরায় ঘুমোতে দেখে খানিকটা হতাশ হলো রাহিতা। তবে মনে মনে বেশ খানিকটা খুশিও হলো স্বপ্নিল আনমনেই ওকে চলে যেতে মানা করছে বলে! এরই মাঝে শাশুড়ির ডাক পড়ায় আস্তে করে স্বপ্নিলের হাত ছাড়িয়ে সে বিছানা থেকে নেমে রুম ত্যাগ করে নিচে চলে যায়। তবে যাওয়ার আগে রুমের দরজা ভালোভাবে চেপে দিয়ে যায়, যাতে নিরিবিলিতে ঠিকভাবে ঘুমোতে পারে স্বপ্নিল! একটি শান্তির ঘুম!
_______________________
নিচে আসতেই শাশুড়ির মুখোমুখি হয় রাহিতা। উনি হাসিমুখে ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। রাহিতা বুঝে এবার সব বলতে হবে শাশুড়িকে। মা হিসেবে তারও জানার অধিকার আছে, এজন্যই নির্দ্বিধায় সব খুলে বলে স্বপ্নিলকে। সবকিছু জানার পর একিসাথে বিস্ময় ও বিষাদে ছেয়ে যায় দিলারা বেগমের অন্তর। ছেলেটা তার একা একা কতকিছু সহ্য করলো ভাবতে ভাবতেই আঁচলে মুখ চেপে কাদেন তিনি। শাশুড়িকে কি বলবে এ মুহুর্তে ভেবে পায়না রাহিতা, তাই উনার পাশে বসে চুপচাপ সবকিছু লক্ষ্য করলো শুধু৷ দিলারা বেগম খানিকটা থামতেই সান্ত্বনার সুরে বললো,
—মা, আপনি কাদবেন না। উনি নিজেই এখন নিজেকে পরিবর্তনের চেস্টা করছেন৷ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেস্টা করছেন। তাই আমাদের এ মুহুর্তে তার পাশে থেকে তাকে সাপোর্ট করা উচিত।
—ঠিক বলেছিস, মা। আমি আজ ভীষণ খুশি জানিস? অবশেষে আমার ছেলেটা ওর জন্য কি সঠিক সেটা বুঝতে পেরেছে। আমার বিচক্ষণ ছেলে অতীতের মায়া ত্যাগ করে বর্তমানকে সুযোগ দিতে চেয়েছে। তুই সব জেনেও ওর পাশে আছিস, ওকে সুযোগ দিচ্ছিস, আল্লাহ তোকে সবসময় সুখী রাখুক, মা। সত্যিই স্বপ্নিল ভাগ্য করে তোর মতো বউ পেয়েছে। তুই ঠিক বলেছিস, এ মুহুর্তে অশ্রু নয় হাসি-ই মানায়!
চোখের পানি মুছে হাসিমুখে রাহিতার দিক তাকিয়ে বললেন তিনি। তার হাসি দেখে হাসলো রাহিতা নিজেও! দুজনের আরও টুকিটাকি গল্পগুজবের মধ্যে দিয়ে দুপুর ঘনিয়ে এলো। সামিরা কলেজ থেকে ফিরেছে, দিলারা বেগমও ব্যস্ত হয়ে গেলেন রান্নাঘরে। এদিকে রাহিতাও রুমে চলে এলো।
___________________
রুমে পৌঁছাতেই স্বপ্নিলকে এখনো গভীর ঘুমে ডুবে থাকতে দেখে মৃদু হাসে রাহিতা। যে মানুষটার এতদিন রাতেই ঠিকমতো ঘুম হতোনা, সে আজ বহুদিন পর এক টুকরো শান্তির পরশ পেয়ে এই ভরদুপুরেও কতটাই না নিশ্চুপভাবে ঘুমাচ্ছে দুনিয়া থেকে বেখেয়ালি হয়ে! কিন্তু এখন যে উঠাতে হবে ওকে, কাল রাতেও ঠিকমতো খায়নি স্বপ্নিল, আজ সকালেও না। দুপুরে না খেলে তো নির্ঘাত শরীর খারাপ হয়ে পড়বে৷ যা ভাবা সেই কাজ। ওর শিয়রে বসে মিহি স্বরে বার’কয়েক ডাকার পরেও সাড়া দিলোনা স্বপ্নিল। অতঃপর ওর বাহু ধরে ঝাকানোর পর পিটপিটিয়ে সদ্য ঘুম ভাঙা চোখ মেলে চাইলো রাহিতার পানে। এখানে কি হচ্ছে বুঝার চেস্টা করলো কিছুক্ষণ, ওর মনের কথা বুঝতে পারলো রাহিতা। হালকা হেসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা স্বপ্নিলের দিক চেয়ে বললো,
—বেশ কয়েক ঘণ্টা তো ঘুমোলেন৷ এবার উঠুন, মা খেতে ডাকছে। দুপুর পার হয়ে গেলো! খাবেন না?
—ক’টা বাজে এখন?
—এইতো আড়াইটা পেরিয়েছে একটু আগে!
—আমি এতক্ষণ ঘুমিয়েছি?
বেশ খানিকটা বিস্ময়ের সাথেই বললো স্বপ্নিল। ওর চাহনি খেয়াল করে মুখ টিপে হেসে মাথা নাড়লো রাহিতা। আড়চোখে কিছুক্ষণ সেদিক চেয়ে কিছুক্ষণ পর গলা ঝেড়ে স্বপ্নিল বললো,
—থ্যাংক ইউ, রাহিতা। তুমি শুধু আমার উপকারই করছো। তোমায় কি বলে ধন্যবাদ দিবো আমার কাছে ভাষা নেই..
—ধুর, এসব কথা বাদ দিন তো। এতদিন পর ভালো একটা ঘুম দিয়েছেন এটাই তো অনেক। এখন গোসল করে আসুন। আমি নিচে যাচ্ছি!
কথাটি বলে চলে যেতে উদ্যত হতেই ওর হাত ধরে থামিয়ে দেয় স্বপ্নিল। কিন্তু যেই স্থানে রাহিতার হাতে লেগেছিলো সেদিন, নিজের অজান্তেই ওখানে চেপে ধরায় ব্যথা পায় রাহিতা। আনমনেই “আহ” সূচক ধ্বনি বেড়িয়ে আসে ওর মুখ থেকে! চমকে উঠে ওর হাতের দিক তাকাতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় স্বপ্নিলের। আস্তেধীরে হাত সরিয়ে নেয় সেখান থেকে। এতক্ষণে ওর নিরবতা দেখে রাহিতা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই ওকে বাহু ধরে বিছানায় বসিয়ে দেয় স্বপ্নিল। এরপর হুট করে নিজেই উঠে যায় বিছানা থেকে। রাহিতা চুপচাপ ওর কর্মকাণ্ড দেখছিলো। এরই মাঝে ফার্স্টএইড বক্স থেকে মলম বের করে নিয়ে আসে স্বপ্নিল। ওকে মলম আনতে দেখে রাহিতা বলে,
—এখন মলম লাগানোর দরকার নেই আর। কাল সামিরা লাগিয়ে দিয়েছিলো তো। আপনি রাখুন এটা।
কিন্তু স্বপ্নিল নির্বিকারভাবে ওর পাশে বসে মলম বের করে হাতে ভরিয়ে ওর ক্ষতস্থানে লাগাতে ধরতেই ইষৎ চিনচিনে ব্যথায় রাহিতা কুঁকড়ে উঠে,
—কি করছেন? বললাম তো আমার লাগবেনা। লাগানোর দরকার নেই মলম!
—শুস..এত কথা বলো কেন? তোমার না লাগলেও আমার লাগবে। ব্যথা যখন আমিই দিয়েছি তখন মলম লাগানোর অধিকারটাও তো আমারই, তাইনা? তাই চুপচাপ আমাকে আমার কাজ করতে দাও।
এতক্ষণে মুখ খুলে স্বপ্নিল। রাহিতার ক্ষতস্থানে ফু দিতে দিতে স্বাভাবিক কণ্ঠে জানিয়ে দেয় নিজের উত্তর। এদিকে ওর এমন সহজ স্বীকারোক্তি ও দায়িত্ববোধ মুগ্ধ করে রাহিতাকে! স্বপ্নিল কি তবে সত্যিই পরিবর্তন হতে শুরু করেছে? ওর সাথে নিজের সম্পর্ককে মেনে নিতে শুরু করেছে? রাহিতার মনের মাঝে চলা প্রশ্নের ঘূর্ণিঝড়ের আভাস যেনো ওর চোখমুখে ফুটে উঠে, যা দৃষ্টিগোচর হয়না স্বপ্নিলের। মলম লাগানো শেষ করে উঠে যেতে যেতে শান্ত কণ্ঠে বলে দিলো,
—আমি জানি তুমি হয়তো অবাক হচ্ছো আমায় এভাবে স্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে৷ কিন্তু ট্রাস্ট মি এখন আমি বদলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এতদিন যা করার করেছি, এবার থেকে অন্তত কখনোই তোমার সাথে খারাপ আচরণ করবোনা, রাহিতা এবং কাউকে করতেও দিবোনা। স্বপ্নিল কখনো নিজের দায়িত্ববোধ থেকে পিছু হটেনি, এবারেও ব্যতিক্রম হবেনা। আমি তোমার প্রতি আমার সব দায়িত্ব পালন করবো। যদিও পুরোপুরি স্বামীর মতো হতে পারবোনা কি না জানিনা তবে এটলিস্ট একটা ভালো বন্ধুর মতো এখন থেকে সবসময় তোমার পাশে পাবে তুমি আমায়। এটুকু নিশ্চিত থাকো!
#চলবে