#মনের ক্যানভাসে
#লাবিবা_আল_তাসফি
১০.
________________
সন্ধ্যা সাতটা। ছাদের দরজা ঠেলে পা বাড়াতেই অন্ধকার ছাদের কিনারা ঘেষে একটা ছায়ামূর্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলাম। তবে অবাক হলাম না। এটা প্রত্যাশিত ছিলো। ধীর পায়ে ছায়াটার পাশে যেয়ে দাড়াতেই পুরুষালি কন্ঠে মর্তিটি বলে উঠলো,
‘ভয় লাগেনি?’
‘ভয়ের কি আছে?’
‘এই অন্ধকারে মানুষের জায়গায় অন্যকেউ ও তো হতে পারতো?’
‘ভূত প্রেত তো আর ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকে দুঃখ বিলাশ করবেনা স্বাভাবিক। অবশ্যই এটা কোনো মানুষের কাজ।’
‘হুম। ব্রিলিয়ান্ট। কিন্তু মানুষের মাঝেও খারাপ আছে। এটা কোনো চোর ডাকাত ও হতে পারতো।’
‘নো ওয়ে। আপনার মতো ডাকাতের বাড়িতে ভুলেও কোনো চোর ডাকাত পা রাখবে না। আর আসলেও তারা নিচে ভালোমন্দ খাবার খাবে, ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকবে না।’
আমার কথায় রাশেদ ভাই নিঃশব্দে হাসলো। সে হাসিতে শব্দ না হলেও আমি ঠিক বুজলাম।
‘চা খাবি মিনি?’
‘আপনি বানাবেন? তাহলে খাব।’
‘এখানেই দাড়া। আমি কয়েক মিনিটে আসছি।’
আমি শুনলাম। দাঁড়িয়ে থাকলাম। বেখেয়ালি চিত্তে আকাশ পানে চাইলাম। আকাশে কোনো তারার দেখা নেই। কেবল ধূসর কালো মেঘ ঘুরছে ফিরছে। এমন পরিবেশে একটা গান খুব মনে পড়ছে।
মেঘের পালক চাদের নোলক
কাগজের খেয়া ভাসছে।
বুক ধুকফুক চাঁদপানা মুখ,
চিলেকোঠা থেকে হাসছে।
মেঘের বাড়িতে ভেজা ভেজা পায়ে
তা থৈ তা থৈ বর্ষা
কাক ভেজা মন জল থৈ থৈ
রাত্রি হলো ফরসা।
……….
……
সুন্দর মুহূর্তটাকে হয়তো বিধাতার পছন্দ হলো না। মোবাইলের ভুত ভুত কম্পন আমার গানের সুরকে। আটকে দিলো মাঝ পথে। ফোনের স্ক্রিনর নাম্বারটা বিদেশি। ফোনের ওপারের মানুষটা আমার অজানা কেউ নয়। আদনান। অসময়ের বৃষ্টির মতোই মানুষটাকে বিরক্ত লাগে আমার। ফোন কেটে সুইচ অফ করে রাখলাম। বিষাদে ভরা মনকে এই মানুষটার সাথে কথা বলে আর তিক্ত করতে চাইনা।
কিছু সময় পর রাশেদ ভাই এলো। হাতে ধোঁয়া ওঠা দু মগ গরম চা। চা-টা ভালো। চুমুক দিতেই তাজা চা পাতার ঘ্রাণ নাকে লাগলো।
‘ঘ্রানটা ভালো না?’
‘হুম। অসাধারণ।’
‘সিলেট থেকে আনা টাটকা চা পাতা।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘আপনি সিলেট গেছিলেন? এমা কবে? আমি কেন জানিনা?’
‘ধুর পাগল। আমি গেলে সবার আগে তুই জানতে পারতি। আমার এক বন্ধু গেছিলো। আসার পথে আমার জন্য নিয়ে এসেছে।’
‘আমায় কিছু দিবেন?’
‘ভালো লেগেছে?’
‘হুমমম।’
‘আচ্ছা। নিস তবে।’
তারপর দীর্ঘক্ষণ নিরবতা। চায়ের কাপের চা ফুরাতেই আমি ঘুরে দাড়ালাম। রাশেদ ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় চাইতেই সে করুন স্বরে আবদার করলো তার পাশে বসে সারারাত গল্প করার জন্য। এই আবদারটা দুদিন পূর্বে করলে হয়তো আমি ভালোলাগার সমুদ্রে গা ভাসিয়ে বিনা সংকোচে রাজি হয়ে যেতাম। কিন্তু আজ সম্ভব নয়। ঐ অসোহায় চোখে তাকিয়ে না করতে খুব কষ্ট হলো। তবুও আমি আবেগে হারালাম না। আবেগ খুব ভয়ংকর। প্রশ্রয় দিলেই তা ভাবনার থেকে দু কদম সামনে এগিয়ে যাবে। নিচে নেমে মিতু আপুকে বললাম,
‘রাশেদ ভাই ছাদে অপেক্ষা করছে।’
আর কোনো কথা না বলে বের হয়ে এলাম। আমি আজ কাঁদবো না। কান্নাদের বিদায় জানিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলাম।
___________
আজ তিনদিন ধরে আদনানের ফোনকল এড়িয়ে চলছি। বিনিময়ে মায়ের চোখ রাঙানোর সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ভাবছি আর একবার কল করলে খুব কড়া করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিব।
ঘর অন্ধকার। আলোর সামান্যতম উপস্থিতি নেই। অন্ধকারে হাতড়ে পানির বোতল তুলে ঢক ঢক করে পানি গলায় ঢেলে নিলাম। স্বপ্ন দেখেছি। খুব বাজে। দেখেছি কেউ একজন আমার রুমের জানালা ধরে উল্ট হয়ে ঝুলে আছে। খুব বিভৎস তার মুখ, চোখের দৃষ্টি। এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যেয়ে লাইট জ্বালালাম। বুক ধকধক করছে। ভিষণ রকম ভয় পেয়েছি। এমনটা খুব কম হয় আমার সাথে। মাকে কি একবার ডাকবো? নিজেকে প্রশ্ন করলাম। কিন্তু এত রাতে মাকে জাগাতে ইচ্ছা হলো না। ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলাম। অনেকগুলো নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে। এর মাঝে একটা আইডি থেকে আসা রিকুয়েস্ট দেখে অবাক হলাম। সাথে কিছুটা কৌতুহল ও। আইডির মধ্যে ঢুকতেই আদনানের হাসি মাখা ছবি চোখে পড়লো। ২k রিয়্যাক্ট! বাহ! লোকটার জনপ্রিয়তা দেখছি বেশ। আরো কিছুক্ষণ আইডি ঘুরে বের হয়ে এলাম। কিছুদিন ঝুলে থাকুক তারপর নাহয় একটা ব্যাবস্থা করা যাবে। ফোন পাশে রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আলো নিভালাম না। রাতে যদি আবার ভয় পাই এই ভেবে।
বাড়ি থেকে বিশ মিনিটের পথ পাড় হলেই পাবলিক গ্রন্থাগর। লাইব্রেরি থেকে আনা সবকটা বই কয়েকবার করে পড়া হয়ে গেছে। অলসতার কারণে বই বদলে আনা হয়নি।
Winter of discontent বইটা উল্টে পাল্টে দেখছি। হুমায়ূনের কোনো এক গল্পে বইটার নাম পড়েছিলাম। তাই কৌতুহল নিয়ে বইটা খুললাম।
‘ইংলিশ নোভেলও পরেন বুঝি?’
পাশে তাকাতেই অপরিচিত এক লোককে দেখলাম। প্রশ্নটা তিনিই করেছেন আমাকে। আমি হেসে উত্তর দিলাম,
‘না। ইংলিশ নোভেল পছন্দ না আমার। বাংলা উপন্যাসের ভেতর যে আনন্দটা পাই তা ইংলিশে খুঁজে পাইনা। কেবল কৌতুহল বশত বইটা দেখলাম।’
লোকটা সুন্দর করে হাসলো। লোকটার বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি হবে। পরনে কোর্ট প্যান্ট।
‘বইটা আপনার প্রয়োজন না হলেকি আমি পেতে পারি?’
ভাবনায় বাঁধা পড়লো ভদ্র লোকের কথায়। আমি মুচকি হেসে বইটা তাকে দিয়ে দিলাম। লাইব্রেরি থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর বারোটা বেজে গেল। বাসায় ফিরে গোসল সেরে বই হাতে বসে গেলাম। নতুন বই হাতে আসলে সেগুলো শেষ না অবদি মনে শান্তি পাওয়া যায় না। ইমদাদুল হক মিলনের ‘সেই বিদেশিনী ‘ উপন্যাসের বইটা নিয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। এটা শেষ না করা অবদি আজ খাওয়া বন্ধ।
_________
বর্ষাদ বিদায় ঘটেছে। আগমন হয়েছে শরৎ এর। ফুটেছে কাশফুল, বকুল, শিউলি, শেফালি, হিমঝুড়ি, কলিয়েন্ড্রার মতো কতশত নাম না জানা ফুল।
সকাল সকাল আসমানি রঙের শাড়ি পরে মিতু আপুর আগমন ঘটলো। ঘুমে কাতর আমি তখন স্বপ্নের দেশে ভেলা ভাসাচ্ছি। মিতু আপুর ধাক্কা আর চিৎকারে ঘুম ঘুম চোখে সটান করে উঠে বসলাম। কাবার্ড থেকে নীলচে শাড়ি ব্লাউজ বের করে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে মিতু আপু। এক প্রকার জোর করেই আমাকে শাড়ি পড়তে বাধ্য করলো। আজ সারাদিন ঘোরাঘুরি হবে। বিকেলের দিকে কাশবনে অল্প কিছু ফটোশুট দেন বাড়ির পথে রওনা। এটাই আজকের প্লান।
আপু রাশেদ ভাইকে অনেকবার বলেও রাজি করাতে পারেনি ঘুরতে যাওয়ার জন্য। মন খারাপ করে ঘরে বসে ছিল। রাকিব নাকি মিতু আপুকে বুদ্ধি দিয়েছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেই মুহূর্তে সে রেডি হয়ে আমার বাড়িতে হানা দিয়েছে। আমি আর দিরুক্তি করলাম না। আপু বেশ মিষ্টি একটা মেয়ে। সবসময় হাসি তার মুখে লেগেই থাকে। দেখতেও বেশ মিষ্টি। লম্বায় অনেকটা আমার মতোই কিংবা একটু বেশি হবে। আমি জানি আপু ভালো নেই। আপুর এই হাসিটাও মিথ্যা। রাশেদ ভাই আপুকে মেনে নিতে পারেনি। এখানে আমার কিছু করার আছে কিনা জানিনা। শুধু দোয়া করি একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। এখনো জ্যামে আটকে আছি। ক্ষুদায় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। আমি অসহায় চোখে আপুর দিকে তাকালাম। তার অবস্থাও আমার মতোই। আমি আপুর ওপর কিছুটা চটে গেলাম।
‘কে বলেছিল তোমাকে এদিকে আসতে? সবসময় বেশি বেশি বুঝ। ‘
‘মিতা। বোন আমার। রাগ করে না। আর একটু
জান। এইতো এখনি জ্যাম ছেড়ে দিবে।’
বাচ্চাদের মতো করেই শান্তনা দিলো আপু আমাকে। কিন্তু আমি বাচ্চা না। আমি জানি আরো ঘন্টা খানেক লাগবে জ্যাম ছাড়তে।
চলবে……….