মধুমাস পর্ব-০৭

0
630

#মধুমাস
#পর্ব_০৭
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর

“শ্যামা বেশী কথা বলোনা।”

“আমি এমনই।”

“অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু।”

“তো!আমি কি করবো?”

ফিরোজ নিজেকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করে বললো,
“আমি কি চলে যাবো?”

“আমি কি জানি?”

ফিরোজ নিঃশব্দে ফোন কেটে দেয়।মনটা বিষিয়ে উঠে।যে মেয়ে রাতে দেখা করতে চলে আসে সে মেয়ে বিকালে আসছেনা কেনো?তার ইচ্ছে করছে শ্যামাকে ধরে এনে সামনে বসিয়ে রাখে,দেখা করতে না আসার শাস্তি স্বরূপ ভিষণ ভ,য়ংকর রকমের শাস্তি দেয়া উচিত।ফিরোজ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে,তার মনে হালকা সম্ভাবনার রেখা ছিলো যে শ্যামা আসবে কিন্তু দশ মিনিট পরেও যখন আসলো না তখন সে বিষ্ময়ে রাগ করার কথা ভুলে যায়।চুপচাপ সেই যায়গা থেকে সরে আসে।দুনিয়ার সবাই তাকে ফাঁকি দেয়।

মোহাম্মদ আলী মূলত কখনোই সকালের নাস্তা ঘরে করা হয় না।ফজরের নামায পড়েই উনি হোটেলে চলে যায় হোটেলেই নাস্তা সারেন।আজকে হোটেলে যায় নি উনার শরীরটা ভালো লাগছেনা।নিজের ঘরে শুয়ে আছে রোজিনা বেগমের হাকডাক শুনে উঠে টেবিলে গিয়ে বসে।কন্ঠে বিরক্তি মিশিয়ে বললো,
“সকালবেলাই এমন চিল্লাচিল্লি শুরু করেছো কেনো?”

রোজিনা বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি কথা বললেই চিল্লাচিল্লি!খাবার বানিয়ে বসে থাকার জন্য বান্দী করে এনেছো নাকি?”

মোহাম্মদ আলী স্ত্রীর দিকে শান্ত চোখে তাকায়।একে একে ফারিয়া আর তামিম এসে টেবিলে বসে।তিনি ফিরোজের দরজার দিকে তাকায়।রোজিনার সমস্ত রাগ যে ফিরোজের উপর এটা উনি জানেন।উঠে গিয়ে ফিরোজের দরজা ধাক্কা দিলেন,চাপানো ছিলো বলে খুলে গেলো।ধীরপায়ে ভেতরে ডুকে দেখেন,ফিরোজ খাটে হেলান দিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছে।উনাকে দেখে নড়েচড়ে বসে বললো,
“আব্বা!”

মোহাম্মদ আলী ছেলের মুখ দেখেই বুকে ব্যথা অনুভব করেন।ছেলেটা সব শুনে,বুঝে তবুও কতোটা নিশ্চুপ।
“নাস্তা খেতে আয়।”

ফিরোজ মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায়।বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
“আপনি যান আমি আসছি।”

মোহাম্মদ আলী ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়।শতো চাইলেই উনি ফিরোজের উপর শক্ত হতে পারেন না।নাস্তার টেবিলে বসার পরে রোজিনা বেগম ঘ্যানঘ্যান করে বললো,
“কি আসেনি?আসবে কেনো বেয়াদবের চূড়ান্ত এই ছেলে।অসভ্য মহিলা নিজে চলে গেছে এই আপদ আমার কপালে দিয়ে গেছে।বলি যাবিই যখন নিজের ঝামেলা সাথে নিয়ে যা,না আমার জন্য রেডিমেড ঝামেলা দিয়ে গেছে।”

মোবারক সাহেব টেবিল কাঁপিয়ে রোজিনা বেগমকে ধমক দেয়।
“মুখ সামলে কথা বলো।আপদ কি হ্যাঁ?”

রোজিনা বেগম মুখ অন্ধকার করে থাকে।
তামিম মায়ের কথায় অসন্তুষ্ট।বাবা যে রেগে আছে সেটা স্পষ্ট।কথা বাড়ার আগে সে মাকে বললো,
“এসব কি কথা আম্মা?ভাই ঝামেলা হলে তো আমিও ঝামেলা।”

রোজিনা বেগম হিসহিসিয়ে বললো,
“তুই পেটের ছেলে আর ওইটা আমার সতীনের ছেলে।”

মোহাম্মদ আলী তামিমের দিকে তাকায়।তামিম বললো,
“চুপ করো আম্মা।এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না,সকাল সকাল ঝগড়া করোনা।”

রোজিনা কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগে ফিরোজ সেখানে এসে উপস্থিত হয়।খালি চেয়ারে বসে যায়।এতোক্ষণ রোজিনা বেগমের সকল কথা সে শুনেছে তাই তার মুখের ভাব যথেষ্ট গম্ভীর কিন্তু আব্বার সামনে সে গম্ভীর থাকেনা।মোহাম্মদ আলীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“হোটেলে যান নি কেনো আব্বা?”

“শরীর ভালো লাগছেনা।”

ফিরোজ গাজরের হালুয়া নিয়ে খেতে শুরু করে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আচ্ছা শরীর খারাপ লাগলে যাওয়ার দরকার নেই।আমি যাবো।”

মোবারক সাহেব মাথা নেড়ে সায় দেয়।মুখে বললো,
“আচ্ছা।”

ফিরোজ চুপচাপ খাবার খেয়ে উঠে হোটেলে চলে যায়।ফিরোজের মন খারাপের চিত্র রোজিনা বেগম ছাড়া বাকি তিনজনই উপলব্ধি করতে পেরেছে।ভাই বেরিয়ে যাবার পরে ফারিয়া রাগী গলায় বললো,
“তুমি ভাইয়ের সাথে এমন করো কেনো?ভাইয়া কষ্ট পায় বুঝনা? আর এসব বলবেনা।”

রোজিনা মেয়ের কথা শুনে হায়হায় করে বললো,
“তোরা দুইজন আমার পেটে হয়েছিস?ভাবতে অবাক লাগে।”

মোহাম্মদ আলী রুমে চলে যায়।রোজিনা বেগমের এসব কথাবার্তা শুনতে ভালো লাগছেনা।স্ত্রীকে বেশী কিছুও বলতে পারেন না।আবার ছেলেকে কিছু বললেও ভালো লাগে না।

ফিরোজ আজকে হোটেলে যেতে বাইক নেয়নি,হেটেই যাচ্ছে।অন্যমনস্ক হয়ে হাটছে।রোজকার এই খোঁচার কথা,হট্টগোল তার একটুও ভালো লাগে না,সারাক্ষণ অশান্তি লাগে।এই পৃথিবীতে তার একটুও শান্তি লাগে না।কোথায় গেলে একটু শান্তি পাবে সে?গম্ভীর মুখে রাস্তা ধরে হেটে যায়।মা নামের নারীটার উপর তার অনেক রাগ,দুনিয়ার আলো দেখিয়েছে ঠিক কিন্তু সব সুখ কেড়ে নিয়েছে।ফিরোজের বয়স যখন তিন তখন ফিরোজের আম্মা রেবেকা বেগম পরকীয়ায় আসক্ত হয়।সেই পুরুষের হাত ধরেই পরবর্তীতে চলে যায়,ফিরোজকে ভাসিয়ে যায় এক আকাশ দুঃখের মাঝে।ছোট বেলা থেকেই রোজিনা বেগমের অবহেলা,মার,অপমান সহ্য করে এসেছে,একা রুমে বাচ্চাদের মতো ডুকরে কেঁদেছে।যতো বড়ো হয়েছে ততোই নারী জাতির উপরে ঘৃণা জন্মেছে,তার ধারনা তার মায়ের কারণেই তার জীবনের এই ছন্দপতন।

মাঝরাস্তায় গিয়ে শ্যামাকে দেখে দাঁড়িয়ে রাব্বির সাথে কথা বলছে।কাধে ব্যাগ দেখে বুঝলো কলেজে যাচ্ছে হয়তো ফারিয়ার জন্যই দাঁড়িয়েছে।রাব্বির সাথে শ্যামাকে দেখে আর মন খারাপের কালো মেঘ আরো ঘন হলো,না চাইতেই মুখাবয়ব হলো আরো গম্ভীর।মেয়ে মানুষ মানেই খারাপ,এতোদিন পাগলের মতো তার পিছনে ঘুরে এখন আবার রাব্বিকে পেয়ে তার সাথে!ছ্যাহ।শ্যামাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফিরোজ ওদের দিকে তাকালোনা।অন্যদিকে তাকিয়ে চুপচাপ চলে গেলো।না তাকালেও ফিরোজের বুক পুড়লো,শ্যামার পাশে আরেকজনকে ভালো লাগছে না।ভেতরটা জ্বলছে,বুকে ভিষণ জ্বলছে।তার মনটা কি চায় সেটাই এখনো তার বোধগম্য হচ্ছে না।

শ্যামা অবাক হয়ে ফিরোজের হেটে চলা দেখে।আজকে বাইক আনেনি!আর সবচেয়ে বড়ো কথা একবারও তার দিকে তাকায়নি।রাব্বির সাথে দেখেও চেহারা ভাবলেশহীন, গম্ভীর।শ্যামার মন উতলা হয়ে উঠে,বুকে চিনচিন করে উঠে ব্যাথারা।ফিরোজের মন খারাপ কেনো জানতে মন আনচান করে।
ফারিয়া আসলে শ্যামা উশখুশ করে কিভাবে জিজ্ঞেস করবে।তারপর বহু ভেবেচিন্তে বললো,
“ফিরোজ ভাইয়ের বাইক কই;নষ্ট নাকি?”

আজকে ফারিয়ারও মন খারাপ।ফিরোজ তার সৎ ভাই এটা সে কখনো ভাবতে পারে না।তাকে কতো ভালোবাসে ফিরোজ।মায়ের কথায় ফিরোজের গম্ভীর চেহারা দেখে তারও মন খারাপ হয়।
“না। বাইক বাড়িতেই।”

“তাহলে হেটে গেলো কেনো?মনও খারাপ দেখলাম।”

“এমনিতেই।আম্মা একটু বকাঝকা করেছে তাই।”

ফিরোজের আম্মা যে ফিরোজকে পছন্দ করে না পাশাপাশি বাড়ি হয়ে সেটা শ্যামার জানা আছে।শুধু শ্যামা কেনো সবাই জানে।রোজিনা বেগম সবার সাথে যেমন ভালো ব্যবহার করেন ফিরোজের সাথে তেমনি খারাপ ব্যবহার করেন।শ্যামার খারাপ লাগে,ফিরোজের কষ্টটা নিজের মনে হয়।ফারিয়া শ্যামার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো,
“আমার ভাইয়ের এতোকিছু খেয়াল করিস?”

শ্যামা থমথমে মুখে বললো,
“সামনে দিয়ে গেলো তাই জিগ্যেস করলাম।”

সবাই চুপচাপ কলেজে যায়।আসার সময় রাব্বি বলে তাদের দুজনকে খাওয়াবে।কারণ জানতে চাইলে বলে এমনি।শ্যামা দেখে ফিরোজ এখনো হোটেলে আছে।শ্যামা বললো,
“তাহলে বাগদাদ হোটেলে খাওয়া।বাগদাদের রান্না সেই হয়।”

রাব্বি ইচ্ছা ছিলো রেস্টুরেন্টে খাওয়াবে যেহেতু শ্যামাকে পছন্দ করে সুতরাং শ্যামার কথাই ফাইনাল করা হয়।রাব্বি আর ফারিয়া ফিরোজের সাথে টুকটাক কথা বলে খালি টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়,শ্যামা যায় না।চুপচাপ ফিরোজকে দেখছে।ফিরোজ মাথা তুলে তাকালে শ্যামা বললো,
“মন খারাপ?”

ফিরোজ একদৃষ্টিতে শ্যামার দিকে তাকিয়ে আছে।এই মেয়েটার দিকে তাকালে ভালো লাগে,হঠাৎ করেই মনে হলো শ্যামাকে দেখলে তার শান্তি লাগে।বুক চিরবিরয়ে ভালো লাগার সুভাস বয়।কিন্তু শ্যামাও বোধহয় রাব্বিকে পছন্দ করে তা না হলে সারাদিন ছেলেটার সাথে ঘুরবে কেনো?না চাইতেও মুখের ভাব গম্ভীর হয়ে যায়।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“না।”

“আমার মনে হচ্ছে।”

“তোমার তো কতোকিছুই মনে হয়।”

শ্যামা টেবিলের কাছে এসে বললো,
“এমন করে কথা বলেন কেনো?”

“আমি এমনই,তাই এমন করে কথা বলি।”

ফর্সা মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে।শ্যামা এই অহেতুক রাগের কারণ খুঁজে পেলো না।আবার এই হোটেলে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলাও দৃষ্টিকটু।সে আস্তে করে বললো,
“বিকালে দিঘির পাড়ে আসবেন? আমি অপেক্ষা করবো।”

ফিরোজ ত্যাড়া গলায় বললো,
“তুমি বললেই আসতে হবে?”

শ্যামা মিষ্টি করে হেসে বললো,
“হ্যাঁ।”

ফিরোজ কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“আচ্ছা।”

শ্যামা হেটে ফারিয়াদের কাছে চলে যায়।খাবার খাওয়ার পুরোটা সময় ফিরোজ শ্যামার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে,রাব্বি এতোবার তাকাচ্ছে কেনো?

যথারীতি বিকেলে শ্যামা দীঘির পাড়ে যায়।আজকে লাল টুকটুকে জামা পড়েছে।দুরুদুরু বুকে ফিরোজের জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু ফিরোজ আসে না।মাগরিবের আজান পড়লে শ্যামার চোখ বেয়ে পানি পড়ে।অভিমানে মন কেঁদে উঠে।কালকে সে আসেনি তাই উনিও আজকে আসেনি।বদলা নিলো?শ্যামা বাড়ি ফিরে আসে।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ফারিয়ার অনেকগুলো ফোন।দুপুরেই দেখা হলো এখন এতোগুলো ফোনের দরকার কি?এসব ভাবতে ভাবতেই ফারিয়া নিজেই এসে উপস্থিত।শ্যামার হাত ধরে খিলখিল করে হেসে বললো,
“আমি আজকে খুব খুশী।”

বান্ধুবীর হাসিমুখ দেখে শ্যামার মনও ভালো হয়ে যায়।
“এতো খুশীর কারণ কি?”

ফারিয়া হেসে হেসে বললো,
“ফিরোজ ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

যেমন ফারিয়ার মুখের হাসি দেখে তার মন ভালো হয়ে গিয়েছিলো তেমনি ফারিয়ার মুখের কথা শুনে শ্যামার উপর বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো।সে থমকে গেলো তার পুরো পৃথিবী থমকে গেলো।
“কখন?কার সাথে?”

“আজকেই,মুনিয়া আপুর সাথে।আমার যে কি খুশী লাগছে।তোর অগ্রীম দাওয়াত।আমি এখন যাই।সন্ধ্যা হয়ে গেছে আম্মা বকবে।”

ফারিয়া যেমন তুফানের মতো এসেছিলো তেমন তুফানের মতোই চলে গেলো মাঝখান দিয়ে শ্যামাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেলো।শ্যামা চুপচাপ দরজা বন্ধ করে মুখে হাত চেপে কেঁদে দেয়।সে তো মুখে প্রকাশ করেছিলোই যে ভালোবাসে তারপরেও ফিরোজ কিভাবে রাজী হলো!শ্যামা পাগলের মতো কাঁদে।ফোন হাতে নিয়ে ফিরোজকে ফোন দেয় কিন্তু ফোন বন্ধ জানায়।শ্যামার ভঙ্গুর মন ভাবে ফিরোজ তাকে ব্লক করে দিয়েছে।হাত দিয়ে বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরে বললো,
“তোমাকে ছাড়া আমি ম,রে যাবো।এক সেকেন্ডও বাঁচতে পারবো না ফিরোজ।”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে