#মধুমাস
#পর্ব_০৬
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
রিপন কখনো কল্পনাও করেনি এই রাতের আধারে ফিরোজের পাশে শ্যামা থাকবে।দূর থেকে ফিরোজকে ট্রাউজারের পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে আরেক হাতে সিগারেট ফুঁকতে দেখে বাইক থামায় না।ফিরোজের সাথে তার মনমালিন্য আছে।অতিরিক্ত ত্যাড়া এই ফিরোজকে তার অপছন্দ।তার উপর কথাবার্তায় বেয়াদবির ছোঁয়া সর্বদা বিদ্যমান।ফিরোজকে দেখেও রিপন না থেমে বাড়িতে চলে যায়।
রিপন চলে গেলে ফিরোজ চাপা হাসির গলায় বললো,
“মেয়ে মানুষ হয়ে একটা ছেলের সাথে দেখা করতে চলে এসেছে।নির্লজ্জ মেয়ে,রিপনকে বলে দেয়া উচিত ছিলো।”
রাস্তার পাশে মানুষ খড়কুটো শুকিয়ে একসাথে করে জমিয়ে রেখেছে।শ্যামা এর আড়ালেই নিজেকে ঢেকে নিয়েছে।রিপনের বাইকের শব্দ চলে যাবার পরে ফিরোজের কথাগুলো তার কানে যায়।সে ভাবে,কার জন্য সে এতোবড়ো ঝুঁকি নিচ্ছে,রাতে একটা মেয়ে অন্য একটা ছেলের সাথে দেখা করতে আসা যে কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ তা কি ফিরোজ বুঝে?বুঝলে এখনো এসব বলতে পারতো?সে কি একটু বেশীই বেহায়াপনা করছে না?সেদিন অসুস্থ অবস্থায় কেমন নির্দয়ের মতো থাপ্পড় দিলো।বছর দুইয়েক ধরে এমন আগেপিছে ঘুরছে কোনো পাত্তা দেয় না।কথায় কথায় কোন অপমানটা করে না?কিন্তু শ্যামা কোনো কথা গায়ে মাখে না বলেই কখনো কোনো কথার খুত ধরেনি।এই লোকটার কাছে থেকে সে ভালোবাসা চেয়েছিলো আর পেয়েছে কি?অপমান আর কষ্ট।আজকে আবার মালিহার সাথে কেমন করছিলো।শ্যামার হঠাৎ ভিষণ অভিমান হলো।অপমানে ছ্যা ছ্যা করে উঠলো মন,মনটা তিরিবিড়িয়ে বলে উঠলো বইয়ের মতো নিজের মন বিছিয়ে দিয়েছিস বলেই ফিরোজ মূল্য দিচ্ছে না নিজেকে শক্ত খোলসে বন্ধ করে রাখলেই দেখতি ঠিক খুলতে চাইতো,মূল্য দিতো।
ফিরোজ নিজের মতো করেই সিগারেট খাচ্ছে।শ্যামা গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে আসে।ফিরোজ কিছুই বলে না যেনো সে থাকা না থাকাতে তার কিছুই আসে যায় না।শ্যামার মনে হলো এই সামনে দাঁড়ানো পুরুষটার মন শক্ত কোনো পাথর দিয়ে তৈরি।শ্যামা সেদিকে তাকিয়ে শক্ত কঠিন গলায় বললো,
“আমাকে সেদিন মা,রলেন কেনো?”
ফিরোজ শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে।মেয়েটা এখনো মনে রেখেছে?সে তো সরি বলেছিলো।
“বেয়াদবি করেছো বলে।”
“এটা বেয়াদবি!আর বেয়াদবি হলেও থাপ্পড় দিতে হয়?বুঝিয়ে বললেই হতো।”
“এতোটা জোড়েও দেইনি,হালকা পাতলা করে দিয়েছি যেনো ব্যথা না পাও।তুমি জানো আমি মেয়েদের পছন্দ করিনা।”
শ্যামা ঠোঁট চেপে মুচকি হেসে বললো,
“মুনিয়া আপু মেয়ে না?”
ফিরোজ হাতের সিগারেট গাছের সাথে চেপে নিবিয়ে দেয়।
“তুমি জেলাস নাকি?”
ফিরোজের এমন ভাবলেশহীন কথাবার্তা শুনে শ্যামা কান্না আসে।এই লোকটার কথায় কোনো অনুভূতি নেই।সারাক্ষণ তাকে অপমান করার পায়তারা করে।
“জেলাস হতে যাবো কেনো?”
ফিরোজ ঠিক জায়গায় কথাটা বলতে পারলো,
“কেনো মধুমাসে যেতে হলে তো জেলাসি থাকারই কথা,খারাপ মেয়েদের জেলাসি হওয়াই স্বাভাবিক।”
শ্যামার অভিমানী মন যেমন ভালোবাসায় কাতর হতে পারে তেমনি অভিমানে হঠাৎ করেই কুকড়ে যেতেও দ্বিধা করে না।তার মনে হচ্ছে ফিরোজকে আর নিজের অনুভূতির বহর দেখানো উচিত হয়নি।এমন পাগলামি করে বলেই ফিরোজ তাকে সস্তা ভাবে,আর এক ক্ষেত্রে সে নিজেই নিজেকে সস্তা বানিয়ে দিয়েছে।অন্ধকারের অভিমানী বালিকার চোখ বেয়ে পানির চিকন স্রোত নেমে যায় যা ভাবলেশহীন ফিরোজের অজানাই থেকে যায়।শ্যামা গম্ভীর গলায় বললো,
“আসলে আপনার সাথে দুষ্টুমি করেছিলাম।আর আমি জেলাস হবো কেনো?মুনিয়া আপুর সাথে শুধু লুডু খেলা না বিয়ে করে নিলেও আমার সমস্যা নেই,আজকে থেকে আর জ্বালাবো না।”
শ্যামা দাঁড়ায় না দ্রুত পায়ে বাড়িতে চলে যায়,তার ভাই যে কোনো মুহূর্তে তাকে খুঁজতে পারে।ফিরোজ অবাক হয়ে শ্যামার চলে যাওয়া দেখে।হঠাৎ কি হলো? শ্যামার কথাগুলো কি সত্যি ছিলো নাকি রেগে বলেছে।ফিরোজের মন প্রতিবাদ করে বললো’শ্যামার কথা মিথ্যা হোক,শ্যামা আশেপাশে থাকলেই ভালো লাগে,লিলুয়া বাতাস গা ছুঁয়ে যায়।’মনের কথা শুনে ফিরোজ বললো,
‘তাতে কি আশে যায়?আমি যে মেয়েই পছন্দ করিনা।’
মন হিসহিসিয়ে ভয়ংকরভাবে হেসে উঠে,’তুই যে কি পছন্দ করিস সেটা তুই নিজেও জানিস না।’
‘আর জ্বালাবো না’ফিরোজ মাথা নেড়ে হাটতে হাটতে বললো’বললেই হলো জ্বালাবো না?আর না জ্বালালেই কি?আমার কচু হবে।আমাকে ভ,য় দেখায়।’
যদিও ফিরোজ বললো কচু হবে কিন্তু তারই কি যানো হয়ে গেলো।শ্যামাকে দেখার আশায় বুকে কেমনতর খরা লাগে।হাস-ফাস করে কিন্তু এর কারণ খুঁজে পায় না।ফিরোজ বুঝলো না কি কারণে শ্যামা এমন করছে।ফিরোজের মন ঠোঁট বাকিয়ে হাসে,’এটাই তো চেয়েছিলি।’ফিরোজ নিজের মনের প্রশ্নের উত্তর নিজে খুঁজে বেড়ায়।সে কি শ্যামাকে দূরে সরাতেই চেয়েছে?তাহলে এমন ছটফট লাগছে কেনো?
শ্যামা তার কথা রেখেছে।কষ্ট হলেও ফিরোজের কাছে আসেনি,কথা বলেনি কিংবা অসভ্যতামি করার চেষ্টা করেনি।কিছুদিন পরে এক সকালে ফারিয়ার সাথে প্রাইভেটে যাচ্ছিলো তখন রাস্তায় ফিরোজকে দেখতে পায়।শ্যামা একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিলো তখন দুজনের চোখের মিলন হয়ে যায়।শ্যামা চুপচাপ ফিরোজকে পেরিয়ে আসে।লোকটার কাছে আসলেই হৃদপিণ্ড বেশামালভাবে লাফায়,ইচ্ছে করে ফিরোজের বুকে বিড়ালছানার মতো ঘাপটি মে,রে মিশে থাকতে কিন্তু সব ইচ্ছা কি আর পূরণ হয়?শ্যামার এই অমনোযোগী,বেখেয়ালিভাব ফারিয়ার নজর এড়ায় না।
“কিছুদিন ধরে তোকে অন্যরকম লাগছে।”
শ্যামা নিজের মন খারাপ লুকোতে চায়।হেসে বললো,
“কি রকম?”
“মনম,রা,বিষন্ন।”
শ্যামা হাসে।হাসির সৌন্দর্যে ফারিয়াকে কথা ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
“আরে কিছুনা।”
ফারিয়া সন্ধানী চোখে বললো,
“প্রেম ট্রেম করিস নাতো?”
“করলে তুই জানতি না?”
ফারিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস শ্যামা প্রেম করলে সে অবশ্যই জানবে।
“তা জানতাম।”
দুজনে নানান প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে কলেজে যায়।ফিরোজ দূর থেকে শ্যামার যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।মেয়েটার এমন এড়িয়ে চলা তার ভালো লাগছে না।মনে হচ্ছে বুকে কেউ কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে,শ্যামার প্রানোচ্ছল চাহনিতেই সে অভস্থ এখন এই শ্যামাকে অপরিচিত লাগছে।অথচ এমন অনুভূতি হওয়ার কথা ছিলো না বরং শ্যামার এই ব্যবহারে খুশী হওয়ার কথা ছিলো,হচ্ছে উল্টোটা।
রাব্বি শ্যামাদের সমবয়সী,পড়েও এক ক্লাসে।রাব্বি মনে মনে শ্যামাকে পছন্দ করে কিন্তু ভয়ে বলতে পারে না।শ্যামা খুবই রাগী মেয়ে প্রেমের কথা বললে আবার কি বলে ফেলে।কিন্তু কথায় আছে না মানুষ যাকে পছন্দ করে তার সাথে থাকতেই বেশী পছন্দ করে রাব্বিও এমন।শ্যামার সাথে থাকতে তার ভিষণ ভালো লাগে,কারণে অকারণে সে শ্যামার আশেপাশে ঘুরে।রাব্বি মখে কিছু না বললেও শ্যামা আর ফারিয়া দুজনেই বুঝে রাব্বির মতলব।শ্যামা বুঝেও নির্বাক,ফিরোজকে ভালোবেসেছে যদি ফিরোজকেই না পায় তাহলে আর কাউকে চাই না।আজকে কলেজ থেকে আসার পথে শ্যামাদের সাথে রাব্বিও আসছিলো।তিনজনে কলেজের পিকনিক নিয়ে আলোচনা করছিলো।রাব্বি হাটার ফাঁকে ফাঁকেই শ্যামাকে দেখছিলো।
ছেলেদের চোখের দৃষ্টি আরেক ছেলে ঠিক বুঝতে পারে।তেমনি রাব্বির চোখের ভাষা ফিরোজের চোখ এড়ায় না।শ্যামার দিকে তাকিয়ে দেখে সেও কেমন হেসে হেসে কথা বলছে।না চাইতেও ফিরোজের হাতের মুষ্ঠি শক্ত হয়।হাত দিয়ে বাইকের চাবি খামচে ধরে।
শ্যামা মূলত ফিরোজকে দেখেই রাব্বির সাথে বেশী হেসে কথা বলেছে।কেনো বলেছে জানা নেই কিন্তু ফিরোজকে দেখিয়ে কথা বলতে কেমন ভালো লাগছিলো।
ফারিয়া স্কুল থেকে ফিরার পরে ফিরোজ তাকে রুমে ডাকে।ফারিয়া ভাইয়ের খাটে গিয়ে বসে,পা দুলিয়ে বললো,
“কি?”
ফিরোজ ফ্লোরে শুয়ে আছে।গরমকালে ফ্লোরে শুয়ে থাকতেই তার ভালো লাগে।ফিরোজ শক্ত গলায় বললো,
“আজকে একটা ছেলে দেখলাম তোর সাথে।”
ফারিয়া বললো,
“রাব্বি আমার ক্লাসমেট।”
ফিরোজ গম্ভীর গলায় বললো,
“ক্লাসমেট নাকি প্রেমও করিস?”
ভাইয়ের কথায় ফারিয়া চমকে উঠে।দুই হাতে গালে তওবা করে বললো,
“আসতাগফিরুল্লাহ ভাইয়া।এসবে আমি নেই,রাব্বি তো শ্যামার পাগল।”
আসল কথায় আসাতে ফিরোজ উঠে বসে।
“তাই নাকি?শ্যামাও রাজী?”
ফারিয়া ভাবুক গলায় বললো,
“না মনে হয়।কিন্তু শ্যামাকে আজকাল বুঝতে পারি না।”
“আচ্ছা।”
ফারিয়া চলে গেলে ফিরোজ রেডী হয়।পায়ে স্যান্ডেল চাপিয়ে শ্যামাদের বাড়ির রাস্তায় যায়।মোবাইল হাতে নিয়ে শ্যামাকে ফোন দেয়।শ্যামা ফোন রিসিভ করে না,কেটে দেয়।ফিরোজ বিরক্ত হয়ে হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে আবারো ফোন দেয়।শ্যামা রিসিভ করে বললো,
“বারবার ফোন দিচ্ছেন কেনো?”
ফিরোজ শ্যামার এমন তেতে উঠা কন্ঠে অবাক হলো।
“দরকার তাই ফোন দিয়েছি।”
শ্যামা চাপা গলায় বললো,
“একটা ছোট বাচ্চার সাথে ত্রিশ বছরের বুড়োর কি দরকার থাকতে পারে?”
ত্রিশ বছরের বুড়ো!ফিরোজ মোবাইল কানে রেখেই নিজের শরীরের দিকে তাকায়,শক্তপোক্ত পেটানো শরীর কোনোদিন দিয়ে তো বুড়ো মনে হচ্ছে না।তাহলে এই মেয়ে বুড়ো বলে কেনো?
“আমি বুড়ো?”
শ্যামা কথা বলেনা।ফিরোজ বললো,
“আমি তোমার বাড়ির সামনে আছি।”
শ্যামার মনে লিলুয়া বাতাস হুড়মুড়িয়ে ডুকে কিন্তু নিজেকে চুপ করিয়ে দেয়।উনি আসলেই কি?সেদিনের মতো অপমান করতে ডাকছে?চুপ থেকে বললো,
“তো কি করবো?”
শ্যামার কথায় ফিরোজ অবাক হয়।তার ধারনামতে শ্যামার ছুটে আসার কথা।
“দেখা করো।”
“না।”
ফিরোজ বেপরোয়া হয়ে বললো,
“না!না কেনো?বেয়াদবি করোনা শ্যামা।”
এই লোকটা তাকে ভালোবাসে না কিন্তু কেমন উতলা গলায় কথা বলছে।সে গম্ভীর গলায় বললো,
“বেয়াদব,অসভ্যের সাথে কথা বলার জন্য এতো শখ কেনো ফিরোজ ভাই?”
“এতো পকপক না করে আসো।”
শ্যামা ত্যাড়া গলায় বললো,
“আপনি ডাকলেই আসতে হবে?”
ফিরোজের মুখের ভাব শক্ত হয়।এতো কথা বলছে কেনো এই মেয়ে?
“কে ডাকলে আসবে?রাব্বি?”
শ্যামা মুচকি হেসে বললো,
“আপনার কি তাতে?”
“সমস্যা আছে।”
“বেয়াদবের কাজকর্মে আজকাল নেতার সমস্যাও হয় দেখি।”
ফিরোজ চেপেচেপে বললো,
“ছেলেদের সাথে এতো কথার দরকার কি?তুমি আসলেই বেয়াদব।”
শ্যামা বললো,
“ফিরোজ ভাই,আপনার কি জ্বলে?”
চলবে…..