ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-১১

0
128

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -১১

দারোগা সাহেব হাসলেন। সে হাসিতে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। ভয়ে শরীর জমে আসে। ভীতু গলায় বললাম, “কাকে মা’র’তে চাইছেন? আমাকে?”

দারোগা সাহেব অট্টহাসি দিয়ে বললেন, “তোমাকে মে’রে আমার কি লাভ? আমি তো তোমার মা’কে মা’র’তে চাইতাম। যে মেয়ে আমার গোটা জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। তাকে কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না। কিছুতেই না।”

“মা বেঁচে নেই। অনেক আগেই পৃথিবীতে ছেড়ে চলে গেছে। তার ওপর আপনার কিসের এতো রাগ? কি করেছে আমার মা?”

দারোগা সাহেব হড়বড় করে বললেন, “জানি আমি। সবকিছু জানি।”

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। কি বলবো কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার অভিধানে এখন একটা শব্দ ঘুরে বেড়ায় -বুঝতে পারছি না। মাঝেমধ্যে নিজের ওপরই বিরক্ত লাগে। কেন আমি কিছু বুঝতে পারি না? সবকিছু কেন এলোমেলো হয়ে যায়? দারোগা সাহেব কিছু না বলে হনহনিয়ে মাঠের মধ্যে চলে গেলেন। কৌতুহল বশত আমিও উনার পিছন পিছন গেলাম। লোকটার আচরণ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। অদ্ভুত ব্যবহার করছে। যেন উনি মানসিকভাবে সুস্থ নেই। একটা কলাগাছের ওপর ক্রমাগত ছু’রির আঘাত করছে, বিড়বিড় করে কিছু বলছে। সেসব কথার ধরন খুব হালকা, বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায়।

চাঁদের আলোয় খোলা মাঠের নিচে দারোগা সাহেবকে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে। সুস্থ মানুষ মনে হচ্ছে না। খানিক বাদে উনি ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। বিস্মিত গলায় বললাম, ” ঠিক আছেন আপনি? এমন ব্যবহার করছেন কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”

দারোগা সাহেব মাথা নাড়লেন। অস্পষ্ট গলায় বললেন, “আমি ঠিক আছি। গাড়িতে গিয়ে বসো। দ্রুত যাও।”

উনার সাথে কথা বাড়ালাম না। তড়িঘড়ি করে এসে গাড়িতে বসলাম। ভয় কিংবা আতঙ্ক কোনটাই কাটেনি। ঘন্টা খানেক বসে থাকার পর দারোগা সাহেব ফিরলেন। গাড়িতে বসতে বসতে অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, ” ফয়সাল, তুমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলে তাই না?”

মাথা নাড়ালাম। তিনি বললেন, “এটা আমার খুব পুরনো একটা রোগ। মাঝেমধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হয়। কয়েকটা ওষুধ নেওয়া লাগে। এ মাসে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি্ দু’দিন ধরে ওষুধ নেওয়া হচ্ছে না৷ সেজন্য খানিকটা ওলটপালট হয়ে পড়েছিলাম৷ তোমার কোন ক্ষতি করিনি তো?”

সরল গলায় বললাম, “না। আমার কিছু করেননি। আমি ঠিক আছি।”

” সত্যি বলতে কি? এই পৃথিবীতে অনেক কিছু আবিষ্কার হলেও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার মেশিন তৈরি হয়নি। সাইকিয়াট্রিস্ট আমায় অনেক কিছু বুঝিয়ে বলে, আমিও উনার কথা বুঝতে চেষ্টা করি। নিয়ম-কানুন মেনে চলি। তারপরেও আমি তো একটা মানুষ! কত সময় আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি বলো?”

দারোগা সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। কি বলবো বুঝতে পারলাম না। খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর দারোগা সাহেব বললেন, “তুমি হয়তো আমার কথা বুঝতে পারছ না। অবশ্য গোটা ঘটনা না শুনলে বুঝতেও পারবে না৷”

“বলুন আমাকে। আমি বুঝতে চাই। কোথায় কষ্ট আপনার?”

দারোগা সাহেব শব্দ করে নাক ঝাড়লেন। টিস্যু পেপার দিয়ে হাত মুছতে বললেন, “তুমি বাচ্চা মানুষ। তোমায় সবকিছু বলা ঠিক হবে না। শুধু জেনে রাখো আমাকে তোমার মামা এই কে’সের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। উনি জানতেন তোমার প্রতি আমার অন্য ধরনের দূর্বলতা আছে। সেজন্যই দিয়েছিলেন। যেন আমি সবটুকু দিয়ে তোমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করি।”

“আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। মামা আপনাকে আমার দায়িত্ব কেন দিবে? উনি চাইলে তো সরাসরি আমার সাথে দেখা করতে পারতেন।”

“এতদিন খোঁজখবর না নেওয়ার পর হুট করে এসে দেখা করা যায় না। অন্তত তোমার মামা এমনটা মনে করেননি।”

“মামা কেমন আছে? শেষবার মা’য়ের সাথে গেছিলাম। তারপর আর যাওয়া হয়নি।”

দারোগা সাহেব কিছু বললেন না। গাড়ি চালাতে লাগলেন। মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষ পুলিশ চাকরি করে? কিভাবে? নাকি কেউ উনার এই সমস্যার কথা জানে না? কোন বিষয়ে অতিরিক্ত কৌতুহল ভালো না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। দারোগা সাহেব আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে সহজ গলায় বললেন, “পরে কখনও দেখা হলে আমার জীবনের গল্প বলবো। ভালো থাকবে।”

ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম, “আমার প্রতি আপনার কিসের দূর্বলতা? কি হন আপনি আমার?”

দারোগা সাহেব জবাব দিলেন না। শুধু হাসলেন। তারপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলেন। এক দৃষ্টিতে গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আজ হঠাৎ অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। এ অনুভূতি বলে প্রকাশ করা যায় না।
শান্ত পায়ে বাড়ির ভেতরে যেতে লাগলাম। এতদিন হয়ে গেছে দাদির লা”শ পাওয়া যায়নি। পুলিশেরা লা’শ দেয়নি। দাফন কাফন করা হয়নি। কেন দেয়নি বুঝতে পারছি না। দারোগা সাহেবকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করার দরকার ছিল। করা হয়নি। আজ-কাল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মনে থাকছে না। ফুফু সোফার কোণায় বসে ছিল। আমায় দেখে স্বাভাবিক গলায় বলল, ” দারোগা সাহেব দিয়ে গেলেন?”

মাথা নাড়ালাম। মুখে কিছু বললাম না। ফুফু বলল, ” হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নে। রান্না শেষ হলে খেতে ডাকছি।”

ফুফুর ব্যবহারে আশ্চর্য হলেও মুখে কিছু বললাম না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরে চলে এলাম। বহুদিন বাদে নিজের বিছানায় শুয়ে আছি। সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। হয়তো স্বপ্নটা সুন্দর নয়, তবে বিষাক্তও নয়। শূন্যতা আছে, পূর্ণতা নেই। তবুও খুব একটা খারাপ লাগছে না। রাতের খাওয়ার সময় ছোট দাদি বললেন, ” ফয়সাল, আমার ছেলেটা তো জে’লে চলে গেল। আমাদের একটু দেখে রাখবা? বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছি।”

শান্ত গলায় বললাম, “আমি কিভাবে দেখে রাখবো? দেখে রাখার বয়স হয়নি আমার। আমি কখনও আপনাদের ক্ষতি চাইনি। তারপরও তো আপনারা আমায় আপন ভাবতে পারেননি।”

ফুফু বলল, “আমাদের ভুল হয়ে গেছে বাবা। তোর ফুফা বুঝতে পারেনি।”

“হাসালে! সত্যিই হাসতে ইচ্ছে করলো। ফুফা কি বাচ্চা ছেলে যে বুঝতে পারেনি? এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ফুফু। আমি তোমাদের আপন মনে করতাম। কিন্তু তোমরা তা করোনি। দাদিকে পর্যন্ত আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছ। তোমাদের ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠে না।”

ফুফু বিস্মিত গলায় বলল, “তার মানে? কি বলতে চাইছিস তুই?”

“কিছুই বলতে চাইছিলাম না। তবে তোমরা যখন নিজে থেকে জানতে চাইলে তখন বলছি- তোমাদের সাতদিন সময় দিলাম। এই বাড়ি থেকে চলে যাবে। কোথায় যাবে কি করবে কিছু জানার ইচ্ছে আমার নেই। আমি শুধু জানি তোমাদের এই বাড়িতে রাখলে আমি একদমই নিরাপদ থাকবো না।”

“আমাদের কাছে তুই নিরাপদ থাকবি না?”

“না থাকব না। এতদিন দাদি থাকার পরও কি নিরাপদ ছিলাম? ছিলাম না। শোনো ফুফু, তুমি খুব ভালো করেই জানো এই বাড়ি আমার। অন্তত দাদার উইল অনুযায়ী এই বাড়ির মালিক আমি। তাছাড়া আমার বাবার সব সম্পত্তির মালিকও আমি। দাদা তোমার অংশ আগেই তোমাকে দিয়ে দিয়েছে। কাজেই আমার সম্পত্তির একটা কানাকড়িও তোমরা পাবে না।”

ফুফু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের ভাব। আমি এমন কিছু বলব তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। ফুফুর চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললাম, “এসব সম্পত্তি নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। কখনও ভাবিনি তোমরা সম্পত্তির মোহে পড়ে র’ক্তের সম্পর্কের মূল্য দেবে না।”

ফুফু আমতা আমতা করে বলল, “তোর ফুফা যা করেছে তাতে আমি খুব লজ্জিত রে বাপ। এসব বলে আমার কষ্ট বাড়িয়ে দিস না।”

“কষ্ট? লজ্জা? সবসময় ফুফার হয়ে সাফাই গাইতে তখন তোমার কোন লজ্জা ছিল না? আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর একবারও বলেছিলে আমি এমন কিছু করতে পারি না। বলোনি। সবসময় ফুফার হা তে হা বলেছ, না তে না মিলিয়েছ। এখন কুমিরের কান্না কেঁদে কোন লাভ হবে না।”

শিমুল তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “মায়ের সাথে ঠিকভাবে কথা বল ফয়সাল। না হলে তোর খবর করে দিবো।”

মুচকি হেসে বললাম, ” কি খবর করবি আমার? আমার গায়ে যদি ফুলের টোকাও লাগে পুলিশ এসে তোদের সবাইকে জে’লে নিয়ে যাবে। দারোগা সাহেবকে বলে সেই ব্যবস্থা করে এসেছি। আর একটা কথা, এটা আমার বাড়ি। তুই আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমায় হুমকি দিতে পারিস না। এক্ষুনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা।”

শিমুল খাবার ফেলে উঠে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফুফুর দিকে তাকিয়ে ফোসফাস করতে করতে ঘরে চলে গেল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করে খেতে শুরু করলাম। ছোট দাদি বললেন, “দাদু ভাই তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। তাই বলে এতো তাড়াহুড়ো করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না। আমরা তোমার নিজের লোক।”

“না, আপনি কিংবা আপনারা কেউই আমার নিজের লোক না। এতদিন জে’লে ছিলাম। কয়বার আমায় দেখতে গিয়েছিলেন? একবার? দুবার? শূন্যবার?”

ছোট দাদি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন, “তোমার দাদির লা’শ ফেরত দিক। দাফন হোক। আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। অন্যের কথা শুনে থাকার দরকার কি যখন নিজেদেরই বাড়িঘর আছে।”

“এইতো ঠিক বুঝেছেন। কাল সকালে থানায় যাব। দাদির লা’শের ব্যাপারে কথাবার্তা বলবো। তারপর আপনারা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। কোন কিছুর বিনিময়ে আমি আর আপনাদের সাথে থাকব না।”

ছোট দাদি কিছু বললেন না। চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগলেন। খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে এলাম। দারোগা সাহেবের কথাটা মাথা থেকে সরাতে পারছি না। আমার প্রতি ওনার কি এমন দূর্বলতা থাকতে পারে? এই ব্যাপারটা আমায় খোঁজ নিতেই হবে। আমার কাছে মায়ের একটা ডাইরি আছে, ওইটা পড়ে দেখবো? ওখানে কিছু থাকলেও থাকতে পারে। ভাবনা মতো ডাইরিটা বের করে নিয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। হঠাৎই তিশা আপু দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। তড়িঘড়ি করে দরজা লাগাতে লাগাতে বলল, “ফয়সাল লাইট বন্ধ করে দে। তোর সাথে কথা আছে।”

খানিকটা অবাক হলেও লাইট বন্ধ করে দিলাম। তিশা আপু ফিসফিস করে বলল, “আব্বা নানিকে খু’ন করেনি রে ভাই।”

“এসব কি বলছ? তাহলে কে খু’ন করেছে?”

“আমি। আমি খু’ন করেছি। সেদিন নানির সাথে আমিও বেরিয়েছিলাম। তারপর!”

দরজার ওপর কেউ খুব জোরে আঘাত করল। যেন দরজা ভেঙে ফেলবে। ওপাশ থেকে ফুফুর গলা শোনা যাচ্ছে। তীক্ষ্ণ গলায় বলছে, “ফয়সাল দরজা খোল। এক্ষুনি দরজা খোল। তিশা তোর ঘরে এসেছে?”

তিশা আপু ভয়ে কাঁপছে। ইশারায় না বলতে বলছে। আপুকে খাটের কোণায় লুকিয়ে থাকতে বলে দরজা খুললাম। দরজা খোলার সাথে সাথে ফুফু আমার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মা’রল। কর্কশ গলায় বলল, “তিশা কোথায়? বল তিশা কোথায়?”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে