ভুল সত্য
৩
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর বাড়ি আস্তে আস্তে ফাকা হয়ে যেতে শুরু করল। আমার ভালোই লাগছিল। এত লোকজনের ভীড় তার উপর আবার এমন জবরজং শাড়ী গয়না পরে থাকতে হচ্ছে। অতিথিরা সব যাবার আগে আমার কাছে বিদায় নিয়ে হাতে কিছু গুজে দিয়ে যাচ্ছিল। আমি বেশ অবাক হলাম। পরে বুঝলাম এটা ওদের পরিবারের নিয়ম। যাক আমার আর কি করা। মনার মায়ের মতো আমার ও ভালোই আমদানি হল।
সবার শেষে বিদায় নিলেন রেহানা আন্টি। উনি আমার কাছে এসে বললেন
মনার মাকে রেখে যাই। কাল পাঠিয়ে দিস। এখানে তো কেউই নেই। ভাবি নাকি রেবা কে ছুটি দিয়ে দিয়েছে।
আমি মনে মনে বললাম
ছুটি দেয়নি ছাটাই করে দিয়েছে। আর তার যায়গায় অন্য কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে। মুখে বললাম , লাগবে না আন্টি। সব তো আপনি গুছিয়েই দিয়েছেন।
উনি আমাকে কোথায় কি আছে সব বুঝিয়ে দিলেন।
ফ্রিজে বিয়ের অনেক খাবার রয়ে গেছে। ওখান থেকে বের করে রাতে খেয়ে নিস। তারপর কাছে এসে গলা নিমিয়ে বললেন
মনার মা কে কিছু দিয়েছিস? হাতে কিছু দিস। আশা করে আছে।
আমি রান্না ঘরে গিয়ে দেখলাম মনার মা সব গুছিয়ে রাখছে। এই মহিলা কথা বেশী একটা বলে না। তবে কাজে বেশ তুখোড়। অল্প সময়ে অনেক কাজ করে ফেলেছে। আমি এগিয়ে এসে আমার নাকফুলটা ওর হাতে দিয়ে বললাম
এটা ময়না কে দিয়েন।
ময়নার মা ভাবলেশহীন মুখ করে ওর ব্লাউজের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট পুটলি বেড় করে সেটাতে ওটা রেখে বলল
আর কিছু করন লাগবো?
আমি হেসে ফেললাম।
না, আর কিছু করা লাগবে না । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সে নিরাসক্ত গলায় বলল
আইচ্ছা। তাইলে গেলাম
আমি ভেবেছিলাম উপহারটা পেয়ে সে হয়ত খুশি হবে। জিনিসটা বেশ দামী। হোয়াইট গোল্ডের উপর পিওর রুবী। আমার বিয়ের শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে কেনা। যদিও আমার ইচ্ছা করছিল মুকুলের দেয়া নাকফুলাটাই দিতে কিন্তু ওর প্রতি প্ কৃতজ্ঞতাবশত দিতে পারলাম না। অন্তত প্রথম রাতে ও আমার উপর ঝাপিয়ে পরেনি। এর বিনিময়ে এইটুকুতো ওর প্রাপ্য।
তবে একটা ব্যপার ভেবে মজা লাগল যে আজকাল কেউ সহজে তুস্ট হয়না। মানুষের প্রত্যাশার মাত্রা বেড়ে গেছে। আগেকার দিনের মতন অল্পতেই এখন আর কেউ খুশি হয় না, এমনকি কি বেশিতেও হয় না। তখন মনে হয় আর একটু বেশী হলে ভালো হত।
সবাই চলে যাবার পর আমি ঘরে এসে পোশাক পাল্টে নিলাম। শাড়ী না পরে হালকা শুতির জামা পরলাম। এখানে আসার সময় লাগেজ ভর্তি জামাকাপড় সহ আরো অনেক আনুসাঙ্গিক জিনিস পত্র দিয়ে দিয়েছিল বাসা থেকে।
এতসব জিনিসপত্র কোথায় রাখবো বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আলমারিটা খুলে দেখলাম একটা পাশ ফাঁকা; বুঝলাম হয়তো আমার জন্যই রাখা হয়েছে। আমি সবকিছু বের করে গুছিয়ে রাখলাম। পাশেই একটা ড্রেসিং টেবিল দেখতে পেলাম। দেখে মনে হচ্ছে জিনিসটা নতুন। বোধহয় আমার কথা ভেবেই কেনা হয়েছে। আমি আমার সমস্ত কসমেটিকস গুছিয়ে রাখলাম। লাগেজ খালি হয়ে গেলে সেটাকে আলমারির পাশে দাড় করিয়ে রাখলাম। চারপাশে চোখ বুলিয়ে মনে হল এবার ঠিক আছে। অগোছালো ঘর আমার একেবারেই পছন্দ না। আমার বোধহয় একটু শুচিবাইয়ের মত আছে। বাড়িতেও আমি সবসময় সব গুছিয়ে রাখতাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম পাঁচটা বেজে গেছে। একটু চা খেতে মন চাইছে। আমি শাশুড়ির ঘর পাশ কাটিয়ে নিচে নামলাম। উনার ঘরের দরজা বন্ধ।
রান্নাঘরে চা বানাতে গিয়ে একটা মজার জিনিস পেয়ে গেলাম। ফ্রিজের সঙ্গে ম্যাগনেট দিয়ে আটকানো জরুরী ফোন নাম্বার গুলোর মধ্যে রেবার ফোন নাম্বারটাও পাওয়া গেল। আমি চা নিয়ে উপরে গিয়ে চট করে রেবাকে ফোন করে ফেললাম। যদিও ফোনটা করেই মনে হল ভুল করে ফেলেছি। মানুষের অ্যাভারেজ টাইপিং স্পিড শু্নেছি মিনিটে চল্লিশ শব্দ। কথা বলার ক্ষেত্রে এমন কিছু আছে কিনা আমার জানা নেই। যদি থাকত তাহলে নিঃসন্দেহে রেবার স্পিড হত মিনিটে চার হাজার। ামাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ও হড়বড় করে কথা বলেই যেতে লাগলো।
হায় আল্লাহ! ভাবী আপ্নে ফোন দিসেন। আমার তো বিশ্বাসই হইতাসেনা। আমার যে কি শক আসিল আপ্নেরে দেহার। খালি আপ্নের ছবি দেখসি ভাইজানের কাছে। মাশাল্লা আপ্নে পরির মতন সুন্দর। খালাম্মা আমারে ছুটি না দিলে এক্ষনি আইসা দেইখা যাইতাম। সবাই যে কি খুশি। আর খুশি হইব না কেন? এমন সুন্দর বউ পাইসে। খালাম্মা তো খুশির ঠ্যলায় আমারে এক মাসের বেতন সহ ছুটি দিয়া দিল। আমি এক মাসের আগেই চইলা আমু। আম্পের লেগা কি আনমু কন ভাবী। আমাগো বস্তির সামনে ঠ্যলাগাড়িতে কইরা আমরা বেচে। গোলাপ ফুলের মত আমরা। হায়রে মজা। কি যেন একটা মশ্লা দেয়। মুখে লাইগা থাকে। আমড়া আলা ব্যটায় বেজায় রসিক। উনার নাম মজিবর। আমারে দেকলে মিচকি মচকি হাসে। আমর সব হাসির জুক কয়। আপ্নে যদি উনার জুক শুনেন হাসতে হাসতে প্যট ফাইটা যাইব। খাড়ান আপনেরে একটা শুনাই…
রসিক মুজিবরের জুক শোনার ব্যপারে আমি বিশেষ উৎসাহ দেখালাম না। ওকে থামিয়ে দিয়ে জরুরী তথ্যগুলো জেনে নিলাম। প্রয়োজনীয় কথা শেষ হবার পরেও অনেকক্ষণ রেবার বকবকানি সহ্য করতে হলো; এমনকি রসিক মুজিবরের একটা জোকও শুনতে হলো।
কথা শেষ হওয়ার পর আমি দীর্ঘশ্বাস খেললাম। তাকিয়ে দেখলাম আমার চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আরেক দফা গরম করব বলে বাইরে বেরিয়ে আচমকাই আমার শাশুড়ির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমার হাতে চায়ের কাপ দেখে উনি বললেন
চা খাইতাসো? একবার তো আমারে জিগাইলাও না?
আমার এক্টূ খারাপ লাগল। বাড়ীতে আমরা দুজন মাত্র মানুষ। আমার জিজ্ঞেস করে উচিত ছিল। কিন্তু উনাকে রাগিয়ে দেবার জন্যই বললাম
রেবা তো আপনাকে বিকালের চা দিত না।
উনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন
আমার লগে রং দেহাও? লেজ বেশী লম্বা কইরো না। লম্বা ল্যজ ক্যম্নে কাটতে হয় আমি জানি।
আমি ভালো মানুষের মত মুখ করে জানতে চাইলাম
কি করে কাটতে হয়?
উনি অগ্নি চক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
ফাইজলামি কর?
জি না। একটু কৌতূহল বোধ করছিলাম আরকি। মানে লেজের তো প্রকার ভেদ আছে তাই কাটার পদ্ধতি ও নিশ্চই ভিন্ন
উনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন
যখন কাটুম তহন টের পাইবা
কি টের পাব? যে আমার লেজ কেমন? কুমিরের মত কন্টকময় না ঘোড়ার মত রোমশ।
এই কথাটা অবশ্য মনে মনে বললাম। কারন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি রাগে তার শরীর রীতিমত কাঁপছে। আমি মনের মধ্যে এক প্রকার প্রশান্তি অনুভব করলাম। মানুষ তার প্রেমিকাকে রাগিয়ে যেমন আনন্দ পায় আমি ও তেমনি অদ্ভুত আনন্দ পেতে লাগলাম।
পরপর দুকাপ চা খাওয়ার জন্যই বোধহয় রাতে ঘুম এল না। খুব করে চেয়েছিলাম মুকুল আসার আগেই ঘুমিয়ে পরতে। ঘুমের ভান করে পরে থাকলেও স্পষ্ট টের পেলাম ও ঘরে ঢুকেছে।
চলবে………