ভদ্র স্যার♥রাগী বর-পর্ব ১৬

0
4615

#ভদ্র স্যার♥রাগী বর-১৬
Writer: ইশারাত জাহান সুপ্তি

ল্যাপটপের স্কিনে স্যার আর সেই মেয়েটার ছবি।
দুজনে পাশাপাশি বসে আছে।আমার চোখ দিয়ে একটি বড় অশ্রুর ফোটা গড়িয়ে পরতে না পরতেই
স্যার রুমে চলে আসল।
আমি তাড়াতাড়ি উঠে পিছনে ঘুরে চোখের পানি আড়াল করলাম।
স্যার ব্যস্ত হয়ে গাড়ির চাবি টা হাতে নিয়ে বলল,
সুপ্তি,আমার এখনই আর্জেন্ট একটু অফিসে যেতে
হবে।তুমি সাবধানে থেকো।
বলে স্যার ল্যাপটপ নিয়ে চলে গেলো।

আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে ছাদে চলে গেলাম।ছাদের দোলনায় পা উঠিয়ে হেলান দিয়ে বসে রইলাম।
মাথার ভেতর আবার সেই দৃশ্য ঘুরছে।
স্যারের সেই মেয়েটির সাথেও সম্পর্ক আছে আর স্যার আমার সাথেও নরমাল বিহেভ করছে,কেনো?
হঠাৎ মাথায় নাহিদ ভাইকে স্যারের বলা সেই কথাটা ভেসে উঠল,
“বিয়ের পরে অনেক পরিস্থিতিতে তোর ভালো না লাগলেও তোকে তা হ্যান্ডেল করতে হবে।কারণ তখন সেটা তোর দায়িত্বের মধ্যে পরবে”।

স্যার সেদিন নাহিদ ভাইকে এই কথাটাই কেনো
বলল।তার মানে কি স্যার শুধুমাত্র আমার সাথে বিয়ে হয়েছে বলে দায়িত্বের টানে পড়ে এত ভালো ব্যবহার করেছে।
এটা শুধুমাত্র দায়িত্ব ছাড়া আর কিছুই না?
হয়ত দায়িত্বের টানে সে আমার সাথে সারাজীবন সংসার করার জন্যও প্রস্তুত হয়ে পড়বে।তার মতো
আদর্শ ছেলে তো এমনি করবে।
কিন্তু আমি তো এমন সম্পর্ক চাই না।পরিস্থিতির স্বীকারে তাকে আমার সাথে দায়বদ্ধতার সম্পর্ক পালন করতে হবে না।
নিজের মনটাকে যদি হাতে পেতাম তাহলে গলা টিপে ধরতাম।আবার আরেকবার এ কেনো ভুল বুঝলো।কেনো আবার ভাবতে শুরু করল যে স্যার আমাকে সত্যিই ভালোবাসে।

কিছুক্ষণ শুনশান নিরবতার পর হঠাৎ স্যার আমার সামনে সেই মেয়েটিকে নিয়ে আসল।আমি
তাদের দুজনকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম।
স্যার আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,আমি ওকেই ভালোবাসি।তোমার সাথে জেদের বশে বিয়ে করে আমি এখন নিরুপায়।
না পারছি ওকে ভুলতে না পারছি তোমাকে ছাড়তে।তুমি আমাদের পথের কাঁটা।পথের কাঁটা।
পথের কাঁটা….

আমি ধরমরিয়ে চোখ খুলে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলাম।আমি এখনো দোলনাতেই শোয়া আছি।
চারপাশে অন্ধকার হয়ে গেছে।তার মানে আমি কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম?

তাড়াতাড়ি দোলনা থেকে নেমে ভেতরে গিয়ে রুমে ঢুকলাম।রুমের মধ্যেও ঘুটঘুটে অন্ধকার।আমি লাইট জ্বালাতে যাব তার আগেই রুম আলোকিত হয়ে উঠল রঙ বেরঙের লাইটিং এ।পুরো রুমে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে।ক্যান্ডেলও জ্বালানো।রুমে এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে রয়েছে।
একটুপরই তার মধ্যে থেকে শুভ্র স্যার একটি ব্লাক কালারের শার্ট গায়ে বেড়িয়ে এলো হাসি মুখে।
আমি হতভম্ব হয়ে সব দেখেই যাচ্ছি।
আজ আর এসব আমার ভালো লাগছে না।নিজেকে কেমন বোঝা বোঝা লাগছে।
আমি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।স্যার আমার কাছে এসে হাসিমুখে বলল,এত কষ্ট করে এত কিছু করলাম।আর বউ আমার কিছুই বলছে না?
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বেশ রুক্ষ স্বরেই বললাম,আমি বলেছি আমার জন্য এসব করতে।
স্যার আমার এরকম আওয়াজ শুনে একটু অবাক
হলেও স্বাভাবিক হয়েই বলল,তোমার ভালো লাগছে না?
আমি কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিলাম।কেনো যেনো তার দিকে তাকাতেও পারছি না।কিন্তু স্যার আমার হাত ধরে বলল,আমার তোমাকে কিছু বলার ছিল।
আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম,
আমার এখন কিছু শুনতে ইচ্ছা করছে না।
স্যার ভুরু কুঁচকে আবার নরম হয়ে বলল,এমন কেনো করছো?
আমি এবারো নিশ্চুপ।আমার নিরবতায় স্যার রেগে গিয়ে আমাকে তার দুই হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বলল,কেনো করো তুমি এমন?
আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরল।স্যারের চোখও ছলছল করছে।স্যার আমাকে ছেড়ে পিছনে ঘুরে বলল,
আমি ভেবেছিলাম আমাদের আগে যা হয়েছে হয়েছে এখন সেসব ভুলে নতুন…… তাই আমি এত চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু তুমি?
আমি চোখের পানি মুছে বললাম,কেনো?…কেনো করছেন এত চেষ্টা??
স্যার আমার দিকে ঘুরে তার দু হাতে আমার মুখ আলতো করে ধরে কান্না ধরা গলায় বলল,কেনো করছি! তুমি কি কিছুই বুঝো না?
স্যারের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।বাঁধ
মানছে না আমার অশ্রুও।আমি তার দিকে তাকাতে পারছি না।
সে এবার আমার কপালের সাথে তার কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে খুব আবেগী গলায় বলল,
শুনতে কি পাও এই নিঃশ্বাসে এই হৃদস্পন্দনে প্রতিনিয়ত কার নাম বলে।এখানে কার নাম লেখা আছে।
আমি অশ্রু ঝরিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
স্যারের গরম নিঃশ্বাস আমার চোখে মুখে লাগছে।
এমনকি তার হৃদস্পন্দনও আমি স্পষ্ট শুনতে পারছি।খুব মানতে ইচ্ছে করছে যে এখানে শুধু আমার নাম লেখা।শুধু আমার….
কিন্তু না আমি আবারো মনের বিভ্রান্তিতে ধরা দিব না।কিছুতেই না।

কিছুক্ষণ নিরবতা শেষে স্যার হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে চোখ বন্ধ করেই একটি বড় দীর্ঘশ্বাসের সাথে বলে উঠল,I Love Youuu…

শুনে আমার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল।
আমি ধপ করে চোখ খুলে ফেললাম।স্যারের চোখ এখনো বন্ধ।আমার মন এক প্রশান্তিতে ভরে উঠল।কিন্তু পরক্ষনেই হঠাৎ…..
চরম প্রশান্তির এই কথাটি আমাকে প্রচন্ড বেদনা দিতে লাগল।বুকের ভেতরটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে।
আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বললাম,থাক।
এখন শুধুমাত্র আমার সাথে আপনার বিয়ে হয়েছে বলে আপনাকে আমায় জোড় করে ভালোবাসতে হবে না।
স্যার চোখ মুখ কুঁচকে বলল,জোড় করে?
তাহলে তুমিও কি আমাকে জোড় করেই ভালোবাসো?

আমি অপ্রস্তুত হয়ে অন্য দিকে ঘুরে বললাম,
আমি কি আপনাকে বলেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি?
সে আমাকে তার দিকে ঘুড়িয়ে বলল,তুমি আমাকে ভালেবাসো না?
আমি আবারো নিশ্চুপ হয়ে রইলাম অন্য দিকে তাকিয়ে।
সে আমাকে ছেড়ে ড্রয়ার থেকে কিছু বের করে হাত উঠিয়ে বলল,যদি আমাকে ভালো না বেসে থাকো তবে এটা এখনো যত্ন করে রেখেছো কেনো?

আমি তার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার
হাতে সেই পরীক্ষার খাতাটি যেখানে স্যার তার পছন্দের কথা আমাকে লিখেছিল।
যেটা আমি আজ পর্যন্ত খুব যত্ন করে একটি
মখমলের কাপড়ে পেঁচিয়ে আমার আলমারিতে
সযত্নে তুলে রেখেছিলাম।

স্যার আমার আরো কাছে এসে খাতাটি  আমার
মুখের সামনে ঝাঁকিয়ে রেগে বলল,কি হলো কথা বলছো না কেনো? জবাব দাও।
যদি আমাকে ভালোবেসে নাই থাকো তাহলে এই সামান্য কাগজটা এখনো রেখে দিয়েছো কেনো?
আর সেই অ্যাকুরিয়াম দুটো কেনো রেখেছো নিজের কাছে।এমনকি বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়িও নিয়ে এসেছিল।
তারপর আবার চেঁচিয়ে বললো,জবাব দাও।
আমি শুধু কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,এই কাগজ আপনি কোথায় পেয়েছেন?
সে বলতে থাকলো,তোমার আলমারিতে।প্রথম যেদিন তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম সেদিনই পেয়েছিলাম।
এখন এই কথার কি উত্তর আছে তোমার কাছে বল?
আমি চুপ করে মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে কাঁদতে লাগলাম।
স্যার আমার আরো কাছে এসে দু হাত দিয়ে আমার মুখ তোলার চেষ্টা করতে করতে বলছে,কি হল চোখ বন্ধ করে রেখেছো কেনো?
আমার দিকে তাকিয়ে বল তো তুমি আমাকে ভালোবাসো না।
আমি মাথা নিচু করে কেঁদেই যাচ্ছি।
আর স্যার বলে যাচ্ছে,কি হলো তাকাও।তাকাও বলছি।
আমও হঠাৎ শক্ত হয়ে তার হাত ছিটকানি দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,না ভালোবাসি না।
আপনার যদি আমার জন্য খুব অসুবিধা হয় তাহলে বলে দিন আমি চলে যাব।

স্যারের চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল।রাগে সে হুংকার দিয়ে টি টেবিলটা উপুর করে ফেলে দিল,
বিছানার পাশে থাকা ল্যম্প হাত দিয়ে এক আছাড় মেরে গর্জন করে বলতে লাগল,চলে যাবে..ছেড়ে চলে যাবে না।এটাই তো তোমার অস্ত্র।
ছেড়ে চলে যাওয়া তো তুমি খুব ভালোই পারো।
কেনো খেলছো আমায় নিয়ে এমন।
কি করেছি আমি?
আমি স্যারের এই তান্ডব দেখে ভয়ে চুপসে গেছি।
একবার মনে হল বলে দেই আমার সব চাপা কথা কেনো আমি এসব বলছি।কিন্তু পারলাম না।কিচ্ছু বলতে পারলাম না।যখনই এই কথাটা মুখে আনতে যাই একরাশ নিরবতা আমাকে ছেয়ে যায়।বুকের চাপা কষ্টে কথাটা আমার মুখ দিয়ে বের হতেই চায় না।
মুখ পর্যন্ত আসতেই তীব্র ব্যাথা অনুভব হয়।তাছাড়া আমি আগের থেকেই কষ্টের সময় কান্নার সময় যা বলা দরকার তা ঠিকমতো সাজিয়ে বলতে পারি না।সবকিছু গুলিয়ে ফেলি।আমার জীবনের সবচাইতে কষ্টের এই সত্যটি আমি মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতেই পারি না।
কেউ যদি শুনে তাহলে হয়ত তার মনে হতেই পারে কেনো আমি বলতে পারি না।বলে ফেললেই তো হয়।কিন্তু এই মন জিনিসটাই যে সবথেকে বড় অদ্ভুত।কখন কি করায় কিছুই বোঝা যায় না।আর
কাউকে ভালোবাসলে তখন তা আমাদের সম্পূর্ণ হাতের বাইরে চলে যায়।
খুব কষ্ট হয় খুব।বুকের ভেতরটা যেন কেউ ক্রমাগত ছুড়ি দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে।

স্যারের ভাঙাচোরা চলতেই আছে।সে যেন আজ সব কিছু ধ্বংস করে দিবে।বারবার হুংকার দিয়ে বলছে,আবার এমন করলে তুমি আমার সাথে। আবার!আরেকবার আবার আমাকে স্বপ্ন দেখিয়ে সব ভেঙে চুরমার করে দিলে।কেনো করো বারবার
এমন?কেনো?
হঠাৎ একটি কাঁচের টুকরোয় হাত লেগে স্যারের হাত কেটে গেল।গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে সেখান থেকে।সেই অবস্থাতেই সে আরও ভাঙচুর করতে লাগল।আমি দৌড়ে গিয়ে তার হাত টেনে ধরে বললাম,কি করছেন পাগল হয়ে গেলেন।
রক্ত বেরোচ্ছে তো।স্যার আমাকে তার দুই হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল।তার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেছে আর তার চারপাশে অশ্রুর ছোঁয়া।দাঁতে কিরমির করে বলে উঠল,এই ক্ষত তোমার চোখে পড়ল,আর আমার এই বুক যে ক্ষত বিক্ষত হয়ে রয়েছে সেটা তোমার চোখে পড়ে না?এখানে যে যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যায় সেটা তুমি বোঝো না?
এত কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারছি না।বারবার এভাবে কষ্ট না দিয়ে একেবারে মেরে ফেলতে পারো না।
বলে আমাকে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে হনহন করে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে।
একটুপর আওয়াজ পেলাম হাইস্পিডে গাড়ি চালিয়ে সে চলে গেল।
তার শেষের কথাটা শুনে আমার হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেল।

বিছানার পাশে ফ্লোরে হাঁটু ভাজ করে বসে তার মধ্যে মুখ লুকিয়ে আমি ক্রমাগত কেঁদে যাচ্ছি।
শুভ্র স্যারের জন্যও এখন খুব চিন্তা হচ্ছে।রাত তিনটা বেজে গেছে অথচ সে এখনো বাড়ি ফেরে নি।যেভাবে রাগ হয়ে বাড়ি থেকে বের হল না জানি
কোথায় গেছে!কি করছে!

বারবার ফোনে তাকে ট্রাই করে যাচ্ছি কিন্তু প্রতিবারই বন্ধ আসছে।
আমার খুব চিন্তা লাগছে।কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে খুব।
সকাল ভোরে স্যারের নাম্বার একটা রিং বাজতে না বাজতেই আমি উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে কিছু বলতেই আমার হাত থেকে ধপ করে ফোনটা মাটিতে পড়ে গেল।তারপর…………..

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে