বৃষ্টিভেজা আলাপন পর্ব-১৭

0
711

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (১৭)

অভিরাজের বাহুতে ঘুমিয়ে পড়েছে উষশী। মেয়েটি বয়স অনুযায়ী বেশ লম্বাটে। তবু সেই অভি’র বুকের কাছে ঠেকে মাথাটা। বাদামী রঙা চুল গুলোতে হাত গলিয়ে দিয়েছে অভি। এটা পুরোই অজান্তে করা। কিয়ৎক্ষণ বাদে পাখির গুঞ্জন বন্ধ হয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে ছয়টা বাজে। আর কেউ না এলেও লাবণ্য আসবে নিশ্চিত। সে চাচ্ছে না তার আর উষশী’র এই মুহূর্তটা অন্য কারো নজরে লাগুক। সেই কারণেই কি না মেয়েটিকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে ফ্রেস হয়ে এল। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নিতেই লাবণ্য’র দেখা।
“কখন এলি?”

“একটু আগে।”

“উষশী এখানে এসে ঘুমিয়েছে?”

“হুম।”

“আমি ভাবলাম কোথায় না কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোকো ভীষণ জ্বালিয়েছে গত রাতে। সহসা এমন করে না প্রাণীটা।”

“কোনো সমস্যা দেখেছিস?”

“উহু। তবে চেকাপ করিয়ে আনলে ভালো হয়।”

“ভালো কথা, উষশীর ফ্যামেলির লোকাল এক আত্মীয়ের বাড়ির ঠিকানা পেয়েছি। তবে লাভ কত টুকু হবে বলতে পারছি না।”

“চিন্তা করিস না। কিছু একটা হবেই।”

হুট করেই চায়ের কথা মনে হলো লাবণ্য’র। সে চা আনতে যেতেই মেয়েটির পাশে বসল অভিরাজ। তার বড়ো হাতের বৃদ্ধা আঙুলি দিয়ে মেয়েটির নরম গাল স্পর্শ করল। একটা অন্যরকম সুখ রয়েছে এই মেয়েটির মাঝে। অভি ব্যকুল হয়ে পড়ল। সে ইচ্ছে করেই সব কিছুতে ঢিল দিয়েছে। তার মন চায় না উষশী ফিরে যাক। অথচ তার এই চাওয়াটা খুবই অন্যায়।

ঈশান আর ছোঁয়া’র ব্যপারটা উষশী’র নিকট রোমাঞ্চিত সাথে বেশ দুঃখের ও। তার মনে খুব বেশি মায়া জন্মেছে। পনের বছরের জীবনে অনেক ছেলেমেয়ের শা রী রিক মেলামেশা দেখেছে সে। তবে ভালোবাসা খুব একটা দেখা হয়ে উঠে নি। তাই হয়ত বিষয় গুলো ওকে বেশ আকর্ষণ করছে।

কোকো’র খাবারের বাটিটা ভেঙে গেছে। সেই থেকে মন খারাপ করে আছে উষশী। অন্যমনস্ক থাকায় বাটিটা পড়ে গেল। বাড়ির পরিচারিকা এই নিয়ে বেশ কথা শুনিয়েছে তাকে। বিষয়টা উষশী’র খুব খারাপ লেগেছে। অথচ এমন ভুল হতেই পারে। এটা খুবই সাধারণ একটা বিষয়। উষশী বিষয়টা গোপন করে গেলেও ঈশান ঠিকই জানতে পারল। সে আবার সেই পরিচারিকাকে কথা শুনাল। দীর্ঘ দিন সিনহা বাড়িতে কাজ করছে ফরিনা নামের মহিলাটি। সেই জন্যেই সব কিছুতে অধিকারবোধটা বেশি। কিন্তু উষশীকে বকা’র মতো অধিকার যে তার নেই সে একদমই ভুলে বসেছিল। উষশীকে শুরু থেকে পছন্দ করে না সে। এর প্রধান কারণ উষশী সর্বদা হাঁটুসম জামাকাপড় পরিধান করে। মেয়েটি অত্যধিক রূপবতী। তার মতে বাড়িতে এত গুলো পুরুষ মানুষ। এভাবে ঠ্যাং না দেখিয়ে বেড়ালেই নয়। ব্যপারটা কথায় কথায় উঠে এল। উষশী এতে খুব বেশি কষ্ট পেয়েছে। প্রতিটা দেশেরই একটা নিজস্ব ও স্বাভাবিক কালচার রয়েছে। সে অনুযায়ী জামাকাপড় পরিধান করে এসেছে উষশী। তাই বলে তার সম্পর্কে এমন সব কল্পণা করবে তা ভাবতেও পারে না সে। তার কষ্টটা ঈশান অনুভব করতে পারল।
“বোকা কষ্ট পেও না। দেখ, আমাদের কান্ট্রির একটা কালচার আর তোমাদের কান্ট্রিতে আরেকটা। তাই সবাই সবটা নিতে পারে না।”

“বুঝতে পেরেছি।”

“কষ্ট পেও না।”

“হুম।”

উষশী’র মন ভালো করতে ঈশান শুধাল,”ব্রো কে বলেছিলে কিছু?”

“কি বলব?”

“ভালোবাসার কথা।”

“না।”

“উফ এখনো বলো নি। আজই বলবে কেমন?”

“ঠিক আছে।”

উষশীর মন ভালো করতে ওকে নিয়ে গেমিং রুমে এল ঈশান। এই গেমিং রুমে বসে এক সময় চুটিয়ে গেম খেলত অভিরাজ। সময়ের সাথে সাথে পরিত্যক্ত হয়ে উঠেছে। জিনিস গুলো দেখছিল উষশী। ঈশানের কল আসায় সে বলল,”চলে এসো উষশী। আমাদের যেতে হবে।”

ঈশান চলে গেলেও থেকে গেল উষশী। সে সব গুলো জিনিস খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল। উষশী’র কোনো রকমের ফোবিয়া নেই। তবু রুমের দরজাটা বন্ধ দেখে ভীত হয়ে পড়ল। সাউন্ড প্রুফ রুম হওয়াতে চেচিয়েও কাজ হচ্ছে না। ঈশানের কথা অনুযায়ী সপ্তাহেও এই রুম খোলা হয় না। এর মানে দাঁড়ায় সে আটকে গেছে। ঘটনাটা কল্পণা করতেই গলা শুকিয়ে এল। শরীর ক্লান্ত হতে লাগল। একটা সময় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে।

ঈশানের মাঝে বেশ অপরাধবোধ কাজ করছে। উষশী কি করে লক হয়ে গেল সে জানে না। বন্ধুর কল পেয়ে বের হতে হয়েছিল তাকে। প্রায় দেড় ঘন্টা জ্ঞান শূন্য হয়ে ছিল উষশী। তাকে উদ্ধার করা হয়েছে কিছু সময় পূর্বে। অভিরাজ খবরটা পেয়েই গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছে। লাবণ্য শারীরিক স্বাস্থ্য চেকআপ করছে। সকলেই বেশ চিন্তিত। সকালে ফরিনা উষশী’র প্রতি কিছু মন্তব্য করেছিল। সেই জন্যে বেশ বকাও খেয়েছে। সকলে দোষটা তার উপর দিবে এমন একটা ভাব চলে এসেছে। তাই সে কান্না করছে তখন থেকে। ঈশান সবথেকে বেশি বিরক্ত হলো। তাকে বের হতে বলে লাবণ্য’র নিকট বসল।
“ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে তাই না রে?”

“হ্যাঁ। ওকে রেখে কেন বের হয়েছিস?”

“আমি খেয়াল করি নি।”

“অভি এসে দেখিস,খুব বকবে।”

একটা মন খারাপের সুর নেমে এল লাবণ্য’র কণ্ঠে। অভিরাজ এসে সত্যিই ঈশানকে বেশ বকাঝকা করল। ঈশান ও চুপ ছিল। তার দোষের কারণেই উষশী’র এই অবস্থা। ছোঁয়া’র পাশ দিয়ে যাচ্ছিল ঈশান। মেয়েটা হুট করেই ওর হাত টেনে ধরল।
“ভাইয়া’র কথায় কষ্ট পেও না।”

“ঠিক আছি।”

ঈশান চলে যেতেই আমিনা বললেন,”ছোট ভাই এর সাথে এমন ব্যবহার কেন করলে অভি?”

“সেটার কারণ তো জানোই মা।”

“তাই বলে এক ঘর লোকের সামনে…”

“ও জানে আমি কেমন।”

“ভাই কে সরি বলবে।”

“বলব।”

আমিনা উষশী’র জন্য হলুদ দেওয়া দুধ পাঠালেন। এরই মধ্যে ফরিনা’র বলা কথা গুলো কানে এল অভিরাজের। সে ভ্রু কুটি করে বলল,”বাড়ির সবাই তখন কি করছিলে?”

“কেউ শুনতে পায় নি তো। ঈশান একটু শুনেছিল। পরে আন্টি’র সাথে বেশ রাগারাগি করেছে। বাদ দে বয়স্ক মানুষ।”

পুরো মেজাজ গরম হয়ে গেল অভিরাজের। সে কষ্ট নিয়ে উষশী’র দিকে তাকাল। মেয়েটা সবার সাথে ঠিক ঠাক মানিয়ে উঠতে পারে নি। আর সে কি না ভবিষ্যৎ কল্পণাও করে নিয়েছে!

বিকেলের দিকে সুস্থ হলো উষশী। ট্রেরেসে সকলের আড্ডা চলছিল। সেখানে ঈশান ও রয়েছে। ঈশানের ব্যপারটা শুনে বেশ কষ্ট পেয়েছে উষশী। অভি শুধু শুধু ছেলেটাকে বকা দিয়েছে। তাই ট্রেরেসে না গিয়ে সোজা অভি’র রুমে এল। ছেলেটা তখন সবে গোসল করেছে। উন্মুক্ত বুকটা নজরে আসতেই ধক করে উঠল কিশোরী মেয়েটির হৃদয়।
“উঠে গেছ? এদিকে আসো।”

মেয়েটির নিকটে এসে দরজা লাগিয়ে দিল অভিরাজ। সে খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবে এখন।
“কেমন লাগছে?”

“ভালো।”

“একটা কথা জিজ্ঞাসা করব। একদম সত্যি বলবে।”

“হুম।”

“তুমি কিভাবে গেমিং রুমে লক হলে?”

“জানি না। আমি তো সব দেখছিলাম।”

উষশী যে মিথ্যে বলছে না তা চোখ দেখেই বুঝতে পারল অভিরাজ। হয়ত সে একটু বেশি ভাবছিল। তবে এতটুকু অনুভব করেছে বাড়ির সবাই মেয়েটিকে তেমন আপন করে নিতে পারে নি। আর না উষশী পেরেছে। একটা তপ্ত নিশ্বাসে রুমটা কেমন গুমোট হয়ে এল। উষশী বেশ করুণ সুরে বলল,”ঈশানকে বকা দিয়েছেন?”

“হুম।”

“ফ্রেন্ডের কোনো দোষ ছিল না। আমাকে সে বের হতে বলেছিল। আমিই অন্যমনস্ক হয়ে বের হই নি।”

“জানি।”

“তবু কেন বকেছেন?”

“কারণ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।”

“আমার খুব খারাপ লাগছে। ফ্রেন্ড শুধু শুধু বকা খেল।”

“এখন কি করলে খুশি হবে তুমি?”

“ঈশানকে ডেকে দুঃখ প্রকাশ করবেন।”

“আচ্ছা করব। তবে গোমড়া মুখ করে থাকলে তোমায় বকা দিবে।”

উষশী এবার ঠোঁট প্রসারিত করল। অভি উঠে গিয়ে টি শার্ট পরে নিয়েছে।
“খাবে চলো।”

“আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।”

“পরে বললে হয় না?”

“না, এখনি বলব।”

“ঠিক আছে বলো। শুনছি আমি।”

শরীরে কড়া সুগন্ধি দিচ্ছে অভিরাজ। যার মাতাল করা সুবাস একবার অনুভব করল উষশী। পর মুহূর্তেই নিজেকে গুছিয়ে শুধাল, “আপনি আমায় ভালোবাসেন?”

“কে বলল?”

“ফ্রেন্ড বলেছে। এটা নাকি টপ সিক্রেট।”

“সিক্রেট জিনিস বলতে নেই জানো না?”

“জানি তো।”

“তাহলে বললে যে?”

“আমি কিন্তু উত্তর পাই নি।”

“তোমার কি মনে হয়?”

“বুঝতে পারছি না।”

“যেদিন বুঝতে পারবে সেদিন উত্তর দিব।”

উষশীকে আর একটা প্রশ্ন করার ও সুযোগ দিল না অভিরাজ। মেয়েটিকে নিয়ে সোজা ডাইনিং এ এসে বসেছে। আজ উষশী’র পছন্দের কিছু স্ন্যাকস অর্ডার করা হয়েছে।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ ন‍ৌশি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে