মনের অরণ্যে এলে তুমি পর্ব-১০

0
1174

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১০

” এটা ভদ্রলোকের বাড়ি। কোনো জলসাঘর নয় যে হাহা হিহি করে অন্যদের শান্তি বিনষ্ট করবে। ”

পুরুষালি ভারিক্কি স্বরে হকচকিয়ে গেল হৃদি, ইনায়া। ডানে ঘুরে তাকালো দু’জনে। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো এজাজ সাহেবের অবয়ব। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো ইনায়া। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো। অবনত মস্তকে মৃদু স্বরে বললো,

” আ আব্বু আমরা..! আ’ম স্যরি। ”

ক্ষমা গ্রহণ করলেন না উনি। বরং রাশভারী কণ্ঠে আদেশ প্রদান করলেন,

” রুমে যাও। পড়তে বসো। ভুলে যেয়ো না সামনে এইচএসসি। এ প্লাস যেন কোনোভাবেই মিস্ না হয়। ”

ইনায়া মলিন বদনে হাঁ সূচক মাথা নাড়ল। অতঃপর সেথা হতে প্রস্থান করতে উদ্যত হলো। সে মুহূর্তে মালিহাও উপস্থিত হলেন সেথায়। সাক্ষী হলেন অভাবনীয় এক কাণ্ডের।

” পাপা! ”

ফিরে যাচ্ছিলেন এজাজ সাহেব। আচমকা এমনতর সম্বোধন শুনে পিছু ঘুরে দাঁড়ালেন। তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলেন পুত্রবধূর পানে।

” কি বললে তুমি? ”

” পাপা। পাপা ডেকেছি পাপা। ”

ভারী নিষ্পাপ মুখে বললো হৃদি। ধমকে উঠলেন এজাজ সাহেব।

” অ্যাই মেয়ে। কিসের প্যা প্যা করছো? একদম উল্টো পাল্টা বলবে না। ”

হৃদি মাসুম চেহারা বানিয়ে শ্বশুরের পানে এগিয়ে গেল। ওনার শার্টের স্লিভে আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে করতে আদুরে কন্যার ন্যায় বললো,

” তুমিই তো আমাকে বাবা ডাকতে মানা করলে। তাহলে আমি কি বলে ডাকবো বলো তো? নাম ধরে তো আর ডাকতে পারি না। তাই পাপা। পছন্দ হয়নি ডাকটা? ”

মুখ তুলে উচ্ছ্বসিত বদনে শুধালো মেয়েটি। এজাজ সাহেব বাকরুদ্ধ। পুত্রবধূর নতুন অবতার ওনায় প্রায় মূক বানিয়ে দিয়েছে। বোধহীন হয়ে দাঁড়িয়ে উনি। সাড়া না পেয়ে হৃদি ওনার বাহু ধরে নাড়তে লাগলো,

” পাপা ও পাপা! তুমি শুনছো কি বললাম? ”

সম্বিৎ ফিরে পেতেই ছিটকে দূরে সড়ে গেলেন এজাজ সাহেব। উপস্থিত সহধর্মিণী এবং কন্যার মুখে একপলক তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে সেথা হতে প্রস্থান করলেন। পেছনে রয়ে গেল হতভম্ব মালিহা এবং ইনায়া! দুষ্টু হাসির রেখা ফুটে হৃদির অধরকোলে।

” পাপা! ”

রবি’র উষ্ণ কিরণে আলো ঝলমলে বসুন্ধরা। দোতলার করিডোর ধরে হেঁটে চলেছে হৃদি। হাতে আলুজ চিপসের প্যাকেট। কানে গুঁজে ইয়ারফোন। শুনছে রোমান্টিক হিন্দি গান। গানের ছন্দে ছন্দে নড়ছে ওষ্ঠাধর। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটি পৌঁছে গেল নিজস্ব কক্ষে। ভিড়িয়ে রাখা দ্বার দেখে কিছুটা বিরক্ত বোধ করলো। ডান হাতে মুখে আলুজ পুড়ে ধাক্কা দিলো দ্বারে। তৎক্ষণাৎ সেটি উন্মুক্ত হলো। আয়েশি ভঙ্গিতে চিপস চিবোতে চিবোতে ভেতরে প্রবেশ করলো হৃদি। তাকালো বাঁয়ে। সেটিই ঘটালো অঘটন!

স্তব্ধ চাহনিতে বাঁ পাশে তাকিয়ে হৃদি! দৃষ্টি নিবদ্ধ সমতল আরশি বরাবর। আরশির সম্মুখে দাঁড়িয়ে দীর্ঘকায় বলিষ্ঠদেহী এক মানব। পড়নে তার সফেদ পাজামা। উন্মুক্ত দেহের ঊর্ধ্ব ভাগ। সদ্য স্নাত মানবের হাতে তোয়ালে। সেটি চালনা করে চলেছে সিক্ত কেশের আনাচে কানাচে। শুষে নিচ্ছে প্রতি বিন্দু জলকণা। কিছু অবাধ্য জলকণা লেপ্টে প্রশস্ত বক্ষপটে, গলদেশ, পৃষ্ঠ এবং স্কন্ধে। কেউবা বক্ষ ভাঁজ গড়িয়ে পড়ছে উদরে। গৌর বর্ণের সুঠামদেহী মানবের এমনতর রূপ যেকোনো ললনার হুঁশ উড়োতে সক্ষম। যেমন করে বাকরুদ্ধ তার অর্ধাঙ্গিনী। মেয়েটির হাতে থাকা চিপসের প্যাকেট একপ্রকার মুঠোবন্দী হয়ে গেল। কর্ণ কুহরে তখন শ্রবণ হচ্ছে,

‘ তুমছে মুঝে ইয়ে কেহনা থা
ও কেহনা থা হামদাম
হো সামনে তো কেয়া কাহু
কেয়া কেহনা থা হামদাম ‘

সত্যিই বাকশূন্য মেয়েটি। একান্ত জনের এমনতর খোলামেলা রূপ তার তনুমনে তোলপাড় সৃষ্টি করলো। চেঁচানো কিংবা প্রতিবাদী স্বরে কিছু বলবার কথা ভুলেই গেল। আস্তে ধীরে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো মেয়েটি। চিপসের প্যাকেট হাতে সেথা হতে প্রস্থান করাই শ্রেয় মনে করলো। তবে তেমনটি হলো না। পেছন হতে শোনা গেল গম্ভীর স্বর,

” হেই ওয়েট! ”

মেয়েটি শুনলে তো। কর্ণ কুহরে তার তখন পৌঁছাচ্ছে,

‘ হোটো পে কিয়ু আনে সে ইয়ে সারমাতে হ্যায়
আখো মে কিয়ু ইয়ে হার ঘাডি আ যাতে হ্যায় ‘

ধীরপায়ে সেথা হতে বেরিয়ে গেল মেয়েটি। দ্রুত দেহে পাঞ্জাবি গলিয়ে ইরহাম অবলোকন করলো সে প্রস্থান। বোধগম্য হলো না এমনতর আচরণের মূল হেতু কি।

হৃদির চোখেমুখে ফুটে উঠেছে অবর্ণনীয় খুশির ছাপ। উচ্ছ্বসিত মেয়েটি আত্মহারা হয়ে শাশুড়ি মায়ের ডান কপোলে চুমু এঁকে দিলো। লজ্জা মিশ্রিত মেকি বিরক্তি প্রকাশ করলেন উনি। তবে মনে মনে খুশি হলেন। হাসলেন পুত্রবধূর হাসিমুখ দেখে। সারাটা দিন আনন্দে আত্মহারা হয়েই অতিবাহিত হলো। সময়ের পরিক্রমায় হাজির হলো রাত্রি। লিভিং রুমে তখন ছোটাছুটি করে চলেছে মেয়েটি। আকস্মিক কলিংবেল বেজে উঠলো। থমকে গেল হৃদি। পিছু ঘুরে তাকালো মূল ফটকের পানে। এই রে! এর কথা তো বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। এবার কি হবে? অনবরত শুকনো ঢোক গিলতে লাগলো সে। ততক্ষণে একজন পরিচারিকা দ্বার উন্মুক্ত করে ফেলেছে। সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো ইরহাম। হৃদি দ্রুত পায়ে সেথা হতে ভেগে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। তবে তা বাস্তবায়িত হলো না সঙ্গীর অনুপস্থিতিতে। ঘাবড়ে গেল মেয়েটি। ডানে বামে ঘুরে সঙ্গীকে খুঁজতে লাগলো। কোথাও নেই। এরমধ্যে গেল কোথায়? অজানা ভয়ে গলদেশ শুকিয়ে গেল। টলমল করে উঠলো আঁখি যুগল। হঠাৎ পেছন হতে সঙ্গীর কণ্ঠস্বর শুনে ঘুরে দাঁড়ালো। চক্ষু হলো চড়কগাছ। হোয়াট দ্যা হেক!

” ম্যাঁও! ”

লিভিং রুম অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছিল ইরহাম। সহসা পায়ের কাছে বিড়ালের কণ্ঠ শুনে চমকালো! মাথা নিচু করে তাকালো পায়ের পাতার পার্শ্বে। ছোট্ট এক বিড়াল ওর মুখপানে চেয়ে। অবাক হলো মানুষটি! আর ভয়ে হাবুডুবু খেতে লাগলো হৃদি। শেষ। সব শেষ। ওর আদুরে পকিমন বুঝি শেষমেষ খারুস চৌধুরীর হাতে শহীদ হতে চলেছে। নাহ্! এ হতে পারে না। দ্রুত পায়ে ছুটে গেল সে। ততক্ষণে পকিমন ইরহামের কোলে। ওকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ালো ইরহাম। ঠিক ওর সামনে এসে ব্রেক কষলো মেয়েটা। বোকা হেসে বললো,

” হাই! স্ স্যরি। আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ”

” ভালো আছেন? ”

দাঁত বের করে শুধালো মেয়েটা। মাথা নাড়িয়ে ইতিবাচক সম্মতি জানালো ইরহাম। বিড়ালের তুলতুলে নরম দেহে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করলো,

” ও কোথা থেকে এলো? ”

ভীত রমণীর মুখশ্রী কালো মেঘে ছেয়ে গেল। আদরের সঙ্গীর পানে তাকিয়ে ভেজা কণ্ঠে বললো,

” ও আমার পোষা বেড়াল। আমি চেয়েছিলাম বলে আম্মু সকালে পাঠিয়েছে। আপনি দয়া করে.. ”

অসম্পূর্ণ রইলো বাক্য। বেড়াল কোলে নিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করেছে মানুষটি। লিভিং রুম অতিক্রম করে সিঁড়ি বেয়ে নিজ কক্ষে পৌঁছে গেল। পিছুপিছু দ্রুত কদমে ছুটলো হৃদি। পাছে ওর প্রিয় বিড়ালকে ঝাঁ’ড়ি
মে রে শহীদ না করে দেয়! হৃদি কক্ষে পৌঁছে হতবাক! পকিকে মেঝের একাংশে আরাম করিয়ে বসিয়েছে ইরহাম। আদুরে প্রাণী ওর দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন ভাব প্রকাশ করলো,

” ম্যাঁও! ”

ইরহাম সোজা হয়ে দাঁড়ালো। হাতে থাকা রিস্ট ওয়াচ খুলতে খুলতে হৃদি’কে জিজ্ঞেস করলো,

” ক্যাট ফুড আছে? নিয়ে এসো। ওর বোধহয় ক্ষুধা লেগেছে।”

হতবাক রমণী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ধীরপায়ে হেঁটে কক্ষ হতে বেরিয়ে গেল। যখন ফিরে এলো তখন ইরহাম ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। বিড়ালের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে তুলতুলে শরীরে হাত বুলিয়ে চলেছে। হৃদি গিয়ে স্বামীর পাশে হাঁটু মুড়ে বসলো। বাটিতে থাকা ক্যাট ফুড এগিয়ে দিলো পকির দিকে। খাবার পেয়ে পকিমন উৎফুল্ল হয়ে ডেকে উঠলো। খেতে লাগলো নিজস্ব খাবার। ইরহাম বলে উঠলো,

” খিদে পেয়েছিল বেশ‌। ”

মাথা নাড়িয়ে স্বামীর পানে তাকালো হৃদি। বিস্ময় ভাব লুকাতে না পেরে বলে উঠলো,

” আপনি বেড়াল পছন্দ করেন? ওদের প্রতি ঘেন্না লাগে না? ”

ইরহাম ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

” না মানে অনেকেই পছন্দ করে না। তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি। ”

ইরহাম উঠে দাঁড়ালো। কেশে হাত বুলিয়ে বললো,

” আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বিড়াল পছন্দ করতেন। তাঁর উম্মত হিসেবে আমরা কি করে বিড়াল অপছন্দ করতে পারি? ”

অপ্রত্যাশিত জবাবে প্রসন্ন হলো কোমল হৃদয়। কৌতুহলী হৃদি শুধালো,

” সত্যি রাসূল (সা.) বিড়াল পছন্দ করতেন? ”

বিছানায় বসলো ইরহাম। বললো,

” বিভিন্ন হাদীসে তাই তো বর্ণিত আছে। ”

” তাহলে তো ভালোই। পকি এখন থেকে এখানেই থাকবে। নো চিন্তা ডু ফুর্তি। ”

” পকি! কে? ” ভ্রু কুঁচকে তাকালো মানুষটি।

হৃদি উৎফুল্ল হয়ে বললো,

” আরে পকি। আমার সোনাটা। ওর নাম পকিমন। আমি নিজে রেখেছি। সুন্দর না? ”

” এমন অদ্ভুত নাম কি করে? ” জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইরহাম।

হৃদি অধর প্রসারিত করে পকির পাশে বসলো। কোলে তুলে মাথায় চুম্বন এঁকে বলতে লাগলো,

” একটা জনপ্রিয় কার্টুন আছে। ওখানে পকিমন নামের ক্যারেক্টার ছিল। নামটা খুব কিউট। আমার বেশ পছন্দ হলো। তাই তো যখন ওকে.. ”

খুশিমনে কত কি বলে গেল মেয়েটি। ইরহাম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। প্রতক্ষ্য করে গেল চঞ্চল বধূর বকবকানির সামান্য অংশবিশেষ।

আঁধারিয়া রজনী। চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। আঁধার চিড়ে সরু রেলপথ ধরে এগিয়ে চলেছে একটি দীর্ঘকায় ট্রেন। আশেপাশে ঘন বৃক্ষরাজি। ট্রেনে স্বল্প কিছু যাত্রী এবং অসংখ্য মালামাল। একটি বগিতে চারজন বসে। পরিবারের সদস্য তারা। স্বামী স্ত্রী এবং বৃদ্ধ পিতা সঙ্গে কনিষ্ঠ ভ্রাতা। বৃদ্ধ মানুষটি বগির একটি সিটে শয্যাশায়ী। বয়সের ভারে নুয়ে দেহ। ওনার বিপরীত দিকে স্বামী স্ত্রী বসে। কনিষ্ঠ ভ্রাতা পাশের সারির সিটে বসে পত্রিকা পড়ছে। অন্ধকারের মাঝে চলমান তাদের বহনকারী ট্রেন। একটা দু’টো করে কয়েকটি স্টেশন অতিক্রম হলো। চতুর্থ স্টেশনে এসে থামলো ট্রেনটি। বেশকিছু যাত্রী নেমে গেল। আর মাত্র দু’টো স্টেশন বাকি। সারা ট্রেনে মাত্র নয় দশজন যাত্রী অবশিষ্ট। ভিন্ন ভিন্ন বগিতে বসে তারা। কেউ কেউ তন্দ্রাচ্ছন্ন। কেউ মোবাইলে মগ্ন। কেউবা আলাপচারিতায় লিপ্ত। ট্রেন যেই চলতে শুরু করবে অমনি ভেতরে প্রবেশ করলো কয়েকজন। নৈশকালীন সময়ে তাদের আকস্মিক উপস্থিতি বড় ভূতুড়ে লাগলো। কেমন গা ছমছম পরিবেশ। বগিতে থাকা কয়েকজন নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে লাগলো। তন্মধ্যে চলতে আরম্ভ করেছে ট্রেনটি। নতুন উদিত আটজন কোনো নির্দিষ্ট সিটে বসলো না। বরং এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। হাঁটতে লাগলো এদিক ওদিক। তীক্ষ্ণ তাদের চাহনি। যে চাহনিতে ভীতসন্ত্রস্ত হলো পূর্ব হতে উপস্থিত যাত্রীবৃন্দ। অতিবাহিত হলো কিছু মুহূর্ত। হঠাৎ…

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে