#মন_বিনিময়
#পর্বঃ২
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
সহসা শাশুড়ির রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে রাহিতা। দরজা স্বাভাবিকভাবেই ভেতর থেকে বন্ধ করা। বিয়েবাড়ির চঞ্চল পরিবেশও এখন রাতের আধারে নিস্তব্ধতায় ঘেরা। এমতাবস্থায় কিছুটা বিচলিত হলো মেয়েটা। এতক্ষণ আবেগের বশে স্বপ্নিলকে কথা শুনিয়ে এতদূর চলে এলো ঠিকই কিন্তু এ সময় শাশুড়িকে ডেকে তার কাঁচা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে মন সায় দিলোনা তার। একিসাথে মাথায় এলো কেউ যদি তাকে বধূবেশে এ সময় স্বপ্নিলের রুম ব্যতীত এখানে দেখে তবে বিষয়টা মোটেও ঠিকভাবে নিবেনা। আর যাই হোক নিজেদের সম্পর্কের মারপ্যাঁচ বাহিরের মানুষদের দেখানোর মানসিকতা নেই তার মধ্যে। তাই মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্নের ঘূর্ণিঝড় হলেও সবকিছু বিবেচনা করে ধৈর্য ধারণ করা বেছে নিলো সে। কয়েক কদম পিছিয়ে এসে স্বপ্নিলের রুমের দিক পা বাড়াতেই চোখে পড়লো তড়িৎবেগে সরে যাওয়া স্বপ্নিলকে। কিন্তু চুপিচুপি স্বপ্নিল কেন ওর পিছে পিছে এসেছিলো বোধগম্য হলোনা রাহিতার!
রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে পেছন ফিরতেই বিছানায় বসে থাকা স্বপ্নিলের সাথে চোখে চোখ মিলে যায় তার। সে চোখে চোখ রেখেই স্বপ্নিল ব্যঙ্গাত্বক স্বরে প্রশ্ন ছুড়ে,
—তো কি কথা হলো মায়ের সাথে?
ওর কণ্ঠ শুনে ও কথার ধরন দেখে রাগে গা জ্ব’লে উঠলো রাহিতার। ভাবখানা এমন করছে যেন এতক্ষণ এখানেই বসে থেকে তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। ক্ষি’প্ত রাহিতা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—কেন? আপনি ঠিকমতো দেখতে পান নি বুঝি? আমার পিছে এতদূর গিয়েও কি লাভ হলো যদি কি হয়েছে জানতেই না পারেন!
ধরা পড়ে যাওয়ায় এতক্ষণের কৌতুকপূর্ণ মুখভঙ্গি বদলে যায় স্বপ্নিলের। মেয়েটা তার মানে দেখেছে ওকে, আবার সেটা নিয়ে খোটাও দিচ্ছে! এ তো দেখা যায় ভালোই ফাজিল। মনে মনে এসব ভাবলেও কিছু বলতে গিয়ে শেষমেশ থেমে যায় স্বপ্নিল। বলাবাহুল্য সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে, শারীরিক মানসিক উভয়দিক দিয়েই। তাই এখন তর্ক করে এনার্জি নস্ট করার মানে হয়না। অন্তত এই ফাজিল মেয়েটার সাথে তো নয়-ই, মনে মনে ভেবে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো সে।
স্বপ্নিল ঘুমোতেই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাগেজ থেকে ড্রেস বের করে ফ্রেশ হতে চলে গেলো রাহিতা। অতঃপর ক্লান্ত শরীরে বিছানায় শুয়ে পড়লো তার পাশেই। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে একটা ঘুম এখন তন ও মন দুটোরই বড্ড প্রয়োজন!
___________
সকালবেলা দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে রাহিতার। ঘুমুঘুমু চোখজোড়া মেলে ঘড়ির দিক তাকাতেই হুশ ফিরে আসে। সকাল প্রায় ৯টা বাজছে। নতুন বউ প্রথমদিনই এতবেলা করে ঘুমোবে তা নিশ্চয়ই ভালো দেখায় না৷ পাশে তাকিয়ে দেখে স্বপ্নিল নেই। মনে মনে কস্ট পেলো রাহিতা৷ লোকটা নিজে উঠে চলে গেছে সকালবেলা অথচ ওকে ডাকার প্রয়োজন মনে করলোনা একটাবারও! কি এমন হতো ওকে ডেকে দিলে? কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো যে ছেলেটা তাকে এখনো মন থেকে বউ হিসেবে স্বীকার করেই না সে কেন যেচে পড়ে তার সাথে কথা বলবে? স্বপ্নিলের কথা ভাবতেই কালরাতের কথোপকথন পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো রাহিতার। তবুও সেগুলোকে মনের মধ্যে চাপা দিয়েই দরজার কাছে গেলো সে। দরজা খুলতেই চোখে পড়লো এক হাস্যোজ্জ্বল মেয়েকে, যে স্বপ্নিলের চাচাতো ভাইয়ের বউ – সায়মা। কাল বিয়েতে তার সাথে পরিচয় হয়েছে রাহিতার। তাকে দেখে রাহিতাও মুখে হাসি টেনে বললো,
—সরি ভাবী, উঠতে একটু লেট হলো। সবাই উঠে গেছে না? কখন এত বেলা হয়েছে আমি টেরই পাইনি!
—আরে কোনো সমস্যা নেই, পাগলি। বিয়ের প্রথম প্রথম এমন হয়। আমরাও তো সেই সময় পার করে এসেছি নাকি? বুঝতে পারছি তোমার অবস্থা।
সায়মার রসিকতাপূর্ণ কথায় হাসবে না লজ্জা পাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলোনা রাহিতা। মনে মনে শুধু বললো,
—যদি তোমাদের মতো আমার বিয়েটা একটা স্বাভাবিক বিয়ে হতো তাহলে হয়তো তোমার কথা ঠিক হতো, ভাবী। কিন্তু আমার বর যে আমায় মন থেকে চায় না। চাপে পড়ে বিয়ে করেছে!
—কি গো কি ভাবছো মনে মনে? আমার দেবরের কথা নাকি?
সায়মার ডাকে মনের চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে রাহিতা। বিনিময়ে নম্র সুরে বলে,
—উহু৷ ভাবছিলাম আমি কি এখন কি পড়বো? শাড়ি তো পড়তে পারিনা আমি৷ সবসময় মা-ই পড়িয়ে দিতো। তুমি কি আমায় হেল্প করবে, ভাবী?
—কেন নয়? অবশ্যই হেল্প করবো। এজন্যই তো এখানে। নয়তো কি আর এমনি এমনি এসেছি? তুমি গোসল করে এসো, আমি শাড়ি পড়িয়ে রেডি করে দিচ্ছি। তোমার শাশুড়ি মা-ই পাঠিয়ে দিলেন আমায়। তার একমাত্র পুত্রবধুকে জাগিয়ে রেডি হয়ে নিচে নিয়ে যেতে বললেন। জানো চাচি তোমায় ভীষণ ভালোবাসে তোমায়, রাহি। তুমি অনেক লাকি। সবার শাশুড়ি এমন হয় না।
সায়মার কথায় বাহির থেকে হাসলেও ভেতরে ভেতরে কিছুটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো রাহিতা। সে নিজেও জানে দিলারা বেগম তাকে ভালোবাসেন কিন্তু তবুও তিনি স্বার্থপরের মতো তাকে পুরো সত্যটা না জানিয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত কিভাবে নিলেন তা বেশ ভাবাচ্ছে তাকে। যে করেই হোক আজ উনার সাথে কথা বলতেই হবে তার, শুনতেই হবে সবকিছু। নয়তো সারাজীবন এভাবে সমঝোতা করে কিভাবে চলবে সে স্বপ্নিলের সাথে?
নিজের এসব ভাবনার মাঝেও একটা জিনিস নজর এড়ালোনা রাহিতার। তা হলো এতক্ষণ হাসিমুখে সব কথা বল্লেও শেষের কথাটা কিছুটা দুঃখের সাথেই বললো সায়মা। তার মুখাভঙ্গি দেখে কপালে ভাজ পড়লো রাহিতার। কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই তাকে ঠেলেঠুলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলো সায়মা। কোনোকিছু বলার সুযোগই আর পেলোনা সে!
মেরুন রঙের জামদানি পড়ে আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখছে রাহিতা। সায়মা তাকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে শাশুড়ির ডাকে নিচে চলে গেছে দ্রুতপায়ে। উজ্জ্বল ত্বকে মেরুন রঙ বেশ মানিয়েছে তার গায়ে। গোসল করে আসা ভেজা চুলে আয়নার সামনে শাড়ি পরিহিত রাহিতাকে সদ্য ফুটে উঠা গোলাপের ন্যায় দেখাচ্ছে। আয়না থেকে নজর সরিয়ে রুম থেকে বের হবে এমন সময় সেখানে প্রবেশ করে স্বপ্নিল। আস্তেধীরে হেটে আসায় রাহিতা খেয়াল করে, কালরাতের তুলনায় কিছুটা অন্যরকম দেখাচ্ছে তাকে। চোখমুখে যেন স্পষ্ট লালচে ভাব। কৌতুহলী চোখে সেদিক চেয়ে কিছু বলবে তার আগেই তাকে এক প্রকার ইগ্নোর করে রুম পেরিয়ে বারান্দায় চলে যায় স্বপ্নিল। এক পলক দেখেওনা ওর দিকে! এতে ভেতরে ভেতরে খানিকটা অভিমান জমলেও বাহির হতে তা প্রকাশ না করে রুম থেকে বের হচ্ছিলো সে।
হঠাৎ কি মনে করে বারান্দায় যেতেই চোখে পড়লো হাতে সিগারেট ধরে রাখা স্বপ্নিলকে। একদৃষ্টিতে আকাশের দিক চেয়ে বিষন্ন মনে ধোয়া উড়াচ্ছে। এই উজ্জ্বল রোদেলা সকালেও তার চোখেমুখে স্পষ্ট আধার। স্বপ্নিলের এমন চেহারা দেখে খারাপ লাগার পাশাপাশি সামান্য অপরাধবোধও হলো রাহিতার। একটু কি সময় দেওয়া যেতো না ছেলেটাকে? কেন এত তাড়াতাড়ি সবকিছু করতে হলো? প্রত্যেকটা মানুষেরই সময়ের সাথে সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার একটা ব্যাপার থাকে যেটা স্বপ্নিল পায়নি। এসব ভেবেই সেখান হতে প্রস্থান করছিলো রাহিতা। এমন সময় কানে এলো স্বপ্নিলের শান্ত কণ্ঠস্বর,
—চোরের মতো পেছনে দাঁড়িয়ে না থেকে কিছু বলার থাকলে সামনে এসে বলো।
চমকে উঠে পেছন ফিরলো রাহিতা। না এখনো স্বপ্নিল আগেকার মতোই রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে। পেছনে ঘুরে দেখেনি অব্দি তাকে। তবু কিভাবে বুঝলো? বিস্ময়কে সাথে নিয়েই খানিকটা এগিয়ে এসে সে প্রশ্ন করলো,
—আপনি কোথায় গিয়েছিলেন সকাল সকাল?
উত্তরের আশায় অপেক্ষা করা রাহিতাকে হতাশ করে চুপ রইলো স্বপ্নিল। বিষয়টাকে উপেক্ষা করে রাহিতা পুনরায় প্রশ্ন করলো,
—আপনি সিগারেট কেন খাচ্ছেন? আপনি না আগে এসব খেতেন না।
—একদম বউয়ের মতো আচরণ করবেনা।
—কেন করবোনা? বিয়ে করার সময় এটা মাথায় ছিলোনা যে ঘরে বউ নিয়ে আসছেন?
এবার স্বপ্নিলের উত্তর না পাওয়ায় রাগ হলো রাহিতার। কয়েক কদম এগিয়ে তেজিহস্তে সিগারেটটি কেড়ে নিলো ওর হাত থেকে। অতঃপর তা নিচে ফেলে দিতে উদ্যত হতেই তার হাত ধরে ফেললো স্বপ্নিল। পেশিবহুল পুরুষালি হাতে নিমিষেই এটে গেলো তার ক্ষুদ্রাকায় হাতটি। রেলিঙের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা রাহিতা বেশ কিছুটা জোর খাটিয়ে হাত সরানোর চেস্টা করেও ব্যর্থ হলো স্বপ্নিলের শক্তির কাছে। অতঃপর স্বপ্নিল এখনো নীরব থাকায় বিরক্তিকর কণ্ঠে সে বলে উঠলো,
—কি সমস্যা আপনার? ছাড়ুন হাত! ফেলে দিবো আমি এটা।
—ওকে! ছাড়ছি হাত।
বলে আচমকা হাত ছাড়তেই অপ্রস্তুত ভংগিতে পেছন দিক ঝুঁকে যায় রাহিতা। ফলশ্রুতিতে গ্রিলহীন বারান্দা হতে পড়ে যেতে ধরে সে। চোখমুখ কুচকে এক বিকট চিৎকার দেওয়ার প্রস্তুতি নিতেই পুনরায় তার হাত আকড়ে ধরে স্বপ্নিল। শক্তমুঠোয় রাহিতার হাত পেচিয়ে ওকে আরো খানিকটা পেছনে ঝুকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলে,
—ফেলে দিই তোমাকে এবার? কি বলো?
ভয়ে বাকরুদ্ধ রাহিতা চোখ মেলতেই অক্ষিদ্বয় মিলিত হলো স্বপ্নিলের ইষৎ লালচে চোখজোড়ার সাথে। যে চোখের ভাষা পড়তে ব্যর্থ হলো সে। রাহিতাকে চুপ থাকতে দেখে স্বপ্নিল হাতের বাধন খানিকটা ঝাঁকিয়ে করে ঠান্ডা গলায় আবারো বললো,
—চুপ কেন? এবার বলো। ফেলে দিই তোমায়?
ভয়ে চোখমুখ কুচকে ধীর কণ্ঠে রাহিতা জবাব দিলো,
—যদি পারেন ফেলে দিন।
—তুমি কি মনে করেছো আমার মধ্যে সাহস নেই? আমায় চ্যালেঞ্জ করছো তুমি? দেখাতে হবে তোমায়? ওকে দেন। গুড বাই মিসেস রাহিতা।
তীর্যক হেসে গটগট করে কথাগুলো বলেই হাতের বন্ধন ঢিলে করে দিলো স্বপ্নিল। এতক্ষণ মনের মাঝে সাহস নিয়ে ঝুকে থাকা রাহিতার যেন শ্বাস আটকে গেলো কণ্ঠনালিতে! তবে কি স্বপ্নিল সত্যিই ওকে নিচে ফেলে দিবে?
#চলবে