#মনে_পড়ে_তোমায়_সন্ধ্যে_বেলায়
#সূচনা_পর্ব
#নুজাইফা_নূন
-” বাসর রাতে আমার বরের পরিবর্তে সাত বছরের দেবরের সাথে রাত্রি যাপন করতে হয়েছে।যেই রাতে বরের সাথে গল্পগুজব ,সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়া কথা। সেই রাতে সারাটা রাত আমার চোখের পানি ফেলতে ফেলতে কেটেছে।আমার বর কবুল বলেই বিয়ের আসরে আমাকে একা ফেলে চলে এসেছে।যেখানে মেয়েরা বরের হাত ধরে শ্বশুর বাড়ি প্রবেশ করে।সেখানে আমি সাত বছরের দেবরের হাত ধরে শ্বশুর বাড়ি প্রবেশ করেছি।আমাদের বিয়ের দুই টা দিন পার হয়ে গিয়েছে । অথচ আমার বর একটা বারের জন্যও আমার মুখ দর্শন করে নি।আমার সাথে দুটো ভালো করে কথা বলে নি।একটা মেয়ের কাছে এর থেকে বড় অপমান আর কি হতে পারে ? বলতে পারিস আদিতা?”
-” কি বলছিস আপু? উৎস তালুকদার তোকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয় নি ?”
-“আমাকে উৎসের স্ত্রী হিসেবে মেনে নেওয়ার কথা ছিলো বুঝি? কেন আমার জীবন টা নষ্ট করে দিলি আদি? বিশ্বাস কর আমি বেশি কিছু চাই নি।আমি একটু ভালো ভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোর টাকা , পয়সা, বাড়ি গাড়ি, অর্থের লোভ আমার জীবন টা শেষ করে দিলো রে আদি।”
-” তুই আমাকে ভুল বুঝছিস আপু। উৎস তোকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয় নি।এখানে আমার দোষ কোথায় বল তো আপু? আমি তো আর উৎস কে বলে দেই নি সে যেনো তোকে স্ত্রী হিসেবে না মেনে নেয়।”
-” উৎস তোকে ভালোবাসে আদি। দু দিন আগে উৎসের সাথে তোর বিয়ে হবার কথা ছিলো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আমি আমার ছোট বোনের হবু বরের বউ হয়ে গেলাম।সেটা আবার যেনো তেনো বউ না। কাগজের বউ।যাদের সম্পর্ক শুধুমাত্র তিন কবুল আর একটা কাগজের মধ্যে সীমাবদ্ধ।বিয়ে , বাসর রাত নিয়ে প্রত্যেক টা মেয়ের জীবনে নানা রকম জল্পনা কল্পনা থাকে।স্বামী নামক অপরিচিত ব্যক্তির জন্য মনের গহীনে কতো শতো স্বপ্নের জাল বোনা থাকে।তাদের মধ্যে ভর করে একরাশ লজ্জা , কামনা , বাসনা, প্রিয় মানুষ কে কাছে পাওয়ার আকুলতা, ব্যাকুলতা ,ভয় আর সুখ মিশ্রিত অনুভূতি ।আমি ও তার ব্যাতিক্রম ছিলাম না আদি। কিন্তু তুই আমার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিলি। কেন আমার সাথে এমনটা করলি?তোকে আমি কোনোদিন ও ক্ষমা করতে পারবো না আদি। কোনোদিন ও না বলেই ফোন রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো আদ্রিকা। তার পুরো নাম আদ্রিকা খন্দকার। সজল খন্দকার আর শায়লা খন্দকারের বড় মেয়ে আদ্রিকা খন্দকার।আদ্রিকা আর আদিতা দুজনেই জমজ বোন।আদিতার থেকে আদ্রিকা দুই মিনিটের বড়। সবাই ভালোবেসে আদ্রিকা কে আদ্রি আর আদিতা কে আদি বলে ডাকে।জমজ হওয়ার দরুন তাদের চেহারার মিল থাকলে ও চারিত্রিক দিক দিয়ে এক জন অন্যজনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।আদি অনেক স্টাইলিশ আর চঞ্চল প্রকৃতির ।বিলাসবহুল জীবনযাপন তার পছন্দ। বড়লোক বাপের বখে যাওয়া ছেলেমেয়েদের সাথে তার উঠাবসা।মাঝ রাত অব্দি পার্টি করা , ড্রিংক করা , সিগারেট খাওয়া তার কাছে ভাত মাছ।অন্য দিকে আদ্রিকা আদিতার সম্পূর্ণ বিপরীত।আদ্রি খুবই সহজ ,সরল, শান্ত প্রকৃতির।বাবা মায়ের বাধ্য সন্তান।নিজেকে সবসময় বোরকা হিজাবে মুড়ে রাখতে পছন্দ করে।আদ্রি, আদি দুজনেই অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। কিন্তু কেউ জানে না তারা দুজন একই মায়ের পেটের আপন বোন।আদি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে।আদির ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই জানে তার বাবা অনেক বড় বিজনেস ম্যান।অথচ আদির বাবা সজল খন্দকার সামন্য বেতনে প্রাইমারি স্কুলে দপ্তরের চাকরি করেন।আদির হোস্টেলে থাকা খাওয়া ,পড়াশোনার খরচ চালানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। শুধু মাত্র আদির কথা ভেবে আদ্রি পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি শুরু করে।মাস শেষে নিজের বেতনের সম্পুর্ন টাকা বোনের হাতে তুলে দেয়।যাতে বোন নিজের পড়াশোনা ভালো ভাবে চালিয়ে যেতে পারে।অথচ সেই বোনের জন্যই আদ্রির জীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ।”
-” আদ্রি ভার্সিটি গিয়ে ক্লাস শেষ করে পরপর তিন টা টিউশনি করে তবেই বাড়ি ফেরে।দিনটি ছিলো সোমবার। সেদিন আদ্রির স্টুডেন্ট নাতাশার জন্মদিন ছিলো।আদ্রি নাশাতা কে পড়াতে গিয়ে দেখে তাদের পুরো বাড়ি এক নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে উঠেছে।আদ্রি ভেতরে গিয়ে জানতে পারে আজ নাতাশার জন্মদিন।রাতে অনেক বড়ো করে পার্টি হবে। অনেক বড় বড় সম্মানীয় ব্যক্তিরা আসবেন নাতাশার জন্মদিনের পার্টিতে।এসব দেখে আদ্রি চলে আসতে গেলে নাতাশা আদ্রি কে বাঁধা দেয় ।যা দেখে নাতাশার মম র’ক্ত চক্ষু নিয়ে নাতাশার দিকে তাকিয়ে থাকে।তিনি আদ্রি কে খুব একটা পছন্দ করেন না। কিন্তু মেয়ের ভালোর কথা বিবেচনা করে আদ্রি কে চোখের সামনে সহ্য করতে হয়। তার হাজবেন্ড ফারুক চৌধুরী নাতাশার পড়াশোনার জন্য আদ্রি কে এই চৌধুরী ভিলায় নিয়ে আসে।আদ্রি খুবই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট।অন্যদিকে নাতাশা খুবই দুষ্টু আর চঞ্চল প্রকৃতির। এজন্যই কোনো টিচার ই তাকে পড়াতে চায় না।সেই দুষ্টু মেয়েটাকে আদ্রি ভালোবাসা দিয়ে খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। নাতাশা পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠে।তার পড়াশোনায় ইমপ্রুভমেন্ট দেখে ইতি চৌধুরী চাইলেও আদ্রি কে চৌধুরী ভিলা থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে নি। কিন্তু সুযোগ পেলে আদ্রি কে অপমান করতে ছাড়ে না। নাতাশার জন্মদিনেও ছাড়ে নি।তিনি নাতাশা কে সাইডে নিয়ে গিয়ে বলেন,
-” এটা তুমি কি করলে বেবি? তুমি জানো আমাদের বাসায় আজকে কতো মেহমান আসবে। কতো বড়ো বড়ো সেলিব্রিটিদের তোমার জন্মদিনের পার্টিতে ইনভাইট করা হয়েছে।এতো লোকের মাঝে তুমি ঐ থার্ড ক্লাস মেয়েকে থাকতে বললে? সবাই যদি মেয়েটার পরিচয় জানতে চায় ।তখন আমি কি জবাব দিবো?আমি যদি সবাইকে বলি একটা থার্ডক্লাস গরীব মেয়ের কাছে আমার বেবি পড়ে।তাহলে আমার মানসম্মান থাকবে বলো?”
-” ইতি চৌধুরীর কথা শুনে আপনা আপনি চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে আদ্রির।আদ্রি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নাতাশা দৌড়ে গিয়ে আদ্রির হাত ধরে বললো,
-” প্লিজ ম্যাম, মমের কথায় আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি আর একটু থাকুন ম্যাম। আমার ভালো লাগবে।”
-“আমি শুধু শুধু কেন থাকবো নাতাশা।এখানে তো আমার কোনো কাজ নেই।”
-“পার্লারের মেয়েরা আমাকে সাজাতে এসেছে। আপনি বরং তাদের সাথে থেকে আমাকে সাজিয়ে দিন ম্যাম।তাহলে মম ও কিছু বলতে পারবে না।আর আপনি ও আমাদের বাড়িতে কিছু টা সময় থাকতে পারবেন।”
-” ঠিক আছে চলো বলে আদ্রি নাতাশা কে রেডি করতে নিয়ে যায়। পার্লারের মেয়েরা নাতাশা কে সাজিয়ে দিচ্ছে।আর আদ্রি তাদের কে এটা ওটা এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করছে। অবশেষে প্রায় তিন ঘণ্টা পরে নাতাশার সাজ কমপ্লিট হয়। ততোক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।আদ্রি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে চৌধুরী ভিলা থেকে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু ধরনীর বুকে আঁধার নেমে এসেছে দেখে অনেক টা ঘাবড়ে যায় আদ্রি।আদ্রি বেখেয়ালে দুরুদুরু বুকে চৌধুরী ভিলা থেকে সামনে কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই শক্ত পুরুষালী দেহের সাথে ধাক্কা লেগে নিচে পড়ে যাওয়ার আগেই লোকটা এক হাতে আদ্রির কোমড় জড়িয়ে ধরে। জীবনের প্রথম পুরুষালী হাতের স্পর্শে আদ্রি চমকে উঠে।তার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গে শিহরণ বয়ে যায়।আদ্রি লোকটার চোখের দিকে এক নজর তাকিয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়।আদ্রির যাওয়ার পানে তাকিয়ে লোকটা তার বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বললো,
-” সন্ধ্যে বেলায় এক সন্ধ্যে কন্যা উৎস তালুকদারের হৃদয় হরণ করে নিয়ে গেলো।অথচ উৎস তালুকদার টের ও পেলো না।হাউ স্ট্রেঞ্জ??”
চলবে ইনশাআল্লাহ।