ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
166

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট

রাত বাড়ছে। চাঁদের আলো পরিষ্কার হয়ে আসছে। আকাশে ঘন-কালো মেঘের ছড়াছড়ি। অথচ চাঁদের গায়ে একবিন্দু মেঘের দেখা নেই। সে নিজস্ব ধারার জোছনা বিলিয়ে যাচ্ছে। ঈশান কোণে হালকা মেঘের গর্জন ভেসে আসছে। বৃষ্টি নামতে পারে। আত্মীয় স্বজনদের বেশিরভাগই বাড়ি ফিরে যায়নি। মেঝেতে বিছানা করা হয়েছে। উঠানে বড় হাঁড়িতে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। এই মুহূর্তে বাড়ির পরিবেশ দেখলে মনেই হবে না এখানে কোন শোক আছে। এই বাড়ির কোন মানুষ মা’রা গেছে। বিকেলে ফুফু কাঁদছিল। সে কি কান্না! চিৎকার শুনলে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। এখন অবশ্য ফুফুর কান্না থেমে গেছে। কোমরে কাপড় বেঁধে রান্নার তদারকি করছে। কয়েকজন বাচ্চা উঠানে দৌড়াদৌড়ি করছে। উৎসবমুখর পরিবেশ।
সবার চোখের আড়ালে বেশ খানিকটা দূরে চলে গেলাম। আমার এসব ভালো লাগছে না। অন্ধকারে মধ্যে বেতের চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে আছি। হঠাৎই দারোগা সাহেব একটা চেয়ার নিয়ে এসে আমার পাশে বসলেন। কোমল গলায় বললেন, “খারাপ লাগছে?”

“না, আমি ঠিক আছি। আপনি ফিরে যাননি?”

“যেতে চেয়েছিলাম। তোমার ফুফু যেতে দেয়নি। খাওয়া-দাওয়া করে যেতে বলল।”

“ওহ আচ্ছা।”

“তোমার বলেছিলাম না- আমার তোমার প্রতি এক ধরনের দূর্বলতা আছে?”

“হ্যাঁ বলেছিলেন।”

“কারণটা জানতে ইচ্ছে করেনি?”

“করলেও কি আপনি বলবেন?”

“হ্যাঁ বলব। তোমার মা’কে আমি খুব পছন্দ করতাম। বলতে পারো ভালোবাসতাম। কিন্তু ”

“মাকে নিয়ে কিছু শুনতে চাই না। আমার কাছে মা এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ। তারপর এখন তিনি বেঁচে নেই। দয়া করে তাকে নিয়ে কোন বাজে কথা বলবেন না।”

দারোগা সাহেব হাসলেন। শান্ত গলায় বললেন, “তুমি ঠিক বলেছ। তোমার মা সত্যিই খুব ভালো মানুষ। আমি তাকে বদনাম দিচ্ছি না।”

“তাহলে?”

“তাকে আমি ভালোবাসতাম ঠিকই! তবে আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিল না। প্রেম আলাপ হতো না।”

“আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।”

“এক তরফা ভালোবাসার নাম শুনেছ? আমার ক্ষেত্রেও তাই। যেদিন প্রথম তাকে ভালোবাসার কথা জানালাম সেদিন সে বলল তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহে বিয়ে। তোমার মামাদের অনেক অনুরোধ করেছি। লাভ হয়নি। সেদিন রাতের কথা মনে আছে? তোমার মামারা আমাকে মে’রে ওখানে ফেলে রেখে গেছিল। সারারাত ওখানেই পড়ে ছিলাম। পরেরদিন লোকজন ধরে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। শারিরীকভাবে সুস্থ হয়ে উঠি। চাকরি পাই। কিন্তু মানসিকভাবে ঠিক হতে পারিনি।”

“কেন পারেননি?”

“নিজের ওপর প্রচন্ড ঘৃণা হয়। কেন কয়েকদিন আগে তাকে নিজের মনের কথা বলতে পারলাম না? শুধু তাই নয়। আমার জন্য তোমার মামারা তোমার মা’কেও অনেক মে’রে’ছিল। দু’দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। এসব কারণে নিজেকে আজও ক্ষমা করতে পারিনি।”

“বিয়ে করেছেন?”

“না। এমন অদ্ভুত জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে ইচ্ছে করেনি। একজনের স্মৃতি নিয়ে বেশ সুখে আছি। এক পলকের স্মৃতি নিয়েও যে বেঁচে থাকা যায় তা নিজেকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।”

“একটা কথা জানতে চাইবো?”

“বলো।”

“মামা খুঁজে খুঁজে আপনাকে আমার কে’সের দায়িত্ব দিলো কেন?”

“এই থানার দারোগা হিসাবে কেসের দায়িত্ব আগে থেকেই আমার ওপর ছিল। পরে তোমার মামা কল দিয়ে তোমার পরিচয় বললেন। এই আর কি!”

“আমার ওপর আপনার কিসের দূর্বলতা?”

“তোমাকে তোমার মায়ের মতো দেখতে। এটাই আমার দূর্বলতা।”

হাসলাম। আমার খুব ক্লান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে এই বেতের চেয়ারের ওপরই আমি ঘুমিয়ে পড়ব। দাদি মা’রা যাওয়ার পর আমার মাঝে মাঝে এরকম হয়। নিজেকে অসহায় এবং খুব ক্লান্ত মনে হয়। আশেপাশে কোথায় কি হচ্ছে, কে কি বলছে কিছু বুঝতে পারি না। কারোর কথাবার্তা কানে আসে না। নিজেকে খুব একা মনে হয়। এইতো দারোগা সাহেব এখনও আমার পাশে বসে আছেন। সমান তালে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছেন অথচ তার কোন কথা আমার কানে আসছে না। মায়ের গলা শুনতে পাচ্ছি। তিনি খুব আদর করে আমার নাম ধরে ডাকছেন। বাবা ফয়সাল! এতো সুন্দর করে কি কেউ কখনও আমার নাম ধরে ডেকেছে? মনে পড়ে না। পানির শব্দ কানে বাজছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ নদীর বুক চিরে দাঁড় বাইছে।

বেলা করে ঘুম ভাঙলো। ঘড়িতে সকাল নয়টা বাজে। ফুফু বলল, “কাল রাতে কি তোর শরীর খারাপ লাগছিল? ওভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলি কেন?”

মাথা নাড়ালাম। আমার কিছু মনে পড়ছে না। শেষবার দারোগা সাহেবের সাথে কথা বলছিলাম তারপর আর কিছু মনে নেই। ফুফু চিন্তিত গলায় বলল, “তুই ঘুমিয়ে পড়ার পর দারোগা সাহেব কোলে করে খাটে দিয়ে গেলেন। তুই কি কিছু ঠিক পাসনি?”

“না। আমার কিছু মনে নেই। সবাই চলে গেছে?”

“না। আজ মা’য়ের নামে মিলাদ পড়ানোর কথা আছে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে যে যার বাড়ি যাবে।”

“তুমিও ওদের সাথে এ বাড়ি থেকে চলে যেও ফুফু। আমি তোমাদের কারো সাথে থাকতে চাই না।”

ফুফু আৎকে উঠলো। ভেজা গলায় বলল, “তিশা এখানকার কলেজে পড়ে, শিমুল তালেবের স্কুলও এখানে। তোর ফুফা নেই। এই অবস্থায় আমি কোথায় গিয়ে থাকব?”

সহজ গলায় বললাম, “সে কথা জানার কোন ইচ্ছে আমার নেই। তোমাদের ব্যাপার তোমরাই ভালো বুঝবে।”

“সে না হয় আমরা চলে গেলাম। কিন্তু তুই? তুই কি একা একা এই বাড়িতে থাকতে পারবি? কে রান্না করে খাওয়াবে তোকে?”

“আমি যেহেতু একা। সেহেতু একা থাকতেও পারব। আজ তোমার আমায় কে রান্না করে খাওয়াবে তার চিন্তা হচ্ছে। অথচ যেদিন আমাকে জে’লে নিয়ে গেল। সেদিন কি একবারের জন্য ও চিন্তা হয়েছিল? বাকিরা না হয় অন্যরকম। কিন্তু তোমার সাথে তো আমার র’ক্তের সম্পর্ক আছে। আমি তোমার আপন ভাইয়ের ছেলে। মা বাপ ম’রা এতিম মানুষ। একবারের জন্য হলেও কি আমায় দেখতে যেতে পারতে না? সত্যি বলতে কি? সবাই স্বার্থপর। আজ তুমি আমার প্রয়োজনে আমার সাথে থাকতে চাইছ না। নিজের প্রয়োজনে চাইছ। আমি সবাইকে মাফ করে দিতে পারি। ফুফা, ছোট দাদি, তুলি আন্টি, শিমুল তালেব সবাইকে। শুধু তোমাকে কখনও মাফ করতে পারব না। পারলে তুমি আমায় মাফ করে দিও।”

ফুফু কিছু বলল না। মাথা নিচু করে রইলো। চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে আসছে। এখন আর পানি বন্ধ করার কোন উপায় নেই। আমি ইমোশনাল হতে চাই না। এদের জন্য কাঁদতে চাই না।
চোখ জোড়া শুকিয়ে যাক,
মুছে যাক অশ্রুকণা।
যে আমার জন্য কাঁদে না,
আমিও তার জন্য কাঁদব না!
চোখ মুছে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বারান্দার অনেকখানি জায়গায় সূর্যের আলো পড়েছে। গোটা ঘটনায় শুধু ওই হাত কা’টা লোকটার জন্য আমার আফসোস হচ্ছে। বেচারা কোন দো’ষ না করেও মারাত্মকভাবে ফেঁসে গেল। দাদি মা’রা যাওয়ার পর তার লা’শে ছু’রি ঢুকিয়ে রেখে গেল। লোকজন নিয়ে জায়গাটা পাহারা দিয়ে রাখল যেন কেউ আসতে না পারে। দিনশেষে তার কোন লাভ রইল না। মানুষের জীবন বড্ড অদ্ভুত!

মিলাদ শেষ হয়ে গেছে। দারোগা সাহেব এসেছেন। হয়তো ফুফু উনাকে দাওয়াত দিয়েছে। সবকিছু মিটে যাওয়ার পর ফুফু আমাকে নিজের কাছে ডাকলো। সহজ গলায় বলল, “আমি যা করেছি তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার কোন ভাষা আমার জানা নেই। ধরতে গেলে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি। স্বামী, শশুর বাড়ি, মা, ভাইপো। সবাই আমায় ছেড়ে চলে গেছে। আমি কাউকে ধরে রাখতে পারিনি। তোর সাথে আমার সম্পর্ক কখনও স্বাভাবিক হবে না। তাই আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেখানে আশ্রয় হয় সেখানেই না থাকব। খেতে পেলে খাব না পেলে না খেয়ে দিন কাটবো। তবুও তোর সাথে থাকব না। এই বাড়ি তোর। বাড়ি নিয়ে ভালো থাকিস।”

ফুফু নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি তাদের ডাকলাম না। বিবেকের বিপক্ষে গিয়ে মনের আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়ার কোন মানে হয় না। তিশা আপু যাওয়ার সময় দু’বার পিছন ফিরে তাকিয়েছিল। চোখ সরিয়ে নিয়ে গেছি। এই মানুষটা আমায় কখনও খারাপ জানেনি। সবসময় নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবেসেছে। আপু হয়তো জানতো সে একবার বললেই আমি তাদের রেখে দেবো। সেজন্যই কিছু বলেনি। সদর দরজা লাগিয়ে দিয়ে গিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ধরনীর বুকে রাত নামছে। রাত নামছে আমার জীবনেও। সবকিছু থাকার পরও আজ আমি একা। বিশাল বড় এই বাড়িতে ধুকে ধুকে ম’র’লেও কেউ আমাকে দেখতে আসবে না। তেষ্টায় কাতর হয়ে চিৎকার করলেও এক গ্লাস পানি পাওয়া যাবে না। অঢেল সম্পদের মাঝে ঢুবে থাকা অসহায় প্রাণ আমি। তবে কি কিছু ভুল করলাম? ফুফুকে মাফ করে দিয়ে আমার কাছে রেখে দেওয়া যেত না? ক্ষমা যে মহৎ গুন। কেন পারলাম না আমি? দুষ্টু গরুর থেকে শূন্য গোয়াল ভালো- এ কথাটা আমার মা বলতেন। এই কথাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি বিধায়ই পারিনি। দারোগা সাহেবের সাথে কথা হয়েছে -উনি আমার সাথে ব্যাংকে যাবেন বলেছেন। কিছু টাকা তুলতে হবে। ফুফুর হাতে হয়তো টাকা-পয়সা নেই। তাকে কিছু দেবো। নিজের জন্যও কিছু রাখতে হবে। রান্নার লোক খুঁজতে হবে। দাদির ক’ব’রের পাশে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া হয়নি। অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। দিনের আলো ফুটতেই কাজ শুরু করতে হবে। সত্যিই কি আমার জীবনে নতুন সূর্য উঠবে? নাকি নিকষ কালো রাতের মতো আঁধারে ডুবে থাকবে এ জীবন! হয়তো ভালো কিছুই হবে। দারোগা সাহেব বলেছেন- আমায় দত্তক নিবেন। আঠারো বছর পর্যন্ত নাকি দত্তক নেওয়া যায়? সত্যি মিথ্যা জানি না। তবুও আশায় বুক বাঁধতে ইচ্ছে করে। সুন্দর স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। এটাই যে জীবন। সে তো নদীর মতে বহমান।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে