ভুল সত্য
২
বিয়ের প্রথম রাতে নববধূকে মানুষ আংটি দেয়; নেকলেস, ব্রেসলেট ,মোবাইল হানিমুন টিকিট আরো অনেক সব উপহার দেয় বলে শুনেছি কিন্তু আমার হাতের মুঠোয় যে জিনিসটা দেখতে পাচ্ছি সেটা একটা লজেন্স। চিকমিকি কগজে মোড়া ছোট্ট একটা লজেন্স। ছোট বেলায় এই লজেন্স আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। আর বড় হবার পর এই জিনিস দেখলে আমার নাড়িভুঁড়ি উল্টে বমি আসে। এর অবশ্য একটা কারন আছে। এই লজেন্সের সাথে আমার ছেলেবেলার দুঃসহ কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মুকুল বলল
খুলে দেখ
কি?
মুকুল উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি নিতান্ত অনিচ্ছায় মড়োকটা খুললাম এবং আগের চাইতেও বেশী অবাক হয়ে গেলাম। ভেতরে একখণ্ড হীরে ঝিকমিক করছে। আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। ও নাকফুলটা তুলে নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলল
পরে দেখ
নাকফুল আমার খুব প্রিয় একটা গয়না। কলেজে ওঠার পর আমি আর তিথি খুব শখ করে পার্লারে গিয়ে নাক ফুটো করিয়েছিলাম। বলতে একটু লজ্জা করলেও এইরকম একটা নাকফুলের আমার অনেকদিন ধরেই শখ ছিল। যেখানে শুধুমাত্র এক টুকরো হীরে নাকের উপর ঝিকমিক করবে। এই কথাটা কোনদিন কাউকে বলা হয়নি; এমনকি তিথিকেও না। এই লোক এটা জানল কি করে? আশ্চর্য তো! আমাকে চুপ করে ভাবতে দেখে মুকুল পিনটা খুলে এগিয়ে দিল। আমি সাত পাঁচ না ভেবে টুক করে ওটা পরে নিলাম। তাকিয়ে দেখলাম ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একটু সময় নিয়ে বলল
তোমাকে প্রথমে যেদিন দেখেছিলাম বৃষ্টির এক ফোঁটা পানি তোমার নাকের উপর শেষ বিকেলের আলোতে ঝিকমিক করছিল। সেদিনই ঠিক করেছিলাম বিয়ের পর তোমাকে একটা ডায়মন্ড এর নোসপিন কিনে দেবো। । যেটা তুমি সব সময় পরে থাকবে।
আমি একটু থেমে বললাম
শুধু নাকের উপর ঝিকমিক করাই দেখেছেন, আর কিছু দেখেননি?
এবার ও তার অতিরিক্ত সাদা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল
না আরো অনেক কিছু দেখেছি।
আমি মনে মনে বললাম
বদমা/ইশের বাচ্চা! এজন্য তোরে আমার এত অসহ্য লাগে।
মুকুল আরেকটু এগিয়ে এসে চুলগুলো আমার কানের পেছনে গুজে দিতে দিতে বলল
আজকে আমার একটু…
আমি ওকে কথা শেষ করতে দিলাম না, উঠে দাড়িয়ে বললাম
আমাকে নিচে যেতে হবে। সবাই খাবার জন্য অপেক্ষা করছে
যতক্ষণ দরজার কাছে পৌঁছেছি ও পেছন থেকে ডেকে বলল
ইয়ে মানে তুলি, আজকেও আমার আসতে একটু দেরি হবে। মানে তোমাদের সঙ্গে খেতে বসতে পারবো না। বন্ধুদের সঙ্গে লাঞ্চ করতে হবে। রাতে তোমাদের সঙ্গে ডিনার করবো। প্রমিস। আই হোপ তুমি কিছু মনে করছ না। একদম দেরি করবো না, দেখো।
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম
এত কৈফিয়ত দেবার দরকার নেই; তবে মিথ্যা কথাটা না বললেও চলত
মুকুল অবাক হয়ে বলল
কি মিথ্যা বললাম?
কাল দেরি হবার জন্যও একই অজুহাত দিয়েছিলেন
না আসলেই। মিথ্যা বলছি না। কাল ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ডদের ট্রিট দিতে হয়েছে আর আজকে ধরেছে হলের বন্ধুরা। আসলে বিয়েতে সবাইকে দাওয়াত দিতে পারিনি তো। এত তাড়াহুড়ায় সবকিছু হয়ে গেল। উইক ডেতে প্রোগ্রাম করতে হল বলে অনেকে চাইলেও আসতে পারেনি। তাই সবাই মিলে ছোটখাটো একটা…
এই লোক অতিরিক্ত কথা বলে। কথা বলে বলে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম
এত কথা বলার দরকার নেই। আপনি যেখানে ইচ্ছা যান, যতক্ষণ ইচ্ছা থাকুন।
এই বলে আমি আর দাঁড়ালাম না, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে হল শেষের কথাগুলো না বললেও পারতাম। এখন নিশ্চয়ই ভেবে বসবে আমি অভিমান করেছি। ফিরে আসার পর মান ভাঙ্গানোর জন্য নানা ভুজুং ভাজুং দেওয়ার চেষ্টা করবে। পুরুষ মানুষের মান ভাঙানো তো আবার সব এক জায়গায় গিয়ে শেষ হয়। যত্তসব!
নিচে নেমে দেখলাম খাওয়া দাওয়ার বিশাল আয়োজন বসেছে। রেহানা আন্টি সবকিছুর তদারকি করছেন। সবকিছু এত নিখুঁতভাবে কি করে হচ্ছে সেই রহস্যটা এতক্ষণে বুঝলাম। উনি বাড়ি থেকে মনার মাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। মনার মা তাদের বাড়ির পুরনো কাজের লোক। তার বড় মেয়ে ময়নার সামনে বিয়ে। এখানে আসার সুবাদে তার অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে। বলাবাহুল্য সবার কাছেই সে বিয়ের কথাটা বলছে এবং এতে করে তার বেশ ভালোই আমদানি হচ্ছে।
এই কারনেই বোধ হয় আজ তার পারফর্মেন্স দুর্দান্ত। বলা মাত্র চোখের নিমিষে সব কাজ সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে।
আমি চারিদিকে তাকিয়ে তিথিকে খুজতে লাগলাম। রেহানা আন্টি বোধহয় সেটা বুঝতে পেরেই বললেন
তিথি ছোটদের খাওয়াচ্ছে। মুরুব্বিদের খাওয়া হয়ে গেলে আমরা খেতে বসব। তারপর কাছে এসে গলা নামিয়ে বললেন তখন তোর শাশুড়িকেও ডাকিস।
আমি ঘাড় কাত করে সায় দিলাম। মুকুলদের বাড়িটা বেশ বড় আর অনেক সুন্দর। এমন বাসা আমি আগে দেখিনি। আজকাল এত যায়গা নষ্ট করে কেউ বাড়ি বানায় না। ডুপ্লেক্স বাড়ী আমি আগেও দেখেছি কিন্তু এটা একদম আলাদা। নাটক সিনেমায় এমন বাসা দেখেছি কাছ থেকে কখনো দেখিনি। একতলায় বিশাল হলঘরের মতো ড্রয়িং রুম, একপাশে কিচেন সেটাও বেশ বড়। ঘেড়া দেওয়া বিশাল ডাইনিং। একপাশে দুটো ছোট ছোট ঘর। গেস্ট্রুম হবে হয়ত। হলঘরের একদিক দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে উপর তলায়। সেখানে টানা বারান্দা আর তার পাশে তিনটা শোবার ঘর। প্রথমটা আমার শাশুড়ির। দ্বিতীয়টা আমাদের। তারপরেরটা তালা বন্ধ থাকে। কখনো কোন মেহমান আসলে খুলে দেয়া হয়। কাল রাতে সবাই বোধহয় এগুলোতেই মিলেমিশে ছিল।
সামনের ড্রয়িং রুমটার মেঝেতে সব কাজিনরা মিলে খেতে বসেছে । ডাইনিং এ মুরুব্বীরা খাচ্ছেন। ওদের পরিবারে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। মুকুলের বাবা বেঁচে নেই। চার ফুপু। রেহানা আন্টি সবার বড়। দ্বিতীয়জনের বিয়ে হয়েছে তিথির সেজো চাচার সঙ্গে। এই বিষয়টা আমি আগে জানতাম না। অবশ্য জানার কখনো প্রয়োজন ও পড়েনি। অন্য দুই ফুপুর একজন থাকেন বকশিবাজারে অন্যজন নারিন্দায়। কাল রাতে আমদের সঙ্গেই সবাই এসেছেন।মুকুলের মায়ের দিকের কিছু আত্মীয় স্বজন ও আছে কিছু। আমি তাদের আলাদা করে চিনলাম না। তিথিকে দেখলাম সবাই কে খাবার দিচ্ছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল
কিরে মন খারাপ?
আমি ভুরু কুচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালাম। ও হেসে বলল
ভাই চলে গেল দেখলাম। মিস করছিস?
আমি কঠিন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। হয়ত এটাই স্বাভাবিক। বিয়ের পরদিন স্বামীর এভাবে চলে যাওয়াটা মন খারাপ করার মতই ব্যপার। হয়ত ও ধরেই নিয়েছে আমাদের মধ্যে ভাব ভালবাসা হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। তিথির নিজের কোন ভাই নেই। ওরা তিন বোন। মুকুলকে ও নিজের ভাই এর চেয়ে ও বেশী ভাবে। মুকুল ও বোনদের অসম্ভব স্নেহ করে। তিথি একথা আমাকে আগে অনেক বার বলেছে। এই বিয়েতে মনে হয় সব চেয়ে খুশি ওই হয়েছে। ওর এত আনন্দ দেখে আমি ওকে কিছুতেই বলতে পারিনি যে মুকুলকে আমার পছন্দ হয়নি। এখন ও কিছু বলতে পারলাম না। আমার হাসির স্টক থেকে একটা লজ্জা লজ্জা হাসি উপহার দিলাম।
চলবে……