#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৮
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরেও স্বপ্নিল আসেনি। তাই নিরুপায় রাহিতা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ শুয়ে পড়লো বিছানায়। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে বিছানার সামনের সোফায় স্বপ্নিলকে বসে থাকতে দেখে খানিকটা অবাক হয় রাহিতা! সে সোফায় বসে থেকে একমনে কি যেন করছিলো, উৎসুক চোখে সেদিক চেয়ে বিছানা থেকে উঠে সোফায় এগিয়ে যেতেই ওকে দেখে স্বপ্নিল হকচকিয়ে হাতের জিনিস লুকিয়ে ফেলে! এরপর রাহিতাকে দেখে খুব শান্ত অথচ ধীর কণ্ঠে সে বলে উঠে,
—এখন কেমন আছো তুমি?
হঠাৎ স্বপ্নিলের এমন প্রশ্নে চমকে উঠে রাহিতা। সে যে এ সময় এমন প্রশ্ন করবে ভাবতে পারেনি ও! তবে রাহিতা কিছু বলার আগেই স্বপ্নিল আবার বলে,
—খুব ব্যথা পেয়েছিলে, তাইনা?
—আমি ঠিক আছি।
—আমি আসলেই বুঝতে পারিনি কখন রাগের বশে তোমায় আঘাত করে ফেলেছি, যদি পারো আমায় ক্ষমা করে দিয়ো।
—বাদ দিন এসব। আপনি কি করছিলেন এখানে? হাতে কি আপনার? দেখি।
—কিছু না। আমি খুব খারাপ তাই না, রাহিতা? সবাইকে অনেক কস্ট দিয়ে ফেলেছি। সবাই খুব রেগে আছে আমার উপর!
স্বপ্নিলের এসব কথার বিপরীতে কি বলবে তৎক্ষণাৎ ভেবে পেলোনা রাহিতা। কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতেই পুনরায় অতি শীতল কণ্ঠে স্বপ্নিল বলে উঠে,
—আমার উপর যদি বেশি রাগ হয়ে থাকে তবে মনে কস্ট রেখোনা, মাফ করে দিয়ো আমায়। মা-কেও বলো আমায় ক্ষমা করতে। সবার সাথেই যে অন্যায় করেছি আমি!
আচমকা ওর এমন কথার আগামাথা কিছুই বোধগম্য হলোনা রাহিতার। কেমন যেন খটকা লাগলো মনে! স্বপ্নিল হঠাৎ করে এসব কেন বলছে?
—কি হয়েছে আপনার? এসব বলছেন কেন এখন?
কিন্তু ওর প্রশ্নের জবাব দিলোনা স্বপ্নিল। শুধু নির্বিকারভাবে এক পলক রাহিতার চোখে চেয়ে রুম ত্যাগ করলো। বিচলিত রাহিতা চিন্তিত ভংগীতে সোফায় বসে ভাবতে লাগলো স্বপ্নিল কি করছিলো এখানে? আর কেন-ই বা এসব বলছিলো হুট করে? নজর ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে কিছুক্ষণ খোজার পর যা পেলো তাতে ভয়ে রক্ত হিম হয়ে গেলো রাহিতার! সোফার নিচে এক ধারা’লো ব্লে’ড লুকিয়ে রেখেছিল স্বপ্নিল। অজানা ভয়ে মুহুর্তেই হাত-পা কাঁপতে লাগলো মেয়েটার! তবে কি স্বপ্নিল পুনরায় সু’ইসা’ইড করতে যাচ্ছিলো নাকি? সর্বনাশ!
_____________________
আধা ঘণ্টা যাবত অতি টেনশনে রুমের মাঝে পায়চারি করছে রাহিতা। পুরোপুরি শিওর না হওয়ার কারণে বেচারি না পারছে কাউকে বলতে আর না পারছে নিজে কিছু করতে! স্বপ্নিলকে ফোন দিয়েও লাভ হয়নি কেননা সে বাসাতেই ফোন রেখে বেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে চিন্তারত তার ফোন বেজে উঠে তাড়স্বরে। বিরক্তি নিয়ে ফোনের দিক তাকাতেই দেখে ওর এক কাজিন ফোন দিয়েছে। রাহিতার মামাতো ভাই আর কি, আকাশ। তো এত সকালে কেন সে ফোন দিলো মাথায় এলোনা রাহিতার। এমনিতেই সে বেশ চিন্তায় আছে স্বপ্নিলকে নিয়ে তাই একবার ভাবলো রিসিভ করবেনা ফোন। কিন্তু পরে ভাবলো যদি সে কোনো দরকারে ফোন দেয় তবে? তাইতো কল কেটে যাওয়ার শেষ মুহুর্তে হুট করে ধরে ফেলে ফোন। ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে,
—হ্যালো, রাহি। কেমন আছিস তুই?
—এইতো ভালো, ভাইয়া। তুমি?
—আমিও ভালো আছি। কি করিস?
—কিছুই না। ভাবছিলাম তুমি হঠাৎ এত সকালে ফোন দিলে যে?
—আরে অফিস আসছিলাম সকালবেলা। রাস্তায় তোর বরকে চোখে পড়লো। বলি এত সকালে পায়ে হেটে কোথায় যাচ্ছিলো ও? তোর জামাই কি অফিস যায়না নাকি?
আকাশের মুখে স্বপ্নিলের কথা শুনে প্রচন্ড বিস্মিত হয় রাহিতা! তড়িঘড়ি করে বলে,
—স্বপ্নিলকে দেখেছো তুমি? কোথায় যাচ্ছিলেন, ভাইয়া? আমায় বলবে প্লিজ।
—বলছি কিন্তু আগে তুই এটা বল যে ওর হয়েছেটা কি? তোদের মধ্যে কোনো ঝগড়া-টগড়া হয়েছে নাকি? যতটুক খেয়াল করলাম স্বপ্নিলকে বিষন্ন দেখাচ্ছিলো।
এ প্রশ্নের কি জবাব দিবে রাহিতা ভেবে পেলোনা। তবু কোনোভাবে বললো,
—আসলে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। উনার আজ মন ভালো নেই তো তাই হয়তো হাটছেন ওইভাবে। কোথায় দেখেছো তুমি? আমায় লোকেশন পাঠাও না ভাইয়া, প্লিজ!
—আচ্ছা ঠিক আছি মেসেজ করছি তোকে আমি। যদি তোর আপত্তি না থাকে তবে কি কারণে তোদের ঝগড়া হয়েছে আমি জানতে পারি? মানে নতুন নতুন বিয়ের পর সাধারণত ঝগড়া হয়না, তাই অবাক হয়েছি আর কি!
—আসলে এখন একটু তাড়ায় আছি। আমি পরে কথা বলছি। তুমি জলদি আমায় মেসেজ দেও। রাখছি, ভাইয়া। থ্যাংক ইউ জানানোর জন্য!
—ইটস ওকে। তোর যেকোনো সমস্যা আমাকে জানাতে পারবি, আমি সবসময় চেস্টা করবো তোর হেল্প করার বুঝেছিস?
—হুম। আল্লাহ হাফেজ।
ফোন কেটেই আকাশের মেসেজ পাওয়ার অপেক্ষা করতে থাকলো রাহিতা। কিছুক্ষণের মাঝেই পেয়েও গেলো ঠিকানা। মনে মনে স্বপ্নিলের ঠিকানা পাওয়ার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আর বিলম্ব না করে সে নিজেও দ্রুতকদমে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। শাশুড়িকে আসল কারণ বললোনা কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে, শুধু এটুকু জানালো যে তার একটা কাজ আছে। দিলারা বেগমও আর প্রশ্ন না করে ওকে যেতে দিলেন। এবার শুধু সময় থাকতে স্বপ্নিলের কাছে পৌঁছাতে পারার অপেক্ষা!
___________________
যতদ্রুত সম্ভব কাংক্ষিত জায়গায় পৌঁছে গেছে রাহিতার! বাসা থেকে একটু দূরে অবস্থিত হওয়ায় এদিকে কোলাহল কম। সামনে একটি নদী আছে, নদীর তীর ঘেঁষে কিছু মানুষ চুপচাপ হাটাহাটি করছে। বলতে গেলে মন খারাপ হলে এরকম জায়গায় আসা বেশ যুক্তিযুক্ত বলে মনে হলো রাহিতার। গভীর নদীর শান্ত স্রোতের দিকে তাকিয়ে মন শান্ত করার প্রয়াস ব্যর্থ হবেনা যেন। হয়তো এজন্যই স্বপ্নিল এখানে এসেছে, আনমনেই ভাবে রাহিতা। দৃষ্টি এদিক সেদিক ফিরাতেই অদূরে নদীর দিক এগিয়ে যাওয়া স্বপ্নিলকে চোখে পড়লো তার! স্বপ্নিলকে নদীর দিকে এগোতে দেখে হঠাৎ করেই অজানা ভয়ে মন কেপে উঠলো রাহিতার! নিজের অজান্তেই জোরকদমে দৌড়ে গেলো স্বপ্নিলের পানে! জীবনে এত দ্রুত কখনো দৌড়িয়েছে কিনা মনে নেই রাহিতার তবে এ মুহুর্তে যে তার স্বপ্নিলের কাছে পৌঁছানো অতীব জরুরি! ছন্নছাড়া পায়ে আরেকটু সামনে এগোনোর আগেই পেছন থেকে ওর শার্ট খামচে ধরলো রাহিতা, নিজের সব শক্তি দিয়ে পেছন থেকে নিজের দিক টেনে ধরলো ওকে। বলাবাহুল্য, আচমকা এমন ধাক্কার জন্য স্বপ্নিল প্রস্তুত না থাকায় ভার সামলাতে না পেরে রাহিতার সাথে পেছনে হেলে পড়ে সে!
রাহিতাকে দেখে হতভম্ব হয়ে বসে আছে স্বপ্নিল। হুট করে পড়ে যাওয়ায় দুজনেই মাটিতে বসে হাপাচ্ছে। বিস্মিত স্বপ্নিলের মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এ মুহুর্তে এখানে রাহিতাকে আশা করেনি সে! খানিকবাদে বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে হালকা সুরে জিজ্ঞেস করলো,
—তুমি এখানে কেন এসেছো, রাহিতা?
বহু চেস্টায় নিজেকে শান্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় এবার আর নিজের রাগ সামলাতে পারলোনা রাহিতা। প্রচন্ড রাগে স্বপ্নিলের কলার চেপে ধরে বলে উঠলো,
—কেন আসবোনা আমি? আপনি আমার জীবন নিয়ে খেলে এখানে সবকিছু শেষ করার জন্য আসবেন আর আমি বাসায় বসে বসে সবকিছু সহ্য করে যাবো? কি ভাবেন আপনি নিজেকে হ্যাঁ?
হুট করে রাহিতার এমন রণচ’ণ্ডী রুপ দেখে অবাক চোখে চেয়ে রইলো স্বপ্নিল। রাহিতা যে তার সাথে এভাবে ধমকে কথা বলবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি! স্তব্ধ সে চুপচাপ চেয়ে রইলো শুধু! এরই মাঝে ওর জবাব না দেওয়ায় ক্ষি’প্ত রাহিতা আবারও গর্জে উঠে,
—কি হলো? চুপ করে আছেন কেন এখন? এমনি তো আমার সাথে ঝগড়া করার সময় মুখে খই ফুটে আপনার, তবে এখন কেন এত নিরবতা? কোন সাহসে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আপনি? আমাদের অনুভূতির কোনো মূল্য নেই আপনার কাছে? আমার কথা তো বাদ-ই দিলাম, অন্তত একটাবার আপনার মা, বোন এবং আপনার সাথে জড়িত মানুষদের কথাও কি মাথায় এলোনা? বলুন!
কাদতে কাদতে স্বপ্নিলের কলার ঝাকিয়ে পুনরায় চেচিয়ে প্রশ্ন করে রাহিতা। স্বপ্নিল কিছুটা সময় নেয় স্থির হতে, যখন ওর বুঝে আসে রাহিতা কি মনে করেছে তখন চোখ বন্ধ করে নিজেকে কোনোরকমে স্বাভাবিক করে সে। অতঃপর লালচে চোখজোড়া খুলতেই চোখাচোখি হয় একজোড়া টলমলে অশ্রুসিক্ত চোখের সাথে। হঠাৎ করেই স্বপ্নিলের কি হয় সে জানেনা, এতক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেঙে অবশেষে মুখ খুলে বলে,
—তুমি যা ভাবছো তা নয়। আমি..
—চুপ করুন আপনি। আমি সব বুঝেছি আপনি কি করতে এসেছিলেন! সোফার নিচে ব্লে’ড দেখেছি আমি! আর এখানে নির্জনে গভীর নদীর তীরে আপনি কেন হেটে যাচ্ছিলেন সেটাও বুঝেছি। আমার কাছে মিথ্যা বলে লাভ নেই, বুঝেছেন? আমি সব বুঝি!
আবারো রাগ দেখিয়ে ধরে রাখা কলারে খানিকটা বল প্রয়োগ করেই বলে রাহিতা। ওর ক্ষো’ভ দেখে মনে মনে খানিকটা হাসে স্বপ্নিল, একি সাথে অবাকও হয়! সদা বাধ্যগত মেয়েটা ওর চিন্তায় কিভাবে দৌড়ে এসেছে এখানে, আবার রীতিমতো বউয়ের অধিকারে ওকে ঝাড়ছেও এভাবে! আড়চোখে আশেপাশে তাকিয়ে এবার আস্তেধীরে নিজের কলার থেকে রাহিতার হাত সরিয়ে নেয় স্বপ্নিল। তাতে মন ছোট করে খানিকটা দমে গেলেও পরমুহূর্তে স্বপ্নিলের আচরণে অবাক না হয়ে পারেনা সে! কলার থেকে হাত সরিয়ে ওর দুটো হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শান্ত গলায় চোখে চোখ রেখে স্বপ্নিল বলে,
—আমি সুই’সাইড করতে আসিনি, রাহিতা। তুমি ভুল ভাবছো আমায়!
এবার বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকায় মেয়েটা! বলছে কি স্বপ্নিল? যদি সে উদ্দেশ্যে না আসে তবে সকাল থেকে এমন উদ্ভট কথাবার্তা ও আচরণ করছে কেন? আর হুট করেই এখানে এলো কেন? ওর মনে বইতে থাকা প্রশ্নের ঝড় ওর মুখভঙ্গিতে দৃশ্যমান হওয়ায় স্বপ্নিলের বুঝতে অসুবিধে হয়না রাহিতার ভেতরে কি চলছে! তাই ওর হাত দুটো ছেড়ে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মিহি কণ্ঠে সে বলে,
—তুমি যখন এসেছোই তখন আর কিছু লুকোবোনা তোমার থেকে। আজ সব খুলে বলবো তোমায়। অনেক লম্বা কাহিনি, হয়তো তোমার খারাপও লাগবে শুনতে। তোমার কি সময় হবে?
এই প্রথম স্বপ্নিলের নরম আচরণে বুকের ভেতর অদৃশ্য ঝড় উঠে রাহিতার। সে পারেনা ওকে মুখ ফুটে বলতে,
“আপনার জন্য আমার সারাজীবন সময় হবে, স্বপ্নিল। এটাও কি জিজ্ঞেস করা লাগে?”
তবু মুখে কলুপ এটে বাধ্য মেয়ের ন্যায় উৎসুক চোখে মাথা নেড়ে মতামত জানায় সে। কেননা সে নিজেও চায় স্বপ্নিল ওকে সব খুলে বলুক, ওর থেকে কোনোকিছু গোপন না করুক, ওর সাথে নিজের অনুভুতি ভাগাভাগি করুক! তাই তো দুরুদুরু বুকে স্বপ্নিলের পানে চেয়ে থাকে রাহিতা, হয়তো এবার সৃষ্টিকর্তা ওর ডাকে সাড়া দিয়েছেন তবে?
#চলবে