#মধুমাস
#পর্ব_১৫
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
ফিরোজ মুচকি হাসে।শ্যামাকে কাছে এনে দাঁড় করায়।
“জানোনা?তাহলে আমাকে মধুরাজা বলতে কেনো?”
“এমনি।”
ফিরোজ বললো,
“বসন্ত মাসকে মধুমাস বলা হয়।বসন্ত প্রেমের মাস।তুমি আমাকে মধুরাজা বলো।তাহলে আমি বসন্তের রাজা,প্রেমের রাজা,তোমার রাজা।”
শ্যামা হাসে।ফিরোজ শ্যামার চোখে চোখ রেখে বললো,
“আমাকে তুমি এমন পা,গল বানিয়ে দেবে আমি কখনো ভাবিনি।”
“পা,গল হয়েছেন?”
“হয়েছি মানে,রাতে ঘুম আসেনা।ইচ্ছে করে…..”
ফিরোজ বাকি কথা বলার আগে শ্যামা বললো,
“চুপ।ছিহ!কেমন সব কথা!”
ফিরোজ শীতল চোখে তাকিয়ে বললো,
“ত্রিশ বছরের পুরুষের থেকে আর কি আশা করো সুন্দরী?তাছাড়া আমি বলতে চাচ্ছিলাম রাতে তোমাকে ছাড়া ঘুম আসেনা।তুমিই এক ডিগ্রি বেশি বুঝো”
শ্যামা ফিরোজের কাছে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বললো,
“আপনি এতো খারাপ।”
ফিরোজ শ্যামার কানের কাছে ঠোঁট লাগিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“এই পৃথিবীর সব পুরুষ তার নির্দিষ্ট নারীর কাছে খারাপ,কোনো পুরুষ শুদ্ধ না।”
শ্যামা ছুটে নিচে চলে যায়।এই লোকের কাছে আর এক মিনিট থাকলে নির্ঘাত পা,গল করে দেবে।ফিরোজ তার কথামতো ঠিক সুদে আসলে সব শোধ করছে,আর শ্যামার দম আটকে যাচ্ছে,সুখে সুখে ম,রে যেতে ইচ্ছা করছে।
ফারিয়া তার বুকের কাঁপন টের পাচ্ছে।সারাদিনটা তার কাছে স্বপ্নের মতোই ছিলো।পাত্রের নাম মাহিন।ফারিয়ার হঠাৎ করে মনে হচ্ছে মাহিন নামটা খুবই সুন্দর।আর ব্যক্তিটাও সুন্দর।যেহেতু মাহিনকে আগে থেকেই জানাশোনা ছিলো তাই আজকেই বিয়ের ডেট ফাইনাল করা হয়।মাহিন যেহেতু সরকারি চাকরি করে তারও ছুটির একটা ব্যপার আছে।সবকিছু বিবেচনা করে সামনের মাসের এক তারিখে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়।মাহিন এখন তার সামনে বসে আছে।ফারিয়া চোখ তুলে একবার তাকিয়েছিলো মাহিন তার দিকে তাকিয়ে আছে।সে তাড়াতাড়ি করে চোখ নামিয়ে নেয়।আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলেও সে আজকেই প্রথম মাহিনকে দেখলো,মাহিনের মাঝে আলাদা একটা আত্মসম্মানবোধ আছে,যার প্রখরতা দূর থেকেও টের পাওয়া যায়।ফারিয়ার আগে ধারণা ছিলো চশমা পড়া ছেলেদের বলদের মতো লাগে কিন্তু আজকে সেই ধারনা পাল্টে গিয়েছে,মাহিন চশমা পড়ে আছে আর এতেই যেনো তার সৌন্দর্য হাজার গুন বেড়ে গেছে।তার সামনে বসা এই পুরুষটা তার স্বামী হতে যাচ্ছে,সবচেয়ে আপনজন হতে যাচ্ছে।এতোই আপনজন যার কাছে নিজের সব অসস্তির কথা,ভালো লাগার কথা নির্দিধায় বলা যায়।ফারিয়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়,বুকের মাঝে হৃদপিণ্ড এতো জোড়ে লাফাচ্ছে।তার মনে হচ্ছে দুই হাত দূরে বসে থাকা মাহিন তার বুকের ধুকপুক শব্দ শুনতে পাবে।ফারিয়া লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না,দুই হাত শক্ত করে ধরে রাখে।
মাহিন ফারিয়ার লজ্জা,ভয়,অসস্তি সবটাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখে।তার বয়সের তুলনায় এই মেয়ে ছোট কলেজে পরে,বয়স নিয়ে তার তেমন মাথা ব্যাথা নেই মেয়েরা একটু তাড়াতাড়িই ম্যাচিয়ুর হয়ে যায় কিন্তু ফারিয়া যে এখন এভাবে লজ্জা পাচ্ছে এই ব্যাপারটা তার নিজের কাছেই অসস্তি লাগছে।তাহলে কি ফারিয়া তার চিন্তাধারার মতো ম্যাচিয়ুর না?সে গলা খাকারি দিয়ে কথা বলার প্রস্তুতি নিলো।গলার স্বর দাম্ভিক করতে না চেয়েও কিছুটা গম্ভীর শোনালো,
“ফারিয়া আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন?”
ফারিয়ার জানামতে মাহিন ফারিয়ার চেয়ে বয়সে বেশ বড়ো উনার মুখে নিজের প্রতি আপনি সম্মোধন শুনে সে আরো মিহিয়ে যায়।চকিত নয়নে চোখ তুলে মাহিনকে এক নজর দেখে মাথা নাড়ে।ফারিয়া কি অর্থে মাথা নাড়ে মাহিন বুঝতে পারে না।সে যে প্রশ্নটা করেছে এটা করা ঠিক হয়নি,মেয়েটা তার সামনে প্রথম এসেছে স্বাভাবিকভাবেই সে লজ্জা পাবে।তাছাড়া সে ফারিয়াকে আপনি করে সম্মোধন করে ফেলেছে,আসলে তুমি করা বলা তার কাছে অনুপযোগী মনে হয়েছে,হুট করেই কি তুমি বলা যায়?কিন্তু তুমি বললেই বোধহয় ভালো হতো সম্পর্কে সহয হওয়া যেতো।মাহিন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।হঠাৎ করে মাহিন খেয়াল করলো তার শব্দভাণ্ডারে শব্দের সংকট দেখা দিয়েছে,ফারিয়ার কাছে কি বলে কথা শুরু করবে সেই শব্দগুলো তন্নতন্ন করেও খুঁজে পাচ্ছে না।সে অবাক হয়ে ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে;এই কমবয়সী তরুনী তার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটিয়ে দিয়েছে,লাজুক তরুনীর সামনে নিজেকে কেমন এলোমেলো লাগছে।সে হাতের আঙ্গল দিয়ে কপাল চুলকে বললো,
“আপনার কি কোনো পছন্দ আছে?”
ফারিয়া মাহিনের প্রশ্ন শুনে মাথা নাড়ে।মুখে মিষ্টি কন্ঠে আস্তে করে বললো,
“না।”
“এই বিয়েতে আপত্তি আছে?”
“না।”
“আপনি আমার সাথে সারাজীবন কাটাবেন সুতরাং আমাকে কি আপনার ভালো লেগেছে?নির্দিধায় বলুন।”
ফারিয়া সোজা মাহিনের চোখের দিকে তাকায় কিন্তু মুখে কিছু বলেনা।মাহিন সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।বালিকার চোখের দৃষ্টিতে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ইশারা ছিলো।আর তাতেই তার মন কেমন নরম ঘাসের মতো দুলে উঠে,ঠোঁটের কোনে স্থান নেয় এক চিলতে হাসি।মুখে বললো,
“আচ্ছা।”
ফারিয়া চুপ করে থাকে।মাহিন আস্তে করে বললো,
“ফোন নাম্বার দিয়ে দেন।মাঝে মাঝে কথা বলা হবে।”
ফারিয়া নিঃশব্দে মোবাইল মাহিনের দিকে এগিয়ে দেয়।মাহিন কিছুক্ষণ পরে উঠে দাঁড়ায়।
“আবার দেখা হবে।”
শ্যামা রাতে সবার সাথে বসে আছে।সবাই ফারিয়ার বিয়ে নিয়ে আলোচনা করছে।ফাতেমা বেগম বললো,
“এতো ভালো ছেলে কিভাবে যোগার করে ফেললো?”
স্বপন ইসলাম সায় দিয়ে বললো,
“আত্মীয় লাগে নাকি।”
রিপন মুখ বেকিয়ে বললো,
“আত্মীয় না ছাই।দেখো প্রেম করে বিয়ে ঠিক করেছে হয়তো।”
শ্যামা প্রতিবাদ করে বললো,
“না না।ফারিয়া প্রেম ট্রেম করেনা।মাহিন ভাই তার খালার দেবরের ছেলে।”
ফাতেমা বেগম সায় দিয়ে বললো,
“আমিও এটাই শুনেছি।যাক।বাবা মায়ের আশায় ধৈর্য ধরে থাকলে কপালে ভালো কিছুই হয়।শ্যামার জন্য এমন একটা ছেলে পেলেই হয়।”
রিপন বললো,
“বান্ধুবীর যেহেতু বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাহলে শ্যামার জন্যও পাত্র দেখো।”
শ্যামা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
“আমি এখন বিয়ে করবোনা।আমি পড়বো।”
কেউ কিছু বলার আগে রুমে ছুটে যায়।রুমে গিয়ে শুনতে পায় স্বপন ইসলাম বলছে,
“পড়তে চাইলে পড়বে বিয়ের নাম নেয়ার দরকার কি?”
ফাতেমা বেগম বললো,
“হ্যাঁ পড়ুক আর পড়তে পড়তে একটা দূর্ঘটনা ঘটাক।আজকাল কার মেয়েকে ভরসা করা যায় না।”
স্বপন ইসলাম গম্ভীর গলায় বললো,
“আমার মেয়ের উপর ভরসা আছে।”
শ্যামার হঠাৎ মন খারাপ হয়ে যায়।ফিরোজ কোনো চাকরি করে না যেটা করে সেটা তার আব্বার একদম পছন্দ না।ফিরোজকে কাছে পেতে যে ঝড় আসবে তা কি সে মোকাবিলা করতে পারবে? তার আব্বা তাকে বিশ্বাস করে আর সে কি করছে সব বিশ্বাস ধুলোয় মিশিয়ে ফিরোজকে নিজের করে পাওয়ার প্রতিজ্ঞা করছে।শ্যামা এসব ভাবতে চায় না।ফিরোজকে বিয়ে করে নিলেই বোধহয় সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে,তার মন এখন প্রেমে পাগল,অন্যকিছু ভাবতেও ভালো লাগে না।সে ফিরোজের গেঞ্জিটা পড়ে শুয়ে পড়ে।মোবাইল হাতে নিয়ে ফিরোজকে ফোন দেয়।
“হ্যালো।”
ফিরোজ তখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।চিরপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন দেখে মুচকি হাসে।
“জ্বী।”
শ্যামা সোজাসাপটা বললো,
“আমাকে বিয়ে করবেন কবে?”
“বান্ধুবির বিয়ে দেখে কি বিয়ের অসুখ হয়েছে?”
“না।ফারিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে তাই সবাই চাচ্ছে আমারো বিয়ে হয়ে যাক।”
“হলে হবে।”
শ্যামা ফুসে উঠে বললো,
“মানে?”
“কিছুনা।তুমি টেনশন করোনা।আমি ছাড়া তোমাকে কেউ বিয়ে করতে আসবেনা।আসলে হাত পা ভে,ঙ্গে দেবো।”
“সব জায়গায় নেতাগিরি চলে না।”
“আচ্ছা।তখন দেখা যাবে।”
শ্যামা মরিয়া গলায় বললো,
“কেউ যদি না মেনে নেয়।”
ফিরোজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি সবাইকে মানিয়ে নেবো।তুমি এসব নিয়ে ভ,য় পেও না।ঘুমাও।”
ফিরোজের কথায় শ্যামা সস্তি পায়।
“আচ্ছা।”
“আমার গেঞ্জি পরেই ঘুমাচ্ছ?”
“প্রতিদিনই ঘুমাই।”
“আমি জানি।”
ফারিয়া খিলখিল করে হেসে বললো,
“কিভাবে বুঝলেন?”
“আমি সব বুঝতে পারি।”
“তাই।আমার এখন কি করতে ইচ্ছে করছে বলুন তো।”
“আমার সাথে দেখা করতে,আমার আদর পেতে।”
শ্যামা ফিসফিস করে বললো,
“না।কখনোই না।”
“কেনো?”
কারণটা শ্যামা বলে না।সে বললো,
“এতো কিছু জানি না।ঘুমাবো।লাভিউ লাভিউ লাভিউ।”
ফিরোজ চোখ বন্ধ করে রাখে।এই ছোট শব্দগুলোর এতো জোড়!এই শব্দগুলো তার অন্তর ঠান্ডা করে দিতে পারে।প্রথম প্রথম শ্যামার আবদারে বললেও এখন নিজেই বলে।হ্যাঁ এটা ঠিক যে এই কথাটা না বললেও ভালোবাসা হয়,কিন্তু আলাদা প্রশান্তি আছে।সে ফিসফিস করে বললো,
“ভালোবাসি আমার চড়ুই পাখি।একটুও চিন্তা করবেনা সোনা,আমি থাকতে আমার রানী আর কে নিবে বলো?রাজার বুকেই রানীর স্থান।”
চলবে………