ভুল সত্য পর্ব-০১

0
463

ভুল সত্য

কালকে থেকে রেবা আসবে না, সব কাজ তোমাকেই করতে হবে। বুজতে পারসো?

বিয়ের একদিনের মাথায় শাশুড়ির মুখে এই কথে শুনে চমকে গেলেও বিশেষ অবাক হলাম না আমি। ওনার চরিত্র সম্বন্ধে আগেই একটু ধারণা পেয়েছিলাম, আমার বান্ধবী তিথির কাছ থেকে। তিথি আমার স্কুল জীবনের বান্ধবী। স্কুল-কলেজে আমরা একসঙ্গে পড়েছি; বিশ্ববিদ্যালয় ও একই কিন্তু ভিন্ন ডিপার্টমেন্ট। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বন্ধুত্বের চেয়ে একটু বেশিই । এখন তো আবার আত্মীয়তাও হয়ে গেছে। তিথি আমার স্বামীর ফুপাতো বোন।যদিও ওই লোকটাকে স্বামী বলতে আমার একটু ও ইচ্ছে করেনা। কিন্তু এখন আর কি করা; বিয়ে যখন হয়েই গেছে। এখন তো আর ফিরিয়ে নেবার উপায় নেই। যাক সে কথায় পরে আসছি। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে উনি আবারো বললেন
কি কইলাম বুঝতে পারতেসো না?
আমি নির্বিকার কন্ঠে বললাম
জি বুঝেছি। কি কি কাজ করতো রেবা?
সবই করতো
সবই মানে কি?
আমার বলার ধরন দেখে উনি একটু থমকালেন কিন্তু মিইয়ে গেলেন না । কাটা কাটা গলায় বললেন
সকালের নাস্তা বানানো, ধোয়া পাকলা, ঘর মুছা, কাপড় ধোয়া সবই
এই সব এখন থেকে আমাকে করতে হবে?
হ? কেন? কাম কাজ কিছু জান না? বাপ মায়ে কিছু….
কত বেতন দিতেন রেবাকে?
উনি বেশ তেড়ে উঠে বললেন
ক্যন, তোমারে ও বেতন দেওয়া লাগবো নাকি?
রেবা কি বেতন ছাড়াই এসব কাজ করতো?
উনি এবার বেশ ফুসে উঠে বললেন
রেবারে তো ভাত দিতাম না। তুমি তো ভাত ও খাইবা আবার বেতন অ চাও
আমাকে ও ভাত দিতে হবে না
কি বল্লা?
রেবার ফোন নাম্বার টা কি পাওয়া যাবে?
ক্যন ফোন নাম্বার দিয়া কি করবা?
কাজের ডিটেইলস গুলো একটু জেনে নিতাম আর বেতনটাও জানা যেত আপনি যেহেতু বলছেন না
এবার উনি সত্যি সত্যিই রেগে গেলেন। এখন উনাকে একটা অতিকায় তেলাপোকার মতো লাগছে। শুরু দুটো এন্টেনার অভাব।
উনি তেলাপোকার মতো স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর হেসে ফেললেন। বলতে বাধা নেই ভদ্রমহিলা দেখতে বেশ সুন্দরী। ধব ধবে ফর্সা গায়ের রং, ছেলের মতো কালো না। খয়েরী রঙের শাড়ীটা মানিয়েছে ভীষণ। যদিও খয়েরী শাড়ীতে তাকে আরো বেশী করে তেলাপোকা মনে হচ্ছে। তবে একটা কথা না বললেই নয় তার হাসি দেখে আমি রীতিমতো ধাক্কা খেলাম। আমার ধারনা ছিল এমন হাসি শুধু আমিই হাসতে পারি। যে হাসির অর্থ হল- বাছাধন তুমি জানো না তুমি কার সঙ্গে খেলায় নেমেছো, এতদিন ঘুঘু দেখেছো কিন্তু ফাঁদ দেখোনি। আজ বুঝবে ফাঁদ কেমন হয় বাঁশের কঞ্চির না কাটা তারের। আমি বোধহয় তার হাসি দেখে মুগ্ধ হয়েই আমার বিখ্যাত হাসিটা উপহার দিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমি অনেকগুলো হাসি আয়ত্ত করেছি। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে এই হাসি গুলো ভীষণ কাজে দেয়। এর মধ্যে সব চাইতে যেটা ফলপ্রসু এই মুহূর্তে সেটাই ব্যবহার করলাম। এর অর্থ হল আমি ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানিনা। উল্টে খাওয়া তো দূরে থাকুক সারাজীবন ভাজা মাছই খাইনি। সিদ্ধ মাছ খেয়ে জীবন পার করেছি। তাও লবন হলুদ ছাড়া। মুহূর্তেই উনার মুখের হাসি মুছে গেল। উনি তীক্ষ কন্ঠে বললেন
এখন নিচে যাও। মেহমানরা খাইয়ে বসবো। অগো সাথে থাকো। খাওয়া শেষ হইলে তারা বিদাই হবে
যাহা আজ্ঞা
এই কথাটা অবশ্য জোরে বললাম না। মনে মনে বললাম। যা বুঝলাম এই মহিলার সঙ্গে থাকতে হলে বেশীরভাগ কথা মনে মনেই বলতে হবে।

সিড়ি দিয়ে নামার সময় আমার মুকুলের সঙ্গে দেখা হল। ও আমাকে দেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
তুলি একটু উপরে আসবে?
এই লোকের সঙ্গে উপরে যাবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। এমনিতেই একে আমার অসহ্য লাগে এছাড়াও আর একটা কারন, উপর তলায় মা ছেলের ঘর পাশাপাশি। উনি আবার নাগ-মনি পাহাড়া দেবার জন্য ছেলেকে পাশের ঘরে এনে রেখেছেন। যেতে হলে এখন ওই মহিলার ঘরের সামনে দিয়ে যেতে হবে। এই মুহূর্তে সেটা করার কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও আবারো বলল
কি হল এসো, নাকি এখনো রাগ করে আছো?
আমি ভুরু কুঁচকে তাকালাম। রাগ করার বিষয়টা ঠিক বুঝলাম না। ওর উপর রাগ করার কি আছে? ও কে? দুদিন আগে ও তো ওকে আমি চিনতামই না। রাগ তো হচ্ছে আমার বাবা মায়ের উপর। এত করে বলার পরে ও কিছুতেই বুঝল না। এই রকম একটা খোক্কসের গলায় ঝুলিয়ে দিল। যতই আমি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি যে ছেলে আমার পছন্দ হয়নি ততই তারা ওর হয়ে ওকালতি শুরু করে। বারবার একই কথা
কেন পছন্দ না? এত সুন্দর ছেলে। ছয় ফুটের উপর লম্বা, শ্যমলা, তোর কি ইদুরের মতো সাদা ছেলে পছন্দ?
রাগে আমার কথা বন্ধ হয়ে যায়। লম্বা হলেই কি মানুষ সুন্দর হয়ে যায়? কাকতাড়ুয়ার মতো শরীর।কান গুলো খরগোশের মতো। কথায় কথায় দাত কেলিয়ে হাসে। সেই দাত ও মুলোর মতন। ছোটো বেলায় ঠাকুর মার ঝুলিতে পড়েছিলেন। কুলোর মতো কান আর মুলোর মতন দাতের রাক্ষস। এতো তার জমজ ভাই।

শত চেষ্টা করেও আমি বাবা মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনি। ছেলে ভেতরে কেমন সেটা কেউ দেখল না। সবাই দেখল তার এম বিএ ডিগ্রি, মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির চাকরি। ঢাকায় তিনতলা বাড়ি। কিন্তু আসল কথাটা তো আমি কাউকে বলতেই পারলাম না। এই ছেলে আমাকে পছন্দ করেছে আমার শরীর দেখে।

স্কুল জীবন থেকেই ক্লাসের পরে আমি তিথিদের বাড়িতে যেতাম। বাবা মা দুজনেই চাকরী করায় বাড়িতে কেউ থাকত না। বাবা অফিস শেষ করে ফিরিয়ে ফিরতে রাত হত। মার স্কুল শেষ হত পাচটায়। বাড়ি পৌছাতে ছটা বেজে যেত। একা বাসায় থাকতে আমার ভয় করত না তবে কেমন একটা অস্বস্তি হত, বিশেষ করে একটা ঘটনার পর থেকে। যাক সে কথা অন্য সময় হবে। কলেজে উঠে ও আমার ওই স্বভাব গেল না। আমি প্রায় প্রতি দিনই ওর সঙ্গে ওদের বাসায় চলে যেতাম। বাবা রাতে ফেরার সময় আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন।

তিথিদের বাড়ি পুরানো ঢাকায়। আট কাঠা যায়গার উপর বিশাল বাড়ি। বাইরে থেকে দেখলে এতটা বড় বোঝা যায় না। সামনের দিকে সব দোকান। এই বাড়ির বয়স প্রায় পঁচাশি বছর। তিথির দাদুর বাবা করেছিলেন এই বাড়ি। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়াতে পুরোটাই তিনি পেয়েছেন। তিথির বাবারা চার ভাই। তিথির বাবা সবচাইতে বড়। দাদু উনার সঙ্গেই থাকেন। আগে বাড়ির পেছনের দিকে চারটা ঘর ছিল আর সামনে পুরোটাই উঠান। উঠান ভর্তি আম কাঠালের গাছ। এই সব গল্পই আমি দাদুর কাছ থেকে শুনেছি। পরবর্তীতে সবাই বিল্ডারের কাছে দিয়ে ফ্ল্যট করতে চেয়েছিলেন কিন্তু দাদুর জন্য পারেননি। উনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, যেদিন এই বাড়ির একটা ইট ও ভাঙ্গা হবে সেদিন তিনি ছাদের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্নহত্যা করবেন। এই কথা শোনার পর কেউ আর তাকে ঘাটায়নি। পেছনের পুরানো চারটা ঘরের উপর তিন তলা করে তিথিরা থাকে। ছোট তিন চাচা মিলে সামনের দিকে চারতলা বিল্ডিং তুলেছেন। এক এক জন এক একটাতে থাকে। বাকীগুলো ভাড়া।

ওর চাচাত ভাইবোনদের সাথে আমার খুব ভাব। তিথির মা রেহানা আন্টিও আমাকে অসম্ভব স্নেহ করেন। ছোটবেলা থেকেই যাতায়াত ছিল বলে আমি কেমন ওদের পরিবারেরই একজন হয়ে গিয়েছিলাম। ওদের পুরনো বাড়ির ছাদটা আমার ভীষণ প্রিয়। আমাদের নিজেদের বাড়িটা লালমাটিয়ার একটা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে। আধুনিক জীবনযাত্রার সব উপকরণ মজুদ থাকলেও কেমন একটা দম বন্ধ করা ভাব। বিকেলে আমি আর তিথি প্রায়ই পানির টাংকির উপর বসে বসে আচার খাই। মাঝে মাঝে হেড়ে গলায় গান ও করি। তবে আমার সব চাইতে ভালো লাগে এখানে বৃষ্টিতে ভিজতে। বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলে তিথি নিচে থেকে গরম চা নিয়ে আসতো। কেমন একটা স্বর্গীয় অনুভূতি হতো।

এমনই এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলে আমি হাসনাহেনা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে বৃষ্টিতে ভিজছিলাম, তিথি নিচে চা আনতে গেছিল। আমার পরনের ভেজা শাড়ি শরীরের সঙ্গে লেপ্টে ছিল। চোখ মেলে দেখলাম ছাদের দরজায় দুহাত রেখে ঢ্যঙ্গা মতো একটা ছেলে হা করে তাকিয়ে আছে। আমার শরীর কাঁপতে লাগলো। রাগে ভয়ে না ঠান্ডায় ঠিক বুঝলাম না। আমাকে চোখ মেলতে দেখেও সে চোখ নামিয়ে নিল না, নির্লজ্জের মত তাকিয়েই রইল।

পরে জানতে পেয়েছিলাম সে তিথির মামাতো ভাই মুকুল। যদিও আগে থেকেই তার অনেক গল্প আমি শুনেছি। এও শুনেছি তিথির ক্লাসের প্রায় মোটামুটি সবাই তার উপর ক্রাশ খেয়েছে। আমার অবশ্য তাকে আহামরি কিছু মনে হয়নি। এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যেই মুকুল আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল। বাড়ি শুদ্ধ সবাই আমাকে ঘটা করে দেখতে এলেও মুকুল এলো না। আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে ছেলে কি দেখে আমাকে পছন্দ করেছে। এই কথাটা মুখ ফুটে কাউকে বলে বোঝাতে পারলাম না। তবে মনে মনে তার প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা জন্মেছিল গোড়া থেকেই।

ঘরে ঢুকে আমি একটু অবাক হলাম। ঘর ঝকঝক করছে। রাতের পুরনো ফুলের চিহ্ন মাত্র নেই। বিছানায় সাদার উপর নীল নক্সি করা সুতির চাদর টানটান করে পাতা। আমি একটু অবাক হলাম রেবা নেই তাহলে এত কাজ কে করল? এই রহস্য অবশ্য উন্মোচিত হল খাওয়ার সময়। যাই হোক, দেখলাম মুকুল আলমারি থেকে কিছু একটা বের করছে। আমি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। মুকুল খাটে বসে অপরাধী মুখ করে বলল

কাল রাতে আমার ফিরতে দেরী হয়ে গিয়েছিল। তুমি কিছু মনে করো না। আসলে বন্ধুরা এমন করে ধরল। ফিরে এসে দেখলাম তুমি আরাম করে ঘুমাচ্ছ। তাই আর বিরক্ত করলাম না।

বুঝলাম এই লোকের কৈফিয়ত দেবার বিশ্রী অভ্যস আছে। দুই দিনের দেখা আমাকেই যদি এত কৈফিয়ত দেয় তাহলে নিজের মাকে না জানি কি বলে। আম্মা আসলে টয়লেটে কাজ সারার পরে দেখলাম ফ্ল্যস কাজ করছে না। এখন কি করা বলেন। বাধ্য হয়ে দুই বালতি পানি ঢাললাম। এতে লাভ তো হলোই না বরং ভেতরের মাল মশলা সব বাইরে বেরিয়ে এল। সব পরিষ্কার করতে গিয়েই দুই মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ড দেরী হয়ে গেল। আর এমন হবে না আম্মা। বিশ্বাস করেন। আমার চাকরির কসম।

তুলি, এই তুলি

মুকুলের ডাকে আমর ধ্যন ভাঙল। কি সব আবোল তাবোল ভাবছি। মুকুল আমার হাত ধরে খাটে এনে বসাল। তারপর বলল
তোমার জন্য একটা উপহার কিনেছিলাম। কাল রাতে তো দিতে পারলাম না, এখন দেই?
আমি হ্য না কিছুই বললাম না
মুকুল আমার হাতের মধ্যে কিছু একটা গুজে দিল। আমি মুঠো খুলে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

চলবে…………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে