#মনের ক্যানভাসে
#লাবিবা_আল_তাসফি
৭.
______________
প্রেসার কুকারে সিটি পড়েছে। গরুর মাংসের ঘ্রাণ ছড়িয়েছে পুরো বাড়িতে। ঘ্রাণেই যেন অর্ধেক পেট ভরে আসছে।রাকিব গলা উঁচিয়ে মা কে ডাকলো। মাংসে পর্যাপ্ত ঝোল থাকা চাই বলে আবদার করলো। টিউশন থেকে ফেরার পথে বাজার থেকে শসা কিনে এনেছে। গরুর মাংসের সাথে শসা লেবু আর গরম গরম ভাত। আর কি চাই? রাশেদ আজ বাসায়। কিন্ত এখন পর্যন্ত রুম থেকে বের হয়নি। বুঝতে শেখার পর থেকে বড় ভাইয়ের সাথে খুব একটা মেলামেশা করা হয়ে ওঠেনি। কখনো একসাথে মাঠে খেলা হয়ে ওঠেনি। খেলনা নিয়ে দু ভাইয়ে ঝগড়া হয়নি। কেমন একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেই শৈশব থেকেই। শেষ কবে একত্রে বসে ভাত খাওয়া হয়েছে সেটাও মনে নেই রাকিবের। আজ মনে হলো ভাইয়াকে ডাকা উচিত। দু চারটা কথা হওয়া উচিত। তারপর একসাথে বসে একত্রে ভাত খাবে। বিকেল হলে ভাইয়ার বাইকে চেপে নাহয় কোথাও বেরাতে যাওয়া যাবে। ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্কটা দৃঢ় হওয়া উচিত।
বৃষ্টি মাথায় করে বাসায় ফিরেছে আব্বু। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে অবস্থা। আম্মু চুলায় খিচুড়ি বসিয়েছে। বৃষ্টির সময় খিচুড়ি আর কষা মাংসের তুলনা নেই। খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে পরিবার সমেত আড্ডার ব্যবস্থা হলো। এ কদিনের সফরে যা যা ঘটছে তার বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে চলছে আব্বু। মাহিন খুব আগ্রহ নিয়ে আব্বুর বলা প্রত্যেকটা কথা গিলে নিচ্ছে। আড্ডার এক পর্যায়ে কথা উঠলো আমার বিয়ের। চলতে লাগলো বিস্তার আলোচনা। কথজন আত্মীয়-স্বজন আসবেই এগুলো কার্ড ছাপাতে হবে ব্লা ব্লা। এ আলোচনায় আমাকে দরকার বলে মনে হলো না। তাই চুপিসারে উঠে এলাম গল্পের আসর থেকে। এমন নয় যে আমি রাশেদ ভাইকে ভুলে গেছি। আমি কেবল মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের মুখের দিকে তাকালে ভরসা পাই। মন বলে আমি পারবো। এই মানুষগুলোর জন্য হলেও আমি পিছুটান কাটিয়ে এগিয়ে যেতে পারবো বহুদূর। সাহস পাই মনে। কিন্তু দিনের আলো ফুরিয়ে যখন রাত নামে তখন রাতের অন্ধকারের সাথে আমার মনে না পাওয়ার বেদনারা জেগে ওঠে। গ্রাস করে নেয় আমাকে। রাতের নিস্তব্ধতা যেন যেন বারবার করে আমায় আমার ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চায়। সর্বহারা আমি তখন কেবল অপেক্ষা করতে থাকি দিন হবার। একটু স্বস্থির জন্য দিনের আলোর বড্ড দরকার।
আব্বু আম্মুর তুমুল ঝগড়া লেগেছে। ঝগড়ার টপিক আমি নিজে। ব্যাপারটা এমন তারা দুজন দাবি করছেন আমার প্রতি তাদের মধ্যে একজনের অধিকার বেশি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ঝগড়ার এক পর্যায়ে টপিক পাল্টে ইমোশনাল সিন শুরু হয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন,,,
আম্মু–’ তোমার সংসারে এসে সখ আল্হাদ সব ত্যাগ করেছি। কখনো কোনো কিছু চেয়েছি তোমার কাছে? শাড়ি চেয়েছি নাকি গহনা? মেয়েটার বিয়ে সামনে নিজ থেকেতো একটা শাড়ি কিনে এনে দিতে পারতে। তা কি করেছো? আবার এসেছো কর্তব্য দেখাতে।’
আব্বু–’ এত কথা না বলে সোজাসাপ্টা এটা বললেই পারো যে তোমার শাড়ি চাই। বললেই কিনে দিতাম। আমার কি টাকা কম আছে নাকি।’
আম্মু কিছুটা রেগেই গেল। অপ্রিয় সত্য কথা এভাবে বলায় তীব্র ভাবে তা আত্মসম্মানকে আঘাত করলো। ক্ষিপ্ত চোখে আব্বুর দিকে তাকিয়ে কোনো কথা ছাড়া রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আজ সারাদিনে আর দরজা খুলবে বলে মনে হয়না। আমি হাসলাম। আম্মু বড্ড ছেলেমানুষী। খুব সহজ সরল সাধারণ নারী। সাধারণের মাঝে অসাধারণ একজন স্ত্রী, মা। আমাকে দেখতে পেয়ে আব্বু দুঃখী হওয়ার ভান করে বলল,
‘আজ রুমে আমার জায়গা হবে না। গেস্টরুমে থাকার মতো একটু ব্যবস্থা করে দে মা।’
আব্বুর এমন অসহায় মুখ দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো মাহিন। আমিও হাসলাম শব্দহীন। রেণু খালা এলে দুজন মিলে গেস্টরুম পরিষ্কার করে নিব। রেণু খালার দেখা মেলা ভার। সপ্তাহের সাত দিনের পাঁচদিনই তিনি অসুস্থ থাকেন। কাজে ফাঁকি কাকে বলে কত প্রকার কি কি সব তার জানা।
____________
সকাল দশটা বেজে পনেরো মিনিট। আকাশে সোনালি সূর্য উঠেছে। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবুও সেফটির জন্য একটা ছাতা সাথে নিয়েছি। লং একটা থ্রিপিস পড়ে সুন্দর করে তৈরি হয়ে নিলাম। হঠাৎ করেই খুব সাজতে ইচ্ছে হলো। বিরহে বিরহে নিজের যত্ন নিতেই ভুলে গেছি। আয়নায় তাকাতেই নিজের বিদ্ধস্ত চেহারা নজরে এলো। নিজেকে দেখে নিজেরই বড্ড মায়া হলো। দেরি না করে ঝটপট দক্ষ হাতে সুন্দর করে হালকা মেকওভার করলাম। মেকআপ এর আড়ালে লুকিয়ে গেল আমার বিরহের ঝড়ে ধ্বসে পড়া বিধ্বস্ত চেহারাটা। বাসা থেকে বের হতেই রিকশা পেয়ে গেলাম। বাড়ির পাশের চায়ের দোকানটাতে রাশেদ ভাইকে দেখলাম। এদিকেই তাকিয়ে আছে। আমি দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলাম। আগুনের আশপাশে গেলে গরম স্যাক তো লাগবেই। তাই আগুনের থেকে দূরে থাকা ভালো। আমিও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি রাশেদ ভাইকে এড়িয়ে চলার। রিকশা এসে মলের সামনে দাঁড়াতেই ভাড়া মিটিয়ে মলের ভেতর ঢুকে পড়লাম। একা একা শপিং করার মাঝে অন্যরকম তৃপ্তি আছে। এখানে নিজের পছন্দটাই বেশি প্রাধান্য পায়। থ্রিপিসের দোকানে ঢুকতেই বেশ কিছু নিউ কালেকশন নজরে এলো। সবগুলো উল্টেপাল্টে দেখলেও সিলেকশনের সময় দোটানায় পড়লাম। তখনি পাশ থেকে একজোড়া বলিষ্ঠ হাত বাসন্তী রঙের থ্রি পিসটি আমার দিকে এগিয়ে দিল। থ্রিপিসটি সত্যিই সুন্দর। হাতের মালিককে দেখতে ঘাড় ঘুড়াতেই পরিচিত মুখ নজরে এলো।
‘রাশেদ ভাই!’
‘অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এখান থেকেই যাচ্ছিলাম। দেখলাম এত এত জামাকাপড় দেখে হুশ হারিয়ে তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে আছিস। তাই নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে এলাম।’
সে যে মিথ্যা বলছে তা একশোভাগ সত্যি। আমি আসার পথেই তাকে দেখেছি চায়ের দোকানে। এখানে নিশ্চই আমাকে ফলো করতে করতে এসেছে। আসুক তাতে আমার কি? আমি মিতালি কখনো অন্যের জিনিসে আগ্রহ দেখাইনা হুহ।
‘আপনার নাগরিক দায়িত্ব অন্যকোথাও যেয়ে পালন করেন। আমার কোনো সাহায্যের দরকার নেই।’
বলেই নীল রঙের একটা থ্রি পিস প্যাক করতে দিলাম। যদিও এর থেকে বাসন্তী রঙের থ্রি পিসটা বেশি সুন্দর ছিল। কিন্তু রাশেদ ভাইকে উপেক্ষা করার এর থেকে ভালো কোনো উপায় আমি খুঁজে পেলাম না। দোকান থেকে বের হয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই বুঝলাম রাশেদ ভাই আশপাশে নেই। তার অনুপস্থিতি আমার মনকে আহত করলো। তাকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও আমার মন কখনো তাকে এড়াতে পারে না। এখনো সেটাই হয়েছে। আর শপিং করতে ইচ্ছা হলো না। মল থেকে বের হতেই নজরে এলো ফুচকার দোকান। আকাশে তখন কড়া রোদ। রোদে দাড়িয়েই একসাথে দু প্লেট ফুচকা শেষ করলাম। এটা মনকে ভালো রাখার অন্যতম মাধ্যম। ফুচকা খাওয়া শেষে রিকশায় চেপে বসলাম। আজ এ শহরের প্রত্যেক অলিগলিতে বিচরণ করবো। মনের সকল আক্ষেপকে ছুড়ে ফেলবো শহরের কোনায় কোনায়।
যখন বাড়িতে ফিরলাম তখন সন্ধ্যা প্রায়। ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই চিন্তিত পরিবার পরিজন নজরে এলো। আমাকে দেখা মাত্রই মা ভিষণ রেগে গেলো। সারাদিন বাড়ির বাহিরে থাকার অপরাধে দু চারটা কটুক্তি শুনতে হলো প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। মা অবশ্য তাতে কান দিলেন না। নিন্দুকদের মুখের উপর ধুম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আমি তখনো আসামির ন্যায় চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। আব্বু গুরুগম্ভীর গলায় শুধালেন,
‘কোথায় ছিলে সারাদিন?’
‘রিকশা করে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। অনেকদিন বের হওয়া হয়না। ঘরে দমবন্ধ লাগছিল।’
আব্বু আর কিছু বললেন না। কেবল গম্ভীরতা বজায় রেখে বললেন,
‘রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো। তোমার আম্মু নাস্তা বানিয়ে রেখেছ তোমার জন্য।’
ফ্রেশ হয়ে বের হতেই আম্মু গরম গরম পাস্তা সার্ভ করলো। এটা আমার খুব পছন্দের। আমার প্লেটে বেশি পাস্তা দেখতেই মাহিনের চিৎকার শুরু। ওর বেশিটা চাই। কিন্তু আমি কোনোভাবেই আমার পছন্দের খাবার শেয়ার করতে রাজি নই। প্লেট হাতে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। নিজের পছন্দে আর কোনো কিছুই আমি হাতছাড়া করবো না। একদমই না।
চলবে…….