#মধুমাস
#পর্ব_২৩
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
রাত গভীর;ফাতেমা বেগম স্তব্ধ হয়ে চেয়ারে বসে আছে।বিয়ের এতো বছর পরে এই প্রথম স্বামীর হাতে মা,র খেলেন তাও অতী আদরের মেয়ে শ্যামার জন্য।শ্যামাকে এতো আদর ভালোবাসা,দেয়ার পরেও সে কিভাবে এই জঘন্য সম্পর্কে জড়ালো?যে সম্পর্কে জড়ালে বাবা মায়ের মনঃক্ষুন্ন হয় এমন সম্পর্কে জড়ানো আগে বুক কাঁপলো না!শ্যামা খুব ভালো করে জানে এই পরিবারের কেউ ফিরোজকে পছন্দ করে না,এতোসব জানার পরে নিজেকে কিভাবে বিষাক্ত সম্পর্ক নামক বেড়াজালে নিজেকে আটকালো?ফাতেমা বেগম চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়।বেদনাদায়ক দৃষ্টি মেলে মেয়ের রুমের দিকে তাকায়।দুঃখে বুকটা মুচড়ে উঠে,চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করে।এতো কষ্ট করে মেয়ে জন্ম দিয়েছেন এমন কথা শোনার জন্য!সেদিন ঠিক হওয়া বিয়েটা কতো ভালো ছিলো কিন্তু শ্যামার কারণেই ভেঙ্গে গেলো।
শ্যামা লাইট অফ করে শুয়ে আছে।নিঝুম রাত নাম না জানা এক পাখি থেমে থেমে করুন সুরে ডাকছে,এমন করুণ ডাক শুনে মনে হচ্ছে পাখিটা তার মনের দুঃখ বুঝেই এমন করে ডাকছে।তার আব্বা আম্মা এতো সহযে এই সম্পর্ক মানবে বলে মনে হচ্ছে না,শ্যামা চেষ্টা করবে,দরকার হলে নিজের জান বা,জি রেখে হলেও চেষ্টা করবে।তারপরেও ফিরোজকে নিজের করে নেবে।হ্যাঁ সে বাবা মায়ের কষ্টটা বুঝে কিন্তু একবার বিয়ে করে নিতে পারলে ঠিক সবাই মেনে নেবে এই বিশ্বাস শ্যামার আছে।যদিও ফিরোজ তাকে আশ্বাস দিয়েছে যে কালকেই তার আব্বাকে এই বাড়ি পাঠাবে।শ্যামার শান্তি লাগে না,অশান্তিতে ছটফট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
ফিরোজ সারারাত ঘুমাতে পারেনি।বারবার মনের পর্দায় শ্যামার কাতর মুখটা ভেসে উঠছে,সেই মুখে ফুটে উঠা কষ্টের পারদ তাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে।সকাল হলেই তার আব্বাকে শ্যামার কথা বলতে হবে।আর এই বলা নিয়েই ফিরোজের যতো ভয়,তার আব্বা অহংকারী;নাক উঁচু মানুষ।তিনি সহযে কোনোভাবেই শ্যামাকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেবে না।এতো সহযে উনার থেকে সম্মতি আশা করাও বোকামি।ফিরোজের ধারণা শ্যামাকে নিজের করে পেতে হলে তাকে প্রচুর বাধা পেরোতে হবে। তা বাধা আসুক সে সব বাধা পেরুতে রাজী শুধু শ্যামা হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলেই হয়।
সকালে ফিরোজ নাস্তার টেবিলে নাস্তা করতে যায়।টেবিলের দিকে চোখ ভুলিয়ে সবাইকে’ই দেখতে পায়।মোহাম্মদ আলী চায়ের কাপ হাতে চুপচাপ বসে আছে।কিছুক্ষণ পরে উনি আস্তে করে বললো,
“মেয়েটাকে এতো মনে পড়ছে।”
রোজিনা বেগম বললো,
“মন খারাপ করোনা।কালকেই চলে আসবে।”
ফারিয়া কালকেই চলে আসবে।এরপর পরিক্ষার আগে আর যাবেনা তারপরও ফারিয়াকে ছাড়া ঘরটা খালি লাগছে।একমাত্র মেয়ে বলে সবার’ই মন খারাপ।এই মন খারাপের মাঝে শ্যামার প্রসঙ্গ তুলে ধরা কতোটা যুক্তিসঙ্গত তা ফিরোজের ঠিক বোধগম্য হয় না কিন্তু সে নিরুপায় শ্যামার আব্বা আর ভাই কেমন এটা তার ভালো করেই জানা একবার যেহেতু ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গিয়েছে এখন শ্যামার উপরে চাপ আরো বাড়বে।যে সময় হোক তার আব্বার সামনে এই কথাগুলো বলতেই হবে তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো এখনি বলবে।ফিরোজ কিছু খাচ্ছে না দেখে মোহাম্মদ আলী বললো,
“কিরে!খাচ্ছিস না কেনো?”
ফিরোজ বললো,
“আব্বা একটা কথা বলি?”
“বল।”
ফিরোজ খুব গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।বলে,
“আব্বা আপনি সম্মতি দিলে আমি বিয়ে করতে চাই।”
মোহাম্মদ আলীর মুখে হাসি ফুটে উঠে।
“সত্যি?”
ফিরোজ কিছু না বলে মাথা নেড়ে সায় জানায়।মোহাম্মদ আলী বললো,
“তাহলে মুনিয়ার আব্বাকে খবর দেই?উনিতো সেদিনও জিজ্ঞেস করলো।”
ফিরোজ দ্রুত বললো,
“না না।আমি মুনিয়াকে বিয়ে করতে চাই না।”
মোহাম্মদ আলী ভ্রু কুঁচকে তাকায়।হাতের কাপ টেবিলের উপরে রেখে বললো,
“মেয়ে দেখবো?”
“না।”
“তাহলে!কাকে?”
ফিরোজ তার আব্বার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“শ্যামা কে।স্বপন কাকার মেয়ে।”
মোহাম্মদ আলী বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়।কয়েকজোড়া বিষ্ফোরিত চক্ষু তার উপরে এসে নিবন্ধ হয়।মোহাম্মদ আলী নিজের কানকে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।উনি গম্ভীর গলায় বললো,
“কি বলছিস?মাথা ঠিক আছে?”
ফিরোজ মাথা দুলিয়ে বললো,
“হ্যাঁ।আমরা একে অপরকে পছন্দ করি।”
রোজিনা বেগম হতবাক।শ্যামা মাঝে মাঝেই তাদের বাড়িতে আসতো।উনি ভাবতেন ফারিয়ার কাছে আসে কিন্তু এই মেয়ে যে এই বাড়ির ছেলের সাথেই সম্পর্ক গড়ে তুলবে তা কে জানতো?সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে এক দিনও এসব উনার চোখে পড়েনি।অবাক হওয়া চোখে উনি ফিরোজকে দেখছে।এই ছেলে এতোদিন বিয়ের কথা শুনলে লাফাতো কিন্তু তলে তলে ঠিকি প্রেম করেছে।
মোহাম্মদ আলী ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।কি সাবলীলভাবে সে মনের কথা ব্যক্ত করছে।ছেলে এতোদিন বিয়ে করবেনা করবেনা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো এখন দেখা যাচ্ছে বিয়ে না করার পেছনে কঠিন কারণ ছিলো।সব ঠিক আছে কিন্তু শ্যামাকে?অসম্ভব।স্বপন ইসলাম সারাজীবন স্কুলের ছাত্র ঠেঙ্গিয়ে সংসার চালিয়েছে,কোনমতে ছেলেমেয়ে ভরনপোষণ করে মানুষ করেছে,উনাকে বেয়াই বলে পরিচয় দিতে হবে ভাবতেই মোহাম্মদ আলীর পেট ঘুরঘুর করে উঠে।শ্যামাকে কোনোভাবেই এই বাড়ির ছেলের বউ করা সম্ভব না।
“এতোদিন তোকে রুচিশীল,বিচক্ষণ ভাবতাম কিন্তু তুই এমন কাজ কিভাবে করলি?প্রেম করেছিস ভালো কথা।জাতপাত দেখে প্রেম করবিনা?”
ফিরোজ গম্ভীর গলায় গমগমে আওয়াজ তুলে বললো,
“আমার রুচির খারাপ দেখলেন কি?”
“খারাপ রুচি না হলে এতো ছোটলোকের মেয়ে চোখে পড়ে?”
“আব্বা।স্বপন কাকা ছোটলোক না।উনারা মধ্যবিত্ত পরিবারে লোক।এই দুনিয়ার সবাই যে পয়সাওয়ালা হবে তা তো কোনো কথা না।”
মোহাম্মদ আলীর মেজাজ খারাপ হয়।
“তুই আমাকে ছোটলোক আর বড়োলোক এর সংজ্ঞা শিখাবি?”
“শিখাই নি বললাম শুধু।”
“এমন পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করা সম্ভব না।কই আমাদের বংশ আর কই ওরা!”
ফিরোজ শান্ত কন্ঠে বললো,
“আব্বা আমি শ্যামাকে ভালোবাসি এটাই আসল কথা,এসব বংশ পরিচয়ে আমার কিছু যায় আসে না।”
“আমার যায় আসে।”
ফিরোজ তার আব্বার দিকে তাকিয়ে থাকে।মোহাম্মদ আলী আবার বলেন,
“কথা বুঝা গেলো?”
ফিরোজ আস্তে করে বললো,
“আমি শ্যামাকে বিয়ে করবো।আমি চাই আপনি স্বপন কাকার কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাবেন।”
মোহাম্মদ আলী চেচিয়ে উঠে।হুংকার দিয়ে বললো,
“অসম্ভব।”
ফিরোজ নরম স্বরে বললো,
“জীবনে তো কোনো কিছু চাইনি আব্বা,এবার চাইলাম ফিরিয়ে দেবেন?”
মোহাম্মদ আলী ছেলের মুখের দিকে তাকায়।
“এতো পছন্দ?”
“জ্বি।”
“শ্যামার চেয়ে মুনিয়া ভালো ছিলো না?রাজ্যের সাথে রাজকন্যা!”
ফিরোজ উঠে দাঁড়ায়।
“আমার রাজ্য চাইনা আব্বা;রাজকন্যা হলেই হবে।”
মোহাম্মদ আলী হঠাৎ চুপ হয়ে যায়।কিছুক্ষণ পরে গম্ভীর গলায় বললো,
“তাহলে তুই আমার মান রাখবিনা।”
“মান রাখবো বলেই তো অনুমতি নিতে আসলাম,না হলে বিয়ের পরে এসে বলতাম।”
মোহাম্মদ আলী মাথা নাড়ে।
“আমি প্রস্তাব দেয়ার পরে যদি উনারা একবারো না করে আমি কিন্তু আর কখনো ওই বাড়িমুখো হবো না।”
ফিরোজ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,
“না করবে না।”
“আচ্ছা।”
ফিরোজ খুব খুশী হয় কয়েক কদম এগিয়ে তার আব্বাকে জড়িয়ে ধরে।উনি যে এতো সহযে রাজী হয়ে যাবে তা ফিরোজের বিশ্বাস হচ্ছে না কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে অবিশ্বাসও করতে পারছেনা।সে আস্তে করে বললো,
“আব্বা শ্যামাকে এনে দিলে আমার সারাজীবনের সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে,মেয়েটা আমার সেরা উপহার।”
মোহাম্মদ আলী পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
সারাদিন শ্যামার সাথে বাড়ির কেউ কথা বলনি।এতো আদরের কন্যার সাথে কেউ কথা বলেনি এটা আসলেই অবিশ্বাস্য।শ্যামার খুব একা লাগছিলো, সে কয়েকবার মায়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু ফাতেমা বেগম শ্যামাকে পুরোদস্তুর এড়িয়ে গেছেন।শ্যামা ব্যাকুল হয়,বাবা মায়ের এই এড়িয়ে চলা তার সহ্য হয় না।ফিরোজ ফোন দিলে সব বলে।ফিরোজ তাকে বলে,
“আব্বা আজকে সন্ধায় তোমাদের বাড়িতে যাবে।আশা করি কথা পাকা হবে।আমার আব্বা আমার কথা শুনবে দেখো।”
শ্যামা বিরবির করে বললো,
“ভালো হলেই ভালো।আমার এতো অশান্তি হচ্ছে।”
“সব ঠিক হয়ে যাবে।”
শ্যামার ভয় হয়।তার কেনো যানি মনে হচ্ছে কিছুই ভালো হবেনা।
সন্ধায় মোহাম্মদ আলী স্বপন ইসলাম কে উনার হোটেলে ডেকে নেয়।দুজনের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়।গম্ভীরমুখে স্বপন ইসলাম বেড়িয়ে আসে।দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে হাটে।চোখে মুখের ভাষা ঠিক বোধগম্য হয় না।বাড়ির বারান্দায় সবাই বসে আছে।মোহাম্মদ আলী উঠোনের কাছের লাউয়ের ঝাড় থেকে একটা বাশের কঞ্চি হাতে নেয়।সবাই বারান্দায় বসে থাকলেও শ্যামা অনুপস্থিত।উনি কারো সাথে কোনো কথা না বলে শ্যামার রুমে গিয়ে সশব্দে দরজা আটকে দেয়।
চলবে…….
#মধুমাস
#পর্ব_২৪
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
শ্যামা টেবিলে বসে ছিলো।বাহিরের বারান্দায় সবাই বসে থাকলেও শ্যামা সেখানে যায়নি,তার সাথে পরিবারের কেউ কথা বলেনা ওখানে গিয়ে কি হবে।হঠাৎ দরজা বন্ধের শব্দ পেয়ে শ্যামা মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকায়।তার আব্বাকে তার দিকে টকটকে লাল চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে।সে খেয়াল করে তার আব্বার হাতে হাতে বাশের কঞ্চি।স্বপন ইসলামের হাতে কঞ্চি,দরজা বন্ধ শ্যামার বুকটা কেঁপে উঠে।উনার রাগ সম্পর্কে সে বেশ ভালো করে অবগত,তাই এখন যে রেগে আছে তা বুঝতে তার সমস্যা হচ্ছে না।শ্যামা উঠে দাঁড়ায়।আস্তে করে দরজার দিকে যেতে চায়।স্বপন ইসলাম শ্যামার হাত চেপে ধরে,শ্যামা আৎকে উঠে,চোখ জ্বালাপোড়া করে পানি বের হয় কাঁপা স্বরে বললো,
“আব্বা…,অ আম্মা আম্মা,”
স্বপন ইসলাম মেয়ের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,
“তুই ফিরোজকে পছন্দ করিস?”
শ্যামা ভয় পায়। সে তার রাগী আব্বার সামনে নিজের ভালোবাসার কথা কিভাবে প্রকাশ করবে তা ভেবে কুল পায় না,উনাকে দেখে এমনিতেই মনে হচ্ছে ভিষণ রেগে আছে এখন যদি শ্যামা আবার প্রেমের কথা স্বীকার করে তাহলে তুলকালাম বাধতে দেরী হবে না।সে ভ,য়ে ভাবে মিথ্যা বলবে কিন্তু মিথ্যা বললে যে আরেক সমস্যা।সে ভালোবাসে পছন্দ করে এটা ঠিক সেই ভালোবাসাকে অস্বীকার করবে কি করে?তাছাড়া সেই প্রথম ভালোবেসেছে,ফিরোজকে পা,গল বানিয়েছে এখন অস্বীকার করবে কিভাবে?
ফিরোজ বলেছিলো আজকে তার আব্বাকে পাঠাবে যদি সে এখন মিথ্যা বলে তাহলে যদি তার আব্বা না করে দেয়।শ্যামা বুক ভরে শ্বাস নেয়,ভাবে সত্যি বলবে এরপর যা হবার হবে।ভ,য় দূরে রেখে বললো,
“আব্বা ফিরোজ ভাইকে আমার পছন্দ,উনাকে ভালোবাসি।”
স্বপন ইসলাম রা,গে ফুসফুস করে শ্বাস নেয়।মেয়ের সাহস দেখে অবাক হয়।মোহাম্মদ আলীর কথাগুলো কানে গরম শিশার মতো লাগছে কিন্তু ঘরের মেয়ে যদি ঠিক না থাকে তাহলে পরের সাথে তর্ক করে লাভ কি?স্বপন ইসলাম রাগে হুংকার দিয়ে উঠে,হাতের কঞ্চি দিয়ে শ্যামার গায়ে আ,ঘাত করে।হঠাৎ আঘা,ত করাতে শ্যামা ভড়কে যায়।আ,ঘাত থেকে বাঁচতে সরে যেতে চায় কিন্তু স্বপন ইসলাম যেনো আজকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কোনো ভাবেই শ্যামাকে সরতে দেবেনা।শ্যামার চোখ ফেটে পানি আসে।মা,রের কারনে সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।কাঁপা গলায় বললো,
“আব্বা,অ আব্বা।”
স্বপন ইসলাম মেয়ের ডাককে তোয়াক্কা করে না,যেই মেয়ের জন্য অপমানিত হতে হয়,এই মেয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে মে,রে ফেলা ঢের ভালো।বাহির থেকে ফাতেমা বেগম আর রিপন দরজা ধাক্কাচ্ছে আর ডাকছে।
পুরুষ মানুষের হাতের মা,র খুব সহয ব্যাপার না।শ্যামার শরীর এতো আ,ঘাত নিতে পারে না হাটুমুড়ে ফ্লোরে বসে পড়ে।কাঁতর গলায় তার আব্বাকে ডাকে।তার আব্বা অনুনয় না শুনলে তার আম্মাকে ডাকে।কোনো উপায় না পেয়ে স্বপন ইসলামের পা আঁকড়ে ধরে বলে,
“আব্বা আর মা,রবেন না আব্বা,আমি ম,রে যাবো আব্বা।”
স্বপন ইসলাম কঠোর কন্ঠে বললো,
“ম,রে যা,তোর মতো মেয়ে লাগবে না।”
শ্যামার মনে হচ্ছে প্রাণপাখি তার দেহ ছেড়ে চলে যাবে।সে চেচিয়ে তার আম্মাকে ডাকলো,
“আম্মা,আম্মা।”
স্বপন ইসলাম বললেন,
“তুই বল আর কখনো ফিরোজের নাম মুখে নিবি না,তাহলে ছাড়বো।”
শ্যামা এমন কথা শুনে দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখা তার আব্বার পা ছেড়ে দেয়।স্বপন ইসলাম বুঝলেন মেয়ে ফিরোজকে ছাড়বে না।উনি আরোও রেগে যান,বেধম পেটালেন।শ্যামা নিশ্চুপ হয়ে গেছে,শান্ত হয়ে আঘাত সহ্য করছে।ছটফট করতে করতে শ্যামা চোখের সামনে ফিরোজকে দেখলো।বিরবির করে বললো,
“কষ্ট হচ্ছে।”ছটফট করতে করতে শ্যামা জ্ঞান হারায়।মাটির মেঝেতে দেহটা নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে।স্বপন ইসলাম মেয়ের দিকে তাকিয়ে দরজা খুলে দেয়।রাগে মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
ফাতেমা বেগম শ্যামার কাছে ছুটে গিয়ে আহাজারি করে বললো,
“এটা আপনি কি করেছেন?”
স্বপন ইসলাম হাতের লাঠি ছুড়ে দূরে ফেলে দেয়।দাঁতের সাথে দাঁত চেপে বললো,
“ভালো করেছি,ওর ম,রে যাওয়াই ভালো।”
ফাতেমা বেগম মেয়ের চেহারাটার দিকে তাকায়।ফর্সা মুখ কালো হয়ে গেছে।চোখের পানি মাটিতে পড়ে গালে কাদা লেগে গেছে।অতি আদরের মেয়ের এই পরিনতি দেখে উনার বুকটা হাহাকার করে উঠে।কি থেকে কি হয়ে গেলো।
শ্যামাকে ধরাধরি করে বিছানায় শোয়ানো হয়,পানি এনে শ্যামার মাথায় ঢালে যেন জ্ঞান ফিরে।স্বপন ইসলাম তখন রাগের মাথায় মা,রলেও এখন মনে হচ্ছে এতো বেশি আ,ঘাত করা ঠিক হয়নি।ছোট মানুষ সইতে পারেনি।উনি দাঁড়িয়ে আছে,চোখের দৃষ্টি শ্যামার দিকে নিবন্ধ।রিপন তার আব্বার কাছে জানতে চায় কি হয়েছে।রিপনের প্রশ্ন শুনে সবাই উৎসুক চোখে উনার দিকে তাকায়।
স্বপন ইসলামের চোখে ভেসে উঠে সন্ধার দৃশ্য।
প্রতিদিনকার মতো আজকেও বিকালে চা খেতে বাজারে গিয়েছেন।পরিচিত মানুষদের সাথে গল্প করে বাড়ি আসার সময় এক ছেলেকে দিয়ে মোহাম্মদ আলী উনাকে ডেকে পাঠায়।স্বপন ইসলাম হোটেলে যায়।মোহাম্মদ আলী উনাকে বসিয়ে বললেন,
“আপনি তো শিক্ষক মানুষ অথচ ঘরের মানুষকেই আসল শিক্ষা দিতে পারলেন না।”
স্বপন ইসলাম উনার কথার ধাত বুঝতে পারলো না।মাথা নেড়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
“ঠিক বুঝলাম না।”
মোহাম্মদ আলী গম্ভীর গলায় বললো,
“না বুঝার মতো কঠিন কথা তো আমি বলিনাই।আপনার মেয়ে ফিরোজের পিছনে ঘুরে কেনো?”
স্বপন ইসলাম বললেন,
“মানে?”
“আপনার মেয়ে সামলাই রাখেন।”
স্বপন ইসলাম স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।উনাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মোহাম্মদ আলী বললো,
“আপনাকে ভালো মনে করেছিলাম কিন্তু আপনি যে এতো লোভী তা কস্মিনকালেও ভাবিনি।”
স্বপন ইসলাম রেগে যান।না জেনে উনার সম্পর্কে এমন কথা বলাতে উনি বললেন,
“বাজে কথা বলবেন না।আমি লোভীর কি করেছি?”
“নিজের মেয়েকে আমার ছেলের পেছনে লেলিয়ে দিয়ে এখন বলছেন কি করেছেন?”
“আমার মেয়েকে আপনার ছেলের পেছনে কেনো লেলিয়ে দিতে যাবো?”
মোহাম্মদ আলী তাচ্ছিল্য করে বললো,
“কেনো আবার আমার অর্থসম্পদ এর জন্য।এই এতো বড়ো হোটেল তো ফিরোজেরই, তাকে হাত করতে পারলে ভালো না?”
স্বপন ইসলাম থমথম খেয়ে যায়।জীবনে কেউ কখনো উনাকে এমন করে অপমান করেনি।রাগে কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলেন।
“আপনার ছেলে আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে।সেগুলো দেখছেন না?”
মোহাম্মদ আলী উনার গাল ভর্তি দাঁড়ির উপর হাত ভুলিয়ে বললো,
“পোলাপান মানুষ মনে রঙ লেগেছে তাই একটু তামাশা করেছে।আপনি আপনার মেয়ে ঠিক করেন,ও যেনো আর পিছুপিছু না ঘুরে।”
“আমার মেয়ে পিছনে ঘুরে না।”
“ঘুরে।আমার ছেলেকে এমন পটানো পটিয়েছে যে সে বিয়ের জন্য পা,গল হয়ে গেছে।”
স্বপন ইসলাম অবাক হয়ে বললো,
“আমি এসবের কিছু জানি না।”
“জানবেন কেনো?মেয়ে কি ঘরে রাখেন না?মেয়ে যে এমন বদ,মাইশি করছে তা টের পাননি?আপনি কেমন বাবা?জন্ম দিতে পারলেই দায়িত্ব শেষ?নাকি নিজেই বড়োলোক বাপের ছেলে দেখে মেয়েকে দিয়ে রেখেছেন।তাছাড়া সামান্য স্কুলের চাকরি দিয়ে তো আর এতো বড়ো সংসার চালানো যায় না,পয়সাওয়ালা পার্টি ভাগে নিতে পারলে ভালোই হয়,আরাম আয়েশে বাকি জীবন কাটানো যাবে।কি বলেন?”
স্বপন ইসলামের চোখ জ্বালা করে।এই হোটেলে বসে কান্না করা খুবই দৃষ্টিকটু।উনি নিজেকে সামলে নেন।মোহাম্মদ আলী ফের বলেন,
“আপনাদের মতো ছোট বংশের মানুষের সাথে আমি কখনো কোনো আত্মীয়তা করবো না।ভালোয় ভালোয় মেয়েকে সামলে নেন।আর মেয়ে বিয়ে দিতে যা লাগে সব আমি দেবো তারপরও আমার ছেলের থেকে আপনার মেয়ে যেনো দূরে থাকে।”
স্বপন ইসলাম কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে।অপমানে শরীর টনটন করছে।আদরের মেয়ের জন্য আজকে উনাকে এই পরিস্থিতিতে পরতে হলো এটা ভাবতেই ইচ্ছে করছে ম,রে যেতে উনি বললেন,
“আপনার আর কিছু বলার আছে?”
মোহাম্মদ আলী হেসে বললো,
“ভাইসাব রাগ করেন না।ছোট মানুষ ছোট ছোট আত্মীয় খুঁজেন।এতো বড়ো জায়গায় নজর দেয়া ভালো না।”
“আচ্ছা।আমি আমার মেয়েকে সামলে রাখবো আপনার ছেলেকে আপনি সামলাবেন যদি সে কোনো উল্টাপাল্টা করার চেষ্টা করে তখন ভালো হবে না।”
মোহাম্মদ আলী ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
“আমার ছেলে উল্টাপাল্টা করবে কেনো?বললাম না রঙ লেগেছে,রঙ শেষ হলে আর ওমুখো হবে না।এবার আপনি আসতে পারেন।”
স্বপন ইসলাম থমথমে গম্ভীর মুখে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসে।
রিপনের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে যায়।তার আব্বার মুখের কথা শুনেই মাথা গরম হয়ে গেছে।কড়া চোখে শ্যামার দিকে তাকায়,তার এখন ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে জ্যান্ত ক,বর দিতে।শান্তা আর ফাতেমা বেগম দুজনেই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।উনারা মোহাম্মদ আলীকে ভালো মানুষ হিসেবেই জানতো কিন্তু উনি যে এমন মানুষ তা কারো জানা ছিলো না।ফাতেমা বেগম এতোক্ষণ শ্যামার প্রতি সদয় থাকলেও এখন উনারও রাগ লাগছে।আরো একচোট মা,রতে ইচ্ছে করছে।
শ্যামার মোবাইলে মেসেজ আসে।শ্যামার তখনো জ্ঞান ফেরেনি।মেসেজের শব্দে রিপন এগিয়ে গিয়ে মোবাইল হাতে নেয়।ফিরোজ মেসেজ করেছে “শ্যামা আব্বা কি তোমাদের বাড়ি গিয়েছে?জানাও।”
রিপন মোবাইলটা বন্ধ করে প্যান্টের পকেটে রেখে দেয়।গমগমে গলায় বললো,
“আজকে থেকে ওর ঘর থেকে বেরোনো বন্ধ মোবাইল চালানোও বন্ধ,বেশী বাড়াবাড়ি করলে হাত পা ভেঙ্গে ঘরে বসিয়ে রাখবো।”
স্বপন ইসলামের মাথা ঘুরে যায়।উনি হাই প্রেসারের মানুষ,অতিরিক্ত চাপ কিংবা টেনশন সহ্য পারেন না,আজকে তো একেবারে মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে।রিপন উনাকে ধরে রুমে নিয়ে যায়।ফাতেমা বেগম আর শান্তা উনার পিছুপিছু যায়।সবাই চলে যাওয়ার পরে শ্যামার ডাগর চোখের কোন বেয়ে ফোটায় ফোটায় পানি গড়িয়ে পড়ে।তার জ্ঞান ফিরেছে অনেকক্ষণ কিন্তু সে ভ,য়ে, লজ্জায় চোখ খুলেনি,চোখ বন্ধ রেখে তার আব্বার সবগুলো কথা শুনে কষ্টে মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে।ফিরোজ তো বলেছিলো তার আব্বা আসবে কিন্তু এসব বলার জন্য আসবে তা তো বলেনি।স্বপন ইসলামের জন্য শ্যামার কষ্ট হয়,তার জন্যই আজকে উনি এতো অপমানিত হলো।চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করে।মেয়ে হিসেবে নিজেকে খুব ছোট লাগছে।
ফিরোজ সারা সন্ধা ছটফট করে কাটায়।তার আব্বা কি কথা বলে আসে সেই চিন্তায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না।শ্যামাকে কয়েকবার ফোন করেছে কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ।ফিরোজের কেমন অশান্তি লাগে,অকারনেই বুকটা ছটফট করে, গলা শুকিয়ে আসে।সারা শরীরে কেমন এক জ্বালাপোড়া অনুভব করে।অশান্তি যখন চূড়ান্ত পার্যায়ে তখন সে তার আব্বাকে ফোন দেয়।মোহাম্মদ আলী জানায়
“শ্যামার আব্বা না করে দিয়েছে উনি তোর কাছে বিয়ে দেবে না।ওই মেয়ের আরেক জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।”
ফিরোজের পায়ের নিচের মাটি যেনো মৃদু কেঁপে উঠে।
“আপনি কিছু বললেন না?”
“বলবো না আবার আমার ছেলের শান্তি আনতে সব বলতে পারি কিন্তু উনি আমার কোনো কথাই শুনেনি।”
ফিরোজের বিশ্বাস হতে চায় না।সে বললো,
“আব্বা।আপনি সত্যি বলছেন?”
“হ্যাঁ।আব্বা তুই আমার কথা বিশ্বাস কর।শ্যামাকে ভুলে যা।”
ফিরোজ কান থেকে মোবাইল নামিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।ইচ্ছে করছে এখনি শ্যামাদের বাড়িতে যেতে কিন্তু এতো রাতে যাওয়া ঠিক হবেনা।শ্যামার সাথে কথা বলতে পারলে ভালো লাগতো কিন্তু সেই রাস্তাও বন্ধ।
পরের দিন সকালে ফিরোজ ভাবে শ্যামার ফোনের অপেক্ষা করবে।শ্যামা কলেজে যাবে তখন কথা বলবে কিন্তু না শ্যামা কোনো ফোন দিলো না কলেজে গেলো।এমন নিশ্চুপতা দেখে ফিরোজের চিন্তা বাড়ে।দুপুরে ফারিয়া তার শশুড় বাড়ি থেকে আসলে তাকে দেখা করতে পাঠায়।কিন্তু শ্যামার আম্মা ফাতেমা বেগক ফারিয়াকে শ্যামার রুমে যেতেই দেয় না,জানায় শ্যামার শরীর ভালো না পরে দেখা করবে।ফারিয়া এসে এসব জানালে ফিরোজ চিন্তায় পড়ে।কি এমন অসুস্থতা যে ফারিয়ার সাথেও দেখা করছেনা। মনে হয় তার অজান্তে কোনো গোলমাল হয়েছে।
ফিরোজ সন্ধায় দুইজন ছোটভাই নিয়ে শ্যামাদের বাড়িতে যায়।শ্যামার বাবা ভাই তখন বাড়িতেই উপস্থিত ছিলো ।ফিরোজকে দেখে স্বপন ইসলাম রেগে যায়।হুংকার দিয়ে বললো,
“এখানে এসেছো কেনো?বেরিয়ে যাও।”
ফিরোজ বুঝতে পারে ঘটনা আর সহয নেই,যাই ঘটেছে খুব খারাপ ঘটেছে।সে অনুনয় করে বললো,
“চাচা।আমার কথাটা শুনেন।”
ফিরোজ কিছু বুঝে উঠার আগে রিপন তার গালে থাপ্পড় দিয়ে ফেলে তারপর কয়েকটা ধাক্কা দিয়ে বারান্দা থেকে বের করে দেয়।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“তোর আব্বার কাছে যা।ছোটলোকের বাড়িতে আসলে এসবই পাবি।”
ফিরোজ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।সাথের ছেলেগুলো বললো,
“ভাই!গা,ইরালাই কন খালি।”
ফিরোজ মাথা নেড়ে না করে।সে ছলছল চোখে শ্যামার বন্ধ দরজার দিকে তাকায়।
চলবে…….