#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৫
ভোররাতের দিকে একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। বি’ভৎ’স ভ’য়ংক’র স্বপ্ন। লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। স্বপ্নে সেই অচেনা লোকটা দেখলাম। যার একটা হাত কা’টা। লোকটার সাথে ভৈরব নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। সে আমায় নৌকায় করে মাঝ নদীতে নিয়ে গেল। ধা’রা’লো ছু’রি দিয়ে পেটের এ’ফো’ড় ও’ফো’ড় করে দিতে দিতে বলল, “কাজ শেষ! সব কাজ শেষ!”
বুকের ভেতর ব্যাথা ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। কেমন যেন দম আঁটকে আসছে। নিঃশ্বাস ব’ন্ধ হয়ে যাবে মনে হয়। পানির পিপাসা তীব্র হয়ে উঠেছে। পরপর দু গ্লাস পানি পানি করলাম। হাত পা কেমন যেন অবশ হয়ে আছে। এলোমেলোভাবে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। চারদিকে অন্ধকার। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে মনে হয়। গাঢ় অন্ধকারে চোখ মেলে থাকলে ভয়ে অসাড় হয়ে যেতে হয়। কোলবালিশটা বুকে জড়িয়ে আছি। এতে ভয় একটু কম অনুভব হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। ঘুমের অতল গভীরে তলিয়ে গেলাম।
আজ আমার ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। আলো তখনও ভালো করে ফোটেনি। এখনও অন্ধকার গাঢ় হয়ে আছে। আকাশের ক্ষীণ আলো আঁধারিতে মন অন্যরকম হয়ে যায়। ভোররাতে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছিল। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করার কথা। কিন্তু না শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। স্বপ্নের ভয়টা আর নেই। নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বহুদিন হলো মা-বাবার ক’ব’রের কাছে যাওয়া হয় না। আজ যেতে ইচ্ছে করছে। কেন করছে সে-ও এক রহস্য! ধীর পায়ে হেঁটে ক’ব’রের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কালো সিমেন্ট দিয়ে ক’ব’রের দেওয়াল বাঁধানো। তাতে খোদাই করে বাবা মায়ের নাম লেখা। দেওয়ালের ওপার একটা হাত রাখলাম। মা! বাবা! বহুদিন হয়ে গেছে তোমাদের ক’ব’রের কাছে আসা হয় না। এখানে এলেই দু-চোখে পানি ভরে যায়। ব্যাপারটা একটুও ভালো লাগে না। তোমরা খুব রাগ করো তাই না? সত্যি বলতে কি? আমার তোমাদের কাছে আসতে ইচ্ছে করে না। কে আমি তোমাদের? বলো? আমি কি তোমাদের কিছু হই? হই না! আমি যদি সত্যিই তোমাদের কেউ হতাম- তবে আমায় ফেলে এভাবে চলে যেতে পারতে না। পারতে না। অঢেল সম্পদের মাঝে আমায় এমনভাবে ফেলে চলে গেলে যেন মনে হয় সহস্র হা’য়’না’র মাঝে আমি এক অসহায় হরিণ ছানা। যার কেউ নেই। পদে পদে মৃ’ত্যু’ভ’য় যাকে তাড়া করে বেড়ায়। প্রিয় মা! তোমার কথা একটু বেশিই মনে পড়ে। রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে তোমায় শোনানো কড়া কথাগুলো খুব মনে পড়ে। আজকাল কেউ ঘুম থেকে উঠতে জোর করে না। ইচ্ছেমতো ঘুমতে পারি। রাতে খাওয়া শেষে দুধের গ্লাস নিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে না। বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে কাউকে এখন ফাঁকি দিতে হয় না। সবকিছু বদলে গেছে মা। এমন বদল তো আমি চাইনি! ক’ব’রের পাশে দাঁড়িয়ে যেন কোন দোয়াটা পড়তে হয়? ভুলে গেছি। সূরা কালাম যা জানতাম প্রায়ই ভুলতে বসেছি। চর্চা নেই যে। এখন আর কেউ ফজরের নামাজ পড়তে জোর করে না। দাদি বলে ঠিকই। তোমার মতো হয় না। বাবাকেও খুব মনে পড়ে। ঘুমঘুম চোখে বাবার হাত ধরে রাস্তায় হাঁটতে যাওয়া। হিরুর দোকানের আলু পরোটা ছিঁ’ড়’তে ছিঁ’ড়’তে রূপকথার গল্প শোনা। মধ্যে দুপুরে পুকুরের পানিতে সাঁতার কে’টে বেড়ানো। এসবের কিছুই আমি ভুলতে পারি না। স্মৃতি আমায় ভুলতে দেয় না। মধুর স্মৃতি কেন বি’ষা’ক্ত হয়ে যায় বলতে পারো তোমরা? কেন তাতে অশ্রু ঝরে পড়ে?
হাত দিয়ে চোখ-মুখ মুছে ফেললাম। চারদিকে সূর্য আলো চকচক করছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। চমৎকার একটা সকাল। মন ভালো করে দেওয়ার মতো চমৎকার। সকালে নাস্তায় টেবিলে খেয়াল হলো কিছু পরিবর্তন এসেছে। আজকের খাবার অন্যদিকের মতো নয়। পরোটা, ভুনা গোশত, চিঁড়ের পোলাও, দই মিষ্টি। সচারাচর এতো ভালো খাবার সকালের নাস্তায় পাওয়া যায় না। খানিকটা বিস্মিত ভঙ্গিতে বললাম, “কেউ কি বেড়াতে আসবে নাকি?”
ফুফু নাস্তা গুছিয়ে রাখছিল। মিষ্টির প্যাকেট থেকে মিষ্টি বের করতে করতে বলল, “তুলিকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে।”
“তুলি আন্টির বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
“বিয়ে ঠিক হয়নি। সবে দেখাদেখি হচ্ছে। মনে হয় বিয়েটা হয়ে যাবে। তুলি যেমন সুন্দর তেমনই গুণবতী। এমন মেয়ে কি কেউ হাতছাড়া করে!”
তুলি আপু সুন্দর কথাটা সত্যি। টানাটানা চোখ, জোড়া ভ্রু, ঠোঁটের রং হালকা গোলাপি। একবার চোখ পড়লে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তবে তার চরিত্রে ভালোকিছু খুঁজে পাওয়া দায়। স্পষ্ট মনে আছে এই মেয়েই একদিন ফুফুর রান্নায় মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে দিয়েছিল। ঝাল তরকারি কেউ মুখে তুলতে পারেনি। সেই নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। ফুফু নিজেও তার ছোট ননদকে পছন্দ করত না। এখন খুব মিল হয়েছে। হঠাৎই ফুফুর শশুর বাড়ির লোকের প্রতি মহব্বত বেড়ে গেছে। উঠতে বসতে মনে হয় এরা ফুফুর আত্মার আত্মীয়।
কথা ছিল মেহমান আসলে তাদের সাথে সকালের নাস্তা করা হবে। আয়োজনও ছিল তেমন। কিন্তু দাদি তা হতে দিলেন না। নিজে খেয়ে নিলেন এবং আমাকেও জোর করে খাইয়ে দিলেন। ছোট দাদি তী’ক্ষ্ণ চোখে তাকালেও মুখে কিছু বললেন না। খাওয়া শেষ করে দাদি বললেন, “জামাই, তোমাকে একটা কাজ করতে বলেছিলাম। করেছ?”
ফুফা আমতা আমতা করে বলল, “কি কাজ আম্মা?”
“একজন রান্নার লোক ঠিক করতে বলেছিলাম আর দু’টো ঘর ফাঁকা করতে বলেছিলাম।”
ফুফু বলল, “মা তুমিই বলো কার ঘর ফাঁকা করব? সবাই যার যার নিজের ঘরে থাকে। তুমি যদি ফয়সালের সাথে থাকতে তাহলেও একটা ঘর ফাঁকা হয়ে যেত।”
দাদি কঠিন গলায় বলল, “এটা ফয়সালের বাড়ি। এখন ফয়সালকেই যদি অন্যের সাথে ঘর ভাগাভাগি করতে হয় তাহলে এতগুলো ঘরে কে থাকবে?”
ছোট দাদি বললেন, “তাহলে আপনিই বলেন কে কোথায় থাকবে। আমাদের বলা তো আপনাদের পছন্দ হবে না।”
“আপনি গিয়ে তুলির কাছে ঘুমাবেন। আর তিশাকে আমার ঘরে ঘুমাতে বললেন।”
ফুফা বললেন, “মায়ের কারো সাথে থাকতে অসুবিধা হয়। সমস্যা হলে ফয়সালকে তালেব আর শিমুলের সঙ্গে থাকতে দিলাম।”
“জামাই বাবা। এটা আমাদের বাড়ি। নিজের মা’কে স্পেশাল রুমে থাকতে দিতে হলে নিজের বাড়িতে গিয়েই থাকতে দাও। আমাদের কিছু সুবিধা অসুবিধা আছে।”
ফুফা চোখ গরম করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখ দেখে মনে হচ্ছে তার খুব রাগ হচ্ছে। তবে তিনি সেই রাগ প্রকাশ করতে পারছেন না।
ফুফু বলল, “মা তোমার কি মনে হয় না তুমি বাড়াবাড়ি করছ? এত বড় বাড়িতে আমাদের থাকা নিয়ে তোমার এত সমস্যা হচ্ছে কেন? তাছাড়া তোমার এত টাকার প্রয়োজন যে বাড়ি ভাড়া দিতে হবে? দরকার পড়লে আমাদের বলো। আমরাই ভাড়া দিয়ে থাকছি। এ বাড়িতে তো তোমাদের সুবিধার জন্য এসেছিলাম। এখন তোমার ভাব লক্ষন দেখে মনে হয় টাকা-পয়সা ক’ব’রে নিয়ে যাবে।”
দাদি ফুফুর দিকে এগিয়ে গেলেন এবং সবাইকে চমকে দিয়ে ফুফুর গালে একটা থা’প্প’ড় মা’র’লেন। ফুফু হতভম্ব হয়ে দাদির দিকে তাকিয়ে রইল। দাদি বললেন, “অনেকদিন ধরে তোদের বাড়াবাড়ি সহ্য করছি। আর না। তোদের সবার খুব বেশি বাড় বেড়েছে। এতো বড় একটা বাড়ি অথচ ফয়সাল চিলেকোঠার ঘরে থাকে। ঘরে একটা খাট আর টেবিল রাখলে কোন জায়গা থাকে না। অনেকদিন থেকে দেখছি। ভেবেছিলাম তোরা শুধরে যাবি। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। মা-বাপ ম’রা ছেলেটাকে নিঃস্ব করে দিতে চাস? লজ্জা করে না তোদের?”
ছোট দাদি বললেন, ” আপনি ভুল বলছেন বেয়ান। ফয়সাল নিজেই তো ওই ঘর পছন্দ করে নিয়েছে। আপনার মেয়ে তো ফয়সালকে নিজের ছেলেদের থেকেও ভালো জানে।”
দাদি গলায় স্বর বদলে বলল, “আজ-কাল আমার মেয়ের প্রতি আপনার ভালোবাসা দেখে বিস্মিত হয়ে যাই। আশ্চর্য! একটা সময় আপনিই তাকে পছন্দ করতেন না। নিজের ছেলেকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে চাইতেন।”
ছোট দাদি সত্যিকার অর্থে নিভে গেলেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে তার আর কিছুই বলার ক্ষমতা নেই। ফুফুর বিয়ের দু’বছর পর্যন্ত কোন ছেলে-মেয়ে হচ্ছিল না। ছোট দাদি নিজের ছেলের বিয়ে দিতে চাইলেন। পাত্রী পর্যন্ত ঠিক করলেন। শেষ মুহুর্তে দাদা গিয়ে সেই বিয়ে ভেঙে দিয়েছি। টাকা পয়সা দিয়েই ভেঙেছিল তবে কখনও স্বীকার যাননি।
ভেবেছিলাম ছোট দাদি আর কিছু বলবেন না। তবে তিনি আমাকে ভুল প্রমাণিত করে বললেন, “আপনি অহেতুক তর্ক করছেন। ফয়সাল তো সামনেই আছে। ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন। নিজে থেকে ওই ঘর পছন্দ করেছিল কি-না।”
“না বেয়ান। ফয়সাল নিজে ওই ঘর পছন্দ করেনি। শিমুল আর তালেবের থাকার জন্য ফয়সালের নিজের ঘর ছেড়ে ওই ঘরে আসতে হয়েছে। আপনারা অনেক বেশি সর্তকতার সাথে এসব বিষয় পরিবর্তন করেছেন। যেন হুট করে চোখে না পড়ে।”
ফুফা বললেন, “সমস্যা নেই আম্মা। ফয়সালের জন্য দোতলায় একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে। আপাতত আপনি একটু চুপ করেন। আজ তুলিকে দেখতে আসবে। ওদের পছন্দ হলে বিয়ে পড়িয়ে দেব। তখন আপনার একটা ঘর খালি হয়ে যাবে। সামনের মাসে আমরাও বাড়ি ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করব। এভাবে আর থাকা যায় না।”
দাদি চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলেন। তাকে দেখে খুব একটা দুঃখী মনে হলো না।
বেলা বারোটা পর্যন্ত সবাই মেহমানদের জন্য অপেক্ষা করল। ফুফা পর্যন্ত না খেয়ে বসে আছে। মেহমানদের ভাব লক্ষন দেখে মনে হচ্ছে না তারা আসবে। তুলি আন্টি শুকনো মুখে সোফায় বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব অ’প’মা’নি’ত বোধ করছে। পৃথিবীর কোন ছেলের তার মতো সুন্দরী মেয়েকে অপেক্ষা করানোর যোগ্যতা নেই।
ফুফু বলল, “অনেক তো হলো! সবাই যার যার মতো খাবার খেয়ে নাও। আজ মনে হয় ওরা আসবে না।”
ফুফা মাথা নাড়লেন। শান্ত গলায় বললেন, “ফয়সালকেও খেতে দাও। ওকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব।”
আমার সারা শরীরে হিমশীতল বাতাস বয়ে গেল। ফুফার মুখের ওপর না বলার সাহস আমার নেই। আবার তার সাথে যাওয়ারও সাহস নেই। খাওয়া শেষে ফুফা আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেলেন। বরফ শীতল গলায় বললেন, “ভৈরব নদীর পাড়ে চল। একটা কাজ আছে।”
চলবে